বলা হয় বলিউডের থেকে বেশী সিনেমা বা ছবি বিশ্বের কোনও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি হয়না। বিশ্বের প্রায় সবদেশেই কোন না কোনও মানুষকে পাওয়া যাবেই যে হিন্দি গানের ভক্ত। রাজ কাপুর, অমিতাভ বচ্চন, ঋষি কাপুর, শাহরুখ খান ও মিঠুন চক্রবর্তীকে ভারত তো বটেই এমনকী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষও ভালোবাসে। ১৯৫১ সালে রাজ কাপুরের বিখ্যাত গান “আওয়ারা হু” এবং ঋষি কাপুরের “মেরি উমর কী নওজাওয়ানো” গানদুটি দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই তুরস্কে তাদের নিজস্ব অনুবাদে চলে আসছে। অর্থাৎ বলিউডের মাধ্যমে ভারতের সাথে বহু দেশেরই একটি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে বর্তমানে পূর্বের তুরস্ককে খুঁজে পাওয়া যেন মুস্কিল হয়ে গেছে। তুরস্কের বর্তমান সরকারের কুটনৈতিক নীতি পুরোপুরি ভারত বিরোধী।
তুরস্ক প্রায়ই ভারতকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার কথা থেকে শুরু করে রাশিয়া থেকে ভারতে আসা তেল বন্ধ করার হুমকী পর্যন্ত দেয় তুরস্ক বিভিন্ন সময়ে। তুরস্কের ভারত বিরোধী মানসিকতা এতটাই তীব্র যে, তুরস্ক প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং পাকিস্তানকে রীতিমতো অস্ত্র বিক্রি পর্যন্ত করে। জাতিসংঘে ২০১৯ সাল থেকে তুরস্ক কাশ্মীর ইস্যুতে সবসময় পাকিস্তানকে সমর্থন করছে। চীন ও পাকিস্তানের সম্মিলিত সিপেক বা চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরকেও সমর্থন করে তুরস্ক। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে তুরস্কের কী স্বার্থ লুকিয়ে আছে! কেনই বা তুরস্ক ভারত বিরোধীতা করে পাকিস্তানকে সমর্থন করে, এর জবাব কী আছে ভারতের কাছে? এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আরো পড়ুন- টিবিমুক্ত ভারত গড়তে নিজের পকেটমানি দান করলেন সাত বছরের কিশোরী! প্রশংসা নরেন্দ্র মোদীর
তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক প্রথম থেকেই এমন ছিলনা। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু তুরস্কের কামাল মুস্তাফা আতাতুর্কের সেকুলার রাজনীতিকে সমর্থন করত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তুরস্কের রাজনৈতিক অবস্থা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হতে শুরু করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে যায় যাতে গোটা বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভারত সেসময় কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু তুরস্ক ও পাকিস্তান তখন আমেরিকার পক্ষে যোগ দিয়েছিল। সেই থেকেই ধীরে ধীরে তুরস্কের ভারত বিরোধীতা শুরু হয়। ইন্দো পাক যুদ্ধে তুরস্ক পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য পর্যন্ত করেছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি ও অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনকালে তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করা হলেও ২০০৩ সালে তুরস্কের নেতৃত্বে রিসেপ তাইপ এরদোগান আসার পর থেকে সব চেষ্টাই ব্যার্থ হয়ে যায়। এরদোগান প্রথম থেকেই ভারত বিরোধী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। তবে তুরস্কের ভারত বিরোধীতা বৃদ্ধি পায় যখন ভারত কাশ্মীর থেকে আর্টিকেল ৩৭০ তুলে নেয়। আসলে তুরস্ক ভুলে যায় যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তা পাকিস্তান অবৈধ ভাবে দখল করে রেখেছে। গত নভেম্বরে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ সফরে যায় তখন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগানের সাথে বৈঠকে চুক্তি ঠিক হয় যে তুরস্ক পাকিস্তানের মিলিটারি উন্নয়নে সর্বোচ্চ সাহায্য করবে। পাকিস্তান সেসময় তুরস্কের থেকে পিএনএস খাইবার যুদ্ধজাহাজও পায়। তুরস্ক ভারতকে বায়রাখতার টিবি-২ এর মতোন ড্রোন দিতেও অস্বীকার করে। এই ড্রোন তুরস্ক ইউক্রেন ও আজারবাইজানকে দিয়েছে, এমনকি শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানও এই ড্রোন পেতে চলেছে। সম্প্রতি তুরস্ক জানিয়েছে তারা পিওকে বা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে তাদের প্যারামিলিটারি সেনা সাদাতকে মোতায়েন করবে। সাদাত সরাসরি তুরস্কের সরকারি সেনাবাহিনী নয়, সাদাত তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগানের ব্যাক্তিগত বাহিনী। সাদাত বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে তাদের এই ব্যাক্তিগত ভাড়াটে সেনা মোতায়েন করে। সাদাতের সঙ্গে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের খুব ভাল সম্পর্ক রয়েছে। পিওকে তে তুরস্ককে যুক্ত করার পেছনে চীনেরও মদত রয়েছে। চীনের পাকিস্তানের মধ্যে একটি উচ্চাভিলাষী প্রজেক্ট হচ্ছে সিপেক, যার অনেকাংশ পিওকের মধ্যে দিয়ে গেছে, যাতে চীন ইতিমধ্যেই ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে কিন্তু এই প্রজেক্টের মধ্যেই যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সেই জন্য চীন এই প্রজেক্টে তুরস্ককেও যুক্ত করতে চাইছে। এছাড়া তুরস্কের অবস্থান ভূরাজনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন তুরস্ক এশিয়া ও ইউরোপের মাঝে অবস্থিত তাই চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রজেক্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তুরস্ক। পূর্ব লাদাখ নিয়ে চীনের অবস্থানকেও সমর্থন করে তুরস্ক। এছাড়া তুরস্কের বহুদিনের ইচ্ছে পরমানু ক্ষমতা অর্জন করা সেজন্য চীনের সাহায্যে উত্তর কোরিয়া থেকে পরমানু অস্ত্র পাবার চেষ্টা করছে তুরস্ক। তাছাড়া চীনের বিশাল অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে তুরস্ক তার অর্থনীতিকেও সচল করতে সচেষ্ট। তবে পাকিস্তানের মতোই তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই মহূর্তে তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১৭৬ শতাংশ, তুরস্কের মুদ্রা লিরা প্রতিনিয়ত তার মূল্য হারাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে তুরস্কের দুই তৃতীয়াংশ জনগন তাদের মাসিক ঘর ভাড়া ও কিস্তি জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী রাষ্ট্রপতি এরদোগানের ভুল নীতি। এরদোগান শাসনভার গ্রহন করেই পূর্বের অটোম্যান সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছে তুরস্কের জনগনকে। এরদোগান পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও তুরস্ককে নিয়ে পুনরায় অটোম্যান সাম্রাজ্যের মতন বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে কাতার ও সৌদি আরবের থেকে মুকুট কেড়ে নিয়ে নিজেকে ইসলামিক বিশ্বের প্রধান হিসাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। কিন্তু এরদোগান বোধ হয় বুঝতে পারেনি শক্তিশালী হতে গেলে আগে দেশের অর্থনীতিকে মুজবত করা দরকার। যার ফলে বাধ্য হয়ে ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ও সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে তুরস্ক। বর্তমানে তুরস্কে পাকিস্তানের মতোই সন্ত্রাসবাদীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া এরদোগান ভোটে জেতবার জন্য বড় বড় শিল্পপতিদের অত্যন্ত কম সুদে টাকা ধার দিচ্ছে যার কারনে তুরস্কের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করেছে। যখন কোন দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন রাষ্ট্রপ্রধান এমন কিছু করে যাতে দেশের মানুষের মানসিকতা বদলে যায়, এক্ষেত্রে তুরস্ক ভারত বিরোধী প্রচার করে যাতে দেশের মানুষ মানসিকতা অন্যদিকে ব্যাস্ত থাকে।
তুরস্ককে কাউন্টার করবার জন্য ভারত সরাসরি সাইপ্রাসকে হাতিয়ার করেছে। সাইপ্রাস হচ্ছে তুরস্কের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর সাইপ্রাস সফরে গিয়ে সাইপ্রাসের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে, যা যথেষ্ট চিন্তার কারন তুরস্কের জন্য। সাইপ্রাস আগে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যেরই অংশ ছিল, প্রায় তিনশো বছর ধরে অটোম্যান সাম্রাজ্যভুক্ত থাকবার পর ১৯১৪ সালে বিট্রিশরা সাইপ্রাস দখল করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং ১৯২৫ সালে এটি পুরোপুরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ১৯৫৫ সালে সাইপ্রাসে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব শুরু হয় যাতে ব্রিটিশরা সাইপ্রাস ছেড়ে চলে যায় এবং এর দায়িত্ব গ্রীস ও তুরস্কের উপর ছেড়ে দেয়। ১৯৭৪ সালে ১৫ জুলাই সাইপ্রাসে বিপ্লব শুরু হয় যাতে সরাসরি মদত ছিল গ্রীসের। উত্তর সাইপ্রাসে আক্রমন করে তুরস্ক। এরপরেই সাইপ্রাসে সেনা পাঠিয়েছিল জাতিসংঘ। ফলে সম্পূর্ণ সাইপ্রাস দখল করা সম্ভব হয়না তুরস্কের বরং উত্তরাংশ দখল করে তারা। গ্রীস আজও সম্পূর্ণ একক সাইপ্রাসকে সমর্থন করে। এই জন্য ভারত গ্রীস ও সাইপ্রাসের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে যাতে তুরস্ক চাপে থাকে। এছাড়া আর্মেনিয়াকে অস্ত্র বিক্রি করছে ভারত। আর্মেনিয়ার প্রতিপক্ষ হচ্ছে আজারবাইজান। নার্গোনা কারবাখ অঞ্চল নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে ঝামেলা রয়েছে। আজারবাইজানকে সমর্থন করে পাকিস্তান ও তুরস্ক। তবে আজারবাইজানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে ভারতেরও। তাই ভারত সরাসরি আর্মেনিয়াকে সমর্থন করেনা কিন্তু সম্প্রতি আর্মেনিয়াকে ৪০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সাহায্য করেছে যাতে রয়েছে পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার এবং স্বাথি রেডার(Swathi Weapon Locating Radar)। তুরস্কের অর্থনীতির জন্যও ভারত খুব গুরুত্বপূর্ন। তুরস্কের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে দেশটির পর্যটনশিল্প যা দেশটির মোট জিডিপির ১১ শতাংশ জোগান দেয়। ভারতে প্রতিবছর ১৫০০ এর বেশী সিনেমা তৈরি হয়, যার মধ্যে অনেক সিনেমা তুরস্কে শুটিং হয়, যার দরুন বহু ভারতীয় পর্যটক তুরস্কে যায়। যদি ভারত সরকার এটা বন্ধ করে দেয় তাহলে তুরস্কের বছরে বিলিয়ন ডলার লোকসান হবে। তুরস্কের মধ্যে কুর্দি বলে একটি জাতি আছে যার সাথে সিরিয়া ও তুরস্কের মধ্যেই তুরস্কের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়, এই সংগঠন চায় কুর্দিস্থান নামে একটি স্বাধীন দেশ গঠন করতে। যদি এদের ভারত সরকার সমর্থন করে তাহলে তুরস্ক নিজের দেশেই বিপদে পড়বে। সুতরাং এইকারনে আজ পর্যন্ত তুরস্ক সরাসরি ভারত বিরোধী পদক্ষেপ নেয়নি কোনও। এমনকী ২০২২ এর জাতিসংঘ সম্মেলনেও কাশ্মীর ইস্যুতে তুরস্কের সুর যথেষ্ট নরম ছিল।