'বাংলা সাহিত্যের অভ্যুদয়’ - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘বাংলা সাহিত্যের অভ্যুদয়’

‘বাংলা সাহিত্যের অভ্যুদয়’


রানা চক্রবর্তীঃ ভাষার জন্ম হয় দেশের মাটিতে। মানুষের অলক্ষ্যে জলবায়ুসহ সে মাটি যেমন নিয়ত পরিবর্তিত হয়, তেমনি ভাষাও পরিবর্তিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা থেকে কত শব্দ অহরহ লোপ পাচ্ছে, আবার কত নতুন নতুন শব্দ এসে জায়গা করে নিচ্ছে। ভাষার প্রকাশ ভঙ্গিরও ক্রমাগত বদল ঘটছে। কোথা থেকে এই শব্দসম্ভার আসে, বা কেমন করে পুরানো শব্দগুলি অচল হয়ে যায় – এই প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারেন না। বৈয়াকরণরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান, কিন্তু তরঙ্গের গতি রোধ করবার সাধ্য তাঁদেরও নেই। নতুন মৌলিক শব্দ সৃষ্টির সাধ্যও কারো নেই। সেগুলো নিজে থেকেই সৃষ্ট হয়। পৃথিবীর সর্বদেশে সর্বকালে এই চলমান ভাষা সাহিত্যের ভিতর দিয়েই ফলেফুলে বিকশিত হয়। প্রাচীন ভারতের শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন, তাই ওই ভাষাতেই তাঁদের, তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ বেদ রচিত হয়েছিল। চার খণ্ডে সমাপ্ত সেই বিরাট গ্রন্থের ভাষা ছিল আদিযুগীয় সংস্কৃত। এর কয়েক শতাব্দী পরে উপনিষদের যুগে পৌঁছে দেখা গিয়েছিল যে, সংস্কৃতর রূপ ঈষৎ পরিবর্তিত হয়েছে, ঋষিদের চিন্তাধারা আরো গভীরতর হয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতির বর্ণনা প্রসঙ্গে তাঁরা বলেছিলেন, “সূর্য্য সেখানে কিরণ দেয় না, চন্দ্র-তারকা অগ্নি-বিদ্যুৎও কিরণ দেয় না; তিনি আলোক বিকীরণ করলে তবেই তারা আলোকিত হয়। সেই অমর ব্রহ্ম তোমার সম্মুখে পশ্চাতে দক্ষিণে বামে বিদ্যমান রয়েছেন।” –
“ন তত্র সূৰ্য্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তিমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি৷৷”
(মুণ্ডকোপনিষদ, ১১)
উপনিষদের দর্শন চার হাজার বছর পরে জার্মানীতে পৌঁছে ‘Schlegel’ ও ‘Schopenhaur’ সহ সমগ্র বিদগ্ধ সমাজের জীবনদর্শন বদলে দিয়েছিল। সেখান থেকে ওই মহাগ্রন্থ ইংল্যাণ্ডে গিয়ে ‘Carlyle’, ‘Coleridge’, ‘Shelley’, ‘Wordsworth’ প্রভৃতি মনীষীদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল; আমেরিকায় গিয়ে ‘Emerson’, ‘Thoreau’ সহ বহু চিন্তানায়ককে নতুন আলোকের সন্ধান দিয়েছিল। এইভাবে উপনিষদ সারা বিশ্বকে আলোকিত করলেও সেটির ভাষা কিন্তু জার্মান বা ইংরাজী ছিল না, ছিল আদিযুগীয় সংস্কৃত। সে যুগের পণ্ডিতেরা যে ভাষাতে কথা বলতেন, উপনিষদের ঋষিরা সেই ভাষাতেই তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। সংস্কৃত কোনদিন প্রাচীন ভারতের সাধারণের কথ্য ভাষা ছিল কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা রয়েছে। তবে একথা ঠিক যে, সংস্কৃত ভাষায় যদি বৈদিক যুগের জনসাধারণ তাঁদের নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান একেবারেই না করতেন, তাহলে এর ভিতর দিয়ে সেই মহান সাহিত্যের বিকাশ কখনোই সম্ভব হত না। কারণ, কল্পনায় গড়া শব্দ ও ‘empirical’ ব্যাকরণ দিয়ে একটি আস্ত গ্রন্থ রচনা করা তো দূরের কথা, একটি ছোট বাক্য রচনা করাও সম্ভব নয়। সেকাজ করবার মত যদি তেমন কোন শক্তিধর থাকেন, তাহলে তাঁর জায়গা ঈশ্বরের পাশে হবে। সুদূর অতীতের একটা সময়ে সংস্কৃতের প্রভাব সীমান্তের ওপারেও ছড়িয়ে পড়েছিল বলে পার্শীদের ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’র গাথাগুলিতে বৈদিক যুগীয় সংস্কৃত ও বৈদিক আচারের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বৈদিক সংস্কৃতেরও রূপের পরিবর্তন ঘটেছিল, কারণ আর্যদের কথ্য ভাষারও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটেছিল। তাই বেদোত্তর যুগে কপিল মুনি রচিত ‘সাংখ্যদর্শনের’ ভাষা কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল, রামায়ণ-মহাভারতের যুগে পৌঁছে সেই ভাষা আরও স্বতন্ত্র হয়েছিল। তার পরবর্তী যুগে রচিত ‘ভাগবদ্গীতা’র সংস্কৃত বেশ সরল ও সহজবোধ্য। অতীতে মানুষের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য মনু, পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি যে স্মৃতিগ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন, সেগুলির ভাষা গুরুগম্ভীর। ওই সময়ে রচিত বিজ্ঞান, গণিত ও জ্যোতিষের ভাষাও তাই। কিন্তু জনসাধারণের জন্য লিখিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ ও ‘হিতোপদেশের’ গল্পগুলির ভাষা সাবলীল। সেই সব গল্প পরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন নতুর সাহিত্যের সৃষ্টি করেছিল। অনেকের মতেই ‘Aesop’s Fables’-এর গল্পগুলি সেই দুই পুস্তক থেকে সংগৃহিত করা হয়েছিল, তবে ইউরোপ পৌঁছে জন্তুগুলির অবয়ব বদলে গিয়েছিল। ভারতের শিয়াল হয়েছিল গ্রীসের খ্যাঁকশিয়াল! ‘কথাসরিৎসাগরের’ প্লটগুলি সর্বদেশের সাহিতের পুষ্টি জুগিয়েছিল। শেক্সপিয়ার লিখিত ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ নাটকের বণিককের নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী আন্টোনিওর বুক থেকে এক পাউণ্ড মাংস তুলে নেওয়ার কাহিনীর সাথে ‘শিবি রাজা’র উপাখ্যানের আশ্চর্জ্জনক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরপরে নন্দ যুগে পৌঁছে সংস্কৃতর রূপের আরো বদল ঘটেছিল; কারণ, তখন লোকের কথ্য ভাষা বদলে গিয়ে নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাই পাণিনিকে তাঁর ‘অষ্টাধ্যয়ী’ রচনায় জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। সেই যুগে রাজনীতি নিয়ে লিখিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রের’ ভাষা বলিষ্ঠ, আবার তখনকার জনসাধারণকে জ্ঞানদানের জন্য সেই একই লেখক যে নীতিমালার রচনা করেছিলেন, সেটির ভাষা কত সরল! নীতিসারে তিনি বলেছিলেন – “যে দেশে লোকে তোমাকে সম্মান করে না, যেখানে বৃত্তির অভাব, বন্ধু বলতে কেউ নেই বা কৃষ্টিবান লোক নিয়ে যেখানকার সমাজ গঠিত নয়, সে দেশ তুমি অবশ্য‍ই পরিত্যাগ করবে।”
“যস্মিন্ দেশে ন সম্মানো ন রতিন চ বান্ধবঃ।
ন চ বিদ্যাগমঃ কশ্চিৎ ত দেশং পরিবজ্জয়েং॥”
নন্দ যুগ থেকে মৌগ্যযুগের ব্যবধান খুব একটা বেশী কিছু ছিল না, কিন্তু সে যুগে পৌঁছে দেখা গিয়েছিল যে, রাজসভায় ও বিদগ্ধ সমাজে সংস্কৃত ভাষার আগের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকলেও মগধের জনসাধারণের কথ্যভাষা কিন্তু বহু আগে থেকেই, শিশুনাগ বংশীয় রাজাদের সময়েই, ‘পালি’তে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। পালি ছিল জনগণের প্রকৃত – তাই ‘প্রাকৃত’ ভাষা সংস্কৃতের মত ‘classical’ ভাষায় ধর্মাচার্য্যদের চলত না বলে তাঁরা জনসাধারণকে সেই প্রাকৃতেই নিজেদের ধর্মকথা শোনাতেন। গৌতম বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পরে শিষ্যমণ্ডলী তাঁর বাণীগুলিকে সংগ্রহ করে যে ‘ত্রিপিটক’ রচনা করেছিলেন, সেটির ভাষা ছিল পালি ৷ ধম্মপদে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, “কিসের হাসি? কি আনন্দ এই জগত যখন নিয়ত পুড়ে যাচ্ছে? অন্ধকারে আচ্ছন্ন থেকে প্রদীপের সন্ধান করবে না? জ্ঞানাভাবে গৃহকারকের সন্ধানে আমি বহু জন্ম অতিক্রম করেছি; পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ দুঃখ। কিন্তু, গৃহকারক! এইবার তুমি ধৃত হয়েছ, আর তুমি গৃহ নির্মাণ করতে পারবে না। তোমার পর্শুকাসমূহ ভগ্ন ও গৃহকূট বিদীর্ণ হয়েছে। আমার চিত্ত নির্বাণগত, তৃষ্ণা ক্ষয়প্রাপ্ত।”

“কো নু হাসো কিমানন্দো নিচ্চং পজ্জ্বলিতে সতি।
অন্ধকারেন ওনদ্ধা পদীপং ন গবেথ॥ ১১।১
অনেক জাতিসংসারং সংধাবিস্সং অনিব্বিসং।
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্প নং॥ ১১।৮
গৃহকারক দিটঠোসি পুন গেহং ন কাহসি।
সব্বা তে ফাসুকা ভগ্‌গা গহকূটং বিসংখিতং।
বিসংখারগতং চিত্তং তহ্নানং খয়মাগা॥ ১১।৯”
এর দুই শতাব্দী পরেও পালি ভারতে একটি সজীব ভাষা ছিল, অশোকের শিলালিপিগুলি পালিতে লিখিত হয়েছিল। কিন্তু আরো দু’শো বছর পরে, কংসপাত্রের আঘাতে মৃৎপাত্রে ফাটল ধরেছিল, তখন পালিকে কোণঠাসা করে সংস্কৃত আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কুষাণ বংশীয় শ্রেষ্ঠ সম্রাট কনিষ্কের উদ্যোগে যে তৃতীয় বৌদ্ধ-সঙ্গীতির অধিবেশন আয়োজিত হয়েছিল, তাতে নাগার্জুনের নেতৃত্বে মহাযানপন্থীরা পালি ভাষার আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে সংস্কৃতকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ গ্রন্থটি সুললিত সংস্কৃতে রচিত হয়েছিল। সেই সময়ে রচিত ‘সদ্ধর্মপুণ্ডরীকাক্ষ’, ‘ললিতবিস্তার’ প্রভৃতি বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির ভাষাও সংস্কৃত। মহাযানপন্থীরা কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবার ফলে বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্যের সর্বত্র ওই মত প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্যও ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই ভাবে সংস্কৃত ভাষার আধিপত্য তখন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটির রূপ যে তখনও প্রতিনিয়ত বদল হচ্ছিল, বিভিন্ন সময়ে রচিত গ্রন্থগুলি পাঠ করলেই সেকথা বুঝতে পারা যায়। এরপরে গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষার প্রাণশক্তি সারা বিশ্বকে উদ্ভাসিত করেছিল, কিন্তু সেটির রূপ বৈদিক যুগের ভাষা থেকে স্বতন্ত্র ছিল। শুদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ বা কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ ও ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ প্রভৃতি নাটকের ভিতরে সে যুগের কথ্য ভাষারও কিছু কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়৷ যায়। সপ্তম শতাব্দীতে রচিত ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ বা শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’র ভাষাও যথেষ্ট স্বতন্ত্র ছিল। আরো পরে দ্বাদশ শতাদ্বীতে গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেনের সভাকবি জয়দেব তাঁর কোমলকান্ত পদাবলীতে সারা ভারতে এক নতুন মূর্ছনার সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে সংস্কৃতের সঙ্গেই অনাগত বাংলা ভাষার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। সেই মহাকবি বলেছিলেন, “ওগো সুন্দরী! যমুনার তীরে ধীর সমীরণ বইছে, আর তার মাঝে সচকিত নয়নে তোমার পথ চেয়ে বসে আছেন বনমালী।”
“ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।
পীনপয়োধর পরিসরমদ্দন চঞ্চল করযুগশালী॥ ৫-১
পতিত পতত্রে বিগলিত পত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম।
রচয়তি শয়নং সচকিত নয়নং পশ্যতি তব পন্থানম॥ ৫-১১”
আলোচ্য সময়ে রচিত ‘কালিকাপুরাণের’ মধ্যেও একই ধরণের বাংলাঘেঁষা সংস্কৃত ভাষার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
‘গীতগোবিন্দ’ প্রকাশের কিছু কাল পরে তুর্কীরা আয্যাবর্তের তিনটি রাজ্য অধিকার করে নিলে তখন যেসব পণ্ডিত সেইসব রাজ্যের সভাগুলিকে অলঙ্কৃত করতেন, তাঁদের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন। লক্ষ্মণসেনের জনৈক সৈন্যাধ্যক্ষ বটুদাসের পুত্র ‘শ্রীধরদাস’ অন্য রাজ্যে গিয়ে তাঁর ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থটি প্ৰকাশ করেছিলেন। অনুরূপ আরো বহু গ্রন্থই সেই সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। তুর্কী শাসিত ভারতে যখন মামলুকদের তাণ্ডব চলছিল, স্বাধীন রাজ্যগুলিতে তখন কৃষ্টি সাধনার বন্যা বইছিল। হয়সালারাজ দ্বিতীয় বীর বল্লালের সময়ে ১২০৬ খৃষ্টাব্দে ধর্মঘোষ লিখিত ‘শতপদিকা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। একই বছরে জীবদত্তসূরী তাঁর ‘বিবেক বিলাস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন। ত্রিবাঙ্কুরাধিপতি ইরামন কেরল বর্মনের সভাপণ্ডিত সোমেশ্বরের ‘কীর্তিকৌমুদী’ প্রকাশিত হয়েছিল তার তিন বছর পরে – ১২৩৯ খৃষ্টাব্দে। এর আগে ১২১১ খৃষ্টাব্দে মালবে অজুনবর্মণ অমরু-শতকের টীকা ‘রসিকমঞ্জরী’ লিখে যশস্বী হয়েছিলেন। তার পাঁচ বছর পরে অজিতদেবসূরী ‘যোগসিদ্ধি’ রচনা করেছিলেন; উক্ত গ্রন্থটি বর্তমানে লুপ্ত হলেও বিভিন্ন প্রাচীন পুস্তকে সেটির থেকে যেসব উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, তা থেকে গ্রন্থকারের প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ৷ একই সময়ে প্রকাশিত জীবদত্তের ‘বিবেক-বিলাস’ একটি উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ। জীনদেবসূরীর শিষ্য অভয়দেবসূরীর ‘জয়ন্ত বিলাস’ সেই সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল। অনুরূপ মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থ আরো রয়েছে। সেইসব লেখকেরা সবাই যে শরণার্থী ছিলেন তা নয় ৷ তবে একই সময়ে ওই ধরণের সাহিত্যস্রোত প্রবাহিত হওয়ার ফলে এটা অনুমান করা যায় যে, ওই সময়ে তুর্কী অধিকারের মধ্যে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলেই বহু মনীষী বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন। পণ্ডিতদের সেই দেশত্যাগ তারপরেও অব্যাহত গতিতে চলেছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপবাসী পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম মিথিলায় নিজের শিক্ষা সমাপনের পরে উড়িষ্যায় গিয়ে রাজা কপিলেন্দ্রদেবের সভা অলঙ্কৃত করেছিলেন।
বুদ্ধদেবের সময়ে মগধে সংস্কৃত ভাষা যে পালিতে পরিণত হয়েছিল, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। গৌড়ের জনসাধারণ তখন কোন ভাষায় কথা বলতেন, সেটা জানবার কোন উপায় এখন নেই। তবে তার হাজার বছর পরে পাল যুগে যে ভাষাটি গৌড়ে প্রচলিত ছিল, সেটির কিছু কিছু নমুনা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু গৌড়ের তৎকালীন রাজশক্তি সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষাকে আমল দিত না বলেই, সেই বিশাল মহীরুহ নিজের হাজার শাখা বিস্তার করে উদ্যানকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, ক্ষুদ্রতর বৃক্ষগুলি তখন অঙ্কুরোদগমের সঙ্গে সঙ্গেই শুকিয়ে গিয়েছিল। মহীরুহ সুমিষ্ট ফল প্রদান করে একথা সত্যি, কিন্তু লতাগুল্মের স্ফূরণ না ঘটলে ওষুধ তৈরী হওয়া সম্ভব নয়। ধর্মাচার্য্যরা কোন ভাষা দিয়ে আপামর জনসাধারণের ক্ষতের উপরে তাঁদের মতবাদের প্রলেপ দিতেন? তাই রাজশক্তির ঔদাসিন্য সত্ত্বেও তাঁদের উদ্যোগে গৌড়-বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্য ভাষাগুলি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে অনুরূপ ৩৪টি ভাষা দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান ছিল। সেগুলির প্রায় সব ক’টি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত হলেও সেগুলোর নিজস্ব রূপও ছিল। গৌড়ের পালরাজারা নিজেরা বৌদ্ধ হয়েও যখন সংস্কৃতে রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন, ও সেই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে পালি ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছিলেন, তখন রামাই পণ্ডিত প্রভৃতি ধর্মাচার্য্যরা কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত গৌড়ীয় ভাষায় শ্রীবুদ্ধের মহিমা প্রচার করছিলেন। রামাই পণ্ডিতের লেখা থেকে সেই ভাষার কিছু নমুনা নিম্নরূপ –
“বন্ন সুন্নী করতার সভ সুন্নী অবতার
সব্ব সুন্নী মধ্যে আরোহণ।
চরণে উদয় ভানু কোটী চন্দ্র যিনি তনু
ধবল আসন নিরঞ্জন॥”
রামাই পণ্ডিতের শতাধিক বছর পরে বজ্রযানপন্থী বৌদ্ধরা যে সব ডাক পুরুষের বচন রচনা করেছিলেন, সেগুলিও গৌড়ীয় ভাষায় লিখিত হয়েছিল। যথা –
(১) “আদি অন্ত ভুজশী।
ইষ্ট দেবতা পূজসি॥
মরনর জদি ডর বাসসি।
অসম্ভব কভু না খাওসি॥”
(২) “ভাষা বোল পাতে লেখি।
বাটা হুবো বোল কটি সাখি॥
মধ্যস্থ জনে সমাবে নিয়াঅ।
বোলে ডাক রত সুখ পাঅ।
মধ্যস্থ জবে হেমাতি বুঝে।
বোলে ডাক নরকে পইচে।”
এই গৌড়ীয় ভাষার উদ্ভব যে কখন ঘটেছিল, সেটা বলা যায় না; তবে দ্বাদশ শতাব্দীতে গুর্জররাজের সভাপণ্ডিত হেমচন্দ্র ভাষাতত্ত্ব সঙ্গন্ধে যে পুস্তকটি রচনা করেছিলেন, তাতে দেখা যায় যে, সেই সময়ে গৌড়ে ‘গৌড়ী’ ও বঙ্গে ‘প্রাচ্য’ ভাষা নামের দুটি ভাষা প্রচলিত ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতেও ভাষার সেই অবস্থার যে কোন পরিবর্তন হয় নি, সে কথা কবি আমীর খসরু তাঁর ‘কিরানা সালাতিন’ নামক পুস্তকে এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছিলেন, “আমার জন্ম হিন্দে। … বর্তমান সময়ে এ দেশের প্রতি প্রদেশে একটি করে ভাষা আছে যা তার নিজস্ব ও কারও কাছে ধার করা নয়। সিন্ধি, লাহোরী, কাশ্মীরী, ডোগরী, তেলেঙ্গী, গুজরাটী, মেবারী, গৌড়ী, বাংলা – এই সব হিন্দের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা।” খসরুর ভাষ্য থেকে বোঝা যায় যে, গৌড়ীয় ভাষা তখনও পর্যন্ত লোপ পায় নি, এবং বঙ্গের প্রাচ্য ভাষা তখন বাংলা নামে অভিহিত হচ্ছিল। এরপরে পূর্বোল্লিখিত গৌড়ীয় ভাষা একটা সময়ে বিবর্তিত হোতে হোতে ক্রমে বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই শুভক্ষণটি যে কবে এসেছিল, বা মহাকাশের কোন গ্রহ যে তখন কোন জায়গায় অবস্থান করছিল, তা কেউ বলতে পারেন না। তবে বাংলা ভাষাটি যখন সূতিকাগৃহে অবস্থান করছিল, সেই সময়কার অল্পস্বল্প যে সব লেখা এখনও বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলো থেকে দেখতে পাওয়া যায় যে, মহাবৌদ্ধ রামাই পণ্ডিতের যুগ চলে গিয়ে লুইপাদ, সবরিপাদ, ভুষুকপাদ প্রভৃতি সিদ্ধাচার্য্যরা বৌদ্ধদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে নিজেদের মতবাদ প্রচারের জন্য যে সব ছড়া রচনা করেছিলেন, সেগুলিতে বাংলার ছোঁয়া লেগেছিল। নিজের একটি ছড়ায় ভুষুকপাদ বলেছিলেন – “কার কাছে, কি ভাবে আছ? শিকারীরা এসে সব দিক থেকে তোমাকে ঘিরে ফেলেছে। জান না, হরিণ আপন মাংসের জন্য সকলের বৈরী হয়? ভুষুকপাদের দশাও তাই, ব্যাধেরা ক্ষণকালের জন্য তাকে ছাড়ে না।”
“কাহেরে ঘিনি মেলি অচ্ছ কিস।
ভেঢ়িল হাক পড়অ চৌদিশ॥
আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।
ক্ষণহ ন ছাড়অ ভুষুক অহেরী॥”
সাহিত্য হিসাবে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সেই ছড়াগুলির বিশেষ কোন মূল্য বিশেষ নেই, কিন্তু সেগুলির ভিতর দিয়ে বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের ধারা সম্বন্ধে জানতে পারা যায়। হিন্দী সাহিত্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ চাঁদকবি রচিত ‘পৃথ্বিরাজ রাসৌ’-এর ভাষা যতখানি হিন্দী সিদ্ধাচার্য্যদের, উপরোক্ত ধরণের প্রাচীন ছড়াগুলি তার চেয়ে কম কিছু বাংলা নয়। তাই সেই সিদ্ধাচাৰ্য্যদেরকে বাংলা সাহিত্যের পুরোধা বলা যেতে পারে। তাঁদের লেখা বিবর্তিত হতে হতে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যে রূপ নিয়েছিল, সেটা দিয়েই বর্তমান বর্ধমান জেলার কুলীনগ্রাম নিবাসী কবি মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামের যে কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, সেটাকেই বাংলা সাহিত্যের আদি গ্রন্থ বলা যেতে পারে। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে কবি লিখেছিলেন –
“কেহ বলে পরাই পীত বসন।
চরণে নূপুর দিমু বলে কোহ্ন জন॥
কেহ বলে বনমালা গাঁথি দিমু গলে।
মণিময় হার দিমু কোহ্ন সখি বলে॥
কটিতে কঙ্কন দিমু বলে কোহ্ন জন।
কেহ্ন বলে পরাইমু অমূল্য রতন॥
শীতল বাতাস করিমু অঙ্গ জুড়ায়।
কেহ্ন বলে সুগন্ধি চন্দন দিমু গায়॥
কেহ্ন বলে চূড়া বানাইমু নানা ফুলে।
মকর কুন্তল পরাই শ্রুতিমূলে॥
কেহ্ন বলে রসিক জন বড় কাল।
কর্পূর তামুল সনে জোগাইব পান॥”
মালাধর বসুকে বাংলা সাহিত্যের ‘Chaucer’ (১৩৪০-১৪০০) বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয় না। চসারকে দিয়ে যেমন ইংরাজী সাহিত্যের উন্মেষ ঘটেছিল, মালাধরকে দিয়ে তেমনি বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ হয়েছিল। উভয় কবিই কিন্তু পরস্পরের সমসাময়িক ছিলেন। চসারের ‘Canterbury Tales’ ইংরেজি ভাষায় লিখিত প্রথম সুসম্পূর্ণ গ্রন্থ, এদিকে মালাধরের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ও বাংলা সাহিত্যের প্রথম সুসম্পূর্ণ গ্রন্থ। ‘Canterbury Tales’-এর উপাদানগুলি যেমন বিভিন্ন বিদেশী গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছিল, মালাধরের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ও তেমনি ভাগবতের কৃষ্ণচরিত্রের রূপ অবলম্বনে রচনা করা হয়েছিল। চসারের আগে যেমন ‘Beowulf’ প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন কবিতা ইংল্যাণ্ডে প্রচলিত ছিল, মালাধরের আগেও গৌড়ে যে বহু বিচ্ছিন্ন কবিতার অস্তিত্ব ছিল, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। ‘Beowulf’-এর ভাষা ছিল প্রাক-ইংরেজী যুগীয় ‘Anglo-Saxon’ ভাষা, মালাধরের আগে রচিত ছড়াগুলির ভাষাও প্রাক-বাংলা যুগীয় গোড়ীয় ভাষা ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

অপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারাঅপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারা

বর্তমানে একটা দেশ শাসন করে সরকার কিন্তু পূর্বে সেই শাসনভার ছিল রাজ রাজা ও সম্রাটদের হাতে। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে অনেক দয়ালু রাজার জনগণের প্রতি প্রেমের ব্যাখ্যা তো কিছু

লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধলাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ

৫ কোটি লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নোটিশ বোর্ড। এই রাস্তায় আর মানুষ যেতে পারবে না। যান চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ। এমনকি মানুষের বাইরে বেরোনোর সময়সীমাও বেঁধে

ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্বব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্ব

কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে গেলে ঠিক কি দেখতে পাবো আমরা ? হ্যাঁ এই মোক্ষম আর অমোঘ প্রশ্নটা শুধুমাত্র সাধারণ পাঠকদের মনের মধ্যেই নয় এমনকি খোদ মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মনের মধ্যেও ঘুরপাক খাচ্ছে

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রান দিতে পর্যন্ত পিছপা হননি! কে ছিলেন আমস্টারডামবাসী এই আব্রাহাম?বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রান দিতে পর্যন্ত পিছপা হননি! কে ছিলেন আমস্টারডামবাসী এই আব্রাহাম?

নিজের দেশের জন্য লড়েছে এমন বহু বীরদের কথা উল্লেখিত রয়েছে ইতিহাসে। কিন্তু একজন অন্য দেশের নাগরিক হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না।