গৌতমবুদ্ধের অন্যতম বড় ভক্ত মগধের প্রথম শক্তিশালী সম্রাট বিম্বিসার কতোটা শক্তিশালী ছিলেন? - Ei Bangla
Ei Bangla আন্তর্জাতিক গৌতমবুদ্ধের অন্যতম বড় ভক্ত মগধের প্রথম শক্তিশালী সম্রাট বিম্বিসার কতোটা শক্তিশালী ছিলেন?

গৌতমবুদ্ধের অন্যতম বড় ভক্ত মগধের প্রথম শক্তিশালী সম্রাট বিম্বিসার কতোটা শক্তিশালী ছিলেন?


বাহুবলী সিনেমার পর থেকেই ভারতের চলচ্চিত্র জগতে দক্ষিনি ছবির রমরমা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তেলেগু ইন্ডাস্ট্রি আরও একটি বিখ্যাত সিনেমা তৈরি করেছে যার নাম বিম্বিসার, এখানে ভারতের অন্যতম মহান শাসক বিম্বিসারের জীবন সম্পর্কে দেখানো হয়েছে। আনুমানিক ৬০০-৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারতবর্ষে ষোলোটি মহাজনপদ বা রাজ্য ছিল। তবে গোটা ভারত এই মহাজনপদে বিভক্ত ছিলনা, বিশেষ করে উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতই জনপদে বিভক্ত ছিল। দক্ষিন ভারতে একটিই মহাজনপদ ছিল অস্মক। মহাভারতে উল্লেখিত কুরু ও গান্ধারও মহাজনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল মগধ। সুপ্রাচীন কাল থেকেই মগধ ভারতের শক্তিশালী প্রদেশ ছিল।

বিভিন্ন সময়ে মগধের রাজধানী পরিবর্তিত হয়েছে। কখনও রাজগির, পাটলিপুত্র আবার বৈশালী, বিভিন্ন রাজবংশের সময়ে মগধের রাজধানী বিভিন্ন ছিল। মহাজনপদ কালীন সময়ে ভারতে মগধের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। যেমন বর্তমানে ভোটের ক্ষেত্রে বলা হয় উত্তরপ্রদেশ যার দখলে কেন্দ্রে সেই দলের সরকারই আসবে। আবার ১২০০ থেকে ১৭০০ শতকে ভারতে দিল্লির গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। বলা হত দিল্লি যার ভারত তার, সেইজন্য সমস্ত বৈদেশিক শক্তিই দিল্লি দখল করার চেষ্টা করত আগে। ঠিক তেমনি প্রাচীন ভারতে মগধের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। সেসময় পাটলিপুত্র ছিল ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র। তবে মগধের এই উত্থান ঘটেছিল বিম্বিসারের হাত ধরেই। হারয়িঙ্কা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিম্বিসারের হাত ধরেই শক্তিশালী মগধ সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। এরপর তার ছেলে অজাতশত্রু এই সাম্রাজ্যের আরও বিস্তার ঘটিয়েছিল। এরপরে মগধে উত্থান হয় নন্দ সাম্রাজ্যের, যারা প্রায় সমগ্র উত্তরভারত জুড়ে শাসন করেছিল। নন্দ সাম্রাজ্যের পর মগধে উত্থান হয় বিখ্যাত মৌর্য সাম্রাজ্যের। সম্রাট অশোকের সময়ে প্রায় গোটা ভারতবর্ষ সহ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপাল পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য বলা হয়। তবে মৌর্য সাম্রাজ্যের আগেও মগধে আরও তিনটি সাম্রাজ্যের নাম পাওয়া যায় হারিয়াঙ্কা, শিশুনাগ ও নন্দ সাম্রাজ্য। নন্দ সাম্রাজ্যের শেষ রাজা ধননন্দকে পরাজিত করে চানক্যের সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, মৌর্য সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিল। মগধের প্রথম শক্তিশালী সম্রাট বিম্বিসার সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

বিম্বিসারকে মগধের প্রথম শক্তিশালী রাজা বলা হয় কারন এর আগে মগধের তেমন কোন শক্তিশালী রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়না। ৫৫৮-৪৯১ বিসিতে(BCE) মগধের শাসনকর্তা ছিল বিম্বিসার। গৌতমবুদ্ধের অন্যতম বড় ভক্ত ছিল বিম্বিসার। তবে হরিয়াঙ্কা রাজবংশকে কলঙ্কিত বলা হয় কারন বিম্বিসারকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে তার ছেলে অজাতশত্রু এবং অজাতশত্রুকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে তারই ছেলে উদয়নী। বিম্বিসারের জন্ম হয়েছিল ৫৫৮ বিসিইতে, প্রথমে ওনার নাম ছিল শ্রীনিকা। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই বিম্বিসার সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিল। ওনার মায়ের নাম ছিল বিম্ব সেখান থেকেই তার নাম বিম্বিসার হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। বিম্বিসারের বাবা ভাট্টিয়া একটি ছোট এলাকার রাজা ছিল, তাকে পরাজিত করেছিল অঙ্গের রাজা ব্রহ্মদত্ত। প্রাচীন ভারতে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড ও বিহারের কিছু অংশ নিয়ে অঙ্গদেশ গঠিত ছিল যার রাজধানী ছিল চম্পা। বিম্বিসার প্রথমেই অঙ্গ দখল করে বাবার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল এবং ১৫ বছর বয়সে, এরপর পাটলিপুত্র হয়ে সম্পূর্ণ মগধ দখল করে। বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ গুলোতে বিম্বিসার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়, সেখানে তার নামের নামের সাথে সেনিয় নাম উচ্চারিত হয়েছে। এটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিরোধীতা আছে। কারও মতে তার ব্যক্তিগত নাম ছিল সেনিয় আবার কারও মতে তার গোত্রের নাম ছিল সেনিয়। তবে সিংহলী বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশ অনুযায়ী বিম্বিসারকে ওনার পিতা পনেরো বছর বয়সেই মগধের রাজা হিসাবে ঘোষনা করেছিল। প্রাচীন বিহারের রাজগৃহ শহরের নির্মান বিম্বিসারই করেছিল যা আজ রাজগীর নামে বিখ্যাত। তবে বিম্বিসারের আগেও প্রাচীন ভারতে মগধ একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল। মহাভারতেও মগধের কথা উল্লেখিত আছে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকার পর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যছিল মগধই। কুরুরাজ্য হস্তিনাপুরের থেকেও শক্তিশালী ছিল মগধ। মগধ সম্রাট জরাসন্ধ সেসময়ের শক্তিশালী রাজা ছিল। সম্রাট যুধিষ্ঠিরকে চক্রবর্তী সম্রাট হবার আগে জরাসন্ধকে পরাজিত করা দরকার ছিল। যার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশে জরাসন্ধকে পরাজিত করে ভীম। সুতরাং মগধ প্রাচীনকাল থেকেই শক্তিশালী ছিল। বিম্বিসারের সাথে গৌতম বুদ্ধের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হয়। তবে বৌদ্ধ ধর্মের উপাসক হয়েও বিম্বিসার হিন্দু ধর্ম ও জৈন ধর্মের প্রতি অতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। অসাধারন সেনানায়কের পাশাপাশি বিম্বিসার একজন দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন। অঙ্গ জয় করবার কিছুবছর পর আরও ভালো শাসনের জন্য তার ছেলে অজাতশত্রুকে সেখানকার শাসক হিসাবে নিয়োগ করেন। সেসময় মগধ, কোশল, অবন্তী ও বতস এই চারটি সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। বিম্বিসারের কুটনৈতিক দক্ষতা অসাধারন ছিল। বিম্বিসার ছোট রাজ্য গুলোকে দখল করে নিত এবং বড় শক্তিশালী সাম্রাজ্য গুলোর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলত। তিনি প্রথমেই কোশলরাম মহাকোশলের মেয়ে কোশলদেবীকে বিবাহ করেন। যৌতুক হিসাবে কাশী শহর পান তিনি। কোশল ছিল সেসময় মগধের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। এই বিবাহের ফলে দুই সাম্রাজ্যের দীর্ঘদিনের বৈরীতার অবসান ঘটে। এরপর লিচ্ছবী রাজবংশের শাসক চেতকের কন্যা চেল্লনাকে বিয়ে করেন তিনি। এই চেল্লনার পুত্রই অজাতশত্রু। মদ্র দেশের রাজকন্যা ক্ষেমা ও বিদের রাজকন্যা বাসবীও তার পত্নী ছিলেন। এভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিম্বিসার আরও শক্তিশালী রাজা হয়ে ওঠে।

কোশলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পর বিম্বিসার সরাসরি অবন্তীর সাথে যুদ্ধ করে। অবন্তীও সেসময় যথেষ্ট শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল যার রাজধানী ছিল উজ্জয়নী কিন্তু কয়েকবার যুদ্ধের পরও কেউই জয়লাভ করতে পারেনি। মগধ ও অবন্তী সমান শক্তিশালী ছিল। বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুও অবন্তীকে জয় করতে পারেনি। বিম্বিসারের পুরো সাম্রাজ্যের আয়তনের কথা বলতে গেলে বলা যায় তার অধীনস্ত ৮০,০০০ গ্রাম ছিল! এই বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তার দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ছিল। বিম্বিসারের সেনাবাহিনী চারভাগে বিভক্ত ছিল স্থলসেনা, অশ্বারোহী সেনা, রথসেনা এবং গজসেনা। বলা হয় অঙ্গদেশ জেতার পর বিম্বিসার নিজস্ব নৌবাহিনীও গঠন করেছিল। তবে বিম্বিসারের মৃত্যু হয় মাত্র ৫২ বছর বয়সেই তার ছেলে অজাতশত্রুর দ্বারা। বিম্বিসার তার ছেলে অজাতশত্রুকে প্রচুর বিশ্বাস করত, বিম্বিসারের পর রাজা হবার কথা ছিল অজাতশত্রুরই কিন্তু সে পিতার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলো না, যার জন্য বিম্বিসারকে সরিয়ে সে রাজা হয়। অজাতশত্রু বিম্বিসারকে সিংহাসনচ্যুত করার প্রথম পরিকল্পনা জেনে গিয়েছিল কিন্তু তারপরেও ছেলেকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার আবার পরিকল্পনা করে পিতাকে হত্যা করেছিল অজাতশত্রু। বিম্বিসারকে অজাতশত্রু সরাসরি হত্যা করেছিল কীনা সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে কারন অনেক ঐতিহাসিকদের মতে অজাতশত্রু বিম্বিসারকে সিংহাসনচ্যুত করে গৃহবন্দী করে রেখেছিল সেখানেই তার মৃত্যু হয়েছিল।

অজাতশত্রু বিম্বিসারকে হত্যার জন্য উৎসাহিত করেছিল দেবদত্ত নামে ব্যক্তি যে গৌতমবুদ্ধের সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই হত। দেবদত্ত গৌতম বুদ্ধের সাথে বিম্বিসারের সাথে ভালো সম্পর্ক ও প্রভাবের জন্য হিংসা করত, সে চাইত গৌতম বুদ্ধের বদলে মগধের রাজবংশে তার প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সেজন্য অজাতশত্রুকে পরামর্শ দেয় বিম্বিসারকে হত্যা করতে। অজাতশত্রু নিজেও একজন দক্ষ ও শক্তিশালী শাসক ছিল। তার সময়ে মগধ আরও শক্তিশালী হয়েছিল। তবে পিতাকে হত্যার জন্য পরে অনুশোচনা করে অজাতশত্রু এবং গৌতম বুদ্ধের কাছে গিয়ে এরজন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিল সে এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করে শক্তিশালী মগধ সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল। অজাতশত্রু গৌতম বুদ্ধের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা বৌদ্ধ সাহিত্যে লেখা আছে যা আজ কলকাতার মিউজিয়ামে রয়েছে। বিম্বিসারের মতোন শক্তিশালী শাসক ভারতের ইতিহাসে খুবই কমই এসেছে। বলা হয় রাজগীরে কোন এক পর্বতের গুহায় অকুত সোনা রেখে গেছেন তিনি। আধুনিক পাটনা শহরই অতীতের গৌরবোজ্জ্বল পাটলিপুত্র ছিল যা বিম্বিসার প্রতিষ্ঠা করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

হিন্দু মন্দিরে হামলা বরদাস্ত নয়, মন্দিরে ভাঙচুর ইসুতে বললেন অ্যালবানিজহিন্দু মন্দিরে হামলা বরদাস্ত নয়, মন্দিরে ভাঙচুর ইসুতে বললেন অ্যালবানিজ

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের সামনেই সেই দেশে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা নিয়ে চিন্তা জাহির করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই ইস্যুতে ভারতকে আশ্বস্ত করলেন অ্যালবানিজ। আরো পড়ুন- এসএসসি

চিনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কোভিড, জানুয়ারিতেই দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ২৫ হাজার ছোঁবেচিনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কোভিড, জানুয়ারিতেই দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ২৫ হাজার ছোঁবে

কোভিড নিয়ে চিনের উদ্বেগ আরও বাড়বে। এমনটাই মনে করছে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ। রীতিমতো গাণিতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তাঁরা দেখিয়েছেন, আগামী জানুয়ারি মাসে সে দেশের অন্তত ২৫ হাজার মানুষ কোভিডে

নেপালে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা, ৭২ যাত্রী নিয়ে পোখরায় ভেঙে পড়ল বিমাননেপালে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা, ৭২ যাত্রী নিয়ে পোখরায় ভেঙে পড়ল বিমান

কাঠমান্ডুঃ নেপালে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। বিমান দুর্ঘটনায় এখনো পর্যন্ত অন্তত ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা এএফপি। কাঠমাণ্ডু থেকে পোখরাগামী ওই বিমানে মোট ৭২ জন সওয়ারি ছিলেন। তাঁদের

আমেরিকার হ্রদ থেকে উদ্ধার ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারের দেহআমেরিকার হ্রদ থেকে উদ্ধার ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারের দেহ

গত ৯ এপ্রিল নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সি ভারতীয় আমেরিকান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ৷ মঙ্গলবার তাঁর দেহ মিলেছে মেরিল্যান্ডের একটি ছোট হ্রদ থেকে ৷ দেহ উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ