'রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন', (প্রথম পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’, (প্রথম পর্ব)

‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’, (প্রথম পর্ব)


স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য জয় করে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে যে বক্তৃতাগুলি করেছিলেন, সেগুলোর অনেকটা জুড়েই সেই সময়ের যুবকদের উদ্দেশ্যে পরাধীন ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনে তৎপর হয়ে ওঠার দীপ্র আহ্বান ছিল। এই প্রসঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্ট বক্তৃতাগুলি থেকে নির্বাচিত কয়েকটি অংশ তুলে ধরা যেতে পারে –
(১) “ভ্রাতৃবৃন্দ, আমাদের সকলকেই এখন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এখন ঘুমোবার সময় নয়। আমাদের কার্যকলাপের উপর ভারতের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। ঐ দেখ, ভারতমাতা ধীরে ধীরে নয়ন উন্মীলন করছেন। তিনি কিছু কাল নিদ্রিতা ছিলেন মাত্র। ওঠো, তাঁকে জাগাও – তাঁর নতুন জাগরণে, – নতুন প্রাণে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর গৌরবমণ্ডিতা করে ভক্তি ভাবে তাঁকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত কর।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃ- ২৭)
(২) “আগামী পঞ্চাশ বছর আমাদের গরীয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্যা দেবতা হোন। অন্যান্য অকেজো দেবতাদের এই কয়েক বছর ভুললে ক্ষতি নেই। অন্যান্য দেবতারা এখন ঘুমোচ্ছেন।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃ- ৩৫)
(৩) “মানুষ চাই, মানুষ চাই, আর সব হয়ে যাবে … বীর্যবান সম্পূর্ণ অকপট তেজস্বী যুবক আবশ্যক। এমন একশো যুবক হলে সমগ্র জগতের ভাবস্রোত ফিরিয়ে দেওয়া যায়। অন্য কিছু অপেক্ষা ইচ্ছাশক্তির প্রভাব অধিক … বিশুদ্ধ ইচ্ছাশক্তি অসীম … আত্মবিশ্বাসী হও, আমাদের এখন প্রয়োজন শক্তিসঞ্চয়। এখন তোমাদের স্নায়ু সতেজ কর। আমাদের এখন আবশ্যক লোহার মতো পেশী ও বজ্রের ন্যায় দৃঢ় স্নায়ু। আমরা অনেক দিন ধরে কেঁদেছি। এখন আর কাঁদার প্রয়োজন নেই, এখন নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ হও।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃ: ৮৭-৮৮)
(৪) “তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করছ – কোটি কোটি লোক অনাহারে মরছে? কোটি কোটি লোক শতাব্দী ধরে অর্ধাশনে কাটাচ্ছে? তোমরা প্রাণে প্রাণে কি বুঝছ অজ্ঞানের কৃষ্ণমেঘ সমগ্র ভারত গগন আচ্ছন্ন করেছে? তোমরা কি এই সকল ভেবে অস্থির হয়েছ? এই ভাবনাই তোমাদের নিদ্রা কি পরিত্যাগ করেছে? এই ভাবনা কি তোমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে তোমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়েছে? তোমাদের হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনের সঙ্গে কি এই ভাবনা মিশে গিয়েছে? এই ভাবনা কি তোমাদের পাগল করে তুলেছে? দেশের দুর্দশা কি তোমাদের ধ্যানের বিষয় হয়েছে?” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃ- ৮৯)
(৫) “সাহস অবলম্বন কর, ভয় পেয়ো না। আত্মবিশ্বাসী হও, অগ্নিময় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠ। কেবল আমাদের শাস্ত্রে ভগবানকে লক্ষ্য করে অভী – এই বিশেষণ প্রদত্ত হয়েছে। – আমাদের সকলকে অভী, নির্ভীক হতে হবে। তবেই আমরা কার্যে সিদ্ধি লাভ করবো। ওঠ, জাগো, কারণ তোমাদের মাতৃভূমি এই মহাবলি প্রার্থনা করছেন।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, পৃ- ১৬৬)
এর আগে আমেরিকা থেকে ১৮৯৩ সালের ১০ই আগস্ট তারিখে ‘আলাসিঙ্গা’ প্রমুখ যুবকদের উদ্দেশ্যে নিজের যন্ত্রণার উপলখণ্ডগুলি কুড়িয়ে একটিই চিঠিতে তিনি যা লিখেছিলেন, সেটার মধ্যেও স্বাধীনতার আহ্বান প্রতিফলিত হয়েছিল – “এস মানুষ হও। নিজেদের সংকীর্ণ মোহগর্ত থেকে বেরিয়ে এসে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তোমরা কি মানুষকে ভালোবাসো? তোমরা কি দেশকে ভালোবাসো? তা হলে এস, আমরা ভাল হবার জন্যে – উন্নত হবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করি। পেছনে চেওনা – অতি প্রিয় আত্মীয়-স্বজন কাঁদুক; পেছনে চেওনা। সামনে এগিয়ে যাও। ভারতমাতা বস্তুত সহস্ৰ যুবক বলি চান। মনে রেখো মানুষ চাই, পশু নয়। প্রভু তোমাদের এই বাঁধাধরা সভ্যতা ভাঙবার জন্য ইংরেজ গভর্ণমেন্টকে প্রেরণ করেছেন।” বিবেকানন্দের ওই অগ্নিবর্ষী আহ্বান পরাধীন ভারতবাসী বিশেষতঃ তখনকার যুবকদের মনে মুক্তির নির্যাস বয়ে নিয়ে এসেছিল। তাঁর সেই আহ্বানগুলির পেছনে দীর্ঘ ভারত প্রব্রজ্যায় লব্ধ পরাধীন ভারতবর্ষের রক্তারুণ ছবিটি আর পাশ্চাত্য পরিভ্রমণে আমেরিকা-ইউরোপের স্বাধীন দেশগুলির সার্বিক চিত্রটি ছিল। ওই সময়ে একদিকে ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন ভারতবর্ষের নুইয়ে পড়া, অন্যদিকে আমেরিকা-ইউরোপের স্বাধীন দেশগুলির উন্নতি বিবেকানন্দের রক্তে তুফান তুলে দিয়েছিল। তাই তিনি বিদেশ থেকে ভারতে ফিরে এসেই একদিকে যুবকদের যেমন সংগঠিত ভাবে দেশোদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনি অজ্ঞ-নিপীড়িত-কাতর-অসহায় ভারতবাসীর মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে দেওয়ার জন্য ‘আত্মনো মোক্ষর্থং জগদ্ধিতায় চ’ মন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র উদ্দেশ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নিজে রামকৃষ্ণ মিশনের নিয়মাবলী তৈরী করেছিলেন। তাঁর তৈরী সেই নিয়মাবলীর মধ্যেই রামকৃষ্ণ মিশনের লক্ষ্য ও কার্যাবলী স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ধর্ম-আধ্যাত্মিক ও জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানরূপেই রামকৃষ্ণ মিশনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল, এবং পরবর্তীকালে মিশন সেই লক্ষ্যেই পথ চলেছিল। এটা প্রথম থেকেই ঠিক হয়েছিল যে, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কখনোই রাজনীতির কোন যোগাযোগ থাকবে না। ত্যাগ ও মানবসেবাকে প্রাধান্য দিয়ে জগৎবাসীর মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক সচেতনতায় আত্মমুক্তির অভীপ্সা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে যুবকদের যোগ দেওয়ার বিষয়টি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রথম থেকেই রামকৃষ্ণ মিশন সেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এগিয়ে চললেও, আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই উক্ত প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির রোষে পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে এখানে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ‍ করলেই চলবে। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের উপরে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি শুরু হয়েছিল। যদিও সেই বিষয়টি তখন সকলের দৃষ্টিগোচর হতে সময় লেগেছিল। এই প্রসঙ্গে ১৮৯৮ সালের ২২শে মে তারিখে ‘নিবেদিতা’ তাঁর এক বান্ধবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “‘আজ সকালে সন্ন্যাসীদের একজন সতর্কবাণী শুনেছেন – পুলিশ গোয়েন্দা মারফৎ স্বামীজীর উপর নজর রাখছে। ব্যাপারটা সাধারণ ভাবে অবশ্য আমরা জানতাম, কিন্তু আজকের সংবাদটি একেবারে গায়ে আঁচ লাগার মতো। … সরকার নিশ্চই ক্ষেপে গেছে, অন্ততঃ স্বামীজীকে যদি সে কোনভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করে তাহলে তাই প্রমাণিত হবে। সরকারের ঐ কাজ মশালে আগুন ধরিয়ে দেবে, যা সারা দেশে আগুন ছড়াবে।” সেই সময়ে বিবেকানন্দের অসামান্য অপরিমেয় জনপ্রিয়তাকে লক্ষ্য করে ব্রিটিশ সরকার অবশ্য সেকাজ করে নি। তবে বিবেকানন্দের উদ্দেশ্যে বেলুড় মঠে গোয়েন্দা পুলিশ নিযুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার বিবেকানন্দের অগ্নিবাণীতে উদ্বোধিত যুবকদের বুকের মধ্যে স্তূপীকৃত বারুদে অগ্নি সংযোগ করবার কাজটি নিশ্চিতভাবে ত্বরান্বিত করেছিল। অন্ততঃ মিশনের পরবর্তী ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করে। পরবর্তীকালে মিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন কোন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য যখন সরকারী কর্তৃপক্ষ সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিলেন, তখন মিশনের সদস্যপদ লাভের যোগ্যতাগুলি আরেকবার যাচাই করে দেখবার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। ওই সময়ে মিশন কর্তৃপক্ষ রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তিকে মিশনের সদস্যরূপে গ্রহণ না করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই বিবেকানন্দের আহ্বানে একদল যুবক সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে দিয়েছিলেন। উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সেই যুবকদের অনেকেই পরবর্তীকালে দেশ ও মানবসেবার কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনে যোগও দিয়েছিলেন। তাই তাঁদের মধ্যে তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে কার সম্পর্ক রয়েছে আর কার সম্পর্ক নেই – সেসব জানা এবং অনুসন্ধান করাটা মিশন কর্তৃপক্ষের কখনোই সম্ভব ছিল না। তাই ওই সময়ে মিশন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, কেউ রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিতে চাইলে তাঁকে এই মর্মে ঘোষণা করতে হবে যে, কোন রাজনৈতিক বা অন্য কোন গোপন সংগঠনের সঙ্গে তাঁর কোন ধরণের যোগাযোগ নেই। সেই ঘোষণা পত্রের ইংরেজি বয়ানটি ছিল – “I also declare that I have no connection whatever with any political or any secret body.” (History of the Ramakrishna Math and Ramakrishna Mission, Swami Gambhirananda, P- 175) ১৯১১ সাল থেকে মিশনে সেই প্রথা চালু করা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলতঃ ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠাই রামকৃষ্ণ মিশনের রাজরোষের শিকার হয়ে ওঠবার পিছনের প্রধান কারণ ছিল। ১৮৯৪ সালে মহারাষ্ট্রের গণপতি উৎসব, কিংবা তৎকালীন বঙ্গদেশে কালী মন্দিরে গীতা হাতে নিয়ে বিপ্লবীদের দেশমাতৃকার নামে শপথ গ্রহণ – এ সবই এদেশে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধের ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাঁদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলতেন সেই সব উগ্রপন্থী বিপ্লবীদের মতাদর্শ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ‘অমলেশ ত্রিপাঠী’ তাঁর ‘The Extremist Challenge’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “This is the story on an idea at once religious and political.” (The Extremist Challenge, Amalesh Tripathi, P- 15) ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনীতিতে ধর্মের সেই অপরিসীম প্রভাব কিন্তু ইংরেজ সরকারের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাই ওই সময়ে এই দেশের সন্ন্যাসী সমাজের কোন কোন অংশের উপরে তাঁরা বরাবরই গোপনে নজর রেখেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, তাঁদের সেই গোপন প্রহরা থেকে রামকৃষ্ণ মিশনও তখন রেহাই পায় নি। আর না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কেননা রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বান ও বাণীর দ্বারাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন ধারায় পরিচালিত হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘রাজনারায়ণ বসু’ কর্তৃক ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’র (১৮৬০) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ধর্মকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে প্রথমবারের জন্য ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। ওই সভা সেই সময়ের বাঙালী তথা ভারতীয় (বিশেষতঃ হিন্দু) জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল। এরপরে ১৮৬৭ সালে ‘নবগোপাল মিত্র’ আয়োজিত ‘হিন্দু মেলা’ও বহুলাংশে ঐ একই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার চেষ্টা করেছিল। সেই সময়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মোহিনী-মায়াকে ছিন্ন করে সমসাময়িক বুদ্ধিজীবী ও জাতীয়তাবাদী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেব ঋত্বিকেরা পৌরাণিক কাহিনীকে অথবা ইতিহাসাশ্রিত কাহিনীকে আঁকড়ে ধরে পরাধীনতা মাঝে দেশাত্মবোধকে জাগ্রত করবার জন্য তীব্র ভাবে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়ে ভারতের পৌরাণিক যুগের কাহিনীগুলি ধর্মীয় আবহাওয়ায় নব মূল্যায়নে রচিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ প্রকাশিত হওয়ার পরে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ‍ই ওই সময়ের চরমপন্থী-উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকলের কাছে একজন আদর্শ পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় একই সময়ে ‘বালগঙ্গাধর তিলক’ মারাঠী ভাষায় ‘গীতাবহস্য’ রচনা করেছিলেন, ‘অরবিন্দ ঘোষ’ গীতার দীর্ঘ ভূমিকা লিখতে তৎপর হয়েছিলেন, এবং ‘লালা লাজপৎ রাই’কে উর্দু ভাষায় শ্রীকৃষ্ণের জীবনী প্রণয়ন করতে দেখা গিয়েছিল। ওই সময়েই ‘অশ্বিনীকুমার দত্ত’ ভাগবত ধর্মের মূল বিষয়বস্তু – ভক্তিযোগের ব্যাখ্যা লিখতে শুরু করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে যুক্তিবাদী ব্রাহ্ম রূপে সুখ্যাত ‘বিপিনচন্দ্ৰ পাল’, ‘বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী’ প্রচারিত ‘নব বৈষ্ণবীয় তত্ত্বে’ প্রভাবিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ‘ভারত-আত্মা’ রূপে বরণ করতেও দ্বিধা করেননি। এমন কি ক্যাথলিক ‘ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়’ পর্যন্ত ওই সময়ে ‘শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব’ লিখে ফেলেছিলেন। তখন অনেককে আবার নিকট ইতিহাসের শরণাপন্ন হতেও দেখা গিয়েছিল। ‘রমেশচন্দ্র দত্ত’ বিরচিত ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ (১৮৭৮) প্রকাশিত হওয়ার দু’ দশকের মধ্যেই ছত্রপতি শিবাজীর স্মৃতিচারণের অস্ফুট গুঞ্জন দেশব্যাপী শিবাজী উৎসব পালনের সমারোহে পরিণত হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে, বালগঙ্গাধর তিলক সে বিষয়ে অগ্রণী ছিলেন। এরপরে রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতায় (১৯০৪) সেই নব মূল্যায়ন পূর্ণতা পেয়েছিল। আসলে সমসাময়িক কালে ধর্মকে কেন্দ্র করেই ভারতের ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন নানা স্তরে দানা বেঁধে উঠেছিল। এখন এই কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতির অন্তলীন আধ্যাত্মিকতার পুনরুদ্ধার, এবং সেটার দ্বারা নবজাগ্রত ভারতবর্ষের জীবনকে সর্বক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করতেই তাঁরা উৎসাহী হয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে ওই সময়ের বিপ্লবীরা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস; বিবেকানন্দের উদাত্ত আহ্বান, সংশ্লিষ্ট বাণী ও রচনা; এবং ‘গীতা’ দ্বারা বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্লান্ত অবসানে বঙ্কিমচন্দ্রের দর্শন তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। যুগের প্রয়োজনে তিনি অদ্বৈতবাদের সঙ্গে কৃষ্ণতত্ত্বের একটা সমন্বয় সাধনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ঈশ্বরে সাকারত্ব আরোপের জন্য তিনি কখনোই ব্যস্ত হয়ে ওঠেননি। তবে ঈশ্বরের নিরাকারত্ব উপলব্ধির আগে তাঁর অবয়বী রূপ কল্পনা সাধনার পথকে সহজতর করে দেয় বলেই বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন। আবার, অবতারবাদের মধ্যে ঈশ্বরের নরদেহ ধারণের চেয়ে মানুষের দিব্যত্ব অর্জনের ইঙ্গিতই তিনি দেখিয়েছিলেন। এই সমগ্র জীবলোকের আদর্শ হিসেবেই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে চিত্রিত করে, কৃষ্ণ চরিত্রের ঐতিহাসিকত্ব প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন যে, শুধু ফরাসী নয়, হিন্দু চিন্তাধারার প্রচ্ছায়াতেও মানব সমাজের অন্তহীন প্রগতির সম্ভাবনাও রয়েছে। পাশ্চাত্যের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বঙ্কিমচন্দ্র আহরিত ওই অস্ত্রগুলি সেই সময়ে এদেশের ইংরেজ ঘেঁষা, অবিশ্বাসী এবং অজ্ঞেয়বাদীদের সমস্ত প্রতিরোধকে চূর্ণ করে দিয়েছিল। আবার তাঁর দ্বারা হিন্দু ধর্মতত্ত্বের যুক্তিসিদ্ধ, সর্বজনগ্রাহ্য এবং মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিচার তৎকালীন মৌলবাদীদেরও নীরব করে দিয়েছিল। ‘বেন্থাম’ প্রচারিত ‘বহুজন হিতের’ আদর্শ থেকে হিন্দু সাধনার লক্ষ্য (পরভূতহিত) যে মহত্তর, এবং ব্যাপকতর – সেই সময়ে সেটা সকলের কাছে সুনিশ্চিত ভাবে প্রতিভাত হলেও, বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু কখনোই অতীত মূল্যবোধে আবিষ্ট হয়ে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি বিরূপ হননি। মুক্তি অর্জনে সহায়ক বলে প্রতিটি ভারতবাসীরই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়া উচিত বলে তিনি যেমন মনে করতেন, তেমনি আবার পশ্চিমের বস্তুসর্বস্বতার সংযত সমালোচনা করতেও তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ‘অমলেশ ত্রিপাঠী’র অভিমতটি এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি লিখেছিলেন, “প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রই সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ দৃঢ় সেতু-মুখের স্থপতি ছিলেন, যার মধ্যে দিয়ে বিবেকানন্দ প্রতীচ্যের প্রবল শক্তির প্রাণকেন্দ্র আমেরিকায় অভিযান চালিয়েছিলেন। আর এদেশে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সংঘাতে দিশেহারা বিদেশী শাসনের ভারে নিষ্পিষ্ট, অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভ্রান্ত লক্ষ লক্ষ ‘ক্লৈবগ্রস্ত অর্জুন’ তাঁর বাণীতে উদ্বোধিত হয়েছিল।” (ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, অমলেশ ত্রিপাঠী, পৃ- ২৭) বিবেকানন্দের বাণী নরমপন্থীদের (কংগ্রেস) নীতি ও কর্মপন্থার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করে চরমপন্থী সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনুসৃতব্য পথকে আলোকিত করে দিয়েছিল। তাই স্বাভাবিক কারণে তিনিই সেই সময়ের সশস্ত্র তরুণ বিপ্লবীদের অগ্রদূত হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা নরমপন্থীদের সকরুণ আবেদন-নিবেদন-বিবৃতিদানের কর্মসূচীর উপরে রীতিমত বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। ওই সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রস্তাব ও নিষ্ফলা বার্ষিক অধিবেশনগুলি তাঁদের কাছে প্রহসন হয়ে উঠেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী পড়ে সমকালীন তরুণ বিপ্লবীরা এই শিক্ষালাভ করেছিলেন যে, জাতির ভবিষ্যৎ কোন মতেই ঐ ‘অ-জাতীয় কংগ্রেস’ অথবা ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের’ উপরে নির্ভরশীল হতে পারে না। নিজের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থে তিনি কমলাকান্তের মুখ দিয়ে অক্ষম উপরোধের হীন-সারমেয়-নীতি ছেড়ে দিয়ে চরমপন্থীদের বৃষ-তুল্য বিক্রম প্রকাশের উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের সামনে সেই সময়ের দেশমাতৃকার যে চিত্রটি তুলে ধরেছিলেন, তাতে মায়ের দ্বিসপ্ত কোটিভূজে ভিক্ষা-ভাণ্ড নয়, খর তলোয়ার ধৃত ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁদের হৃদয়ে বঙ্গজননীর প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, তাঁর অসামান্য মহিমার প্রতি বিশুদ্ধ ভক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন, তিনিই তাঁদের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। উক্ত সময়ে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রভাবও অপরিসীম ছিল। ‘আনন্দমঠের’ – ‘মা যা হইয়াছেন’ – সেই কৃষ্ণবর্ণা, করালবদনা নগ্নিকা কালীমূর্তি বিপ্লবী অরবিন্দের কাছে বহু শতাব্দীর শোষণ নিপীড়নের প্রতীক বলে প্রতিভাত হয়েছিলেন। আর সন্তানদলের সন্তানদের উদ্দেশ্যে সত্যানন্দের উদাত্ত আহ্বানের মধ্যে দিয়ে তিনি আসুরিক ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের রণোন্মাদনা জাগাবার ডাকই শুনেছিলেন। অসুর বিনাশিনী, যশ, জ্ঞান, শক্তি, সৌভাগ্য ও সাফল্যের প্রতীক দেবী দুর্গার সঙ্গে অরবিন্দের স্বপ্নের দেশমাতার মূর্তি অভিন্ন হয়ে উঠেছিল। তবে সেটা বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলিত জাতীয়তাবাদ ছিল না, সেটা ছিল আইরিশ ও রূশ পপ্যুলিস্ট আদর্শে গড়া পৌরাণিক হিন্দুর অসহিষ্ণু, একমুখী, চরম জাতি বৈর-প্রণোদিত দেশপ্রেম। অরবিন্দ ‘মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত’ নতুন ‘সন্তান দল’ তৈরী করতে চেয়েছিলেন। সেই সূত্রেই তিনি ভবানী মন্দিরের পরিকল্পনা করেছিলেন। দেশপ্রেম তাঁর কাছে ধর্মেরই বিকল্প হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখতে পাওয়া যায় যে, বঙ্কিমের ‘ভারত কলঙ্ক’, এবং ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা’ প্রবন্ধ দুটি অনেকাংশেই অরবিন্দ সহ তাঁর সতীর্থ বিপ্লবীদের উদ্বোধিত করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে, বিশেষতঃ সেই সময়ের চরমপন্থী বিপ্লবীদের উপরে ধর্মীয় প্রভাব নিরীক্ষণ করতে গেলে ‘দয়ানন্দ সরস্বতী’র কথা অবশ্য উল্লেখ্য। রামমোহন রায়ের সকল কর্ম-প্রেরণার উৎস উপনিষদ হলেও, যুক্তিবাদকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে তিনি কখনোই কার্পণ্য করেননি; অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র গীতাকে চিন্ময় জগতের পথপ্রদর্শক বলে মনে করলেও আত্মশুদ্ধির সহায়করূপে সনাতন ঐতিহ্যকে অবহেলা করতে রাজী ছিলেন না। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদকে অধ্যাত্ম জীবনের মুখ্য প্রেরণা রূপে গ্রহণ করলেও দ্বৈত ও অদ্বৈতের সমন্বয় সাধন করে শ্রীরামকৃষ্ণ যেভাবে বক্ষোপলব্ধির একটা সহজ উপায় নির্ধারণ করেছিলেন, বিবেকানন্দ সেটাকেই বাস্তবে প্রয়োগ করেছিলেন; কিন্তু ঊনবিংশ শতকের শেষ উল্লেখযোগ্য ধর্মচিন্তাবিদ দয়ানন্দ সরস্বতীর কাছে – ‘ঈশ্বরোক্ত’ ও ‘নিত্য’ বেদই সকল কর্মের প্রেরণা ছিল। তাঁর রচনা ও চিন্তাধারায় অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্র, এবং বেদোত্তর যুগের বিশিষ্ট ধর্মাত্মাদের উল্লেখ পাওয়া গেলেও, একমাত্র অপৌরুষেয় বেদই তাঁর কাছে প্রকৃত জ্ঞানের, এমনকি বিজ্ঞানের আধার ছিল। দয়ানন্দ মুক্তির যে পথ নির্দেশ করেছিলেন, তাতে আধ্যাত্মিকতার থেকে নৈতিকতার উপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরহিত সাধন, সুবিচার, সুনির্দিষ্ট সংযমী জীবন যাপন ইত্যাদি ধর্মানুশীলনের অঙ্গ, এবং সেগুলি একই সঙ্গে আত্মশক্তি বৃদ্ধির সহায়ক ও ইন্দ্রিয়াসক্তির প্রতিষেধক। সেই সময়ে বিবাহ, খাদ্যাখাদ্য বিচার, পোশাক-আশাক সম্পর্কিত নীতি এবং জাতিভেদ প্রথাকে ঘিরে যে সমস্ত অযৌক্তিক ও অমানবিক সংস্কার হিন্দু সমাজে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল, দয়ানন্দ সেই সমস্ত কিছুকেই ঘৃণা করতেন। তবে জাতিভেদ প্রথাকে নিন্দা করলেও তিনি বর্ণবিদ্বেষী ছিলেন না; কেন না ওই প্রথাটি বেদ-সমর্থিত, এবং সেটার মধ্যে দিয়ে বৈদিক যুগের ভারতের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রতিফলিত হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। নারী জাতি সম্পর্কে, বিশেষ করে তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা, বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের অন্যান্য সমাজ সংস্কারকদের সঙ্গে দয়ানন্দের বিশেষ কোন মতপার্থক্য ছিল না। তবে সে সমস্ত ক্ষেত্রেও তাঁর মতবাদের উপরে বেদের প্রভাবই একক ছিল। সেজন্য তিনি কখনো খ্রীষ্টান আচরণ বা যুক্তিবাদের দ্বারস্থ হননি। ভারতের জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা চিন্তা করেই দয়ানন্দ নিরামিষ আহারের পক্ষপাতী ছিলেন, জ্ঞানার্জন অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে বিদেশে যাওয়া-আসাতেও তাঁর কোন আপত্তি ছিল না। তবে জীবনের একটা সময় পর্যন্ত স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্রহ্মচর্য পালনকে তিনি আবশ্যিক বলে মনে করেছিলেন, এবং তপোবন সুলভ পরিবেশে বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়নের উপরে সমমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। পুরোহিত-তন্ত্র, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কখনোই তাঁর কাছে স্বীকৃতি পায়নি। বেদে যেটার সমর্থন নেই, এমন ধরণের কোন আচার-অনুষ্ঠানকে তিনি আজীবন নিন্দা করে গিয়েছিলেন। তাই বলিষ্ঠ, প্রাণবন্ত এবং আক্রমণোদ্যত আর্যধর্মের পুনুরুজ্জীবনের প্রয়াসে তাঁকে বিবেকানন্দের অগ্রদূত বলে বিবেচনা করাটা খুব একটা অযৌক্তিক হবে না বলেই মনে হয়। অন্ততঃ অরবিন্দ তো সেটাই মনে করতেন। দয়ানন্দের ব্যক্তিগত চরিত্র, তাঁর আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির প্রতি চিরকালই অরবিন্দের বিশেষ শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই কারণে দয়ানন্দ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “ব্রোঞ্জের উপরে খোদাই কাজের মতোই সমকালীন মানুষের মন ও সমাজের উপরে তাঁর গভীর প্রভাব অঙ্কিত হয়েছিল। ঈশ্বরের কর্মশালায় নিযুক্ত অক্লান্ত, অমিতশক্তির এই মানুষটির কথা মনে পড়লে আমার চোখের সামনে অজস্র সংগ্রাম, কর্ম-সাফল্য ও শ্রমার্জিত জয়ের ছবি ভেসে আসে।” (ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, অমলেশ ত্রিপাঠী, পৃ- ৪৭) গ্রীক ধ্রুপদী ভাবধারায় মগ্ন ঈশ্বরের রাজ্যের সেই সৈনিকের মধ্যেই অরবিন্দ হোমারের নায়কের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। আর ভারতীয় জাতীয় চরিত্রের মধ্যে সুপ্রাচীন আর্য সংস্কৃতির বহু মূল্যবান বৈশিষ্ট্য যে তাঁর জন্যই সংযোজিত হয়েছিল – অরবিন্দ সে কথাও সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছিলেন। অব্যবস্থিতচিত্ততা ও সুবিধাবাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে থেকে দয়ানন্দ কখনোই আপোষহীন সংগ্রামের ভান করেননি। তিনি ভারতীয় মানসিকতাকে অস্পষ্টতা ও উদ্দেশ্যহীনতার ব্যাধি থেকে মুক্ত করতে স্থির-প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বহু শতাব্দী ধরেই বেদ ভারতীয় জীবনের একটা গ্র্যানাইট পাথরে গড়া ভিত্তি হয়ে থাকলে দয়ানন্দের ব্যক্তিত্ব যেন সেটার উপরে শিরা-উপশিরা ছিল। মনে হয় অতীতকে তিনি তার উৎস-মুখের নির্মলতায় ও বোধনের পুণ্যলগ্নে আত্মস্থ করেছিলেন। তাই দয়ানন্দ যে অতীতকে পুনরুজ্জীবিত করবার সাধনা করেছিলেন, সেটা একই সঙ্গে চিরন্তন এবং রূপান্তরক্ষম ছিল। বেদের যে মন্ত্রটি তিনি তাঁর কালের মানুষের কাছে মহামূল্যবান একটি উত্তরাধিকার রূপে রেখে গিয়েছেন, তাতে এই প্রার্থনাই ধ্বনিত হয়েছে, “সত্য পরিব্যাপ্ত হোক সমস্ত আত্মার মধ্যে, দৃষ্টি হোক সত্যের অঞ্জন-লিপ্ত, সত্যই হোক সকল বাসনার উৎস, সত্য বিকিরিত হোক সকল কর্মের মধ্যে।” (Dayananda the Man and his works, Sri Aurobindo, Vedic Mission, P- 915) এই দেশের বহুবিচিত্র সংস্কৃতি, বিভিন্ন আদর্শ এবং বহুবিধ উদ্দেশ্যের সংঘাতের মধ্যেও অরবিন্দের অক্লান্ত আকূল অন্বেষণটি – বিশুদ্ধ শক্তি, স্বচ্ছ দৃষ্টি, অভ্রান্ত কর্মকুশলতা এবং ভয়হীন ঐকান্তিকতার জন্য ছিল; আর সেই সমস্ত কিছুর সন্ধান তিনি দয়ানন্দের মধ্যে পেয়েছিলেন। বিপ্লবী অরবিন্দ তাঁর কল্পনায় দয়ানন্দের মধ্যে চরমপন্থীদের আদর্শকে প্রতিফলিত হতে দেখেছিলেন, আর সেই কারণেই এই ভাবমূর্তির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসামান্য হয়ে উঠেছে। আলিপুর বোমার মামলার বিচারকালে বিচারপতি ‘জেনকিন্স’ (Sir Lawrence Jenkins) মন্তব্য করেছিলেন যে, ওই ষড়যন্ত্রের অভিযুক্ত আসামীরা প্রায় সকলেই শিক্ষিত ও ধর্মভাবাপন্ন মানুষ ছিলেন। (Militant Nationalist in India, Biman Behari Majumdar, P- 116) জেনকিন্সের কথা থেকে ভারতের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের প্রতি বিপ্লবীদের আস্থা ও মনোভাবের বিষয়টি বুঝতে পারা যায়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী উগ্র মতাবলম্বী রাজনৈতিক দলের উগ্র সমর্থক বালগঙ্গাধর তিলক একদা মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারতীয় সমাজের একটি মাত্র মনোভাব যা সাধারণভাবে সকলের মধ্যে উপস্থিত, সেটা হল ধর্মকেন্দ্রিক মনোভাব। আর সেই ধর্ম হিন্দুধর্মকেই আশ্রয় করেই এগিয়ে গিয়েছিল। উক্ত সময়ে মুসলমান বা খ্রীষ্টান দ্বারা অংশত অধ্যুষিত হলেও ভারতের গরিষ্ঠ জনসাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীই ছিলেন,এবং এই ধর্মের ভিত্তিতেই ওই সময়ের ভারতে ঐক্য তথা জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠেছিল। (Tilak & Gokhale, A. Stanley Wolpert, P: 201-202) বস্তুতঃ, পরাধীন ভারতবর্ষে জাতীয়তাবোধের উন্মেষে ধর্মই যে বিপুল পরিমাণে প্রেরণা জুগিয়েছিল, সেটা ব্রিটিশরাও তখন এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। (Indian Nationalism and Hindu Social Reform, Vol. II, Charles Heilsath, P: 131-146) এই প্রসঙ্গে মানিকতলা বোমা মামলায় বিচারালয়ে নির্দোষ প্রতিপন্ন হওয়ার পরে অরবিন্দ তাঁর উত্তরপাড়া ভাষণে যা বলেছিলেন সেটা বিশেষ ভাবে স্মরণীয় – “একদা বিশেষ প্রত্যয় সহকারে আমি একথা বলেছিলাম যে, এই আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এ হল একটি ধর্ম, ধর্মমত বা বিশ্বাস। আজ সেই একই কথা আমি আর এক ভাবে বলতে চাই। জাতীয়তাবাদ যে একটি ধর্ম, ধর্মমত বা বিশ্বাস; সে কথার পুনরুক্তি না করে আমি বরং এখন বলতে চাই যে, এ হল সেই সনাতন ধর্ম যা আমাদের চোখে জাতীয়তাবাদের সামিল।” (Uttarpara Speech, 4th edition, Aurobindo Ghosh, 1943, P- 20) ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ তথা জাতীয় আন্দোলনের সূচনায় ধর্ম ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ব্রিটিশ শাসকের নজরও এড়িয়ে যায়নি। তাই সেই কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশনকেও তাঁরা কখনো নিজেদের দৃষ্টির আড়ালে রাখেন নি। তৎকালীন রাজশক্তির দৃষ্টিকোণে বিচার করলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সেই সন্দেহ স্বাভাবিক কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে হতে পারে। ওই সময়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশের এই মর্মে নির্দেশ ছিল যে, যেহেতু ইংরেজ আমলের গোড়া থেকে বঙ্গদেশের সর্বত্র এক শ্রেণীর সন্ন্যাসীদলের আবির্ভাব ঘটেছে, এবং যেহেতু সেইসব সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশবিরোধী কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেহেতু স্থানীয় পুলিশ কর্তারা যেন সেই বিষয়ে তাঁদের কাছে একাধিক রিপোর্টে পেশ করেন। (State Committee for Compilation of History of Freedom Movement in India: Bengal Region, paper No. 49, Bundle No. 15, Political activities of the Sadhus up to 1909) বলাই বাহুল্য যে, বাংলার সন্ন্যাসীকুল সম্পর্কে সন্দেহের সেই সার্বিক পরিবেশের মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনকেও একটি অবাঞ্ছিত প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
ইতিহাসের নিরিখে সমসাময়িক কালের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, বিবেকানন্দের মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যেই, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বিবেকানন্দের আহ্বানে উদ্বুদ্ধ যুবকেরা সহিংস ও অহিংস – দু’ পথেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের অব্যবহিত পূর্বকালে সংশ্লিষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী যুবকেরা বিবেকানন্দের অবর্তমানে তখন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কেন্দ্র বেলুড় মঠ, এবং সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত মিশনের অন্যান্য শাখাকেন্দ্রেও প্রায়শঃই যাতায়াত করতেন। এরপরে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠেছিল, বিপ্লবী যুবকেরা যখন দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত মন্ত্রে অভিসিক্ত হয়ে ব্যাপকতর ভাবে তাঁদের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন, তখন থেকেই ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী রামকৃষ্ণ মিশনের নানা কর্মকাণ্ড ও অন্যান্য শাখাকেন্দ্রের খোঁজ খবর নিতে শুরু করে দিয়েছিল। বস্তুতঃ, ওই সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের বহির্ভারতীয় কেন্দ্রগুলিও পুলিশের সতর্ক নজরকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। তখন সেই সব কেন্দ্রের সন্ন্যাসীরা ও ভক্তবৃন্দ কোথায় কি করছেন, কিভাবে প্রচার চালাচ্ছেন, কিংবা ত্রাণকার্যের সুযোগ নিয়ে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে সন্দেহজনক অন্য কোন কাজকর্ম শুরু করেছেন কিনা – সে সব ব্যাপারের দিয়েও পুলিশ খুব মনোযোগ দিয়ে নজর রেখেছিল। এমনকি তখন রামকৃষ্ণ মিশনের নানা কেন্দ্রে ও আশ্রমগুলিতে প্রধানতঃ কোন শ্রেণীর মানুষেরা যাতায়াত করতেন, সেই সমস্ত বিষয়েও খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ পুলিশের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বিভিন্ন সময়ে মিশন ও শহরতলীর আশ্রমগুলি সম্পর্কে নানা অভিযোগ এসেছিলেন। তখন রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে পুলিশ এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের সব অভিযোগগুলিকে কেবলমাত্র একান্তভাবে গোপন রিপোর্টের মাধ্যমে প্রকাশ করা হত। উক্ত সময়ের উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার ‘এফ. সি ড্যালি’ (F. C. Dally), ‘হাচিনসন’ (Hutchinson), ‘চার্লস টেগার্ট’ (C.A. Tegart), বা বিচারপতি ‘রাউলাট’ (S.A.T. Rowlett) প্রমুখেরা বিভিন্ন সময়ে রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে নিজেদের যেসব মন্তব্য পেশ করেছিলেন, সেগুলি সম্বন্ধে তৎকালীন উচ্চ মহলের স্বল্প সংখ্যক মানুষেরাই জানতে পেরেছিলেন। কালানুক্রমিক বিচারে তৎকালীন রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল এফ.সি. ড্যালির ১৯১১ সালের ৭ই অগাস্ট তারিখের রিপোর্ট, তার আগে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন থানায় লিপিবদ্ধ রিপোর্ট, ১৯১৪ সালে চার্লস অগস্টাস টেগার্টের দীর্ঘ রিপোর্ট (যা অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ ছিল), ১৯১৬ সালের ১১ই ডিসেম্বর টেগার্টের রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে লর্ড কারমাইকেলের দরবাবী ভাষণ এই প্রঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে ১৯১৭ সালের ১লা জানুয়ারী তারিখে লেজিসলেটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসিয়েট সেক্রেটারি ‘সি. টিন্ডেলের’ গোপন নোট, ঐ একই বছরের ২রা ফেব্রুয়ারী তারিখে অনারেবল মেম্বার ‘পি. সি. লায়নের’ কাছে বঙ্গদেশের চিফ সেক্রেটারী ‘এইচ.এল. স্টিফেনসন’ কর্তৃক প্রেরিত নোট, আর সেই নোটেরই সূত্রে ওই বছরের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী তারিখে লর্ড কারমাইকেলের কাছে প্রেরিত নোটও আলোচ্য প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেগুলিই রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের প্রকাশ্য ‘রাজরোষ’-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শেষোক্ত নোট দুটি লর্ড কারমাইকেলের রামকৃষ্ণ মিশনকে সরাসরি অভিযুক্ত করবার পরিপ্রেক্ষিতে ‘স্বামী সারদানন্দ’ কর্তৃক লিখিত প্রতিবাদ পত্রের সূত্রে প্রামাণিক তথ্য উপস্থাপনের বিস্তৃত প্রয়াস ছিল। তবে ব্রিটিশ কতৃপক্ষের সেই প্রয়াস ১৯১৭ সালেই থেমে যায়নি। কারণ, তারপরেই ১৯১৮ সালের সিডিসন কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচারপতি রাউলাট তৎকালীন বঙ্গদেশের বিপ্লবীদের উপরে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রভাবের কথা জোরের সঙ্গেই উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁদের সেই উল্লেখ আরো বেশী বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল। ১৯১৬ সালের ১১ই ডিসেম্বর তারিখে লর্ড কারমাইকেলের দরবারী বক্তৃতায় রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ আনা হলেও, সেদিন যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গেই মিশনের নামটি উচ্চারণ করা হয়েছিল। আসলে রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজশক্তির যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, যেহেতু আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠার দুটি দশকের মধ্যেই রামকৃষ্ণ মিশন বঙ্গদেশ তথা গোটা ভারতবর্ষে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, সেহেতু ব্রিটিশ রাজশক্তি মিশনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেশ না করে কোন ধরণের বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করতে ভরসা পায়নি। তাই ওই সময়ে তাঁরা মিশনের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে গোপনে কড়া দৃষ্টি রাখলেও প্রকাশ্যে কিন্তু মিশনের সেবাকার্যের প্রশংসা করে গিয়েছিলেন। সেই কারণে, লর্ড কারমাইকেলের দরবারী বক্তৃতাতেও মিশনের সেবাকার্যের উল্লেখ ছিল। তবে সেসব যে আসলে ব্রিটিশ সরকারের ব্যাজস্তুতি ছিল, সেটা রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ নিজেরাও জানতেন। তাই তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে, ব্রিটিশ শাসকেরা মুখে যাই বলুন কেন, তাঁদের অন্তরে আসলে মিশনের সম্পর্কে সন্দেহ-মানসিকতা শিকড় গেড়েছে। তাই তৎকালীন সরকারী কর্তৃপক্ষের মন থেকে সেই সন্দেহ মোচন করবার ব্যাপারে তাঁরা নিজেরাও কম সচেষ্ট হননি। পুরানো নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের যুগেই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি পুলিশের সন্দেহ সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু তার অনেক আগেই রাজনীতি সম্পর্কে রামকৃষ্ণ মিশনের অভিমত সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার পরে স্বয়ং বিবেকানন্দ মিশনের জন্য যে নিয়ম নীতিগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, সেখানে রাজনীতির সঙ্গে মিশনের সংযোগহীনতা উচ্চকিত হয়ে উঠেছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের ট্রাস্টীবোর্ড বা অছি পরিষদ গঠনের পরে সেই বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেটা সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে বিশেষ ভাবে উল্লেখিত হয়েছিল। তখন যাঁরা মিশন নিদের্শিত সন্ন্যাস ও ত্যাগব্রতের আদর্শ নিয়েছিলেন তাঁদেরকে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও জীবন গঠনের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছিল, “We find people seeking to utilise the monastic spirit as a mean to some material collective end, … the Swami pointed out that from the earliest ages renunciation has formed. The central ideal, the pivot, on which the India Scheme of life has been made to revolve and that no material or political end can ever supply the organising motive of in the collective life of India.” (History of the Ramakrishna Math and Ramakrishna Mission, Swami Gambhirananda, P- 178) অর্থাৎ, তৎকালীন মিশন কর্তৃপক্ষ মনে করতেন যে, ইউরোপীয় অনুকরণে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও জীবনচর্চা রচনা করা সম্ভব নয়। ভারতের মত দেশে বামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের ত্যাগের আদর্শেই গোষ্ঠী-জীবন গড়ে তুলতে হবে। কোন রকমের জাগতিক, অর্থাৎ, সাময়িক রাজনৈতিক স্বার্থের উদ্দেশ্যে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করবার প্রচেষ্টা একেবারেই নিরর্থক। একমাত্র ধর্মের প্রেরণাই নিখিল ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের মধ্যে মহান ঐক্যের যোগসূত্র রচনা করতে পারে। ত্যাগব্রতের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ দেশের প্রতিটি নাগরিক ও যুবকদের কাছে মিশন কর্তৃপক্ষ তাই প্রার্থিত উচ্চাশা, ভোগ এবং প্রলোভন অথবা রাজনীতির সংকীর্ণ মাদকতাকে উপেক্ষা করে দেশের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করবার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “To such young men shielded by true renunciation from all the seductions of worldly ambition and enjoyment and the alterments of a narrow, exotic political idea for their country, the Ramakrishna Mission sends forth its appeal, for the harvest indeed it full and we watch day to day, for the coming of the reapers.” (History of the Ramakrishna Math and Ramakrishna Mission, Swami Gambhirananda, P- 179) তৎকালীন রাজনীতিকে পরিহার কবে চলবার জন্য এর থেকে অধিকতর সুস্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ অঙ্গীকারবোধ হয়তো মিশনের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। কিন্তু তবুও সেই সময়ের রাজরোষ থেকে রামকৃষ্ণ মিশন মুক্তি পায়নি।
ওই সময়ে বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রান্তে রামকৃষ্ণের নামে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আশ্রমগুলির সঙ্গে বিপ্লবীবাদীদের গোপন যোগাযোগ জানাজানি হয়ে গেলে মিশনের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ‘স্বামী সারদানন্দ’ পুলিশের চাপে পড়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ওই তথাকথিত আশ্রমগুলির সঙ্গে মিশনের কোন ধরণের সম্পর্ক নেই। পরবর্তী কালেও বিভিন্ন তরফ থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংযোগ অস্বীকার করা হয়েছিল। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ‘বিমানবিহারী মজুমদারের’ মতে স্বয়ং বিবেকানন্দও পারতপক্ষে রাজনৈতিক বিষয়ে কোন ধরণের মতামত দেওয়াকে এড়িয়ে চলতেন। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ কুশাসনের বিষয়ে কোন প্রত্যক্ষ মতামত প্রকাশ করে তিনি নিজেকে কখনোই কোন ধরণের বিতর্কে জড়াতে চাননি। কেন না তিনি সেটা করলে তাঁর জীবনের আসল উদ্দেশ্য ও কর্মটি ব্যাহত হত। (Militant Nationalism in India, Biman Behari Majumder, P- 57) এই প্রসঙ্গে বলা চলে যে, বিবেকানন্দ যে কথাগুলি ইতঃস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে নিজের মৃত্যুর আগে প্রকাশ করেছিলেন, কিংবা ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে পরাধীন ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য যুবকদের কাছে যে অগ্নিময় আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেসবেরই প্রভাবে বিপ্লবী যুবকেরা সশস্ত্রভাবে এবং হিংস্র পথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আর গান্ধীজী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রগাঢ় ভাবে ভারতবর্ষকে ভালোবাসার সূত্রে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্রও বিবেকানন্দের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তাঁর সামগ্রিক কর্মের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তাই এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, বিবেকানন্দ একই সঙ্গে ‘Active’ এবং ‘Passive’ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি তরুণ বিপ্লবীদের আকর্ষণ যেমন বেড়েছিল, তেমনি রামকৃষ্ণ মিশনের উপরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশের নিরীক্ষণও বেড়েছিল। ওই সময়ে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বেদান্ত সোসাইটি ও রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন শাখাগুলি সরাসরি রাজনৈতিক প্রচারে অংশ না নিলেও তাদেরকে কেন্দ্র করেই ‘ইন্দো-আমেরিকান ক্লাব’ ও ‘ইন্দো-আমেরিকান সোসাইটি’ গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশরাজ সেগুলিকে ভালো চোখে দেখেনি। রামকৃষ্ণ মিশন এবং বেদান্ত সোসাইটির সঙ্গে ওই সব সন্থাগুলির বরাবরই যোগাযোগ ছিল। অন্ততঃ সেই সময়ে অনেকেই এমন ছিলেন, যাঁরা একই সময়ে বিপ্লবীসংস্থা এবং একযোগে বেদান্ত সোসাইটির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পোর্টল্যাণ্ডের জনৈক এ্যাটর্নি ‘গালওয়ানি’র (G. W. Galwoni) নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। কলকাতা পুলিশের হাতে ‘যামিনী মজুমদার’ নামের একজন গ্রেপ্তার হওয়ার পরে স্বীকার করেছিলেন যে, রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা আমেরিকা থেকে ভারতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতেন। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে সে বিষয়ে প্রমাণ সহ কিছু যাচাই করবার সুযোগ কখনোই ঘটেনি। আমেরিকায় বেদান্ত সোসাইটি তথা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যে রাজদ্রোহমূলক যোগাযোগ ছিল, সে বিষয়ে ব্রিটিশ পুলিশ ববাবরই সন্দেহ করে গিয়েছিল। বিবেকানন্দের ছোটভাই ‘ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত’ ১৯০৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে কিছুকাল ধরে প্রথমে বেলুড় মঠে আত্মগোপন করেছিলেন, তারপরে তিনি আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন। বিবেকানন্দের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক থাকবার জন্য তিনি তৎকালীন বঙ্গদেশের সাধারণ মানুষ, এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের কাছে বিশেষ আদরের মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটির সম্পাদক ‘স্বামী বোধানন্দের’ প্রতি পুলিশের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, তিনি বেদান্ত সোসাইটির আড়ালে ভারতবর্ষের বিপ্লবী আন্দোলনকে সাহায্য করে চলেছেন। ওই সময়ে আমেরিকার অন্যান্য কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘স্বামী অভেদানন্দ’ও বিপ্লবীদের ওপরে সহানুভূতিশীল ছিলেন। আমেরিকায় অবস্থান কালে তিনি যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেগুলি পরবর্তীকালে ‘India and her people’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। পুলিশের ভাষায় তাঁর সেই বক্তৃতাগুলির অধিকাংশই রাজদ্বেষে পূর্ণ ছিল, এবং সেই কারণে তৎকালীন বোম্বাই সরকার ওই বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ১৯০৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখে আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে স্বামী অভেদানন্দ যেদিন কলকাতায় উপস্থিত হয়েছিলেন, সেদিন তাঁকে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল। সেদিন ওই উপলক্ষে হাওড়া স্টেশনে যে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, রাজরোষে পড়বার আশঙ্কায় তাতে কোন সরকারী কর্মচারী যোগদান করেন নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও টাকীর স্বনামধন্য ‘যতীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী’, ‘বসুমতী’ পত্রিকার সম্পাদক ‘জলধব সেন’, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার সম্পাদক ‘নরেন্দ্র সেন’ সেখানে উপস্থিত থেকে স্বামী অভেদানন্দকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এরপরে ঐ উপলক্ষ্যে ১২ই সেপ্টেম্বর তারিখে কলকাতার টাউন হলে আরেকটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সভায় কাথিয়াবাড় নিবাসী এবং সদ্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রত্যাগত গান্ধীজীর প্রতিনিধি ‘মদনজিৎ’ নামের একজন জনৈক স্বাধীনতা সংগ্রামী উপস্থিত ছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতো রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সারদানন্দের ভাই ‘নরেশচন্দ্র চক্রবর্তী’ও একই ভাবে আমেরিকায় গিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। পরে নরেশচন্দ্র এবং তাঁর বন্ধু ‘সুরেন্দ্রমোহন বসু’ ভারতে বিপ্লব আন্দোলন সংগঠিত কারবার কাজে সুদূর প্রাচ্যে ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁরা আমেরিকার ‘হিন্দুস্থান এসোসিয়েশনের’ প্রতিনিধি ছিলেন। ‘কৃষ্ণ বর্মা’ এবং বিশেষ করে ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল প্যারিসের ‘ম্যাডাম কামা’র সঙ্গে তাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। আগেই বলা হয়েছে যে, স্বামী সারদানন্দ কিন্তু প্রকাশ্যে রাজনীতিকে এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সংস্রবশূন্য হয়ে থাকাটাও যে সব সময়ে সম্ভব নয়, সেটাও তিনি বুঝেছিলেন। তাই এক সময়ে তিনি স্বক্ষোভ মন্তব্য করেছিলেন যে, বিরাট ক্ষমতা ও প্রভাব নিয়েও সরকার যেখানে বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করতে অসমর্থ হয়ে পড়েছে, সেখানে সহায়সম্বলহীন রামকৃষ্ণ মিশনের গুটি কয়েক সন্ন্যাসীদের পক্ষে সেকাজ কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই সময়ের কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই কথা বলবার মাধ্যমে স্বামী সারদানন্দ আসলে ব্রিটিশ সরকারের রোষবহ্নি থেকে রামকৃষ্ণ মিশনকে বাঁচাবার জন্যই চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০৬ সালে আরো দু’জন বিপ্লবীকে মিশন কর্তৃপক্ষ আশ্রয় দিয়েছিলেন যাঁদের নাম জানা যায় না; পরবর্তীকালে তাঁরা রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছি।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্তি)

(তথ্যসূত্র:
১- স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড।
২- History of the Ramakrishna Math and Ramakrishna Mission, Swami Gambhirananda.
৩- The Extremist Challenge, Amalesh Tripathi.
৪- ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, অমলেশ ত্রিপাঠী।
৫- Dayananda the Man and his works, Sri Aurobindo, Vedic Mission.
৬- Militant Nationalist in India, Biman Bihari Majumdar.
৭- Tilak & Gokhale, A. Stanley Wolpert.
৮- Indian Nationalism and Hindu Social Reform, Vol. II, Charles Heilsath.
৯- Uttarpara Speech, 4th edition, Aurobindo Ghosh.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

বাতিওয়ালা থেকে গোয়ালা। ঢাকা শহরের হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু পেশাবাতিওয়ালা থেকে গোয়ালা। ঢাকা শহরের হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু পেশা

সভ্যতা যত উন্নত হচ্ছে ততই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিরও আবির্ভাব ঘটছে। যার ফলে পৃথিবীর থেকে হারিয়ে গেছে এমন অনেক পেশা। এক সময় যে সমস্ত পেশা বহুল প্রচলিত ছিল সমাজে তার অস্তিত্ব বর্তমান

তারারে : পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ; যিনি জীবন্ত কুকুর, বিড়াল এমনকি বাচ্চা শিশু খেয়েছিলেনতারারে : পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ; যিনি জীবন্ত কুকুর, বিড়াল এমনকি বাচ্চা শিশু খেয়েছিলেন

সময়টা আঠার দশকের শেষের দিককার। ফরাসি বিদ্রোহ তখন পুরোদমে চলছে। ঠিক সেই সময়টাতে ফ্রান্সের লিঁওতে জন্ম নেয় এক আজব শিশু। তারারে নামের সেই ছেলেটি কুকুর থেকে শুরু করে বিড়াল কিংবা

‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯৪০-এর দশকে কেউ যদি সর্বদেশীয় মেয়েদের নামের মিলন যদি দেখতে চাইতেন, তাহলে তাঁর পুরানো কলকাতার একটি ষ্টীমার ঘাটে গেলেই চলত। সেখানে তখন থরে থরে গঙ্গার বুকের উপরে বাড়ির

‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ পরাধীন ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের উপরে ব্রিটিশ রাজরোষ নেমে আসবার কারণগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে সাজানো যেতে পারে – (১) রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই ব্রিটিশ সরকারের প্রধান সন্দেহভাজন তালিকায়