পতনোন্মুখ হোসেনশাহী ও শের খাঁর উত্থান - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ পতনোন্মুখ হোসেনশাহী ও শের খাঁর উত্থান

পতনোন্মুখ হোসেনশাহী ও শের খাঁর উত্থান


রানা চক্রবর্তীঃ হোসেন শাহের মৃত্যুর পরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘নসরৎ শাহ’ হোসেনশাহী মসনদে আরোহণ করেছিলেন। তবে প্রথানুযায়ী তাঁকে যে তাঁর ১৭ জন ভাইয়ের বিরুদ্ধে মসনদের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ করতে হয় নি, সেটা থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর কূটনীতিজ্ঞান প্রখর ও হৃদয়াবেগ কোমল ছিল। নিজের ভাইদের অন্ধ বা কারারুদ্ধ করবার পরিবর্তে তিনি তাঁদের প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ও নিজের মর্য্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়ে তাঁদের সকলের অভিভাবক হয়ে বসেছিলেন। এর বছর পঁচিশেক আগে তাঁর পিতা হোসেন শাহ দিল্লীশ্বর ‘সিকান্দার লোদী’র আক্রমণ প্রতিহত করবার পর থেকেই গৌড়ের পশ্চিম সীমান্তে আর কোন প্রকারের ঘটনা সংঘটিত হয় নি। তখন থেকেই লোদী ও হোসেনশাহী – উভয় রাজ্যই পরস্পরের স্বাধীনতা মেনে নিয়ে নিজেদের শাসনকার্য পরিচালনা করছিল। কিন্তু নসরৎ শাহের সময়ে লোদী সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরেছিল, তাঁর মসনদে আরোহনের দুই বছরের মধ্যেই লোদীদের একজন সৈন্যাধ্যক্ষ, ‘বাহার খাঁ লোহানি’ বিহারে এসে নিজের একটি স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই লোদী-লোহানি সংঘর্ষের সুযোগ নিয়ে নসরৎ শাহ প্রায় বিনা বাধায় পশ্চিমদিকে হাজীপুর পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ অধিকার করে নিয়ে নিজের রাজ্যের সীমান্তকে গণ্ডক নদী পর্যন্ত প্রসারিত করেছিলেন। এর কিছু দিন পরে মোঙ্গলবীর ‘বাবর’ পাণিপথের প্রথম যুদ্ধে ‘ইব্রাহিম লোদী’কে পরাজিত করবার ফলে তুর্কী ও আফগান সর্দারেরা আশ্রয়ের জন্য দলে দলে পূর্ব দিকে পালিয়ে আসবার ফলে নসরৎ শাহ তাঁদের সংঘবদ্ধ করে মোঘলদের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ১৫২৬ খৃষ্টাব্দে বাবরের পুত্র ‘হুমায়ুন’ যখন সবাইকে পরাভূত করে ঘর্ঘরা নদী পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন, তখন নসরৎ উভয় পক্ষকে দেখিয়েছিলেন যে, সেই মোঘল-আফগান সংঘর্ষে গৌড় নিরপেক্ষ রয়েছে। নসরৎ তুর্কীও ছিলেন না, আবার আফগানও ছিলেন না। ওই দুই জাতির কারোর রক্তই তাঁর দেহে না থাকবার জন্য তিনি সেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বার প্রয়োজনবোধ করেন নি। বৎসরাধিক ধরে তিনি একজন মোঘল দূতকে নিজের দরবারে রেখেছিলেন, এবং পরে মূল্যবান উপঢৌকনসহ নিজের একজন দূতকে বাবরের দরবারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এইভাবে নসরৎ শাহ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলেছিলেন। মোঘল আফগান দ্বন্দ্বে তিনি বাবরের সঙ্গে যেমন সৌহার্দ্য রক্ষা করেছিলেন, তেমনি আবার গোপনে আফগানদের সাহায্য করেছিলেন। এরপরে বাহার খাঁ লোহানির মৃত্যুতে বিহারের আফগানরা অসহায় হয়ে পড়লে বাবর অতি সহজেই গঙ্গা পার করে বক্সারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময়ে আরেকজন আফগান সর্দার, ‘শের খাঁ শূর’ (শূরী) মোঘলদের আধিপত্য মেনে নিয়ে বাহার খাঁর বালক পুত্র ‘জালাল লোহানি’র অধীনে গঠিত নতুন রাজ্যের অস্তিত্বকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছিলেন। তাতে নসরৎ শাহের বিপদ দেখা দিয়েছিল। কারণ, তাঁকে একদিকে যেমন মোঘল বিরোধীদের সক্রিয় করে রাখতে হচ্ছিল, আবার অন্যদিকে তেমনি বাবরের সঙ্গেও সদ্ভাব ক্ষুণ্ণ করলে বিপদের আশঙ্কা ছিল। তিনি জানতেন, সেই সংঘর্ষে যে কোন এক পক্ষ নিঃশেষ হলেই, অন্যপক্ষ বিপদ হয়ে তাঁর দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হবে। ওই সময়েই হঠাৎ এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল। দিল্লীর তখতের নতুন দাবীদার ‘মামুদ লোদী’ বাবরের সঙ্গে বিরোধ নিরর্থক বুঝতে পেরে বিহারে চলে এসে বালক জালালের হাত থেকে ওই রাজ্যটি অতি সহজেই অধিকার করে নিয়েছিলেন। তখন অধিকাংশ বিক্ষুব্ধ আফগান সর্দার তাঁকে নিজেদের নায়ক বলে মেনে নিলেও লোহানিরা কিন্তু তাঁর উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। রাজ্যহারা জালাল লোহানি হাজিপুরে গিয়ে নসরৎ শাহের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু নসরৎ তাঁকে অস্বীকার করে মামুদ লোহানিকে সকল আফগানের নায়ক বলে মেনে নেওয়ার ফলে অসহায় জালাল তখন খোদ বাবরের কাছেই সাহায্য ভিক্ষা করে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে কথা জানতে পেরে আফগানরা তাঁকে নজরবন্দী করে রেখে বাবরের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। শের খাঁ সেই ফ্রন্টে যোগ দিলে মোঘলদের বিরুদ্ধে একটি ত্রিমুখী অভিযান চালাবার পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫২৯ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে মামুদ লোদী ও শের খাঁ তাঁদের নিজের নিজের সৈন্যবাহিনীসহ গঙ্গার উভয় তীর ধরে চূনার ও বারাণসীর দিকে এবং ‘বিবন’ ও ‘বায়াজিদ’ ঘর্ঘরা নদী পার করে গোরখপুরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। শের খাঁ বারাণসী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সেই নগরী অধিকার করেছিলেন, এবং বিবন ও বায়াজিদ মন্থর গতিতে হলেও তাঁদের লক্ষ্যের দিকে এগোতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সর্বাধিনায়ক মামুদ লোদী ছিলেন দুর্বলচেতা। যেই তিনি যেই শুনতে পেয়েছিলেন যে, মোঘলরা সোজা তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন, তখনই তিনি ভীতিবিহ্বল চিত্তে মাহোবার দিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাই তাঁর পক্ষে চুনার অধিকার করা আর সম্ভব হয়নি। তাঁর কাপুরুষতার জন্যই আফগানদের সেই চমৎকার পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। সেই ব্যর্থতার ফলে শের খাঁর সামনে একটা মহা সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন কোন উপায়ন্তর না দেখে তিনি বারাণসী থেকে নিজের অধিকার তুলে নিয়ে সোজা বাবরের কাছে গিয়ে আরেকবার আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এসবের ফলে আফগানদের সম্মিলিত শক্তি তখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, এবং বাবর একেবারে গৌড় সীমান্তে গিয়ে উপনীত হয়েছিলেন। আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে গৌড়েশ্বর নসরৎ শাহ যে কোনও পক্ষে যোগ দেন নি, সে কথা মনে রেখেই বাবর আর পূর্বদিকে এগিয়ে যাননি বটে, কিন্তু তিনি নসরৎ শাহের লিখিত নিরপেক্ষতা দাবী করে তাঁর কাছে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। বাবরের আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নসরৎ-এর মনে কোন সন্দেহ ছিল না, তাই তিনি তৎক্ষণাৎ সেই পত্রের উত্তর পাঠাবার পরিবর্তে মোঘল দূতকে নানা অছিলায় নিজের রাজধানীতে অথিতি করে বসিয়ে রেখেছিলেন। নসরৎ শাহের কূটবুদ্ধিতে বিস্ময়বিমূঢ় হলেও বাবরের পক্ষে ওভাবে তখন সময় নষ্ট করা সম্ভব ছিল না; তাই তিনি নিজের আরেকজন দূতকে নসরৎ শাহের কাছে চরম পত্র সহ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেবারে তিনি আর নসরৎ শাহের নিরপেক্ষতা দাবী করেন নি, সোজা তাঁর আত্মসমৰ্পণ চেয়েছিলেন। তাঁর পরিষ্কার কথা ছিল যে, হয় নসরৎ মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করুন, আর নয়তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। নসরৎ শাহ শেষপর্যন্ত যুদ্ধের পথই বেছে নিয়েছিলেন। এরপরে তিন দিন ও তিন রাত ধরে উভয় পক্ষের পদাতিক, অশ্বারোহী ও নৌবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংগ্রাম চলেছিল। নসরৎ শাহের সৈন্যরা মরণপণ করে যুদ্ধ করেও বাবরের উৎকৃষ্টতর রণকৌশলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেন নি। তাঁদের পর্য্যুদস্ত করে মোঘল ফৌজ ছাপরায় গিয়ে উপস্থিত হওয়ার পরে, উপায়ান্তরবিহীন নসরৎ শাহ বাবরের সব শর্ত পুরাপুরিভাবে মেনে নিয়ে সন্ধি প্রার্থনা করে তাঁর কাছে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন। বাবর তাতে সম্মতি দিলে বালক সুলতান জালাল লোহানি তাঁর অধীনে বিহারের শাসনকর্তা বলে স্বীকৃত হয়েছিলেন, এবং গৌড়-বঙ্গের উপরে নসরৎ শাহর সার্বভৌম অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। কোন যুদ্ধে পরাজয়ের পরে বিজয়ী শত্রুর কাছ থেকে এর থেকে উদার ব্যবহার আশা করা সম্ভব নয়। কিন্তু নসরৎ শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেই সন্ধির আড়ালে বাবর আসলে যুদ্ধের পরিশ্রম থেকে সাময়িক বিরতি চেয়েছিলেন, সদ্য বিজিত সাম্রাজ্যে তাঁর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হলেই তিনি পুনরায় তাঁর সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন। সেই কারণে গৌড়-বঙ্গ থেকে তাঁর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই নসরৎ পুনরায় আফগান সর্দারদের সঙ্গে গোপনে চক্রান্ত শুরু করেছিলেন। লোহানিরা তখন মোঘলদের উপগ্রহে পরিণত হয়েছিলেন বলে, তাঁদের উপরে তিনি আর নিজের আস্থা রাখতে পারেন নি। তাই নসরৎ তাঁদের বাদ দিয়ে শের খাঁ, মামুদ লোদী, বিবন ও বায়াজিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে চতুর শের খাঁ যখন দেখেছিলেন যে, লোহানিদের অপসারণ সম্বন্ধে বাবর বিরোধীরা সকলেই একমত রয়েছেন, তখন তিনি হঠাৎই ঝটিতি আক্রমণে জালাল লোহানিকে সরিয়ে দিয়ে বিহার হস্তগত করে নিয়েছিলেন। সেই সংবাদ দিল্লীতে বাবরের কাছে পৌঁছানোর পরে তিনি যখন আবার পূর্বাঞ্চলে সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এমন সময়ে একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল।

বাবরের পুত্র হুমায়ুন যেমন অলস, তেমনি বিলাসী ছিলেন। তিনি সারা দিন আফিমের নেশা করে বুঁদ হয়ে থাকতেন, আর হাজারখানেক গৃহভৃত্য তাঁর পরিচর্যা করতেন। তাই ওই ধরণের একজন অকর্মণ্য যুবক যে তাঁর তেজোদীপ্ত পিতার মত পূর্ব ভারতে গিয়ে পুনরায় কোন উৎপাত করতে পারবেন না, সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে বিহারের আফগান সর্দারেরা তখন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলেন। মামুদ লোদী পুনরায় তাঁদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে বায়াজিদকে ডাইনে ও শের খাঁকে বামে রেখে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। দিল্লীতে আফগান আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁদের সবাইকে বিভোর করে তুলেছিল। তাঁদের আগমনে জৌনপুরে অবস্থানকারী মোঘল ফৌজ বিনা যুদ্ধে নিজেদের ছাউনি ছেড়ে চলে গেলও, আফগানরা কিন্তু তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করবার পরিবর্তে সোজা লখনৌতির দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। হুমায়ুন নেশাড়ু হলেও আফগানদের সেই অভিযানের সংবাদে নিশ্চেষ্ট থাকতে পারেন নি। তাই তাঁদের অগ্রগতি প্রতিরোধ করবার জন্য সসৈন্যে পূর্ব দিকে রওনা হয়েছিলেন। শেষে ‘দাদরা প্রান্তরে’ উভয় বাহিনীর মধ্যে সাক্ষাতে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মোঘল সৈন্যাধ্যক্ষদের উৎকৃষ্টতর নেতৃত্বের ফলে আফগানরা বিধ্বস্ত হয়েছিলেন, এবং শের খাঁ পুনরায় নিজের রাজনৈতিক রঙ বদল করে, মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে চূনার দুর্গের আধিপত্য লাভ করেছিলেন। সেবারের সেই মোঘল-পাঠান যুদ্ধেও গৌড়েশ্বর নসরৎ শাহ নিরপেক্ষ ছিলেন। অথচ পূর্ব ভারতে তখন কোন উল্লেখযোগ্য শক্তি বলতে তিনি একাই ছিলেন। নিজের স্বার্থে তিনি আফগানদের গোপনে আর্থিক সাহায্য করলেও, কখনো কিন্তু সামরিক সাহায্য করে মোঘলদের বিরাগভাজন হন নি। দাদরার যুদ্ধে যখন সেই আফগান শক্তি পরাজিত হয়েছিল, তখন তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, তিনি নিরপেক্ষ থাকলেও হুমায়ুন সেটা থাকবেন না। ওই যুদ্ধে জয়ের ফলে গৌড়ের পশ্চিম তোরণ মোঘলদের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, এবং সেদিক থেকে মোঘলদের আঘাত হানাটা সময়ের অপেক্ষামাত্র ছিল। অথচ একক শক্তিতে হুমায়ুনের সম্মুখীন হওয়ার সাধ্য নসরৎ শাহের ছিল না। আবার তাঁর রাজ্যের পূর্ব সীমান্তও তখন আর নিরাপদ ছিল না। নসরৎ জানতেন যে, তিনি কোনোভাবে মোঘলদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেই পূর্বদিক থেকে অহমরা গৌড় আক্রমণ করে বসতে পারেন। তাই সবদিক বিবেচনা করে তিনি অন্যত্র বন্ধুর সন্ধান করতে শুরু করেছিলেন। ওদিকে গুজরাটে ‘বাহাদুর শাহের’ও তখন একই দশা ছিল। ইব্রাহিম লোদী যখন দিল্লীতে রাজত্ব করছিলেন, তখন তিনি তাঁর আধিপত্যকে অস্বীকার করে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করেছিলেন। দুর্বলচেতা ইব্রাহিম তাঁর শাসনকালে কোন বিদ্রোহীকেই দমন করতে পারেন নি, তাই বাহাদুর শাহও তাঁর হাতের নাগালের বাইরে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু লোদীর পতনের পরে বাহাদুর রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি জানতেন যে, লোদী সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে বাবর যেকোন দিনই তাঁর কাছে আনুগত্য দাবী করতে পারেন। সেই কারণে নসরৎ শাহের প্রেরিত দূত ‘মালিক মারজান’ যখন তাঁর কাছে গিয়ে মৈত্রীর প্রস্তাব করেছিলেন, তখন তিনি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলেন। নসরৎকে সবরকমের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি নিজের সৈন্যবাহিনীকে মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওদিকে বাহাদুর নিজের শক্তি বৃদ্ধি করছেন শুনে হুমায়ুন গুজরাটে যুদ্ধযাত্রার জন্য আয়োজন শুরু করে দিয়েছিলেন। বাহাদুর-নসরৎ সদ্যসমাপ্ত সন্ধির শর্তানুসারে নসরৎ-এর সেই সময়ে হুমায়ুনকে পিছনদিক থেকে আক্রমণ করবার কথা ছিল, কিন্তু তখনই তাঁর জনৈক ক্রীতদাস তাঁকে গোপনে হত্যা করবার ফলে সেইসব পরিকল্পনা অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল।

সেই হত্যাকাণ্ডের পিছনে ছিলেন নসরৎ শাহের এক অগ্রজ – ‘আবদুল বদর’। নসরৎ হত্যার কিছু দিন পরেই তিনি নসরৎ-এর পুত্র ‘আলউদ্দীন ফিরোজ’কে শমন সদনে পাঠিয়ে দিয়ে বাংলার মসনদ আত্মসাৎ করবার পরে তাঁর সুলতানী নাম হয়েছিল ‘গিয়াসুদ্দীন মামুদ’। কিন্তু তাঁকে ওই ভাবে মসনদ অধিকার করতে দেখে হাজীপুরের শাসনকর্তা ‘মকদুম শাহ’ তাঁর অন্যান্য আমীরদের নিজের দলে টেনে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে শুরু করেছিলেন। তাতে হুমায়ুনের সুবিধা হয়েছিল। কারণ সেই সময়ে তিনি গুজরাটে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকবার জন্য, গৌড়-বিহারের বিরোধী শক্তিগুলি ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাঁকে তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত সম্বন্ধে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন থাকতে হত। মামুদ-মকদুম সংঘর্ষ তাঁকে সেই উদ্বেগের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। মামুদ-মকদুম যখন পরস্পরকে নিধনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, হুমায়ুন তখন নিজের সমস্ত শক্তিকে বাহাদুরের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করে দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধ শেষ হলে হুমায়ুন যে পূর্ব ভারতে আসবেন, সেকথা বুঝতে পেরেও মকদুম শের খাঁকে নিজের দলে টেনে নিয়ে গিয়াসুদ্দীন মামুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ওই যুদ্ধের প্রথম দিকেই মামুদ শাহের উজীর ‘কুতুব খাঁ’ নিহত হওয়ার ফলে তিনি আরো বৃহত্তর একটি সৈন্যবাহিনীকে মকদুম শাহের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মকদুম দেখেছিলেন যে, শত্রুর তুলনায় তাঁর সৈন্যবল একেবারেই নগণ্য। সেই কারণে তিনি তাঁর বিপুল ধন দৌলতের নিরাপত্তার জন্য সেগুলিকে শের খাঁর কাছে চূনার দুর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরে মামুদ শাহ স্বয়ং হাজীপুরে গিয়ে মকদুমকে যুদ্ধে কোণঠাসা করে দিলেও, শেরের গায়ে কিন্তু কোন আঁচড় কাটতে পারেন নি। বরং মকদুমের গচ্ছিত অর্থ দিয়ে শের সৈন্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই তাঁর নিজস্ব শক্তিবৃদ্ধির শুরু হয়েছিল, এবং এরপরেই ভারতের ইতিহাসের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠেছিলেন আফগান বীর শের খাঁ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘ইলিয়াসশাহী’ বংশের পতন‘ইলিয়াসশাহী’ বংশের পতন

পিতা ‘সিকান্দার শাহের’ বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করবার পরে নিজের ষোলজন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের চোখ উপড়ে নিয়ে ‘গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ’ ইলিয়াসশাহী বংশের তখতে আরোহন করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনিই ইলিয়াসশাহী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান

‘চৈতন্য সাহিত্যে খর্বিত চৈতন্য চরিত্র’‘চৈতন্য সাহিত্যে খর্বিত চৈতন্য চরিত্র’

রানা চক্রবর্তীঃ বিভিন্ন চৈতন্য জীবনীকারেরা নিজেদের লেখায় এমন অনেক কথা বলেছিলেন, যা চৈতন্য-জীবনের মূল আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। যে বিশ্বম্ভর ‘শৈব-গায়েনের’ পিঠে চড়ে আনন্দে নৃত্য

মহাভারতের বিবর্তন – সনাতন ধর্মের বিবর্তন’মহাভারতের বিবর্তন – সনাতন ধর্মের বিবর্তন’

তারা চক্রবর্তীঃ পণ্ডিতদের মতে মহাভারত মহাকাব্যের ‘সূচনা’ এবং ‘চূড়ান্ত রূপায়ণ’ এই দুই পর্বের মধ্যে প্রায় আট শতাব্দী সময় কেটে গিয়েছিল – মূল বীর গাথা যা এই মহাকাব্যের বীজ এবং তার

‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯৪০-এর দশকে কেউ যদি সর্বদেশীয় মেয়েদের নামের মিলন যদি দেখতে চাইতেন, তাহলে তাঁর পুরানো কলকাতার একটি ষ্টীমার ঘাটে গেলেই চলত। সেখানে তখন থরে থরে গঙ্গার বুকের উপরে বাড়ির