রামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্ক - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ রামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্ক

রামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্ক


রানা চক্রবর্তীঃ রাজা রামমোহন রায় ও হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর মধ্যে কি কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল? তাঁদের উভয়ের মধ্যে কেমন ধরণের সম্পর্ক ছিল? ‘ইলিয়ট ওয়াল্টার ম্যাজ’ই (Elliot Walter Madge) প্রথম তাঁর ‘Henry Derozio: The Eurasian Poet and Reformer’ (Calcutta, 1905) গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, ডিরোজিওর বন্ধুদের মধ্যে রামমোহন রায় অন্যতম ছিলেন। তবে নিজের গ্রন্থে তিনি কথাটি উল্লেখ করলেও, সেবিষয়ে কোন বিস্তারিত তথ্য দেননি। ডিরোজিও হিন্দু কলেজের শিক্ষক ছিলেন, আর রামমোহনের সঙ্গে হিন্দু কলেজের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাহলে কোথায় তাঁদের আলাপ হয়েছিল? ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভায়? কিন্তু সেখানে রামমোহন কখনো উপস্থিত থাকতেন বলে কোন ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানতে পারা যায় না। তাহলে কি কোনো স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা সভায় তাঁদের উভয়ের মধ্যে পরিচয় হয়েছিল? কিন্তু রামমোহন যেহেতু সেই জাতীয় অনুষ্ঠানে খুব কমই যেতেন, তাই সেই সম্ভাবনাও অল্প। সম্ভবতঃ উভয়ের কোনো বন্ধু বা অনুরাগীর গৃহে (যেমন তারাচাঁদ চক্রবর্তী) তাঁদের দেখা হয়েছিল। ডিরোজিও ও রামমোহনের জীবন সম্পর্কে যাঁরা কিঞ্চিৎ অবগত রয়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন যে, তাঁদের উভয়েই সতীদাহ প্রথা রদে উৎসাহী ছিলেন। সেই সূত্রেও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া সম্ভব। সতীদাহ নিরোধক আইন পাশ হওয়ার পরে ‘লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক’কে সম্ভ্রান্ত হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে একটি মানপত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই মানপত্রে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে ‘কালীনাথ রায়চৌধুরী’, ‘রামমোহন রায়’, ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ‘প্রসন্নকুমার ঠাকুর’ প্রমুখরা ছিলেন। অন্যদিকে তৎকালীন কলকাতার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও বেন্টিঙ্ককে একটি সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। সেই সংবর্ধনার মানপত্রে যাঁরা সই করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শুধুমাত্র চারজনের নামই ছাপা হয়েছিল, বাকি সবাই প্রমুখের দলে ছিলেন। (The Days of John Company: Selections from Calcutta Gazette, Compiled & edited by Aml Chandra Das Gupta, n. d. item no. 428, p- 427) এই প্রসঙ্গে ‘নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়’ তাঁর রামমোহন জীবনীতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। সেই কাহিনীটি তিনি ‘রামতনু লাহিড়ী’র মুখ থেকে শুনেছিলেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে নগেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যে সময়ে গবর্ণর জেনারেলকে অভিনন্দনপত্র প্রদান করা হয়, সেই সময়ে বাবু রামগোপাল ঘোষ, বাবু রসিককৃষ্ণ মল্লিক, বাবু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি হিন্দু কলেজের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তাঁহারা এক দিবস কলেজের এক ঘরে বসিয়া অভিনন্দনপত্ৰ লইয়া অত্যন্ত উৎসাহের সহিত এই তর্কে প্রবৃত্ত হইয়াছেন যে উক্ত পত্রের ইংরেজী রচনা রামমোহন রায়ের কি অ্যাডাম সাহেবের। এমন সময়ে প্রাতঃস্মরণীয় ডিরোজিও সাহেব আসিয়া বিশেষ বৃত্তান্ত শুনিয়া বলিলেন, ‘তোমরা মানুষ, না এই দেয়াল? নারীহত্যারূপ ভীষণ প্রথা দেশ হইতে উঠিয়া গেল, ইহাতে তোমরা কোথা আনন্দ করিবে না অভিনন্দনপত্রের ইংরেজী কাহার রচনা এই বৃথা তর্কে তোমরা মত্ত। রামমোহন রায় ইংরেজীতে কিরূপ সুপণ্ডিত ব্যাক্তি জানিলে তোমরা উহা অ্যাডাম সাহেবের বলিয়া মনে করিতে না।’ …” (মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, দে’জ সংস্করণ, পৃ- ১৯৬) এখানে ডিরোজিওর উক্তি থেকে এটাই মনে হয় যে, রামমোহনকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন ও জানতেন। এছাড়া ইংরেজিতে ‘উপেন্দ্রনাথ বল’ লিখিত রামমোহনের জীবনচরিতেও ডিরোজিওর উল্লেখ পাওয়া যায়। উপেন্দ্রনাথের ইংরেজি বক্তব্যের বঙ্গানুবাদ করলে হয়, “অ্যাঙলো ইন্ডিয়ান তরুণ হেনরি ডিরোজিওর হাতে নাস্তিক শিক্ষা পেয়ে হিন্দু কলেজের বাঙালি অল্পবয়েসি ছাত্রেরা যেরকম আচরণ করছিলেন তাতে তিনি খুবই বিচলিত হন।” (“… he was shocked at the way the young Bengalis were behaving after receiving godless education in the Hindu Collage at the hands of an Anglo-indian young man named Henry Derozio.” Rammohan Roy: A study of his Life, Works and Thoughts, Upendra Nath Ball, Calcutta, 1933, p- 175) রামমোহন নিজে নাস্তিকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর কোনো একজন ভক্ত শিষ্য একবার জনৈক ব্যক্তি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন যে, “ভদ্রলোক আগে deist (একেশ্বরবাদী) ছিলেন, পরে নাস্তিক atheist হন।” সেকথা শুনে রামমোহন নাকি তাঁকে বলেছিলেন, “এরপরে ‘beast’ (পশু) হবে।” (The Life and Letters of Raja Rammohan Roy, Sophia Dobson Collection, Edited by Dilip Kumar Biswas & Prabhat Chandra Ganguli, Calcutta, 3rd edition, 1962, p: 228-29) কিন্তু ‘রাধাকান্ত দেব’ প্রমুখের কাছে রামমোহনের আস্তিক্যবাদ এবং সেযুগের হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে তথাকথিত নাস্তিক্যবাদের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিলো না। তাই ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, বস্তুতঃ রাধাকান্তের উষ্মার কারণেই ডিরোজিওর দুই শিষ্য ‘রসিককৃষ্ণ মল্লিক’ এবং ‘কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়’ যেমন পদচ্যুত হয়েছিলেন, তেমনই ওই একই ব্যক্তির আপত্তিতে রামমোহনের বন্ধু ‘উইলিয়াম অ্যাডাম’-এরও হিন্দু কলেজে চাকরি হয়নি। রাধাকান্তের মতে, “For my part, I cannot entrust the morals and education of those I regard, to such an one that was once a Missionary, then a Vaidaentic or disciple of Rammohun Roy and lastly a unitarian.” (দিলীপকুমার বিশ্বাস লিখিত রামমোহন-সমীক্ষা গ্রন্থের ৪৬৫ নং পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত)
এখনো পর্যন্ত রামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্ক নিয়ে যত গ্রন্থে লেখা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ‘দিলীপকুমার বিশ্বাস’ লিখিত ‘রামমোহন-সমীক্ষা’ গ্রন্থে সেই প্রসঙ্গ সবচেয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের সপ্তম অধ্যায়টির শিরোনাম হল – ‘রামমোহন রায়, ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল’। গবেষক দিলীপকুমার বিশ্বাস ‘দ্য এনকোয়ারার’ পত্রিকার ফাইলপত্রগুলি অন্বেষণ করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর লেখার সুবাদে সেই সময়ের ‘ডিরোজিয়ান’দের, বিশেষ করে ‘দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়’, ‘রসিককৃষ্ণ মল্লিক’, ‘কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়’, ‘শিবচন্দ্র দেব’ প্রমুখের জীবনে রামমোহনের প্রভাব বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। তাঁদের অনেকের কাছেই রামমোহন ‘আধা-উদারনৈতিক’ ছিলেন। উল্লেখ্য যে, স্বয়ং ডিরোজিও কিন্তু ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকার ১৮৩১ সালের ৫ই অক্টোবর 5 অক্টোবর সংখ্যায় রামমোহনের ধর্মমতের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, “কী যে তাঁর (রামমোহনের) মতামত, তা তাঁর বন্ধু কিংবা শত্রু, কেউই জানেন না। সেগুলি কী বলার চেয়ে সেগুলি কী নয় বলা বরং সহজ। … এটা সবারই জানা যে রামমোহন বেদ, কোরান এবং বাইবেল সমানভাবে মানেন – এর সবগুলিকেই তিনি হয়তো সমদৃষ্টিতে বিচার করেন, সব ধর্মের অসিদ্ধ প্রমাণ অংশ বর্জন করে ভালোটি তিনি গ্রহণ করেছেন। … তাঁর জীবন যাপন সব সময়ে হিন্দুর মতো। … তাঁর অনুসারীদের, অন্ততঃ কারো কারো মধ্যে আচরণে কোনো সঙ্গতি নেই। তাঁর নামের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে তাঁরা শাস্ত্রবিরোধী সবরকম অনাচার খাদ্য পানীয়ের ব্যাপারে চালিয়ে যাচ্ছেন; আবার একই সঙ্গে ‘ব্রাহ্মণদের’ দক্ষিণা দিচ্ছেন, হিন্দু ধর্মে আস্থা নেই বলছেন এবং বাড়িতে পুজো-আর্চায় যাতে কোনো অবহেলা না হয় সেদিকে নজর রাখছেন।” (“What his (Rammohun Roy’s) opinions are, neither his friends nor foes can determine. It is easier to say what they are not than what they are … Rammohun, it is well known, appeals to the Vedas, the Koran, and the Bible, holding them all probably in equal estimation extracting the good from each, and rejecting from all whatever he considers apocryphal … He has always lived like a Hindoo … His followers, at least some of them, are not very consistent. Sheltering themselves under the shadow of his name, they indulge in everything forbidden in the Shastras, as meat and drink; while at the same time they fee the Brahmins, profess to disbelieve Hinduism, and never neglect to have poojas at home.” The East Indian, October 1831, quoted in the India Gazette, 5th October 1831; Social Ideas and Social Change in Bengal: 1818-1835, A. F. Salahuddin Ahmed, Calcutta, 2nd edition, 1976, p- 49.) কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়ও রামমোহন সম্পর্কে একই অভিযোগ করে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, তিনি কেন হিন্দু ধর্মের বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি। দিলীপকুমার বিশ্বাস তাঁর গ্রন্থে ‘দ্য এনকোয়ারার’ পত্রিকা থেকে কৃষ্ণমোহনের কিছু কিছু রচনা উদ্ধৃত করেছিলেন। তাতে দেখা যায় যে কৃষ্ণমোহন বলেছিলেন, “এমনই হচ্ছে হিন্দুধর্মের স্বরূপ যে তাঁর (রামমোহনের) মতো ক্ষমতাবান ব্যক্তির বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সম্ভব হয়নি তার মধ্যে যুক্তিবাদের আবরণ দেওয়ার।” (“… for really such is the visage of Hinduism that it was impossible even for such a talented an individual (Rammohun) in spite of all his efforts, to cast a veil of rationality on it.” রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ- ৪৪৭) আরেক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, “ব্রহ্মণ্যবাদকে … তাই বলা যেতে পারে দেশের কেন্দ্রস্থলে রোপিত নষ্টবৃক্ষ … কোনো ব্যক্তি … যদি হতভাগ্য হিন্দুদের উদ্ধার করতে চান তো তাঁকে বৃক্ষমূলে কুঠারঘাত করতে হবে। যতোদিন এর অস্তিত্ব থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত কোনো সুফল আশা করা যাবে না।” (“Braminism … may therefore be called a corrupt tree planted in the midst of the country … If a person wishes to benefit the poor Hindus he must lay the axe at the root of this tree. While it exists, good fruit cannot be expected.” রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ- ৪৭৭) তবে তখনকার সব ডিরোজিয়ানরাই যে কৃষ্ণমোহনের মতাবলম্বী ছিলেন এমন নয়। রসিককৃষ্ণ মল্লিক তাঁর লেখায় রামমোহনের প্রতি হিন্দুদলপতিদের অবিচারের উল্লেখ করলেও, হিন্দুধর্ম সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনে তাঁর বিশিষ্ট ভূমিকার ওপরে জোর দিয়েছিলেন। দিলীপকুমার বিশ্বাসও মনে করতেন, “… রসিককৃষ্ণ তাঁর ধর্মানুশীলনে ও ধর্মবিশ্বাসে রামমোহনের দ্বারা বিশেষতঃ রামমোহন রচিত ‘তুহফাৎ-উল্-মুওহাহিদিন’-এর বক্তব্যের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। দেখা যায় তিনি রামমোহনের মতই উদার সার্বভৌম একেশ্বরবাদে গভীর বিশ্বাসী। … রসিককৃষ্ণের অধ্যাত্মদর্শনে রামমোহনের প্রেরণা যে ক্রিয়াশীল, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এ প্রকাশিত তাঁর এই সুদীর্ঘ বিবৃতি পাঠ করলে সে বিষয়ে সংশয় থাকে না।” (রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ: ৪৪৪-৪৫) দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ওপরে রামমোহনের ধর্মমতের প্রভাব সম্ভবতঃ আরো গভীর ছিল। এই প্রসঙ্গে দিলীপকুমার বিশ্বাস তাঁর গ্রন্থে ‘রাজনারায়ণ বসু’ লিখিত ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থটি থেকে যে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, সেটা অবশ্য উল্লেখ্য – “দক্ষিণাবাবু ব্রাহ্ম ছিলেন, কিন্তু রামমোহন রায়ের সময়ে ব্রাহ্মসমাজে যেমন কেবল উপনিষদ পাঠ ও সঙ্গীত হইত, কেবল তাহাই হওয়া কর্তব্য মনে করিতেন। আমাদের ব্রাহ্মসমাজকে অহিন্দু জ্ঞান করিতেন। … দক্ষিণারঞ্জন উপনিষদকে এত মান্য করিতেন কিন্তু আমাদিগের ন্যায় বেদের প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করিতেন না। … কিন্তু উপনিষদের প্রতি তাঁহার বিশেষ ভক্তি ছিল এবং উপনিষদই ব্রাহ্মসমাজের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হওয়া উচিত এমন মনে করিতেন। তাঁহাকে ঔপনিষদিক ব্রাহ্ম বলিলে হয়।” (আত্মচরিত, রাজনারায়ণ বসু, পৃ- ৪৫৪) তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, রামমোহনের ধর্মবিশ্বাস বিষয়ে ডিরোজিওর শিষ্যদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক ছিল। তবে ধর্ম ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের ওপরে রামমোহনের প্রভাব সম্পর্কে দিলীপকুমার বিশ্বাসের অভিমত ছিল, “… সমস্ত রকম প্রগতিশীল প্রশ্নে রামমোহনের সঙ্গে ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যবর্গের সাধারণভাবে মতৈক্য ছিল। ১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৮৩০ সংখ্যা ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী পোষিত যে সব মতবাদের উল্লেখ পূর্বে করা হয়েছে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় – (১) প্রগতিশীল সমাজসংস্কার (social reform) (২) শিক্ষাবিস্তার (education), বিশেষতঃ নারীজাতির মধ্যে শিক্ষার প্রসার (female education); (৩) চিন্তায় ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (freedom of thought and expression); (৪) অ্যাডাম স্মিথ ব্যাঘ্যাত অর্থনীতি সম্মত ব্যবসাক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার (monopoly) বর্জন ও অবাধ বাণিজ্যের প্রচলন (freedom of trade), (৫) ভারতে উঁচুদরের ইউরোপীয়গণ কর্তৃক উপনিবেশস্থাপন (colonization of India by intelligent Europeans which they believed would lead the welfare of the country)। এই আদর্শসমূহের সব কয়টিই রামমোহনের চিন্তায় ইতিপূর্বেই রূপ গ্রহণ করেছে।” (রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ: ৪৩৯-৪০) ডিরোজিয়ানদের চিন্তাধারায় রামমোহনের অভিঘাত প্রসঙ্গে গবেষক ‘সুমিত সরকার’ও তাঁর ‘The Complexities of Young Bengal, A Critique of Colonial India’ গ্রন্থে একই মত পোষণ করেছিলেন। সামগ্রিক বিচারে সুমিত সরকারের ধারণা ছিল যে, দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ডিরোজিয়ানদের রাজনৈতিক প্রগতিশীলতা রামমোহন প্রচারিত নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই থেকে গিয়েছিল। রামমোহনের মতো তাঁরাও ব্যবসা-বাণিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার এবং কিছু কিছু শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করলেও আদতে বৃটিশ শাসনের প্রতি অনুগত ছিলেন। আর তাঁরাও হিতবাদী দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দু’জন ঐতিহাসিকের মূল্যায়নের পার্থকা শুধু এটাই যে, সামগ্রিক বিচারে এর অধিকাংশ ভাবধারা কতটা প্রগতিশীল ছিল, সে বিষয়ে তাঁদের দু’জনেই সম্পূর্ণ বিপরীত মতাবলম্বী ছিলেন।
রামমোহনের মৃত্যুর পরে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় (১৮৩৪ সালের ২৬শে জানুয়ারি) যে শোকসংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে রামমোহনকে নিয়ে অনেক প্রশস্তি থাকলেও, তিনি যে ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল দলের একজন আদর্শ গুরু ছিলেন, এরকম কোনো ধারণা হয় না। (Death of Rammohun Roy, Selections from Jnanannesan, compiled by Suresh Chandra Maitra, Calcutta, 1979, P: 137-40) আসলে তাত্ত্বিকভাবে রামমোহন তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁদের মূল লড়াইটা ছিল তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের সঙ্গে। উল্টোদিকে রামমোহনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেটাই ছিল, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং প্রভাব প্রতিপত্তি ডিরোজিয়ানদের মধ্যে ছিলনা। নিজেদের প্রথম জীবনে তাঁদের শক্তি ও উদ্যমের অনেকটাই অভিভাবক এবং পরিবার পরিজনদের সঙ্গে সংঘর্ষে ও সংঘাতে ব্যয়িত হয়েছিল। সেজন্য নিজেদের কর্মজীবনে তাঁরা বিশেষভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন। তবে নিজেদের শিক্ষাগুরু ডিরোজিওর আদর্শবাদ তাঁরা কখনোই ভোলেননি, আবার একইসঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা এটাও বুঝেছিলেন যে, তথাকথিত রক্ষণশীল সমাজপতিদের মূল আরো গভীরে প্রোথিত রয়েছে, এবং সম্মুখ সমরে তাঁদের কিছুতেই পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সেজন্যই তাঁরা সমন্বয়ের পথ অবলম্বন করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, সেজন্য তাঁদের অনেক দামও দিতে হয়েছিল। ‘রামকমল সেন’ প্রসঙ্গে ‘প্যারীচাঁদের’ মূল্যায়ন, অথবা রাধাকান্ত দেব বিষয়ে ‘রামগোপাল ঘোষের’ মত পরিবর্তন, সেই সমন্বয়সাধনার অনিবার্য পরিণাম ছিল। এই প্রসঙ্গে ‘কৈলাসচন্দ্র বসু’ (১৮২৭-৭৮) রামগোপাল ঘোষের স্মৃতিসভার যে ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন, সেটি হল – “আপনাদের অনেকেই শুনিয়া আনন্দিত হইবেন যে এই দু’জনই (রাধাকান্ত দেব এবং রামগোপাল ঘোষ) প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি, দুইটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতা হইয়াও ঈর্ষা বা ঘৃণার পরিবর্তে পরস্পরকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতেন। আমি একটি ঘটনা জানি যাহাতে পরস্পরের এই শ্রদ্ধা ও ভক্তির ভাব বিশেষভাবে পরিদৃষ্ট হইয়াছিল। ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে জুলাই মাসে টাউন হলে চার্টার সভায় রামগোপাল তাঁহার সর্ব্বজন-হৃদয়গ্রাহিণী অগ্নিময়ী বক্তৃতা শেষ করিয়া বক্তৃতামঞ্চ হইতে অবতীর্ণ হইলে, সেই সভায় সভাপতি স্যর রাজা রাধাকান্ত তাঁহার আসন পরিত্যাগ করিয়া দন্ডায়মান হইলেন এবং রামগোপালকে তাঁহার সুললিত বক্তৃতার জন্য ধন্যবাদ প্রদান করিয়া প্রেমভরে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, ‘ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন, আপনি আপনার দেশের সেবায় আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিতে সমর্থ হউন। আপনি আমাদের সমাজের মুখপাত্র, আপনি আমাদের জাতির অলঙ্কারস্বরূপ।’ রামগোপাল নম্রভাবে নমস্কার করিয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিয়া বলিলেন, ‘আপনারা আমা হইতে যাহা আশা করিয়াছিলেন তাহা সুসম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছি, ইহা আপনার মুখে শুনিয়া আমি গৌরব অনুভব করিতেছি। কিন্তু মহাশয়, আমি যতদুর করিতে পারিব, দেশ আপনার নিকট হইতে তদপেক্ষা অধিকতর কল্যাণের আশা করে।’ …” (সেকালের লোক, মন্মথনাথ ঘোষ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ: ৫৭-৫৮) ডিরোজিওর ‘fury brand’ ছাত্রকে রাধাকান্ত দেব – “আপনি আমাদের সমাজের মুখপাত্র, আপনি আমাদের জাতির অলঙ্ককারস্বরূপ” – বলে সম্বোধন করেছিলেন! জানা নেই যে ডিরোজিও তখন বেঁচে থাকলে সে বিষয়ে কী বলতেন? অবশ্য এর দুই দশক আগেই (২৬শে ডিসেম্বর ১৮৩১ সাল) সেই নিঃসঙ্গ নায়কের প্রয়াণ ঘটেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

নজরুল-প্রমীলা বিবাহ প্রসঙ্গেনজরুল-প্রমীলা বিবাহ প্রসঙ্গে

রানা চক্রবর্তীঃ ইতিহাসে নজরুল পত্নী ‘প্রমীলা’ এক ‘pathetic’ চরিত্র। অপর পক্ষে নজরুল ইসলামের বিয়ে প্রথমে ঠিক হয়েছিল (মতান্তরে বিয়ে হয়েছিল) যে মহিলার সাথে, সেই ‘নার্গিস’কে বলা যায় ‘ট্র্যাজিক’ চরিত্র। আর

পাকিস্তানের সরকার নির্ধারণ করে সেনাবাহিনী! জুলফিকর আলি ভুট্টোকে যেভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিলপাকিস্তানের সরকার নির্ধারণ করে সেনাবাহিনী! জুলফিকর আলি ভুট্টোকে যেভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল

১৯৭০ এর দিকে দক্ষিন এশিয়ার ভৌগোলিক মানচিত্রটি একটু আলাদা ছিল। ভারতের পশ্চিমে তখন পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব দিকে ছিল পূর্ব পাকিস্তান যা আজকের বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জুড়ে

ধর্মঠাকুর কে?ধর্মঠাকুর কে?

রানা চক্রবর্তীঃ পশ্চিমবঙ্গে ধর্মদেবতার পূজা এখন একান্তভাবে বর্ধমান বিভাগে সীমাবদ্ধ। তবে চব্বিশ পরগণা জেলায় ও কলকাতার কাছাকাছি অঞ্চলে, ধর্মদেবতার বিগ্রহ ও নিত্যপূজা এখনও একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় নি। পূর্ববঙ্গের স্থানে

হোসেনশাহী বংশের উত্থানহোসেনশাহী বংশের উত্থান

রানা চক্রবর্তীঃ গৌড়-বঙ্গে হাবসী যুগের শেষ সুলতান ‘সামসুদ্দীন মুজাফরের’ আততায়ী হোসেন শাহ আরব ভাগ্যান্বেষী ‘সৈয়দ আসরাফের’ পুত্র ছিলেন। অনেক আশা আকাঙ্খা নিয়ে আসরফ বঙ্গদেশে এসেছিলেন, কিন্তু কোথাও কিছু সুবিধা না