ভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ

ভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ


স্পাই গেম কথাটা বলা যতো সহজ বাস্তবে গুপ্তচর সংস্থার কাজ অনেক কঠিন। কোন দেশের এজেন্ট কোন সংস্থার হয়ে কাজ করছে তা বলা কঠিন। ইনটেলিজেন্স দুনিয়ায় অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট সংস্থার এজেন্ট অন্য সংস্থার হয়ে কাজ করে, এদের ডবল এজেন্ট বলা হয়। একজন দক্ষ এজেন্ট তৈরি করা যেকোনও ইনটেলিজেন্স সংস্থার পক্ষেই কঠিন কাজ কিন্তু সেই এজেন্টই যখন দেশের বিপক্ষে ডবল এজেন্টের কাজ করে তখন তা সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার সিআইএ, সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি এবং ব্রিটেনের এমআই সিক্সের মতোন সংস্থা গুলিতে এমন প্রচুর ডবল এজেন্ট ছিল। এখনও ডবল এজেন্ট পৃথিবীর মোটামুটি সব দেশের গুপ্তচর সংস্থাতেই আছে। জানেনকী ভারতেরই এমন একজন গুপ্তচর ছিল যে বড়ই রহস্যময় ছিল।

এই ব্যাক্তি একসাথে পাঁচটি গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ করেছিল। তিনি ছিলেন ডবল এজেন্ট। আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভগতরাম তলওয়ার একাই পাঁচটি দেশের এজেন্ট। সোভিয়েত রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, ব্রিটেনের পাশাপাশি শেষ দিকে জাপানেরও গুপ্তচর। সেই ভগতরাম, যিনি পেশওয়ার থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে পৌঁছে দিয়েছিলেন কাবুলে। তিনি ছিলেন ডবল এজেন্ট। আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভগতরাম তলওয়ার একাই পাঁচটি দেশের এজেন্ট। সোভিয়েত রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, ব্রিটেনের পাশাপাশি শেষ দিকে জাপানেরও গুপ্তচর। সেই ভগতরাম, যিনি পেশওয়ার থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে পৌঁছে দিয়েছিলেন কাবুলে।

ভগত রাম তলোয়ারের জন্ম হয়েছিল ১৯০৮ সালে বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতানখাওয়া প্রদেশের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের এক হিন্দু ক্ষত্রিয় পরিবারে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। তার বাবা গুরুদাসমল খান আব্দুল গফফর খানের সাথে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ওনার মা মথুরা দেবী তলোয়ার। ওনার ভাই হরিকিষনকে তৎকালীন পাঞ্জাব গভর্নরের উপর গুলি চালানোর অভিযোগে ৯ জুন, ১৯৩১ সালে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ভগৎ সিং ও হরিকিষনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, দুজনকেই লাহোরের কেন্দ্রীয় কারাগারে একসাথে রাখা হয়েছিল। সেইবছরই ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে ওখানেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ভাই হরিকিষন ও ভগৎ সিং এর ফাঁসির বদলা নিতে ভগত রাম তলোয়ার তার বন্ধুদের সাথে মিলে লাহোরের ডেপুটি কমিশনারের হত্যার পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে ডেপুটি কমিশনার আসেনি ফলে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এইসময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থী বিচারধারার প্রসার ঘটতে শুরু করে যার ফলে অনেক নতুন সংগঠন তৈরি হয়। এরকমই একটি দল হল কীর্তি কিষান পার্টি, যার সদস্য হন ভগত রাম তলোয়ার। তার সাথে রাশিয়ার বেশ কিছু লোকের সম্পর্ক ছিল যারা বামপন্থী বিচারধারায় বিশ্বাসী ছিল। এরপর আসে ১৯৩৯ সাল, বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ন বছর কারন এই বছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যার প্রভাব ভগত রাম তলোয়ারের জীবনেও পড়েছিল। এই বছরই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের সাথে কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতার দূরত্ব তৈরি হয়, যার কারনে কংগ্রেসের সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন সুভাষচন্দ্র বোস। তিনি সর্বভারতীয় ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন। এরপর চেন্নাই ও কলকাতাতে বেশ কিছু সভা করেন তিনি কিন্তু তারপরই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেন এবং কলকাতার বাড়িতে তাঁকে নজরবন্দী করে রাখা হয়। এরকম অবস্থাতেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের কাবুলে যাবার ইচ্ছে হয়। তিনি চাইছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই সময়ে সেনা গঠন করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। এই জন্য পেশোয়ারের রামকিষন ও চিমাকে পাঠানো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করতে।

রামকিষন পথমধ্যেই মারা যান এবং চিমাকে সোভিয়েত পুলিশ ইংরেজ গুপ্তচর ভেবে গ্রেফতার করে। এই খবর পাবার পর বামপন্থী নেতা শ্রীপাদ ডাঙ্গে এবং পেশোয়ারে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা আকবর শাহ ঠিক করে এই কাজের দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়া হবে। তাদের মাথায় একজনের নামই আসে ভগত রাম তলোয়ার। ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র বোস ছদ্মবেশে ধানবাদের গোমো গ্রাম হয়ে ট্রেনে পেশোয়ার পৌঁছায়। ১৬ জানুয়ারি, ১৯৪১ তিনি অন্যত্র যাত্রা শুরু করেন। ব্রিটিশ সেনাকে ফাঁকি দেবার জন্য তিনি পাঠান সেজেছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ছদ্মবেশ ধারনে দক্ষ ছিলেন। কিন্তু স্টেশনে থাকা এক ব্যাক্তি নেতাজীকে চিনতে পেরে গিয়েছিলেন৷ ওই ব্যাক্তিটি ছিলেন রেহমত খান ওরফে ভগত রাম তলোয়ার।

২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪১ কাবুলে ইটালিয়ান দূতাবাসের সামনে এক আফগান ব্যাক্তি এসে সেখানের নিরাপত্তা রক্ষীদের বলে খানসামার চাকরির জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে। ইটালির রাজদূত পিটার ক্রয়েরিনীর সাথে দেখা করার পর সেই আফগান যুবক তার আসল পরিচয় দিয়ে বলেন তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে কাবুলে নিরাপদে রাখার এবং জার্মানি পৌঁছানোর। এই আফগান যুবক সেজে থাকা ব্যক্তিটি হলেন রেহমত খান ওরফে ভগত রাম তলোয়ার। তাকে দেখে ইটালির রাজদূত পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ইটালির দূতাবাস একমাস পর্যন্ত কোন জবাব দেয়নি তবে তারা আগে থেকেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে চিনতেন। এই একমাস সুভাষচন্দ্র বোসকে লুকিয়ে রাখার সম্পূর্ন দায়িত্ব ছিল তারই উপর। একমাস পর ইটালির দূতাবাস সুভাষচন্দ্র বোসকে জার্মানি পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করেন। তবে কাবুল থেকে বেরোনো এত সহজ ছিলনা। কাবুলে সেসময় প্রচুর ব্রিটিশ গুপ্তচর ছিল। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের কালকাতা থেকে পালিয়ে আসার পর ব্রিটিশ সরকার সর্বোচ্চ ভাবে তাঁকে খুঁজছিল। কিন্ত এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ভগত রাম তলোয়ার এবং তিনি নিজে সুভাষচন্দ্র বোসের সাথে দুশো কিলোমিটার যান। সুভাষচন্দ্র বোস জার্মানিতে চলে যাওয়ার পর ভগত রাম তলোয়ার আবার ইটালির দূতাবাসে যান এবং তিনি ইটালির হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেন। ইটালির বন্ধু জার্মানির হয়েও তিনি গুপ্তচরের কাজ করেন তিনি। জার্মানি তাকে গুরুত্বপূর্ন মিলিটারি মেডেল আয়রন ক্রশ সম্মান দিয়েছিল এবং প্রায় দুই মিলিয়ন ইউরো দিয়েছিল। কিন্তু যখন অ্যাডলফ হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অপারেশন বারবারোসা শুরু করে তখন ভগত রাম তলোয়ার ইটালি ও জার্মানি হয়ে কাজ ছেড়ে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে কাজ করা শুরু করে। এরপর তিনি ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স বিভাগের হয়ে কাজ শুরু করেন৷

বিখ্যাত সিনেমা জেমস বন্ড সিরিজের জেমস বন্ড চরিত্রের নির্মাতা ইয়ান ফ্লেমিং এর ভাই পিটার ফ্লেমিং ভগত রাম তলোয়ারের প্রশংসক ছিলেন৷ পিটার ফ্লেমিং তাঁকে সিলভার কোড নামে ডাকতেন।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ভগত রাম তলোয়ার পুরো পরিবার সহ দিল্লী চলে আসেন। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় শ্রীপাদ ডাঙ্গের। যিনি ভগত রাম তলোয়ারের সাথে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর পরিচয় করান। জহরলাল নেহেরু ভগত রাম তলোয়ারের দক্ষতা ও অবদান সম্পর্কে জানতেন। তিনি ভগত রাম তলোয়ারকে কিছু জমি দেন থাকার জন্য। ১৯৮৩ সালে ৭৫ বছর বয়সী ভগত রাম তলোয়ারের মৃত্যু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধপৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জানিয়েছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর সবচেয়ে চিন্তার কারন ছিল জার্মানির ইউবোট। তিনি আরও জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন ব্রিটেনের যুদ্ধ হচ্ছিল তখন

‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’, (প্রথম পর্ব)‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’, (প্রথম পর্ব)

স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য জয় করে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে যে বক্তৃতাগুলি করেছিলেন, সেগুলোর অনেকটা জুড়েই সেই সময়ের যুবকদের উদ্দেশ্যে পরাধীন ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনে তৎপর হয়ে ওঠার দীপ্র আহ্বান

‘বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক মূল্য’‘বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক মূল্য’

রানা চক্রবর্তীঃ সব মহাকাব্যই ‘কাব্য’ কিন্তু সব কাব্য ‘মহাকাব্য’ নয়। মহাকাব্যের নিরিখ নানা সাহিত্যে নানা সংজ্ঞায় নিরূপিত হয়েছে। তবে, মোটের ওপর বিগত পাঁচ হাজার বছরের বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়