ধর্মঠাকুর কে? - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ধর্মঠাকুর কে?

ধর্মঠাকুর কে?


রানা চক্রবর্তীঃ পশ্চিমবঙ্গে ধর্মদেবতার পূজা এখন একান্তভাবে বর্ধমান বিভাগে সীমাবদ্ধ। তবে চব্বিশ পরগণা জেলায় ও কলকাতার কাছাকাছি অঞ্চলে, ধর্মদেবতার বিগ্রহ ও নিত্যপূজা এখনও একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় নি। পূর্ববঙ্গের স্থানে স্থানেও ধর্মদেবতার পূজার ইঙ্গিত অনবলুপ্ত। সেখানে ধর্মের গাজন সাধারণতঃ ‘দেল পূজা’ অর্থাৎ ‘দেউল পূজা’ নামে প্রসিদ্ধ। একে আবার কোথাও কোথাও ‘পাটপূজা’ও বলা হয়।

বর্ধমান জেলার জামালপুরের বুড়োরাজের কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। বুড়োশিবের ‘বুড়ো’, আর ধর্মরাজের ‘রাজা’, দু’য়ে মিলে ‘বুড়োরাজ’। সাধারণত ‘নাথ’ বা ‘ঈশ্বর’ যোগ করেই এদেশে শিবের নামকরণ হয়, ‘রাজ’ দিয়ে হয় না। জামালপুরে হয়েছে, কারণ সেখানে দুই দেবতা মিলিত হয়ে সর্বজনপূজ্য লোকদেবতায় পরিণত হয়েছেন। রাঢ়ের ধর্মঠাকুরের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ-প্রসঙ্গে সংস্কৃতি-তত্বের দিক থেকে, জামালপুরের বুড়োরাজের গুরুত্ব যে কতখানি, অনুসন্ধানী ও কৌতূহলীরা তা বুঝতে পারবেন। গবেষকদের মতে রাঢ়ের অন্যতম গণদেবতা (তথাকথিত অনুন্নত সমাজের) ধর্মঠাকুর কে ক্রমে হিন্দুসমাজের শ্রেষ্ঠ দেবতা শিবঠাকুর আত্মসাৎ করে ফেলেছেন। জামালপুরের বুড়োরাজ তার অন্যতম ঐতিহাসিক সাক্ষী। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুড়োরাজের পূজা ও গাজন হয়। শিবের পূজা ও গাজন হয় চৈত্রসংক্রান্তিতে। সারা রাঢ় অঞ্চলে বৈশাখী বুদ্ধপূর্ণিমায় ধর্মরাজের গাজন হয়। তাহলে বুড়োরাজ কি শিব না ধর্মরাজ?

পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঠাকুরের প্রভাব-এলাকা প্রসঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোণার বিশেষ গুরুত্ব আছে বলে মনে হয়। চন্দ্রকোণার পশ্চিমে মেদিনীপুরের বিস্তৃত অঞ্চলকে ধর্মঠাকুর বর্ণিত অঞ্চল বললে ভুল হয় না। ওদিকে গোটা ঝাড়গ্রাম মহকুমার কোথাও ধর্মঠাকুর দেখা যায় না। দক্ষিণে কাঁথি মহকুমায়, দু’একটি ধর্মঠাকুরের কথা লোকমুখে শোনা যায়, কিন্তু সেগুলো তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। ধর্মনিরঞ্জনপন্থী কোন সম্প্রদায় বা পরিবার ঐ স্থানে গিয়ে বসবাস করার জন্য হয়ত ধর্মপূজা করতে পারেন। তমলুক মহকুমায় ময়না ছাড়া আর কোথাও ধর্মঠাকুরের বিশেষ পূজার্চনা হয় না। উত্তর মেদিনীপুরের গড়বেতা-চন্দ্রকোণা থেকে ধর্মঠাকুরের প্রতিপত্তি আরম্ভ হয়েছে বলা চলে। গড়বেতা-চন্দ্রকোণা থেকে আরম্ভ করে পূর্বে হুগলীর আরামবাগ মহকুমা, দক্ষিণ-পূর্বের ঘাটাল মহকুমা, উত্তরে বিষ্ণুপুর মহকুমা এবং তার সংলগ্ন দামোদর দক্ষিণ তীরবর্তী দক্ষিণ-বর্ধমানের রায়না-গোতান অঞ্চল – এই হল পশ্চিমবঙ্গের ধর্মঠাকুরের পূজার সর্বাধিক প্রতিপত্তিকেন্দ্র। কোন কোন গবেষকের মতে উড়িষ্যার যাজপুর ধর্মপূজার আদিকেন্দ্র। যদি সেটাই হয় তাহলে মেদিনীপুরের যেসব অঞ্চলে উড়িষ্যার অন্যান্য প্রভাব যথেষ্ট রয়েছে বলে দেখা যায় (যেমন, দেবালয় স্থাপত্যে), সেখান থেকে ধর্মঠাকুরের প্রভাব একেবারে বিলুপ্ত কি করে হয়ে গেল – স্বভাবতই এই প্রশ্ন মনে জাগে। অনেক সময় দেখা যায়, ব্যবহার্য শিল্পকলা উৎপত্তিকেন্দ্র থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে নানা কারণে প্রাধান্য পায়। কিন্তু লোকাচরিত ধর্ম সাধারণতঃ সেইভাবে স্থানান্তরিত বা কেন্দ্রান্তরিত হয় না। তাই মনে হয়, ধর্মনিরঞ্জপন্থীদের আদিকেন্দ্রের সন্ধান যদি বৈজ্ঞানিক উপায়ে করতে হয়, তাহলে পূর্বোক্ত সর্বাধিক প্রতিপত্তি কেন্দ্রেই করতে হবে বা করা উচিত। আর এই কেন্দ্রের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত হল গড়বেতা ও চন্দ্রকোণা।

চন্দ্রকোণার পুরাতন ধর্মমন্দিরগুলো দেখলে বোঝা যায় যে এখানে একসময় ধর্মঠাকুরের কি রকম প্রতিপত্তি ছিল। গোবিন্দপুর, নরহরিপুর, জয়ন্তীপুর প্রভৃতি পাড়ায় এখন একত্রে কয়েকটি মন্দিরের মধ্যে দলবদ্ধভাবে ধর্মঠাকুর বিরাজ করেন। অর্থাৎ বিভিন্ন পাড়া থেকে উদ্বাস্তু ধর্মঠাকুরেরা ক্রমে আশ্রয়ের অভাবে একই মন্দিরের মধ্যে এসে বাস করছেন। তাঁদের সেবায়েত ও পূজারীরা অনেকেই হয় নির্বংশ হয়েছেন, অথবা কর্ম উপলক্ষে দেশত্যাগী হয়েছেন। গোবিন্দপুর পাড়ায় শীতলনারায়ণ, স্বরূপনারায়ণ, রাজবল্লভ রায়, বাঁকুড়া রায় একত্রে একই মন্দিরে বিরাজ করেন এবং তাঁদের সঙ্গে জয়দুর্গা, কালীবুড়ী, রায়বুড়ী প্রভৃতি ধর্মকামিন্যাগণও থাকেন। জয়ন্তীপুর পাড়াতেও বহু ধর্মঠাকুর একত্রে বিরাজ করেন বলে দেখা যায়। চন্দ্রকোণার তিপান্ন গলির অন্তত তিপান্নটি ধর্মঠাকুর আজও কয়েকটি মন্দিরের ভিতর থেকে বোধহয় খুঁজে বের করা যায়। নরহরিপুর পাড়ায় কলকলি দেবী আছেন, ধর্মঠাকুরের কামিন্যা তিনি; প্রাচীন পঞ্চরত্ন দেবালয়ে ধর্মঠাকুর সহ তিনি বিরাজমান। মন্দিরের গায়ে লিপিটি নিম্নরূপ –

“প্রতিষ্ঠিতমিদং শাকে পক্ষাব্জবসুচন্দ্রমে
রাধাক্ষয়তৃতীয়ায়াম্ দিঙমানেকুব্জবাসরে
(১২৯০ সাল, ১০ই বৈশাখ)”

এর ঠিক বামদিকে আরেকটি ভগ্নলিপি আছে। তাতে লেখা আছে –

“কলকলি পদং ধ্যাত্বা তস্যা
গৃহমিদম্ … তাম্বুলি”

প্রায় ১২০-২২ বছর আগে, কোন এক তাম্বুলিবণিক মন্দিরটি কলকলি ধর্মকামিন্যার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরের মধ্যে বিরাট কূর্মমূর্তি ধর্মঠাকুর আছেন। চন্দ্রকোণায় যত ধর্মঠাকুর দেখা যায়, তার সবই কূর্মমূর্তি এবং এত জীবন্ত মূর্তি যে মনে হয় পাথরের নয়, রক্তমাংসের। তবে কেবলমাত্র চন্দ্রকোণায় নয়, পূর্বে ধর্মঠাকুরের যে প্রতিপত্তিকেন্দ্রের কথা আগে বলা হয়েছে, তার সর্বত্রই যেসব ধর্মঠাকুরের মূর্তি দেখা যায়, তার অধিকাংশই কূর্মমূর্তি। চন্দ্রকোণা, জাড়া, রামজীবনপুর, ঘাটাল, গোঘাট প্রভৃতি অঞ্চলে এত সুন্দর নিখুঁত সব বড় বড় কূর্মমূর্তি আছে, যা ভাষ্কর্যের নিদর্শন হিসেবেও উল্লেখযোগ্য। কেউ কেউ বলেন, ধর্মঠাকুরের কূর্মমূর্তিটা প্রধান নয়, একখণ্ড প্রস্তরমূর্তিই আসল। নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন জার্নালে এই ধরণের ঢালাই মন্তব্য-সংবলিত গবেষকদের উক্তি দেখা যায়। ধর্মঠাকুর সম্বন্ধে অধিকাংশ গবেষণা আজ পর্যন্ত কোনো সঠিক নিয়ম মেনে হয়নি, কিছুই প্রতিপন্ন হয়নি এবং অনুসন্ধানও কিছুই হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঠাকুরের কূর্মমূর্তিটাই প্রধান ও আসল, বাকি সব মূর্তি গৌণ ও বিকল্প মূর্তি, একথা আজ যথেষ্ট জোর দিয়েই বলা যায়। একথাও ঠিক যে বিষ্ণুর কূর্মাবতারের সঙ্গে এ-কূর্মের কোন সম্পর্ক নেই, কোনকালেই ছিল না। ধর্মের কামিন্যাদের জয়দুর্গা, কলকলি, কালীবুড়ী, রায়বুড়ী, রায়বাঘিনী ইত্যাদি নামও লক্ষণীয়। বন্য লোকধর্মের ধারা যে ধর্মপূজার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে মিশে গেছে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। একথাও অস্বীকার করা যায় না যে, বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও এর মধ্যে কিছুটা পড়েছে। অবিকল স্তূপের ন্যায় ছোট ছোট পাথরের স্তূপ চন্দ্রকোণা অঞ্চলের অনেক ধর্মমন্দিরে দেখা যায়। সেগুলো ভাস্করের খোদাই করা, হাতেগড়া পাথরের স্তূপ, স্বাভাবিক স্তূপাকৃতি প্রস্তরখণ্ড নয়। ধ্যানী বুদ্ধমূর্তির ন্যায় দু’তিন ইঞ্চি আকৃতির ছোট ছোট পাথরের মূর্তিও অনেক ধর্মমন্দিরে দেখা যায়। এগুলোর নিশ্চই কোন অর্থ আছে এবং একদা কোন অর্থ অবশ্যই ছিল। শৈবধর্মীরাও পরে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে ধর্মঠাকুরকে আত্মসাৎও করে ফেলেছেন। ধর্মঠাকুরের নামটি রয়ে গেছে, তবে তিনি হয়ে গেছেন শিব। এমনকি কোথাও কোথাও ধর্মঠাকুর বৈষ্ণবও হয়ে গেছেন এবং তাঁর নামের সাথে ‘নারায়ণ’ যুক্ত হয়ে গেছে।

কলকাতার ‘ধর্মতলা’ নামটির প্রসঙ্গেও ধর্মঠাকুরের যোগসূত্র অবশ্য উল্লেখ্য। কলকাতার ধর্মতলা নামকরণ সম্পর্কে পাদ্রী-ফিরিঙ্গী সাহেবদের অনেক জল্পনা কল্পনা আছে। যেমন – মুসলমানদের মসজিদ ছিল বলে নাকি ‘ধর্মতলা’ নাম হয়েছে! স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো অঞ্চলের ইতিহাসের যোগসূত্র সন্ধান না করে, বাইরে থেকে কিছু আরোপ করতে গেলে যা হয়, সাহেবদের অনেকেরই তাই হয়েছে। ধর্মঠাকুরের প্রধান্যের জন্যই ধর্মতলার নাম হয়েছে ধর্মতলা, মসজিদের জন্য নয়। মসজিদ বা পীঠস্থানের জন্য বঙ্গদেশের কোনো স্থানের নাম ধর্মতলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই এবং পশ্চিমবঙ্গে অন্ততঃ কোথাও চোখে পড়ে নি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ় থেকে ধর্মঠাকুরের পূজা ভাগীরথীর পূর্বতীরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কলকাতা পর্যন্ত যে প্রচলিত হয়েছিল, তা আজও বোঝা যায়। দক্ষিণে প্রাচীন আদিগঙ্গার তীর ধরে আজও ধর্মের ‘যাত’ হয়। কূর্মমূর্তি ধর্মঠাকুর সোনারপুরের বাজারে ডোমপণ্ডিত পূজা করেন এখনও। বর্তমান হাজরা রোড ও শরৎ বসু রোডের (পূর্বতন ল্যান্সডাউন রোড) মোড়ে একটি প্রাচীন ধর্মঠাকুরের মন্দির আছে, এখন শিবই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছেন। কসবা, বেহালা প্রভৃতি অঞ্চলেও ধর্মঠাকুর আছেন। পূর্বোক্ত সিমস সাহেবের রিপোর্টে দেখা যায় যে, একশো বছর আগে লালবাজার-রাধাবাজার অঞ্চলে ৩১,৬৮০ বর্গফুট জুড়ে বেশ একটি ‘ডোমতালা’ ছিল। ধর্মতলার পিছনে ছিল ‘হাড়িপাড়া লেন’। পশ্চিমবঙ্গের (রাঢ়ের) ধর্মঠাকুরের বিখ্যাত সেবক বা পণ্ডিত ডোম ও হাড়িজাতির বেশ প্রাধান্য ছিল ধর্মতলা অঞ্চলে দেড়শো বছর আগেও। যেখানে হাড়ি ও ডোমের এরকম প্রাধান্য ছিল, সেখানে কোনো ধর্মঠাকুর ছিল না একথা মনে হয় না। সারা কলকাতায় ধর্মঠাকুরের একসময়ে বেশ প্রতিপত্তি ছিল এবং তাঁর গাজনও হত। পরে ধর্মের গাজন শিবের গাজনে রূপান্তরিত ও লুপ্ত হয়েছে।

ধর্মদেবতার উৎপত্তি বহুমুখী। অর্থাৎ বিভিন্ন সূত্রে আগত বিভিন্ন দেবভাবনা ও দৈবচিন্তা মিশে গিয়ে এক হয়ে ধর্মঠাকুরের রূপ নিয়েছে। খুঁজলে এই সব সূত্র কিছুটা পাওয়া যায়।

প্রথমতঃ, ধর্ম সূর্যদেবতা। ধর্মমঙ্গলের কাহিনীতে এর প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্মপূজা তে তো পাওয়া যায়ই।

দ্বিতীয়তঃ, ধর্ম যমদেবতা। বেদে যম বিবস্বানের পুত্র, বৈবস্বত। সুতরাং এখানেও সূর্যের সঙ্গে যোগ। বেদে যম রাজা। ‘যমরাজ’ শব্দটির প্রয়োগ ঋগ্বেদেও আছে, পৌরাণিক সাহিত্যে তো কথাই নেই। বেদে না থাকলেও অন্যত্র যমরাজ সাধারণতঃ ধর্মরাজ বলেই উল্লেখিত। এর থেকেই ধর্মঠাকুরের নামটি এসেছে। ধর্মশিলায় বিশিষ্ট নামের শেষাংশ, যেমন – ‘বাঁকুড়ারায়’, ‘কালুরায়’, ‘মেঘরায়’, ‘চাঁদরায়’, ‘খুদিরায়’, ‘সুন্দররায়’, ‘বুড়ারায়’, ‘জগৎরায়’, ‘দলুরায়’ ইত্যাদি – ধর্মরাজের ‘রাজ’ থেকেই এসেছে। ধর্মঠাকুর রাজা-দেবতা, তার গাজনের অনুষ্ঠানে রাজসভার আকৃতি সুস্পষ্ট।

তৃতীয়তঃ, ধর্ম বরুণদেবতা। ঋগ্বেদে যম আর বরুণ, এই দুই দেবতাই বেশি করে রাজসন্মান পেয়েছেন এবং দুজনে একত্রেও বন্দিত হয়েছেন। ধর্মমঙ্গলের হরিশ্চন্দ্র পালার ধর্মদেবতা ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কথিত শুনঃশেফ কাহিনীর বরুণদেবতার সঙ্গে অভিন্ন। ধর্মঠাকুরের সাংজাত অনুষ্ঠান বৈদিক বরুণ-যজ্ঞের অনুরূপ। গাজনের দাদুড়ঘাটা পর্ব খানিকটা জলদেবতার পূজা-উৎসব।

চতুর্থতঃ, ধর্ম কুর্মদেবতা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ধর্মঠাকুরের শাস্ত্রে ও কাহিনীতে কোথাও ধর্মঠাকুরকে কুর্মদেবতা বলা হয়নি। কেবলমাত্র এটাই বলা হয়েছে যে কুর্ম তাঁর পাদপীঠ, অধিষ্ঠান। এই কারণে পরবর্তীকালের অর্থাৎ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে নির্মিত কুর্মাকৃতি ধর্মবিগ্রহের কুর্মের উপরে ধর্মের পদদ্বয় আঁকা থাকে। ব্রাহ্মণ্য পুরাণে কুর্ম বাসুকিকে ধারণ করে আছেন আর তাঁর উপরে রয়েছেন বসুমতী। ইনিই পুরাণে কুর্ম অবতার বলে বর্ণিত। ধর্মের কাহিনীর সঙ্গে এই কাহিনী মেলাতে গেলে নাগ হন ধর্মঠাকুর আর বসুমতী হন তাঁর কামিনী-কেতকা। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে কুর্ম অবতারের পূজার কোন বিধান আছে বলে জানা যায় না, কিন্তু লোক-ব্যবহারে যে আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই বিষয়ে আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে, ধর্মঠাকুরের নামটি এসেছে ধর্মের সমধ্বন্যাত্মক কোন অনার্য শব্দ থেকে – যদিও এর সমর্থনে কিছু পাওয়া যায় না। যমের সঙ্গে ধর্মের যোগ দৃঢ় ও নিগূঢ়। যমের ধর্মরাজ নাম প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই প্রসিদ্ধ হয়েছিল। সুতরাং ধর্মের নামের উৎপত্তি আর্যভাষার বাইরে খোঁজবার আবশ্যকতা নেই। অবশ্য অন্য দিক দিয়ে ধর্মপূজার সঙ্গে অনার্য আচার-অনুষ্ঠানের কিছু না কিছু যোগ কালে কালে অবশ্যই হয়েছে।

পঞ্চমতঃ, ধর্ম শূন্যমূর্তি দেবতা অর্থাৎ যাঁর কোন মূর্তি নেই। তিনি ব্রহ্ম-অণ্ড ভেদ করে উদ্ভূত হয়েছিলেন এবং তিনি ব্রহ্মাণ্ডের অসীম জলরাশির মধ্যে ত্রিকোণ পৃথিবী এবং ত্রিদেব – ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর – সৃষ্টি করে শূন্যে বিলীন হয়েছিলেন অর্থাৎ মারা গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্য পুরাণের ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা – অর্থাৎ বৃহৎ অণ্ড ভেঙে বিশ্বের উৎপত্তি – ধর্মঠাকুরের কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। ঋগ্বেদের সূক্তে (১০/১২৯) ‘তুচ্ছ’ অর্থাৎ কিছু না থেকে ডিমের আবির্ভাব এবং সে ডিমের দু’দিক থেকে – স্বধা ও প্রযতি – তা দেওয়ার উল্লেখ আছে। ডিম ভেঙে কি বেরলো, তার কোন স্পষ্ট বর্ণনা কোথাও নেই – না বৈদিক সাহিত্যে, না ব্রাহ্মণ্য পুরাণে, না ধর্মের কাহিনীতে। তবে এদিক ওদিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কিছুটা নির্ভরযোগ্য অনুমান খাড়া করা যায়। ধর্মকাহিনীর সৃষ্টি বর্ণনা থেকে মনে হয় যে তিনি ছিলেন সাপ। জলে ভাসতে ভাসতে হাই তোলেন। তার থেকে উলুক পাখির সৃষ্টি হয়। সেই পাখি হয় তাঁর বাহন। সেই বাহনে চড়ে উড়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে শেষে তিনি পৃথিবীর সৃষ্টি করেন। এখানে ব্রাহ্মণ্য পুরাণের সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায় – কুর্মের উপরে বাসুকি বা শেষনাগ, তার মাথায় পৃথিবী। ধর্মঠাকুরকে যে একদা – সম্ভবতঃ অতি প্রাচীন অনার্য বা অবৈদিক ঐতিহ্যে – সাপ বলে কল্পনা করা হত, তার প্রমাণ কি, এই প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রমাণ অবশ্যই আছে। গোড়ার দিকে মনসামঙ্গলের কাহিনী ধর্মকাহিনীর সঙ্গে অভিন্ন (মনসাই ধর্মের কামিনী)। বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল সবচেয়ে প্রাচীন। তাতে পাওয়া যায় যে, শিব মনসাকে সিজুয়া পর্বতে ফেলে রেখে আসবার সময়ে ‘ধামাই’কে সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর রক্ষক ও বাহন রূপে। ধামাই হলেন ধর্ম ও তিনি একটি সাপ। পরে হয়েছেন ‘ঢেমনা’ বা ‘ঢেরা সাপ’। এখানে মিল পাওয়া যাচ্ছে, বাসুকির উপরে বসুমতী = ধামাইয়ের উপরে মনসা। পুরাণে বর্ণিত কৃষ্লীলায় পাওয়া যায় যে, অক্রূর যখন কৃষ্ণবলরামকে বৃন্দাবন থেকে মথুরায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন যমুনার তীরে রথ রেখে তিনি যমুনার হ্রদে ডুব দিয়েছিলেন নাগরাজ শেষকে দর্শন ও বন্দনা করতে। হরিবংশে নাগ রাজাকে বলা হয়েছে ধর্মদেব, তিনি শুভ্র ও তিনি ধর্মাসনগত। নাগরূপী ধর্মদেবতার এক পরিণতি বাস্তুদেবতায়।

আরো পড়ুন- লেখাপড়া করে যে……..‌

ষষ্ঠতঃ, ধর্ম একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা দেবতা। এই দেবতার আবির্ভাব ধর্মমঙ্গলের কাহিনীর উদ্ভবের আগেই হয়েছে। ধর্মপূজাপদ্ধতি বর্তমান রূপ নেবার বেশ কিছুকাল আগে কোন কোন ধর্মমঙ্গল রচয়িতা তাঁকে সিপাহী বেশে কল্পনা করেছেন। এহেন কল্পনার মধ্যে দুটি উপাদান পাওয়া যায়। এক, ইরানীয় বুট পড়া সূর্যদেবতা – যাঁর বিশেষ উপাসক শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ এবং যিনি দুঃসাধ্য রোগের অপহর্তা রূপে উপাসিত হতেন। দুই, বিজয়ী মুসলিম শক্তির সিপাহী রূপ-কল্পনা – ইনিই ব্রাহ্মণ্য পুরাণে প্রোক্ত ভবিষ্যৎ কল্কি অবতার। ধর্মের থানে – এবং তার থেকে পীরের থানে – মাটির ঘোড়া দেওয়া এই যোদ্ধা দেবতারই বিশেষ অর্ঘ্য।

সপ্তমতঃ, ধর্ম একজন গোরূপ দেবতা। আসামের বোড়োদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, ধর্মঠাকুর মৃত গরুর রূপ নিয়ে তাঁর পুত্রদের ছলনা করেছিলেন। তাঁরা সে দেহ ভক্ষণ করেছিলেন। পৌরাণিক কাহিনীতে ধর্মকে বৃষ রূপে কল্পনা করা হয়েছে। সত্যযুগে তাঁর চার পা ছিল। তারপরে তিনযুগে একেকটি করে পা কমে তিনি কলিকালে কল্পিত হয়েছেন একপাদ রূপে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বৈদিক যুগের ঋষিরা দেবশক্তির প্রচণ্ডতা বোঝাতে বৃষের উপমা দিতেন। লোকসাংস্কৃতিক গবেষকরা মনে করেন যে, ধর্মপূজার বিধানে কলিমাজালাল প্রসঙ্গে যে গোহত্যার কথা উল্লেখিত আছে তা প্রাচীনতর গোরূপ-ধর্ম-ঐতিহ্যের এক নব গোমেধ সংস্করণ। মুসলিম রাজশক্তি যখন স্বাভাবিক উপায়ে ধর্মঠাকুরের সঙ্গে মিলে গেল তখন মৃত গোদেহ ভক্ষণের কাহিনীকে মুসলিমদের কুরবানীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া সহজ হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের ধর্মঠাকুরের মধ্যেও মুসলিম প্রভাব বেশ স্পষ্ট। ধর্মমঙ্গল-কবিরা ধর্মঠাকুর কে পীরের বেশেও দেখেছিলেন। রূপরাম চক্রবর্তী তো নিজেকে ‘রূপরাম ফকির’ বলেছেন। ফকিরবেশী ধর্মঠাকুরই মনে হয়, ক্রমে ‘সত্যপীর’ ও ‘সত্যনারায়ণ’ নামে দেবতায় বিবর্তিত হয়েছেন। এছাড়া নাথগুরু ‘মৎস্যেন্দ্রনাথ’ ও ‘পীর মসনদ-আলি’ মিলিত হয়ে ‘মছলন্দী’ বা ‘মোছরা পীর’ হয়েছেন। চব্বিশ পরগণাতেও ‘মছলন্দী’ বা ‘মোছরা পীর’ আছেন। ‘বড় খাঁ গাজী’ তো আছেনই দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে আপস করে। পীর বড়খাঁ গাজী (গাজীবাবা, গাজী সাহেব, মোবারক শাহ গাজী, বরখান গাজী ইত্যাদি নামেও পরিচিত) পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা অঞ্চলের তথা দক্ষিণ বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের অন্যতম প্রধান পীর।

অষ্টমতঃ, ধর্ম শ্বেতপক্ষী। ইনিই আবার ধর্মঠাকুরের বাহন ও মন্ত্রী উলুক, বেদে যমের দূত শ্বেত কপোত রূপে কল্পিত। কোন কোন ধর্মমঙ্গল রচয়িতার কাছে ধর্মঠাকুর আবার শঙ্খচিল রূপে দেখা দিয়েছিলেন।

এভাবে আরও সূত্রগত ভাবনা ধর্মঠাকুরের কল্পনায় এসে মিলিত হয়েছে। যদিও সেসব আরও পরবর্তীকালের যোজনা এবং বর্তমান আলোচনার জন্য ততটা প্রয়োজনীয় নয়।

(তথ্যসূত্র:
১- পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ।
২- The Myths and Gods of India: The Classic Work on Hindu Polytheism from the Princeton Bollingen Series, Alain Daniélou, Simon & Schuster (১৯৯১)।
৩- হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, ডা. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কে.এল.এম প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৬০)।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯০১ সালে গান্ধীজী বেলুড় মঠে স্বামীজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তবে সেবারে শ্রান্ত-ক্লান্ত গান্ধীজীর সঙ্গে বিবেকানন্দের দেখা হয় নি। কারণ, স্বামীজী তখন অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু

‘বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক মূল্য’‘বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক মূল্য’

রানা চক্রবর্তীঃ সব মহাকাব্যই ‘কাব্য’ কিন্তু সব কাব্য ‘মহাকাব্য’ নয়। মহাকাব্যের নিরিখ নানা সাহিত্যে নানা সংজ্ঞায় নিরূপিত হয়েছে। তবে, মোটের ওপর বিগত পাঁচ হাজার বছরের বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়

পতনোন্মুখ হোসেনশাহী ও শের খাঁর উত্থানপতনোন্মুখ হোসেনশাহী ও শের খাঁর উত্থান

রানা চক্রবর্তীঃ হোসেন শাহের মৃত্যুর পরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘নসরৎ শাহ’ হোসেনশাহী মসনদে আরোহণ করেছিলেন। তবে প্রথানুযায়ী তাঁকে যে তাঁর ১৭ জন ভাইয়ের বিরুদ্ধে মসনদের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়

জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ও তৎকালীন বাংলাজাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ও তৎকালীন বাংলা

রানা চক্রবর্তীঃ আকবরের মৃত্যুর পরে শাহজাদা সেলিম ‘জাহাঙ্গীর’ নাম নিয়ে মোঘল মসনদে আরোহণ করবার পরে রাজা মান সিংহ বাংলায় তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবার জন্য পুনরায় রাজমহলে ফিরে এসেছিলেন। তিনি