নজরুল-প্রমীলা বিবাহ প্রসঙ্গে - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ নজরুল-প্রমীলা বিবাহ প্রসঙ্গে

নজরুল-প্রমীলা বিবাহ প্রসঙ্গে


রানা চক্রবর্তীঃ ইতিহাসে নজরুল পত্নী ‘প্রমীলা’ এক ‘pathetic’ চরিত্র। অপর পক্ষে নজরুল ইসলামের বিয়ে প্রথমে ঠিক হয়েছিল (মতান্তরে বিয়ে হয়েছিল) যে মহিলার সাথে, সেই ‘নার্গিস’কে বলা যায় ‘ট্র্যাজিক’ চরিত্র। আর প্রমীলা স্বামীর সান্নিধ্য কতখানি পেয়েছিলেন, সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু দুঃখের দিনে, নিঃসন্দেহে তিনি স্বামীসঙ্গ পেয়েছিলেন। তিনি স্বামীর সেবা-যত্ন করেছিলেন মমতাময়ী নারীর মতো। ‘আজহারউদ্দীন খান’ লিখেছিলেন, “কবিকে দেখভাল করত কিশোর সালুকুশা নামক এক উড়িয়া কাজের লোক। খাওয়ার সময় হলে কবিকে প্রমীলার কাছে নিয়ে যেত। কবি-পত্নী একফুট উঁচু তক্তপোশে শুয়ে থাকতেন এবং ঐ অবস্থাতেই মলমূত্র ত্যাগ ও স্নানাহার করতেন। অর্ধশায়িত অবস্থাতেই নজরুলকে তক্তপোষের একপাশে বসিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন। অন্যকে সহ্য করতে না পারলেও পত্নীর কথা শুনতেন, আকারে-ইঙ্গিতে কবিপত্নী তাঁকে বোঝাতেন।” (বাংলা সাহিত্যে নজরুল, আজহারউদ্দীন খান, পৃ – ২১০) সকলেই জানেন যে শেষ জীবনে কবিপত্নী ‘পক্ষাঘাতগ্রস্ত’ হয়ে পড়েছিলেন, ও কবি নিজে দুরারোগ্য স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কবির ছোট ছেলে ‘অনিরুদ্ধের’ স্ত্রী ছিলেন ‘কল্যাণী’। তিনি নিজের শাশুড়ি সম্পর্কে লিখেছিলেন, “মাকে প্রথম দেখি আজ থেকে প্রায় চৌদ্দো-পনের বছর আগে, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের একটি বাড়ির এক অপরিসর কক্ষে শুয়ে থাকতে। প্রথম দর্শনেই মধুর হাসি হেসে তিনি কন্যাস্নেহে আমায় আপন করে নিলেন। পরবর্তী জীবনে কখনও কোনো অবস্থার মধ্যেই – সুদিনে কি দুর্দিনে – তাঁর সেই মুখের হাসি ম্লান হতে দেখি নি। এই পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠত৷ কালক্রমে আত্মীয়তায় রূপান্তরিত হলো। আমি এ বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রবধূরূপে প্রবেশাধিকার লাভ করলাম। উত্থান শক্তিহীনা এই মহিলার কর্মক্ষমতা দিনে দিনে আমায় বিস্মিত করেছে। সংসারের প্রয়োজনীয় কাজের সবটুকুই তিনি নিজের হাতে করতে ভালবাসতেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেটা কি করে সম্ভব? উত্তরে বলবো, প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর কেউ সে দৃশ্য কল্পনা করতে পারবেন না। তাঁর নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে গেলেও ঊর্ধ্বাঙ্গ সক্ষম ছিল। স্বল্প উচ্চতা বিশিষ্ট প্রশস্ত এক চৌকির একধারে তিনি শুয়ে থাকতেন। তাঁর নির্দেশে চৌকিটিকে দরজার সাথে সমান্তরাল করে এমনভাবে রাখা হয়েছিল, যাতে কোনো কিছুই তাঁর নজর এড়িয়ে না যেতে পারে। আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি অপনোদনের জায়গা ছিল মায়ের পাশের এই জায়গাটুকু। এই চৌকির উপর পাশ ফিরে শুয়ে তিনি মাছ-তরকারি কুটতেন। কোনো কোনো সময় স্টোভে চা বা অন্যান্য রান্নাও তিনি করতেন। পরবর্তীকালে তাঁকে নাতি তিনিদের জন্য সোয়েটার বুনতে বা ছেলেদের জামায় বোতাম লাগাতেও দেখেছি। যতদিন বেঁচেছিলেন বেশির ভাগ দিনই তিনি নিজের হাতে বাবাকে (নজরুলকে) খাইয়ে দিতেন। খাওয়া শেষ হলে তাঁর হাত-মুখ ধুইয়ে সযত্নে তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিতেন, তিনি খাবার পরিবেশন না করলে বা তাঁর সামনে বসে না খেলে আমাদেরও তৃপ্তি হতো না, আর তিনি নিজেও তৃপ্ত হতেন না। লোক খাওয়ানোর ব্যাপারে তাঁর সাথে একমাত্র অন্নপূর্ণারই তুলনা করা চলে। যে কোনো সময়, যে কোনো অবস্থায়, যে লোকই এসেছেন – মা তাঁদের কখনও না খাইয়ে ছাড়েন নি। টাকাকড়ির হিসাব নিকাশ সবই তিনি রাখতেন। কোনো কোনো সময়ে আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি হ’তো। ফলে, আর্থিক সংকটও দেখা দিয়েছে। তবুও কখনও তাঁকে ভয় পেতে বা ভেঙ্গে পড়তে দেখি নি। ধীর-স্থিরভাবে তিনি এই সমস্যার সমাধান কি করে যে করতেন তা ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। মাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগতো সন্ধ্যাবেলায় যখন তিনি চুল বেঁধে মাথায় ও কপালে এয়োতীর চিহ্ন এঁকে সান্ধ্য শঙ্খধ্বনির সাথে সাথে শুভ্র শঙ্খবলয় পরিহিত দুই হাত একত্রিত করে প্রণাম জানাতেন তাঁর ইষ্ট-দেবতাকে সকলের মঙ্গল কামনা করে। মায়ের মুখে শুনেছিলাম যে, তাঁর মা (গিরিবালা দেবী) ছিলেন একাহারী নিষ্ঠাবতী বিধবা। সবাইকে খাইয়ে তারপর পূজা সেরে শুদ্ধাচারে তিনি স্বপাক অনুগ্রহণ করতেন। তিনি নিরুদ্দিষ্টা হওয়ার পর ঠাকুরকে তুলে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আগের বছর মা বলতেন, ‘দেখ, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, কবে আছি, কবে নেই, তুই একটা পুজোর ব্যবস্থা কর।’ তখুনি তাঁর কথামতো সব ব্যবস্থা করা হলো। তিনি সারাদিন উপবাস করে রইলেন। পূজা শেষ হলে সকলকে প্রসাদ দিয়ে তিনি সামান্য প্রসাদ খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করলেন।” (আমাদের মা, নজরুল স্মৃতি, কল্যাণী কাজী, পৃঃ ১৭৬-৭৭) প্রায় দুই যুগ রোগভোগের পর নজরুলের সহধর্মিনী সেই আচারনিষ্ঠা মহিলার প্রয়াণ ঘটেছিল ৩০শে জুন ১৯৬২ সালে (১৫ই আষাঢ় ১৩৬৯ বঙ্গাব্দে)। অবাক করার মতন তথ্য হল, সেই নিষ্ঠাবতী মহিলা জীবনে বেঁচে থাকতে কখনও তাঁর শ্বশুরবাড়ি ‘চুরুলিয়া’য় যান নি। অথচ নিজের মৃত্যুর আগে হিন্দু নারী হয়েও তিনি নিজেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে, যেন তাঁকে ‘চুরুলিয়া’য় কবর দেয়া হয়। ‘মুজফ্ফর আহমদের’ মত ছিল, প্রমীলাকে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে দাহ করার। কবিপুত্র ‘সব্যসাচী’র কাছে তিনি নিজের সেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ‘সব্যসাচী’র কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন প্রমীলার অন্তিম অভিপ্রায়। তিনি লিখেছিলেন, “একটি হিন্দু ছেলে প্রমীলার কাছে থাকত। তাঁর কাজ-কর্ম করে দিত। প্রমীলার মৃত্যুর আগের দিন সেই ছেলেটি সবাইকে এবং আমাদের পার্টি অফিসে এসে আমাকেও বলল যে, প্রমীলাকে যেন কবর দেওয়া হয়, এই ইচ্ছা তাঁর নিকটে তিনি প্রকাশ করেছেন। কবি-প্রমীলার ঘরেই থাকত সেই ছেলেটি। রাত্রে কবি কি করেন, না করেন, তাঁর প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য প্রমীলাদের দুয়ারের বাইরের করিডোরে শোত। একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে তাঁর সঙ্গে প্রমীলার অনেক সব কথা হচ্ছিল। সেই সময়ে প্রমীলা তাঁকে বলে দেয় যে তাঁর মৃত্যুর পর নজরুলের পাশেই যেন তাঁকে কবর দেয়া হয়। প্রমীলা বয়সে নজরুলের চেয়ে নয় দশ বছরের ছোট ছিল। সে হয়তো মনে করেছিল যে নজরুলের পরেই তাঁর মৃত্যু হবে। প্রমীলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার ছিল না। অন্য কোনো লোকও কিছু বলেন নি। তখন নজরুলের ভইপোরা ধরে বসল যে তাঁদের কাকী-মা’কে তাঁরা চুরুলিয়া গ্রামে নিয়ে গিয়ে কবর দেবে। তার মানে মৃত্যুর পরে নজরুলের কবর হবে চুরুলিয়া। তখন কবি, সাহিত্যিক ও দেশপ্রেমিকদের তীর্থভূমিতে পরিণত হবে চুরুলিয়া। …” (স্মৃতিকথা, মুজফ্‌ফর আহমদ, পৃঃ ৩৫৫) অতএব প্রমীলাকে কবর দেওয়া হয়েছিল ‘চুরুলিয়া’য়। আর নজরুল! নিজের প্রাণাধিকপ্রিয় জীবন-সঙ্গিনীকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে তিনি শুধু প্রাণে বেঁচে ছিলেন আরো দুই যুগ। সেই যে তাঁর একাকীত্বের বেদনা, সেটা শুধু অনুভব করার – বলার বা লেখার জন্য সেটা নয়। অবশেষে মৃত্যু এসে তাঁকে মুক্তি দিয়েছিল, ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট (১২ই ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)। কবির ইচ্ছা ছিল – “মসজিদেরি পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।” তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছিল। এখন তিনি কবরে থেকে নিত্য ‘মোয়াজ্জিনের আজান’ শুনতে পান। আর প্রমীলা? তিনি সত্যিই ছিলেন এক দুর্ভাগিনী নারী। স্বামীর পাশে তাঁর কবর হয় নি। দু’জনের মধ্যে ব্যবধান শুধু সীমান্তের হয়নি, হয়েছিল দুস্তর ব্যবধান। জীবনে বা মরণে এই যুগল কি এক হতে পেরেছেন?
‘গ্রীক’ ভাষায় ‘ট্র্যাজেডি’কে বলা হয় ‘নেমেসিস’ – সেটাই ছিল প্রমীলা ও নজরুলের নিয়তি, এবং সে কাহিনী অতীব বেদনাদায়ক। এবং আরও বেদনাদায়ক হল তাঁদের দু’জনের মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁদের নিয়ে চলতে থাকা মিথ্যাচার। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ভারতীয় উপমহাদেশ এমন একটি জায়গা যেখানে নিন্দুকদের অভাব কোন কালেই অনুভূত হয়নি। আর বাঙালি জাতির মতন নিন্দুক সারা পৃথিবীতে আগে না কোনদিন হয়েছে, আর না ভবিষ্যতে হবে। অন্যান্য জাতি যখন নিজেদের মনীষীদের সন্মান রক্ষা করতে প্রাণপাত করতেও ছাড়েনা, বাঙালি তখন নিজেদের মনীষীদের সন্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে। বাংলার কোন মনীষী-ই এই মিথ্যাচার ও নিন্দুকদের হাত থেকে রেহাই পাননি। নজরুলও ব্যতিক্রম নন। তিনি আবার হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত। প্রমীলার সাথে তাঁর বিবাহ নিয়ে তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই নিন্দিত হয়েছিলেন। আর এখন তাঁর মৃত্যুর এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও তিনি এখনও নিন্দুকদের মিথ্যাচারের শিকার হন। নজরুল-প্রমীলার বিবাহ নিয়ে প্রায়শঃই নিন্দুকেরা প্রচার চালান যে, প্রমীলাকে নাকি ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল! অথচ নজরুলের পরিবারের সদস্য-সদস্যাদের লিখিত বিবরণী থেকে এটা পরিষ্কার যে প্রমীলা আমৃত্যু হিন্দু ছিলেন, এবং নজরুল কোনদিনই তাঁকে নিজের ধর্মাচরণের জন্য কোন বাধা দেননি। শুধু কবি কেন, কেউই তাঁকে বাধা দেননি। নিন্দুকেরা প্রশ্ন করেন, প্রমীলা ইসলাম গ্রহণ না করলে কি ভাবে নজরুলের সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল? হিন্দু রমণী হয়েও কেন তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল? কবির বন্ধু, পরিবারের লোকজন, বিবাহে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের বিবরণগুলো থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু নিন্দুকদের পড়াশোনা করার অত সময় কোথায়? কারো চরিত্রে কলঙ্কলেপনের জন্য তো কোন কর লাগে না! বাঙালির চরমতম দুর্ভাগ্য যে, এমন ব্যক্তিও কবির সমালোচনা করেন, যিনি নিজে কস্মিনকালেও দু-লাইন কবিতা লেখেন নি, বা এটাই জানেন না যে, স্বাধীনতার পরেও কবি দীর্ঘ সময় স্বাধীন ভারতে ছিলেন। অধিকাংশ বাঙালি তো এটাই জানেন না যে নজরুলকে ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত করেছিলেন (১৯৬০)। বাঙালির মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন যাঁরা নজরুলের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা এটাই জানেন না যে কবি সংস্কৃত ভাষা মিলিয়ে মোট সাতটি ভাষা জানতেন। কেউ কেউ আবার এটাই বিশ্বাস করতে পারেন না যে একজন মুসলিম হয়েও নজরুল ‘শ্যামাসঙ্গীত’ লিখেছিলেন, এমনকি তিনি নিজেও সেগুলো গাইতেন। আর এই ‘শ্যামাসঙ্গীতের’ প্রসঙ্গেই মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে আক্রমণ করেন। প্রসঙ্গ বড় করতে চাইলে, আরও বড় করা যায়। কিন্তু এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নজরুল ও প্রমীলা দেবীর বিবাহ নিয়ে যে মিথ্যাচার চলে, সেই মিথ্যের আয়নাকে সত্যের পাথর ছুঁড়ে ভাঙা। তাই সেই দিকেই নজর দেওয়া যাক।
নজরুল কলকাতা থেকে অধুনা বাংলাদেশের অপর প্রান্ত ‘কুমিল্লা’য় গিয়েছিলেন তাঁর প্রথম যৌবনে (১৯২১ সালে)। এবং সে-সময়েও তাঁর নিয়তি তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতই ছিল। পুস্তক ব্যবসায়ী ‘আলী আকবর খান’ তাঁকে নিজের গ্রাম, ‘কুমিল্লা’ জেলার ‘দৌলতপুর’-এ নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর ভাগ্নী ‘নার্গিসের’ সাথে নজরুলের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এর মূলে ছিল খানের ব্যবসায়ী মনোভাব। তাঁর চেষ্টা ছিল যে তিনি নজরুলকে পারিবারিক বন্ধনে বেঁধে, তাঁকে দিয়ে কিছু পাঠ্যপুস্তক লিখিয়ে ব্যবসা করবেন। কিন্তু বিধি অন্যরকম কিছু ভেবে রেখেছিলেন। খান সাহেব কলকাতা থেকে নজরুলকে নিয়ে ‘দৌলতপুর আসার পথে ‘কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে’ ‘সেনগুপ্তদের বাড়িতে’ উঠেছিলেন। দিন দুই তাঁরা সেই বাড়িতে থেকে ‘দৌলতপুরে’ গিয়েছিলেন। ‘নার্গিস-নজরুলের’ বিয়ের সময় গোটা ‘সেন পরিবার’ ‘কুমিল্লা’ থেকে দৌলতপুরে গিয়েছিলেন। বিয়েটা আদৌ হয়েছিল কি হয়নি – সেটা নিয়ে আজও বিরোধ বর্তমান। যদি না হয়ে থাকে, তাহলে কেন হয়নি, সেটা যাঁরা নজরুলের জীবনী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, তাঁরা সকলেই জানেন। তাই সেই প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি এখানে না করলেও চলবে। বিয়ের রাত শেষ হতে না হতেই নজরুল ‘বিরজাসুন্দরী দেবী’ ও ‘গিরিবালা দেবী’দের সাথে ‘কুমিল্লা’ শহরে এসে তাঁদের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছিলেন। তারিখটা ছিল, ১৮ই জুন ১৯২১সাল। সেই বাড়িতে বিধবা ‘গিরিবালা’ তখন তাঁর কিশোরী কন্যা ‘প্রমীলা’কে নিয়ে ছিলেন আশ্রিতারূপে। সেই পরিবারে নজরুলের আদর-আপ্যায়নের একটি বর্ণনা দিয়েছিলেন ‘শৈলসুতা দেবী’ – “কাজী যখন আলী সাহেবের বাড়ি হইতে কুমিল্লা শহরে সেন পরিবারে গিয়া উঠেন, পরিবারস্থ সকলেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন। … কাজী যে মুসলমান একথা পরিবারস্থ কাহারও মনে রহিল না। একসঙ্গে আহার বিহার চলিতে লাগিল। তবে রান্নাঘরে তিনি প্রবেশ করিতেন না। এই পরিবারে কয়েকদিন বাস করিবার পর কাজী জ্বরে আক্রান্ত হ’ন। একটি বালিকা এই জ্বরে তাঁহার শুশ্রুষা করে, নাম শ্রীমতি আশালতা। পূর্ব হইতেই আশালতা নজরুলকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিত, সে শ্রদ্ধা গভীর হইয়া উঠিল। … আশালতার জননী গিরিবালা দেবীও কুমিল্লার বাসায় থাকিতেন। নজরুলের গুণে তিনি মুগ্ধ হইয়াছিলেন এবং নজরুলকে অত্যন্ত স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। নজরুলের প্রতি কন্যার শ্রদ্ধা ও প্রীতি তাঁহার দৃষ্টি এড়ায় নাই। নজরুলও কন্যার শ্রদ্ধা ও প্রীতির প্রতিদান দিতে পরান্মুখ নহেন, একথা জানিয়া তিনি অপরিসীম আনন্দ অনুভব করিলেন।” (পরিণয়ে প্রগতি) প্রমীলা ‘দৌলতপুরে’ গিয়ে নজরুলের বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন, অথচ সেই প্রমীলাই আবার বিবাহবাসর ত্যাগ করা (মতান্তরে বিবাহিতা) নজরুলকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। এর মূলে ছিল পারিবারিক প্রশ্রয় – বিশেষতঃ ‘বিরজাসুন্দরী দেবী’ ও ‘গিরিবালা দেবী’র প্রশ্রয়। একদিকে ‘বিরজাসুন্দরী’ ও ‘গিরিবালা’ অপরদিকে ‘মুজফ্ফর আহমদ’ – উভয় পক্ষের আচরণ, আবার কিশোরী প্রমীলার সেবা-যত্ন, নজরুলকে ধীরে ধীরে সেই কিশোরীর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছিল। নজরুলকে ‘কুমিল্লা’ থেকে কলকাতা নিয়ে যাবার জন্য ‘মুজফ্‌ফর আহমদ’ ৬ই জুলাই এসেছিলেন এবং ৮ জুলাই দু’জনে কলকাতা রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে প্রমীলা যে নজরুলের চিত্তে একটা আকর্ষণের সঞ্চার করেছিলেন, এ-কথা অনায়াসে বলা যায়। এরপরে নজরুল ঘন ঘন ‘কুমিল্লা’য় যাতায়াত শুরু করেছিলেন। ১৯২১ সালেই দুর্গা পূজার সময় সেখানে গিয়ে তিনি মাসখানেক ছিলেন। আবার পরের বছর (১৯২২) সেখানে গিয়ে টানা চার মাস (ফেব্রুয়ারি-মে) ছিলেন। এই সময় প্রমীলা ওরফে ‘দুলি’ বা ‘দোলন’ তাঁর চিত্তে প্রবলভাবে আলোড়ন তুলেছিলেন। এবং কবি তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘বিজয়িনী’ (‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থ) কবিতাখানি। কবি-হৃদয়ের বিজয়িনী প্রমীলা ওরফে ‘দোলনের’ নামে উৎসর্গিত কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি ছিল ‘দোলন-চাঁপা’ (প্রথম প্রকাশ আশ্বিন ১৩৩০ বঙ্গাব্দ)। নজরুল যেমন ‘প্রেমিক’ পুরুষ ছিলেন তেমনি ছিলেন ‘বিদ্রোহী’। তাই তিনি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করে লিখেছিলেন যে ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। এই সূত্রে ‘মুজফ্ফর আহমদ’ লিখেছিলেন – (‘কুমিল্লা’ থেকে নজরুল) “কলকাতায় ফিরে এসে ‘ধূমকেতু’তে লিখতে গিয়ে নিজের প্রচণ্ড আবেগের স্রোতে সে নিজেই ভেসে গেল। সে যে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা করবে স্থির করেছিল তাঁর সেই বিবেককে সে লাল পোশাক পরে লাল কালিতে লিখে, এবং মাঝে মাঝে লাল নিশানের কথা ব’লে ঠিক রাখছিল।” (স্মৃতিকথা, মুজফ্ফর আহমদ) অতএব ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অপরাধে ‘ধূমকেতু-সম্পাদক’ নজরুলের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা বের হয়েছিল। নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় তিনি ‘কুমিল্লা’ পালিয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য পালিয়ে গিয়েও তিনি রেহাই পাননি, ১৯২২ সালের ২৩শে নভেম্বর তিনি ‘কুমিল্লা’ থেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁকে পুলিশ প্রহরায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’রূপে বিচারে তাঁর ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই বছরের ১৫ই ডিসেম্বর নজরুল কারামুক্ত হয়ে আবার ‘কুমিল্লা’ গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর প্রতি সেন পরিবারের আচরণ সম্পর্কে ‘শৈলসুতা দেবী’র লেখা থেকে জানা যায় – “বরং এইবারে সেই সৌহাৰ্দ্দ এত নিবিড় হইয়া উঠিল যে, তাঁর সহিত আশালতার বিবাহ দিবার জন্য গিরিবালা দেবী উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেলেন।” কিন্তু সেই বিয়েতে পরিবারের কর্তা ‘ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত’ রাজি ছিলেন না। তাঁর পুত্র ‘বীরেন্দ্রকুমার’ও অমত করেছিলেন। তবে ‘বীরেন্দ্রকুমার’ যখন দেখেছিলেন যে সে বিয়ে হবেই, তখন তিনি বলেছিলেন যে নজরুলকে হয় ‘শুদ্ধি’ গ্রহণ নয় ‘ব্রাহ্মমতে’ বিবাহ কার্য্য নিষ্পন্ন করতে হবে। সেই পরিস্থিতিতে ‘গিরিবালা দেবী’ তাঁর কন্যাকে নিয়ে এতকালের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে ‘বিহারের সমস্তিপুরে’ তাঁর ভাইদের কাছে চলে গিয়েছিলেন। নজরুল, ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে, তাঁদের সেখান থেকে নিয়ে এসে কলকাতার অদূরে ‘বালী’গ্রামের এক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে, তাঁর পরিচিত একজন জনৈক ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে কিছুদিনের জন্য রেখেছিলেন। ওদিকে প্রমীলা-নজরুলের বিবাহের ঘোরতর বিরোধী ‘বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত’ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন – “মুসলমানের সহিত খুল্লতাত তনয়ার বিবাহে তাঁহার আদৌ সহানুভূতি নাই; তাঁহার খুড়ীমা গিরিবারা দেবী তাঁহার এবং তাঁহার পরিবারস্থ অপর সকলের সম্পূর্ণ অমতে মুসলমানে কন্যাদান করিতেছেন। এজন্য তিনি অতঃপর খুড়ীমা তাঁহার সহিতও সমুদয় সম্পর্ক ছিন্ন করিতে বাধ্য হইলেন।” এরপরে ‘বীরেন্দ্রকুমার’ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় আরেকটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন –
“শ্রীযুত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু –
মহাশয়,
বিগত ১৯ মার্চের ‘দৈনিক বসূমতী’তে প্রকাশিত হইয়াছিল যে, কলিকাতা শহরে জোর গুজব উঠিয়াছে, – ‘ধূমকেতু’ সম্পাদক সুকবি কাজী নজরুল ইসলামের সহিত ‘যুগান্তর’ সম্পাদক বীরেন্দ্রনাথ সেনের ভগিনীর বিবাহ হইতেছে। … ব্যাপার এতদূর গড়াইয়াছে বলিয়া এই প্রস্তাবিত বিবাহ সম্বন্ধে আমার অভিমত প্রকাশ করা কর্তব্য মনে করিলাম। অসবর্ণ বিবাহ, – এমন কি, আন্তর্জাতিক বিবাহেরও আমি – সর্বতোভাবে সমর্থন করিয়া থাকি, – কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে কয়েকটি বিশেষ বিবেচনায় আমি এই কার্য্যে সহায়তা করিতে পারিতেছি না – এবং আমার জ্যেঠতাতঃ ভগিনীর বিবাহে আমার কর্তৃত্বও নাই। আমার পিতামাতাও এই বিবাহ প্রস্তাবে সম্মতি দান করেন নাই।
নিবেদন ইতি ২৫শে মার্চ ১৯২৪ সন।
শ্রী বীরেন্দ্রকুমার সেন।”
নজরুল যখন প্রথম ‘কুমিল্লা’য় সেই পরিবারে গিয়েছিলেন তখন (মুজফ্ফর আহমদের কথানুযায়ী) আপনজনের মতো অভ্যর্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিয়েতে ‘ইন্দ্রকুমার’ ও ‘বীরেন্দ্রকুমারের’ ভীষণ অমত দেখে, “বিরজাসুন্দরী দেবী কলকাতায় এসে শ্রীযুক্তা গিরিবালা দেবী ও তাঁর মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও চেয়েছিলেন। তাঁরা যান নি। বলেইছি তো গিরিবালা দেবীর মনের জোর ছিল।” (স্মৃতিকথা, মুজফ্‌ফর আহমদ, পৃঃ ২৭৫) ‘গিরিবালা দেবী’ তাঁর কন্যার ভবিষ্যৎ ভেবেই সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। প্রমীলার সমবয়সী আরো দুটি মেয়ে সেই পরিবারে ছিল। অতএব একজন পিতৃহীনা ও সহায়সম্বলহীন কন্যাকে সেই সময়ে পাত্রস্থ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কেবল গুণী ও খেয়ালি নজরুলের মতন পাত্র পাওয়া তো একেবারেই অসম্ভব ছিল। সেই বিয়েতে শুধু ‘সেন পরিবার’ নয়, বাইর থেকেও বিস্তর বাধা এসেছিল। প্রমীলা ও নজরুলের বিয়ে নিয়ে বিরোধিতা কম হয় নি। তৎকালীন বইপত্র থেকে মনে হয় যে, সম্ভবতঃ ‘ব্রাহ্মরা’ সেই বিয়ের বিরোধিতা করেছিলেন সবচেয়ে বেশী। ‘প্রবাসী’ গোষ্ঠীর ‘ব্রাহ্মরা’ই ছিলেন সেই ব্যাপারে অগ্রণী। তাঁরাই প্রকাশ করেছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’৷ যে ‘প্রবাসী’তে একটা সময় কবিতা ছাপালে নজরুলকে টাকা দেওয়া হতো, সেই ‘প্রবাসী’তে তাঁর কবিতা ছাপানো একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জন্মলগ্ন থেকে সমাজের অচলায়তন ভেঙে চলা ‘ব্রাহ্মরা’ সেই সময়ে হঠাৎ করে পরম হিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন! ‘ব্রাহ্ম’ ছাড়া অন্য হিন্দুরাও কিছু কিছু বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানা যায়।

বিয়ের সময় কনের বয়স ছিল ষোল। প্রমীলা-নজরুলের বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ‘মিসেস এম. রহমান’ – নামেট এক মহিয়সী মহিলা। তিনি ছিলেন ‘হুগলী জেলার সরকারি উকিল’ ‘খান বাহাদুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরী’র কন্যা, ‘চানাচূর’ (প্রবন্ধ) এবং ‘মা ও মেয়ে’ উপন্যাসের লেখিকা। তিনি নজরুলকে পুত্রাধিক স্নেহ করতেন৷ নজরুলও তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। এবং নজরুল-ভক্তদের কাছেও তিনি মাতৃসমা ছিলেন। ‘মিসেস এম. রহমান’ একদিন নজরুল সাগরেদ ‘মঈনুদ্দীন’কে একটি পত্রে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “একখানা বাড়ী দেখে দিতে হবে। ছোটোখাটো একখানা বাড়ী – কয়েক দিনের জন্য। সেখানে তাঁর এক আত্মীয়ের বিয়ে হবে৷” এর কয়েকদিন পরে ‘মিসেস এম. রহমান’ ‘মঈনুদ্দীন’কে তাঁর কলকাতার বাসায় খবর দিয়ে এনে বলেছিলেন, “নজরুলের বিয়ে। আর এর আয়োজন খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। পেছনে ঢের শত্ৰু বেশী হৈ-চৈ করো না।” (যুগ-স্রষ্টা নজরুল, মঈনুদ্দীন পৃঃ ৪৯) কলকাতার ‘৬ নং হাজী লেনে’ বাসা নেওয়া হয়েছিল। বিয়ের ‘অভিনন্দনপত্র’ লিখেছিলেন ‘মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী’ এবং তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন লেখক ব্যতীত ‘আবুল কালাম শামসুদ্দীন’, ‘আবুল মনসুর আহমদ’ ও ‘মঈনুদ্দীন’। বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল ‘২৫শে এপ্রিল ১৯২৪ সাল, রোজ শুক্রবার (১২ই বৈশাখ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে রমযান ১৩৪২ হিঃ)’ এবং সময় – ‘বাদ্‌ জুম্মা’। বিয়ের কথা অনেকে জানলেও সঠিক দিন-কাল গোপন রাখার দরুন নজরুল ভক্তদের কেউ সেখানে হাজির হতে পারেন নি। অতএব একরূপ নিরিবিলিতে বিয়ের কাজ হয়েছিল। নজরুল-প্রমীলার বিয়ের ‘কাজী’ ছিলেন ‘মৌলবী মঈন-উদ্-দীন হোসায়েন’, ‘উকিল’ ছিলেন ‘কুমিল্লা’র ‘আবদুস সালাম’ এবং সাক্ষী ছিলেন ‘মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী’ ও ‘মঈনুদ্দীন’।

বিয়ের আগে কথা উঠেছিল, কোন মতে বিয়ে হবে? হিন্দু মতে হতে পারে না। এক হতে পারে ‘সিভিল-ম্যারেজ’। আর হতে পারে ‘মুসলমানী’ মতে। ‘সিভিল-ম্যারেজ’ মতে, আইন অনুযায়ী বর-কনে উভয়কে এক স্বীকৃতি এই মর্মে দিতে হয়, “আমি কোন ধর্ম মানি না”। কবির তাতে প্রবল আপত্তি ছিল, কেননা তাঁর সুদৃঢ় বক্তব্য ছিল – “আমি মুসলমান – মুসলমানী রক্ত আমার শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, এ আমি অস্বীকার করতে পারব না।” বেশ কয়েকটি গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, সেই সময় কোন এক কোটিপতি মাড়োয়ারী নাকি কবিকে লক্ষ টাকার বিনিময়ে ‘আর্যধর্ম’ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু নজরুল তাতে রাজি হন নি – তাঁর পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিল না। অবশেষে ‘মুসলমানী’ মতে বিয়ে হবে, সেটাই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু এরপরেই একটা জটিলতা দেখা দিয়েছিল। বিয়ের উদ্যোক্তরা পাত্রকে বলেছিলেন, “কনেকে মুসলমান ধর্মগ্রহণ করতে বলা হোক।” নজরুল এতে রাজি তো হনই নি, উল্টে তিনি ভয়ানক ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “কারুর কোন ধর্মমত সম্বন্ধে আমার কোন জোর নেই। ইচ্ছে করে তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে, পরেও করতে পারবেন।” এই বলে তিনি ইতিহাস থেকে বহু নজির দিয়েছিলেন। নজরুলের জ্ঞান, বাগ্মিতা ও ইতিহাস চর্চার বিপরীতে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বিয়ের উদ্যোক্তাদের ছিল না। তাই তাঁর মত মেনে নিয়ে উদ্যোক্তারা বলেছিলেন, “… ‘আহলে-কেতাব’দের সঙ্গে স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া মুসলমানী আইন মতে অসিদ্ধ নয় এখন কথা হচ্ছে এই যে, হিন্দুগণ ‘আহলে-কেতাব’ কিনা! এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন। এই সকল পয়গম্বর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষেও পয়গম্বরের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। অতএব এ বিয়ে সম্ভবতঃ আইনমতে অন্যায় হবে না।” এরপর ‘মুসলমানী’ মতে বিয়ে পড়াবার জন্য কাজী সাহেবের নির্দেশক্রমে ‘মঈনুদ্দীন’, ‘ওয়াজেদ আলী’ ও ‘আবদুস সালাম’ অন্দর মহলে গিয়েছিলেন কন্যার ‘এজিন’ নেয়ার জন্য। কন্যার ‘এজিন’ এবং বিয়ে সম্পর্কে বিশদভাবে নিজের গ্রন্থে লিখেছিলেন ‘মঈনুদ্দীন’ – “কনে শ্রীমতী আশালতা সেনগুপ্তা লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে ছিলেন। মিসেস এম. রহমান ও কনের মা শ্রদ্ধেয়া গিরিবালা সেনগুপ্তা একটু আড়ালে বসেছিলেন। মুসলমানী কায়দা অনুযায়ী উকীল জনাব আবদুস সালাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম নিবাসী মরহুম জনাব কাজী ফকির আহমদ সাহেবের পুত্র কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব আপনাকে ১০০০, টাকা দেনমোহরের এওজে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। তার অর্ধেক মওয়াজ্জেল আর অর্ধেক মায়াজ্জেল। আপনি তাকে শওহরীতে কবুল করতে রাযী আছেন?’ কনে নিশ্চুপ। কথাটি আবার তাঁর ফিরে বলা হলো। এবারও কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। মুসলমানদের বিয়েতে সাক্ষী ও উকীলকে এরূপ সমস্যায় পড়তে হয়, এ আমি জানতাম। কারণ যে-কন্যা টপ করে ‘কবুল’ বলে ফেলেন, তিনি নাকি সবচেয়ে বেহায়া। বর্ষীয়সী মেয়েদের এরূপ ধারণা। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা কনেকে অনবরত চিমটি কাটতে থাকেন, আর কনেকে ‘কবুল’ বলতে যে খুব দেরী করতে হবে, এরূপ ইঙ্গিত করতে থাকেন। পর্দার আড়ালে যে-সব কনেকে বসানো হয়, তাঁদের বেলায়ই এরূপ করা হয়। কিন্তু এখানে কনেকে আমাদের সামনেই বসানো হয়েছিল। এরূপ ইঙ্গিত করার কোন উপায় ছিল না। এখানে কনে চুপ করে বসে আছেন – কবুল বলতে অযথা দেরী করছেন। ব্যাপার কী? বিশেষ করে উভয়ের সানন্দ-সম্মতিক্রমে স্ব স্ব সমাজের সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যেখানে বিয়ে হচ্ছে, সেখানে স্বীকারোক্তি পেতে দেরী হওয়া তো উচিত নয়। আমার কেমন সন্দেহ হলো। বললাম, ‘কথাগুলো সহজ সরল বাংলা ভাষায় বলুন। হয়তো কনের পক্ষে মুসলমানী শব্দগুলো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।’ উকীল মুসলমানী শব্দগুলোকে বাংলায় রূপান্তরিত করলেন। শেষে বললেন – ‘আপনি কি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবকে স্বামীত্বে বরণ করতে স্বীকৃত?’ এবার কনে ক্ষীণকণ্ঠে জওয়াব দিলেন – ‘হাঁ, স্বীকৃত’। তিনবার এরূপ স্বীকৃতি আদায় করে সগর্বে আমরা বাইরের ঘরে চলে এলাম। নজরুল ইসলামের কাছ থেকেও ‘অমুকের’ কন্যা ‘অমুক’ বলে স্বীকৃতি আদায় করে ‘কাযী’ সাহেব বিবাহকার্য সমাধা করলেন। তারপর তিনি আরবী ভাষায় খুৎবা পাঠ করলেন। এটা তিনি পকেটে করে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর তাঁদের মংগল কামনা করে মুনাজাত করা হলো। বলাবাহুল্য, আমরা সবাই ওযু করেছিলাম। নজরুল ইসলাম সাহেব সাদা চাদর দিয়ে পাগড়ী বেঁধেছিলেন।” (যুগ-স্রষ্টা নজরুল, মঈনুদ্দীন, পৃঃ ৫১-৫২)
‘মিসেস এম. রহমান’ একটি অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ছিলেন, তাই তাঁর পক্ষে বলা করা সম্ভব হয়েছিল – “যক্ষপুরীর জালের বেড়া যত শক্তই হোক তা ভাঙ্গবার শক্তি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তা নৈলে নজরুলকে কোলে নিয়ে মুক্তাকাশ তলে দাঁড়াতে পারতাম না।” (৬-১২-১৯২৪) তিনি নবদম্পতিকে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে ভালো করে সংসার পেতে দেবেন, এই প্রয়াসে হুগলীতে তাঁদের নিয়ে গিয়ে পৃথক বাসা করে দিয়েছিলেন। প্রমীলা ছিলেন স্বভাব-সরলা, ভদ্র ও বিদূষী। সেই সংসারের হাল ধরতে এসেছিলেন ‘গিরিবালা দেবী’। অথচ তিনি সাত্ত্বিক জীবন যাপন করতেন। হিন্দু বিধবার কঠোর নিয়ম পালন করতেন। তবু নজরুলের সংসারের সকল তাল তাঁকে সামলাতে হয়েছিল। সেই মহিলার সকল ত্যাগ ও তিতিক্ষা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে যে অঘটন ঘটে নি, সেটা নয়। একদিন রোজার সময় ‘হাবিবুল্লাহ বাহার’কে নিয়ে ‘মঈনুদ্দীন’ হুগলীতে গিয়েছিলেন কবির সাথে দেখা করতে। সেদিনই তাঁরা চলে আসবেন বলে ঠিক হয়েছিল। ওদিকে ‘ইফতারের’ সময় হয়েছিল, আবার ‘মঈনুদ্দীনের’ রোজা ছিল। তাই কবি তাঁদের ‘ইফতার’ করতে বলে অন্দরমহলে গিয়েছিলেন ব্যবস্থা করতে। কবি যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, রোজার দিনে ‘ইফতারী’ কেন তৈরি করে রাখা হয় নি, তার জবাবে ‘গিরিবালা দেবী’ তাঁকে বলেছিলেন, “আমি কি জানি বাপু – ইফতারী কাকে বলে, আর তাতে কি কি দরকার হয়।” এরপরে নজরুল নিজেই মেহমানদের জন্যে ‘ইফতারের’ ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘মঈনুদ্দীন’ নজরুলকে সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন – “এটা আপনার ভারী অন্যায় ভাই। মাসীমা তো আর এ-সব ব্যাপারে অভ্যস্ত নন যে, আপনি তাঁর ওপর অনর্থক রাগারাগি করবেন?” সেই প্রশ্নে তাঁর চোখ দুটো দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল। তিনি শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন – “মুসলমানের ঘরে মেয়ে দিতে পারলেন আর এ-সব জানবেন না মানে? তাঁকে জানতে হবে।” (যুগ-স্রষ্টা নজরুল, মঈনুদ্দীন, পৃঃ ৬৩) তবে লক্ষ্য করা যায়, সুদীর্ঘ পারিবারিক জীবনে নজরুল স্বীয় ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতি যতখানি সম্ভব সংযত রেখেছিলেন। বিশেষতঃ তাঁর শাশুড়ি সাত্ত্বিক বলে। অতএব পারিবারিক অশান্তি বড় একটা ঘটেনি। নজরুল-প্রমীলার দাম্পত্যজীবন একরূপ নিরুপদ্রবে কেটেছিল। নজরুল ও প্রমীলা, উভয়েই নিজেদের বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন।

(তথ্যসূত্র:
১- নজরুল জীবনী, অরুণকুমার বসু।
২- বাংলা সাহিত্যে নজরুল, আজহারউদ্দীন খান।
৩- আমাদের মা, নজরুল স্মৃতি, কল্যাণী কাজী।
৪- স্মৃতিকথা, মুজফ্‌ফর আহমদ।
৫- পরিণয়ে প্রগতি, শৈলসুতা দেবী।
৬- যুগ-স্রষ্টা নজরুল, মঈনুদ্দীন।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

চীনকে চাপে রাখতে আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে মঙ্গোলিয়া ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছেচীনকে চাপে রাখতে আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে মঙ্গোলিয়া ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে

আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে মঙ্গোলিয়া ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে। ভারতের কাছে স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন মঙ্গোলিয়া। পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত মঙ্গোলিয়ার সাথে পৃথিবীর দুটি অন্যতম শক্তিশালী দেশ রাশিয়া ও

রামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্করামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্ক

রানা চক্রবর্তীঃ রাজা রামমোহন রায় ও হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর মধ্যে কি কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল? তাঁদের উভয়ের মধ্যে কেমন ধরণের সম্পর্ক ছিল? ‘ইলিয়ট ওয়াল্টার ম্যাজ’ই (Elliot Walter Madge) প্রথম তাঁর

শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে এক দম্পতি নিজের পুত্র সন্তানের সঙ্গে বড় করেছিলেন এক কন্যা শিম্পাঞ্জীকে! কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে এক দম্পতি নিজের পুত্র সন্তানের সঙ্গে বড় করেছিলেন এক কন্যা শিম্পাঞ্জীকে! কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে সেখানে উল্লেখ করা রয়েছে মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল শিম্পাঞ্জি কিংবা হনুমান। অর্থাৎ বংশানুক্রমে ও কালের পরিবর্তনে এই শিম্পাঞ্জিরাই আস্তে আস্তে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সভ্য

অপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারাঅপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারা

বর্তমানে একটা দেশ শাসন করে সরকার কিন্তু পূর্বে সেই শাসনভার ছিল রাজ রাজা ও সম্রাটদের হাতে। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে অনেক দয়ালু রাজার জনগণের প্রতি প্রেমের ব্যাখ্যা তো কিছু