ইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্য - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্য

ইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্য


রানা চক্রবর্তীঃ ভারতে মোঘলদের হাত থেকে রাজ্যশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করবার সময়ে ঐতিহ্যসূত্র ধরে ইংরেজদের তাঁদের ভৃত্যমণ্ডলীকেও গ্রহণ করতে হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ভারতে মোঘল শাসনের ধার না থাকলেও, ভার কিন্তু যথেষ্টই ছিল; অন্ততঃ সেই সময়ে তাঁদের ভৃত্যমণ্ডলী সেকথারই প্রমাণ দেয়। মোঘল-দরবারের রীতি অনুসরণ করে নতুন শাসক ইংরেজদের বাড়ির নফরকুলের ভাষাও উর্দু বা ফার্সি ছিল। আগেকার দরবারী রেওয়াজ অনুসরণ করেই তখনও প্রত্যেক নফরের কাজের চৌহদ্দি নির্দিষ্ট ছিল; সেই চৌহদ্দির একের সীমানায় অপরের পা দেওয়া বেইমানি ছিল, এবং সেই কাজের ভিত্তিতেই তাঁদের পদমর্যাদাজ্ঞানও টনটনে ছিল। তবে আগেকার মত তখন দরবারী রীতিতেই কাজ না থাকলেও, প্রয়োজন না হলেও পদ ছিল, আর সেই সব পদে বিভিন্ন ধরণের লোকও নিযুক্ত ছিলেন। অবশ্য নতুন শাসকদের সামনে তখন অন্য কোন উপায়ও ছিল না। কারণ, সেই সময়ের ভারতের দীর্ঘদিনের প্রথানুসারে দাস-দাসীর সংখ্যা একটু বেশি না হলে মানুষের মনে সম্ভ্রম জাগত না। এছাড়া বিলাসের প্রতি মোহ তো সাধারণ মানবধর্মই বটে। শেষে একসময়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, ব্যক্তিগতভাবে কেউ আড়ম্বর পছন্দ না করলেও, নফরতন্ত্র তাঁর অপছন্দের হলেও – ‘কোমলি নেহি ছোড়তা’।

‘লর্ড ওয়েলেসলি’ প্রচন্ড বিলাসী মানুষ ছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনই তাঁর কাম্য ছিল। তাঁর পরে নতুন গভর্নর জেনারেল ‘লর্ড কর্ণওয়ালিশ’ এসেছিলেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবার প্রথম দিন, তখনকার প্রথাগত নিয়মানুসারে নিজের পাত্র-মিত্র ও নফরবাহিনীকে সাজিয়ে বিদায়ী গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলি গভর্নমেন্ট হাউসের প্রবেশদ্বারের সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে তিনি কর্ণওয়ালিশকে স্বাগত সম্ভাষণ জানানোর পরে দুই মার্কুইস পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছিলেন। কর্ণওয়ালিশ নিতান্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন, অত আড়ম্বর তাঁর অপছন্দ ছিল, আর ওয়েলেসলির ভৃত্যবাহিনী দেখে তো তিনি রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কি বৃদ্ধ? অশক্ত? পঙ্গু? তাহলে তাঁকে সাহায্য করবার জন্য কেন সেই অকারণ আয়োজন রাখা হয়েছে – সেই প্রশ্নই তখন তাঁর মনে প্রথম জেগেছিল। তিনি তাঁর পার্শ্ববর্তী বন্ধুকে জানিয়েছিলেন, “I do not want them, I do not want them. I have not yet lost the use of my legs. Thank God I can walk very well.” এরপরে কর্ণওয়ালিশকে কলকাতার রাস্তায় দুই ঘোড়ায় টানা সাধারণ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল; তখন কিন্তু তিনি যে সে লোক ছিলেন না, সেই সময়ে তিনি ছিলেন স্বয়ং গভর্নর জেনারেল; তবুও তখন তাঁর সঙ্গে মাত্র একজন সঙ্গী থাকতেন, তাঁর সেক্রেটারী ‘রবিনসন’। তখনকার রেওয়াজ অনুসারে গভর্নর জেনারেলের আগমন ঘোষণা করে তাঁর গাড়ির আগে আগে যেমন কোন ঘোড়সওয়ার ছুটে যেতেন না, তেমনি পিছনেও কোন দেহরক্ষী বাহিনী সদম্ভে তাঁকে অনুসরণ করত না। কিন্তু ওয়েলেসলি গভর্নর জেনারেলের পদটি ত্যাগ করবার পরেও তাঁকে ছয় ঘোড়ায় টানা বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। তখনও তাঁর পিছনে দু’জন দেহরক্ষী, তাঁদেরও পিছনে ‘ড্রাগন’ বাহিনীর কয়েকজন ধ্বজাধারী সৈনিক থাকতেন। কর্ণওয়ালিশ গভর্নমেন্ট হাউসের মত অত বড় প্রাসাদে বাস করবারও পক্ষপাতী ছিলেন না। সেটা নিয়ে তাঁর বন্ধু তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি জানিয়েছিলেন, “এই বাড়ি আদৌ আমার পছন্দ নয়। গাইড ছাড়া কিছুতেই এই বাড়িতে পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এতো বাড়ি নয়, এটা হল কারাগার। জানলা দিয়ে একবার মুখ বাড়ালেই হল, অমনি দু’জন সান্ত্রী বেয়নেট হাতে হাজির হয়। এই ব্যবস্থাকে আমি কিছুতেই চলতে দিতে পারি না।” কর্ণওয়ালিশের পরে ‘লর্ড মিন্টো’ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। এবং নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, “কলকাতায় এসে প্রথম রাত্রে যখন শয়ন করতে গেলাম, দেখি, আমার পিছু পিছু চৌদ্দ জনের একটি বাহিনীও ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করল। তাঁদের পরণে ছিল সাদা মসলিনের গাউন। তবে তাঁদের নারী ভেবে কেউ যেন রোম্যান্টিক কিছু কল্পনা না করেন, কারণ তাঁদের পরিধেয় যেমন গাউন ছিল, তেমনি তাঁদের মুখে কালো দাড়িও ছিল। আমি মনে মনে এই কামনাই করলাম যে, এই দাড়িওলা দাসীরা (বিয়ার্ডেড্র হাউসমেড) আমায় অবিলম্বে ছেড়ে দিয়ে চলে যাক।” তবে শুধু গভর্নর জেনারেল নয়, তাঁকে অনুসরণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যান্য সাধারণ কর্মচারীরাও তখন পাইকারি হারে তাঁদের বাড়িতে দাসবাহিনী নিয়োগ করতেন। সেটার কারণস্বরূপ তাঁদের কেউ কেউ জানিয়েছিলেন যে, ভারতে জাতিভেদ অনুসারে কর্মভেদ প্রচলিত। তাই একই রকমের চাকর সব রকমের কাজ করতে চায় না, তাই সব রকমের কাজের জন্য আলাদা লোকের দরকার হয়। কোম্পানির কর্মচারীদের প্রায় প্রতিটি জর্ণাল বা ডায়েরিতে তাঁদের চাকরদের ফিরিস্তিও পাওয়া যায়, এবং তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই সেই চাকরদের কাজের বিভাগ ও উপ-বিভাগের বর্ণনাও দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ঐসব লেখায় সেই সব সেবকদের উদ্দেশ্যে গালিবর্ষণও দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য তখনকার দেশীয় চাকরদের প্রশংসাও যে কেউ করেন নি – এমন কিন্তু নয়, তবে সেটাকে নিতান্ত ব্যতিক্ৰম বলেই ধরা চলে।

‘মিসেস ফে’ স্বভাবে উন্নাসিক ছিলেন। বঙ্গদেশের একমাত্র “বেঙ্গল মাটন অলওয়েজ গুড” ছাড়া অন্য কোন কিছুই তাঁর ভাল লাগেনি। ১৭৮০ সালে ভারতীয় ভৃত্যদের নিয়ে ডায়েরীতে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “আমি ঘর-সংসার সাজাতে আরম্ভ করেছি। ভারতে কাজটি খুব সহজ নয়। এখানে যে কাজের জন্য যে চাকরকে নিয়োগ করা হয়, তার বাইরে অন্য কোন কাজ করতে বললেই সে সেটা করবে না। আর নিজের কাজটুকুও যে স্বেচ্ছায় করে তাও নয়। সেদিন আমি একজন চাকরকে একটি টেবিল আমার পাশে বসাবার জন্য বললাম। সে দেখি চেঁচিয়ে অন্যান্য বেয়ারাদের সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করতে লাগল। আমি বললাম – ‘তুমি নিজেই টেবিলটা সরাও না কেন?’ জবাব দিল – ‘আমি ইংরেজ নই, বাঙ্গালী। একজন কেন, তিনজন বাঙ্গালীও একত্রে একজন ইংরেজের সমান কাজ করতে পারে না।’ (Oh I no English; one, two, three Bengal man cannot do like one Englishman.) … ইংল্যাণ্ডে চাকর যদি অসৎ হয়, আমরা তাঁকে শাস্তি দিই, বা অপমান করে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করি। তাঁদের দুর্দশা দেখে অন্যান্যরা শিক্ষা গ্রহণ করবে এটা আশা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের এই হতভাগাদের কোন লজ্জাবোধই নেই। আমি দু’-একটি উদাহরণ দিচ্ছি, এর থেকেই বুঝতে পারবে কী অস্বস্তির মধ্যে আমার এখানে দিন কাটছে। মাত্র দেড় পাইট কাষ্টার্ড তৈরী করবার জন্য আমার খানসামা তেরোটি ডিম ও এক গ্যালন দুধ চাইল। আমি এতটা জুরাচুরি প্রশ্রয় দিতে রাজি নই। আমি আপত্তি জানাতে সেও পাল্টা হুমকি দিল। ফলে আমি তাঁকে ছাটাই করে নতুন লোক নিয়োগ করলাম। তাঁকে বললাম – ‘দেখ বাপু, আমি বাজারে গিয়ে কোন জিনিসের কত দাম সব জেনে এসেছি। কাজেই তুমি যা খুশি চাইবে তাই আমি মেনে নিতে পারি না। কাল থেকে আমার বাড়ির জন্য যা কিছু কিনবে সেসবের সঠিক বাজার দর লিখে রোজ সকালে হিসেব দেবে।’ এর ফলে লোকটি দ্বিগুণ মাইনা দাবি করে বসল। কাজেই সেই নতুন লোকটিকে বাতিল করে আমি আবার পুরানোটিকেই বহাল করলাম। আমি জানি যে এই লোকটি গুণ্ডা, এঁরা সবাই তাই। তবুও মনে হয় যে, আমার মেজাজ সে টের পেয়েছে, এবং সংযত হয়েই চলবে। … যে লোকটি আমার বাজার করত সেও চলে গেল। তাঁর অভিযোগ হল যে, গরিব চাকরদের আমার বাড়িতে কাজ করে কোন লাভ নেই। অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করলে মাইনা ছাড়াও দৈনিক অন্ততঃ এক টাকা উপরি আয় হয়। কিন্তু আমার বাড়িতে সে যদি মাত্র এক আনা বা দু’ আনা চায়, সেটাও নাকি আমি তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিই। … হোয়াট এ টেরিবল ক্রিচার আই এ্যাম!” মিসেস ফে এই লেখার মাধ্যমে কেবল এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি একজন জবরদস্ত মহিলা, তাই তখনকার চাকর নামধেয় গুণ্ডারাও তাঁর নামে তটস্থ থাকতেন। কিন্তু তিনি এটা খেয়াল করেন নি যে, দেশীয় চাকরদের জন্য দস্তুরীর যে ব্যবস্থ৷ অদ্যাবধি চালু ছিল, তাতে হস্তক্ষেপ করাটা মালিকের সঙ্কীর্ণচিত্ততার পরিচয় মাত্র ছিল। এখানে মিসেস ফে’র কথা এই কারণেই উল্লেখ করা হল যে, তাঁর যুগটা দেশীয় চাকরদের সুবর্ণ যুগ ছিল। আঠারো শতকের শেষের দিকে দাসবাহিনীর সংখ্যাবৃদ্ধিকেই সাহেবরা তাঁদের আভিজাত্য বলে মনে করতেন, এবং সেই খাতে যেকোন পরিমাণ অর্থব্যয় করাকেই ওই সময়ের বিদেশী অভিজাতবর্গ মানবধর্ম বলে মেনে নিয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে ‘হেবার’ বা ‘পার্কসের’ কালে, বা আরও পরে ‘গ্র্যান্টের’ সময়ে এদেশে ইউরোপীয়দের দাসবাহিনীর সংখ্যা তেমন হ্রাস না পেলেও, আগেকার সেই বর্ণাঢ্য ভাবটুকু আর ছিল না। ‘জেমস অগাস্টাস হিকি’ ফে’রই সমসাময়িক ছিলেন, তিনি খুব বেশি বড়লোক ছিলেন না। তবে এদেশীয় দাস-দাসী নিয়োগের ব্যাপারে, এবং তাঁদের সম্যক মর্যাদাদানের ব্যাপারে হিকি যেমন উদারচিত্ত ছিলেন, তাঁর বন্ধুরাও সেটাই ছিলেন। ‘পার্লবী’ তাঁর জার্ণালে, তাঁর বাড়ির দাসদাসীদের বিস্তৃত তালিকা ও বেতনের হার উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “একজন খানসামা, একজন আবদার (জল ঠাণ্ডা রাখার কাজ করতেন), হেড খিদমতগার, সেকেণ্ড খিদমতগার, এক বাবুর্চি, মেট বাবুর্চি, মশালচি, ধোবি, ইস্তিওলা, একজন দর্জি ও সহকারী, একজন আয়া ও তাঁর সহকারী, এক ডুরিয়া, সর্দার বেয়ারা, মেট বেয়ারা, গোয়ালা, ভেড়ীওলা, মুর্গীওলা, মালী, মেট মালী, তথ্য সহকারী, গম পেষাইওলা, কোচম্যান, আটজন সহিস, আটজন ঘাসুড়ে, ভিস্তিওলা ও তথ্য সহকারী, একজন বড় মিস্ত্রি ও সহকারী, খসের গায়ে জল দেওয়ার জন্য দু’জন কুলি, দু’জন চৌকিদার, একজন দারোয়ান, দু’জন চাপরাসি; মোট নফর সংখ্যা সাতান্ন জন, বেতন মোট দু’শো নব্বই টাকা। সর্বোচ্চ বেতন বারো টাকা, সর্বনিম্ন দু’ টাকা।” তখন যাঁরা কোম্পানির একটু পদস্থ কর্মচারী ছিলেন, তাঁদের জন্য উপরোক্ত তালিকার ভৃত্যরা ছাড়াও আসাবরদার ও চোপদার, এবং কখনও কখনও সোনতাবদারও থাকতেন। আঠারো শতকে উপরোক্ত দুটি তালিকার সঙ্গে আরো অন্ততঃ দু’জন হুকাবরদার যুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়া পরচুলা পরাবার নাপিত ও পাঙ্খাওলা তো ছিলেনই। হিকি তাঁর আমলের কলকাতার মানদণ্ডে এমন কিছু ধনী ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু তাঁরও ভৃত্য সংখ্যা ষাট জনের কম ছিল না। আর তখন যাঁরা একটু অবস্থাপন্ন ছিলেন, তাঁরা অন্ততঃ একশো জন ভৃত্য নিয়োগ করতেন।

বিশপ ‘রেজিনাল্ড হেবার’ প্রথমবার কলকাতায় এসে তাঁর নিজের বাড়ির জন্য নিযুক্ত দাসবাহিনীর সংখ্যা দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেটাকে রীতিমত ‘ভৃত্যরাজকতন্ত্র’ বলে মনে হয়েছিল। তাঁর শিশুকন্যার জন্যই আয়া, বেয়ারা, খিদমতগার, হরকরা এবং একজন পাচক নিযুক্ত ছিলেন। এঁরা ছাড়াও আরও দু’জন তাঁর শিশুর জন্য নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন সেই শিশুকে রৌদ্রের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য ছাতাবহন করতেন, আর অন্যজন তাঁর আগে আগে ‘মেস’ হাতে নিয়ে চলতেন। তবে তখন ‘মেস’ বহন ব্যাপারটা অবশ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই ব্যাপারে মিসেস হেবার আপত্তি তুলেছিলেন। একফোঁটা শিশুর জন্য অত লোক নিয়োগ করা কেন? তখন তাঁকে বোঝানো হয়েছিল যে, সেটাই নাকি ভারতের রেওয়াজ। সেসব নাকি মোঘল আমলের বিলাস-ব্যসনের ছিটেফোঁটা ছিল। তবে হোবার দম্পতির বাড়ির ব্যাপারটা অতি সামান্য ব্যাপার ছিল। কারণ, সেই সময়ের কলকাতায় এমন বাড়িও ছিল, যেখানে মাত্র ছ’বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে আয়া যখন ফিটন গাড়িতে চড়ে পথে বের হত, তখন সেই গাড়ির পা-দানির দু’ পাশে দু’জন সহিস হাঁক দিতে দিতে চলতেন। গাড়ির সামনে থাকতেন চালক, আর পেছনে থাকতেন ছাতাবরদার। তাঁরও পিছনে ছোট একটি ঘোড়া থাকত। কারণ, ছ’বছরের খোকাবাবুর যে কখনো সত্যিকারের জ্যান্ত ঘোড়ায় চড়বার শখ হবে না – তার কোন ঠিক আছে নাকি! অত কিছুর প্রয়োজন না হলেও, তখন কিন্তু ওসব মেনে নেওয়াটাই প্রচলিত ছিল। চন্দননগরের ফরাসি শাসক ‘ডুপ্লে’ও তাঁর বাড়িতে চাকর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজেকে বিরাট ব্যক্তি বলে মনে করেছিলেন।
ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে গ্র্যান্ট ভারতীয় ভৃত্যদের পদ অনুযায়ী যে সব ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছিলেন, আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও অবস্থা প্রায় একই ছিল। তখন অন্য লোকের বাড়িতে শুধু কোন সাহেবের নিমন্ত্রণ হলেও, সাহেব কিন্তু সেখানে যেতেন না; তাঁকে সেখানে নিজের সঙ্গে নিজের খিদমতগার ও ছাতাবরদারকে নিয়ে যেতে হত। আঠারো শতকে তাঁদের সঙ্গে সাহেবের ব্যক্তিগত হুঁকোবরদারও থাকত। তখন খিদমতগারের পোশাক ছিল সাদা লিনেনের, তাঁর কোমরে সোনা বা রূপার ব্যাণ্ড থাকত। ওই সময়ের ভৃত্যদের পদমর্যাদায় বেয়ারাদের স্থান ছিল পঞ্চম। তখন সাধারণতঃ হিন্দু, রব্বানি, উড়িয়া ও বাঙালী – এই তিন রকম বেয়ারাই ইউরোপীয়দের বাড়িতে নিয়োগ করা হত। জাতিতে হিন্দু বলে তাঁদের কেউই সাহেবের খাবার টেবিল স্পর্শ করতেন না। একবার তো উড়িয়া বেয়ারারা পাখা টানতেও অস্বীকার করেছিলেন। কারণ, নিষিদ্ধ মাংস যে টেবিলে রাখা ছিল, পাখাটা ঠিক সেটার উপরেই ঝোলানো ছিল। রব্বানিরা কথায় কথায় চটে গেলেও খুব বিশ্বাসী ও কর্মক্ষম ছিলেন। উড়িয়ারা শান্ত ও ধীর ছিলেন। আঠারো শতকে পাল্কিবহনের জন্যও স্বতন্ত্র লোক নিযুক্ত করা হত। তবে ঊনিশ শতকে বেয়ারাদেরকেই অবসর সময়ে বেহারা হয়ে পাল্কি টানতে হত। সর্দার বেয়ারার সম্মান সবচেয়ে বেশী ছিল। তাঁরা পাল্কি বহন করা দূরের কথা, স্পর্শও করতেন না। মনিব-বাড়ির চাবি তাঁর কাছেই থাকত। মনিবকে পোশাক পরানো, ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, আলো জ্বালানো ইত্যাদির তদারক করাও তাঁর কাজ ছিল। সাহেব যখন মেমকে নিয়ে তাঁর নিজের কক্ষে নিভৃতে বিশ্রন্তালাপে রত থাকতেন, তখন সেখানে একমাত্র সর্দার বেয়ারাই প্রবেশ করতে পারতেন। বাবুর্চিরা সাধারণতঃ মুসলমান হতেন। তবে অনেক সময়ে মগ বা পর্তুগীজদেরও সেই পদে নিয়োগ করা হত। হিন্দু বাবুর্চিকে তখন ‘কাওড়া’ বলা হত। গ্র্যান্ট তাঁর লেখায় মুসলমান বাবুর্চিদের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন, কারণ তাঁরা রান্না করবার সময়ে খাদ্যবস্তু মুখে দিয়ে পরীক্ষা করতেন না, অথচ তাতে অনবদ্য স্বাদ ফুটিয়ে তুলতেন। পক্ষান্তরে মগেরা শূকরের মাংস দিয়ে সুন্দর চপ বানিয়ে দিলেও, স্বাদ চাখতে গিয়ে নিজেরাই সেই রান্নার অর্ধেক সাবাড় করে দিতেন! পাঙ্খাওয়ালার কৃতিত্বে গ্র্যান্ট মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, “সৈন্য ও পর্যটকদের যেমন অনেক সময় ঘোড়ার উপর চলমান অবস্থায় ঘুমিয়ে নিতে দেখা যায়, পাঙ্খাওয়ালারাও তেমনই কর্মরত অবস্থায় ঘুমোতে পারে। তাঁরা চোখ বন্ধ করে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ঘুমালেও পায়ের সাহায্যে পাখা চালিয়ে যায়।”

ওই সময়ের কলকাতার দর্জিদের কাজের প্রশংসা করলেও, সবাই তাঁদের স্বভাবের নিন্দা করেছিলেন। আঠারো-ঊনিশ শতকে তাঁদের চৌর্যবৃত্তি এবং মিথ্যা কথা বলবার দক্ষতা, সেকালের সাহেব মহলে প্রায় প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ‘পার্কস’ লিখেছিলেন, “দর্জি হল ইণ্ডিয়ান লাগজারী। তাঁদের হাতের কাজ অতি চমৎকার। কারুকার্য ও টেকসই উভয় দিক থেকেই তাঁরা ফরাসি দেশের সেরা দর্জিদের সমকক্ষ। কিন্তু আমার দর্জি ছিল পাকা চোর। ছুরি, কাঁচি, সিল সবকিছু তাঁরা আত্মসাৎ করত। এমনকি মূল্যবান নেকলেস ব্রেসলেট নিয়ে সরে পড়বার ঘটনাও ঘটেছিল।” ১৮২৩ খৃষ্টাব্দে ‘ক্যাপ্টেন উইলিয়মসনের’ একবার দেশীয় নাপিতের কাছে দাড়ি কামাবার শখ হয়েছিল, তিনি লিখেছিলেন, “এক টুকরো কটুগন্ধি সাবান, বুরুশের বালাই নেই। শুধু গালে জল দিয়ে হাত বুলিয়ে দাড়ি নরম করে নেওয়া হয়। তারপরে ক্ষুরটা চামড়ার উপরে বুলিয়ে দাড়ি কামাতে শুরু করে। এই ক্ষুর চালানোর সময় যাঁর দাড়ি, তাঁর ভীতিবিহ্বল মুখচোখের দিকে নাপিতের দৃষ্টি থাকে না। শুধু দাড়ি নয়, ক্ষুরের টানে দাড়ির সঙ্গে গালের মাংসও কেটে বেরিয়ে আসে। আমায় দুর্ভাগ্যক্রমে প্রায়ই দেশী নাপিতদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। এই ভয়াবহ কাণ্ড আমার উপর দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবারই গালের ক্ষত নিরাময় হতে সাত থেকে দশদিন সময় লেগেছে।”
আঠারো শতক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হুঁকাবরদারদের সুবর্ণযুগও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঊনিশ শতকে কলকাতার সাহেব-বাড়ি থেকে হুঁকোর চল উঠে গিয়েছিল। গড়গড়ার জল পরিবর্তন, তামাক তৈরী, গন্ধদ্রব্যাদি মিশ্রণের দ্বারা স্বাদসৃষ্টি – ইত্যাদি হুঁকাবরদারদের বহুদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ ফল ছিল। তাঁদের কাজটিও প্রায় বংশানুক্রমিক ছিল। তখন কোন ভোজসভায় মনিবেরা খানসামা ও হুঁকাবরদারকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সভাকক্ষে তাঁরা সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করতেন। আর তারপরে যে যাঁর প্রভুর পশ্চাতে গিয়ে হাতে গড়গড়া, বুকে দু’-তিনটি পাক দিয়ে নল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। লক্ষ্য রাখতে হত যে, একজনের গড়গড়ার নল যেন অপরের নলকে ডিঙিয়ে না যায়; সেটাকে অপমান বলে গণ্য করা হত। তখন সব গড়গড়ার নলই, তা সে আকারে যতই বড় হোক না কেন, নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যে রাখতে হত। মনিব ও গড়গড়ার মাঝামাঝি জায়গাতেও কারো দাঁড়ানোর বা হাঁটাচলা করবার উপায় ছিল না; কারণ, সেটাও অপমান বলেই গণ্য করা হত। ইউরোপীয় মহিলারাও সেই গড়গড়ার লোভ সামাল দিতে না পেরে দু’-এক টান দিয়ে নিতেন – “The mixture of sweet scented Persian tobacco, Sweet herbs, coarse sugar spice etc., which they inhale, comes through clean water and is so very pleasant that many ladies take the tube and draw a little of the smoke into their mouth.” (Price)
বর্তমানে চাকর ও নোকর – এই দুটি শব্দকে সমার্থক করে ফেলা হলেও, তখন কিন্তু এই দুটি শব্দ এক ছিল না। উক্ত শব্দ দুটি দিয়ে তখন ভৃত্যদের দুটি শ্রেণীকে বোঝানো হত। চাকরের থেকে নোকরের মর্যাদা তখন ঢের বেশী ছিল। ফলে তাঁকে চাকর বলে সম্বোধন করলে, সে অপমানিত বোধ করত। ‘উইলিয়মসন’ এই তত্ত্ব পরিবেশন করে জানিয়েছিলেন যে, ওই সময়ের সাহেবরাও এই দুই শ্রেণীর পদমর্যাদা সম্পর্কে সবসময়ে সচেতন ছিলেন না। নোকর বলতে তখন বেনিয়ান, সরকার, দারোগা, মুন্সি, জমাদার, চোবদার, সোঁতাবদার, খানসামা ও কেরানিকে বোঝানো হত। আর অন্যদিকে চাকর বলতে খিদমতগার, মশালচি, হুঁকাবরদার, ভিস্তিওলা, বাবুর্চি, দর্জি, ধোপা, মাহুত, সারোয়ান (উটচালক), সহিস, চাবক আস্যার (যাঁরা ঘোড়ার মুখে লাগাম বাঁধার কাজ করতেন), মালি, আবদার, কম্পাদর, হরকরা, বিত্তেন, দফতরি, হাজাম, ফরাস, মেথর ও ডুবিয়া, খালাসি, ভেড়িয়া, চৌকিদার, দারোয়ান, কাহার, কোচম্যান, আন্না, ধাই ইত্যাদিদের বোঝানো হত।
আঠারো শতকে কোন নতুন সাহেবের কলকাতায় পদার্পন করবার সংবাদ চাঁদপাল ঘাট থেকেই স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট মহলে ছড়িয়ে পড়ত। পরদিন সকালেই তিনি সর্বপ্রথম সরকারের দলের দর্শন পেতেন। তখন সাহেবদের এজেন্ট হয়ে কাজ করবার জন্য একজন সরকারের প্রয়োজন হত। নতুন জায়গায় সাহেবের জন্য আসবাবপত্র কেনা-কাটা, বাড়িতে দাসবাহিনী নিয়োগ, গাড়ি-ঘোড়ার ব্যবস্থা – সবকিছুই তখন সেই সরকার করতেন। এমনকি প্রয়োজন পড়লে উচ্চহারে সুদ কবুল করে সাহেব তাঁর কাছ থেকে অর্থ সাহায্যও নিতে পারতেন। সেই সরকার যদি আগেই নিযুক্ত করা হয়ে যেত, তাহলে তিনিই সাহেবের সম্মতি নিয়ে তাঁর জন্য ভৃত্যকুল নিয়োগ করতেন; অন্যথায় সাহেবকে নিজেই তাঁর জন্য নফর নির্বাচন ও নিয়োগের দায়িত্ব নিতে হত। তখন অসংখ্য বেকার লোক সার্টিফিকেট হাতে সাহেবের কাছে চাকরির জন্য উপস্থিত হতেন। কিন্তু নিজের জন্য ঠিক কতগুলি চাকর প্রয়োজন, সেটা নির্ধারণ করা কোন নবাগত সাহেবের পক্ষেই সম্ভব ছিল না, এবং যোগ্য লোক নির্ধারণ করা তো তাঁর কাছে রীতিমত শক্ত ব্যাপার ছিল। ‘মেময়িরস অব এক ক্যাডেট’ গ্রন্থের লেখক তাঁর স্মৃতিকথায় তৎকালীন কলকাতার ভৃত্যনিয়োগ সমস্যা সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বেকারের দল চাকরির জন্য দল বেঁধে আসে। তাঁদের সবারই হাতে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট থাকে। তাঁদের আগের মনিব চলে যাওয়ার সময় তাঁর চাকরের হাতে এই সার্টিফিকেট দিয়ে যান। এই সার্টিফিকেট আবার হস্তান্তরিতও হয়। একজন চাকরী পাওয়ার পরে তাঁর সার্টিফিকেট অন্যজন নিয়ে চাকরীর জন্য চেষ্টা করে। অনেক সময় লব্ধ সার্টিফিকেট ভাড়া পর্যন্ত দেওয়া হয়, এমনকি বিক্রি পর্যন্ত করা হয়। … আমার কাছে যাঁরা চাকরির জন্য এসেছিল তাঁদের একজনের সার্টিফিকেট বড় মজার ছিল। সেই সার্টিফিকেটধারী যে বাঙালী ছিল না, সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি। কারণ বাঙালীরা খুব চতুর হয়। বিদেশী ভাষায় লেখা সার্টিফিকেটের মর্মার্থ কি, সেটা বুঝবার জন্য তাঁরা ইংরেজি-জানা কোন দেশীয় লোকের কাছে আগে সার্টিফিকেটটা পড়িয়ে নেয়। কিন্তু আমার কাছে যে সার্টিফিকেটটি এল তাতে লেখা ছিল, ‘I do humbly certify that the bearer hereof, Khoda Bux has served me as mashalchee for three months and is discharged for repeated intoxication and insolence, and is moreover a very dirty fellow.’ …” কিন্তু এই লেখকই পরে ইউরোপীয়দের মনিব চরিত্র সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে বলেছিলেন যে, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ – অর্থাৎ, তখনকার অধিকাংশ ইউরোপীয় মনিবই সব দোষ তাঁদের ভারতীয় চাকরদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে সাধু প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করতেন। একই সাথে উক্ত গ্রন্থের গ্রন্থকার সাহেব তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজের দুর্নীতি, উচ্ছৃঙ্খলা ও ন্যায়বোধ বর্ণিত প্রভুত্বকামিতার প্রতি কটাক্ষ করে লিখেছিলেন, “আমার মনে হয়, ভাল চাকর পেতে হলে মনিবকেও (ভারতে কিছুদিন অবস্থানের পরেও) উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।”
গ্র্যান্টও তাঁর সময়ের কলকাতার সাহেবদের আমিরী মেজাজের প্রতি কটাক্ষ করে লিখেছিলেন, “তাঁদের জীবনের প্রধান নীতি হল thou shalt do nothing for thyself which thy servant can do for you. মনিবদের অলস প্রকৃতির ফলে চাকরদের উপরে কাজের চাপ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পায়। অথচ ভাল কাজের জন্য তাঁরা প্রভুর কাছে সমাদর পায় না। অবশ্য বড় বড় সাহেব-বাড়িতে চাকরদের প্রতি যে দুর্ব্যবহার করা হয়, ছোট বাড়িতে তেমন করা হয় না। আমি ছোট ছোট ইউরোপীয়ানদের বাড়ি দেখেছি – সেখানে নবাগত অতিথি গৃহভৃত্যদের কাছ থেকে যে রকম সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছেন, বড় বড় বাড়িতে সেসব পাননি, বরং উপেক্ষাই পেয়েছেন। … আমি এমন বহু ঘটনা শুনেছি যে, প্রভু ও প্রভু-স্ত্রী যখন নৌকায় বা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে দূরদেশে গিয়েছেন, তখন তাঁদের পেয়ে ভৃত্য হাসিমুখে পায়ে হেঁটে ছ’শো, কখনো বা সাতশো মাইল পথ তাঁদের অনুসরণ করেছে। আমি এক বৃদ্ধা আয়াকে জানি। সে বয়োভারে ন্যুব্জপৃষ্ঠ। গাড়ির ঝাঁকুনিতে পিঠে ব্যথা হবে বলে নিজে কখনো গাড়িতে চড়েনি। অথচ প্রভু-স্ত্রীর কষ্ট হবে বলে সে পায়ে হেঁটে প্রভুকে কানপুর থেকে লাহোর, মুসৌরি, গোয়ালিয়র, এবং সবশেষে কলকাতায় অনুসরণ করেছে।”


এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, তখনকার ইংরেজ নরনারীদের জার্নালে বা ডায়েরীতে তাঁদের অসৎ চাকরের কথা যতটা ফলাও করে লেখা হয়েছিল, অসৎ মনিবের কথা কিন্তু তেমনভাবে লেখা হয়নি। অথচ, অকারণে দেশীয় ভৃত্যদের বেপরোয়া প্রহার করবার ঘটনা তখন কিন্তু প্রায়ই ঘটত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুরানো রেকর্ডে দেখা যায় যে, ১৭৬৩ সালের ২১শে মার্চ তারিখে জনৈক ‘মিঃ জনসন’ তাঁর চাকরকে বেদম প্রহারের দায়ে জেল খেটেছিলেন, এবং জেলখানায় নিজের অসহায় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তিনি ইংরেজদের কলকাতা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের কাছে মুক্তির আবেদন জানিয়েছিলেন। ‘মেমইরস অব এ ক্যাডেট’ গ্রন্থেও বলা হয়েছিল, “আজকাল কোন কোন স্টেশনে চাকরদের প্রহারের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য আদালত বসানো হয়েছে।” তখনকার সাহেব-মনিব ও তাঁদের চাকরদের নিয়ে ‘ইণ্ডিয়ান চারিভরি’ পত্রিকায় কার্টুনও আঁকা হয়েছিল। সেই কার্টুনে দেখানো হয়েছিল যে, নবাগত একজন ইংরেজ একটি ভোজসভায় গিয়ে হাঁক দিয়ে বলেছিলেন – ‘কোই হ্যায়? হামকো শেরী শরাব দো।’ খিদমতগার উত্তর দিয়েছিল – ‘জী নেই সাহাব।’ সাহেব বলেছিলেন – ‘হ্যাং ইট। আই ডোন্ট ওয়ান্ট জিন, আই সেইড শেরী শরাব।’ ‘স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল’ একবার নাকি ভারত থেকে কিছু দেশীয় চাকরকে ইউরোপে রপ্তানি করবার কথাও ভেবেছিলেন। তদানীন্তন ইংরেজ চালিত পত্রিকাগুলিতে সেটা নিয়ে ক্যাম্পবেলের খুব সমালোচনা হয়েছিল। তখন ইণ্ডিয়ান চারিভরি সেই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল, ‘পরের মন্দকে ঘরে ডেকে আনার চেয়ে নিজের ঘরের মন্দ ঢের বাঞ্ছনীয়।’

(তথ্যসূত্র:
১- Memoirs Of A Cadet, A Bengalee.
২- Charles Grant and British rule in India, Ainslie Thomas Embree.
৩- Calcutta old and new, H. E. A. Cotton.
৪- কলকাতার ইতিবৃত্ত, বিনয় ঘোষ।
৫- কলকাতার ৩০০ বছরের কাহিনী ও প্রথা, অতুল সুর।
৬- The Wellesley Papers, Vol. 1 & 2: The Life and Correspondence of Richard Colley Wellesley, Richard Colley Wellesley.
৭- The Original Letters from India of Mrs. Eliza Fay; Eliza Fay, Walter Kelly Firminger, Edward Morgan Forster.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘বাংলা সাহিত্যের অভ্যুদয়’‘বাংলা সাহিত্যের অভ্যুদয়’

রানা চক্রবর্তীঃ ভাষার জন্ম হয় দেশের মাটিতে। মানুষের অলক্ষ্যে জলবায়ুসহ সে মাটি যেমন নিয়ত পরিবর্তিত হয়, তেমনি ভাষাও পরিবর্তিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা থেকে কত শব্দ অহরহ লোপ পাচ্ছে, আবার

‘অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বেসরকারি ব্যবসা’‘অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বেসরকারি ব্যবসা’

রানা চক্রবর্তীঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে ইউরোপীয় কেম্পানিগুলির ব্যবসা সরকারি ব্যবসা (Public trade); আর কোম্পানিগুলির কর্মচারী, লাইসেন্সধারী স্বাধীন বণিক (free merchant) ও লাইসেন্সহীন বেআইনি বণিকদের (interloper) ব্যবসা একত্রে বেসকারি ব্যবসা (private

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নিলালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিয়েও রহস্য দানা বাঁধতে দেখা গেছিল। সে রহস্যের মীমাংসা আজ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দ গেছিলেন একটা চুক্তিপত্র

ধর্মঠাকুর কে?ধর্মঠাকুর কে?

রানা চক্রবর্তীঃ পশ্চিমবঙ্গে ধর্মদেবতার পূজা এখন একান্তভাবে বর্ধমান বিভাগে সীমাবদ্ধ। তবে চব্বিশ পরগণা জেলায় ও কলকাতার কাছাকাছি অঞ্চলে, ধর্মদেবতার বিগ্রহ ও নিত্যপূজা এখনও একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় নি। পূর্ববঙ্গের স্থানে