ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ ১৯০১ সালে গান্ধীজী বেলুড় মঠে স্বামীজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তবে সেবারে শ্রান্ত-ক্লান্ত গান্ধীজীর সঙ্গে বিবেকানন্দের দেখা হয় নি। কারণ, স্বামীজী তখন অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু সেবারে নিবেদিতার সঙ্গে কলকাতায় তাঁর দেখা হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে, তাঁদের মধ্যেকার সেই সাক্ষাৎকার ও পারস্পরিক আলোচনা মোটেও সুখকর হয় নি। সেটা না হওয়াই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কেননা গান্ধীজী যেখানে অহিংসার মাধ্যমে গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে তৎপর ছিলেন, নিবেদিতা সেখানে সহিংস বিপ্লবীবাদের ‘উপদেষ্টা’ ছিলেন। গান্ধীজীর সঙ্গে বিবেকানন্দের দেখা হলে কি হত – সেই প্রশ্নের উত্তর এখন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস বলে যে, বিবেকানন্দের পরে জননায়ক রূপে যাঁরা ভারতে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন – তাঁরা হলেন গান্ধীজী ও নেতাজী। ১৯২১ সালের ৩০শে জানুয়ারী তারিখে স্বামী বিবেকানন্দের ৫৯তম আবির্ভাব তিথির দিন স্ত্রী ‘কস্তুরবা’, ‘মতিলাল নেহরু’ ও ‘মহম্মদ আলি জিন্না’ সহ গান্ধীজী আবার বেলুড় মঠে এসেছিলেন। সেবারে ‘স্বামী শিবানন্দ’ তাঁদের স্বামীজীর ঘরে নিয়ে গেলে গান্ধীজী তাঁর নানা জিজ্ঞাসার সদুত্তর পেয়ে স্বামীজীকে নিজের প্রণতি জানিয়েছিলেন। সেদিন বেলুড়ে স্বামীজীর বাড়ির বাইরে গঙ্গার ধারের মাঠে গান্ধীজীকে দেখবার ও তাঁর ভাষণ শোনবার জন্য বহু মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। ওই দিন গান্ধীজী স্বামীজীর বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে সেখানে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আজ আমি এখানে স্বামী বিবেকানন্দকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাতে এসেছি। আমি গভীর নিমগ্নতার সঙ্গে বিবেকানন্দের রচনাবলী পড়েছি এবং মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার দেশাত্ববোধ ও দেশের প্রতি ভালোবাসা তাঁর রচনাবলী পড়ে প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকের এই পুণ্যদিনে আমি আপনাদের কাছে কোন বক্তৃতা করব না। স্বাধীনতা আন্দোলনের কোন ফরমানও জারি করব না। শুধু যুবকদের উদ্দেশ্যে বলব যে, আপনারা এই পবিত্রভূমি থেকে এক টুকরো মাটি নিয়ে যান আর আপনাদের অন্তরে যে বারুদ রয়েছে তার সঙ্গে এই মাটির সংযোগ ঘটান, তাতে যে হাজার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দেবে সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে।” (History of Ramakrishna Math and Ramakrishna Mission, Swami Gambhirananda, P- 223) গান্ধীজীর এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে যায় যে, তাঁর নেতৃত্বাধীন অহিংস পথবাহী নানা আন্দোলনও বিবেকানন্দের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। তাঁর উত্তরসূরী ‘পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু’ও দেশপ্রেম জাগবণের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের ঋণ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “অতীতের মধ্যে প্রোথিত তাঁর মূল, ভারতের ঐতিহ্যের গর্বে পূর্ণ তিনি – তথাপি জীবন সমস্যার সমাধানে আধুনিক দৃষ্টিসম্পন্ন – বিবেকানন্দ অতীত ভারত ও বর্তমান ভারতের মধ্যে সেতুস্বরূপ। হতচেতন হতোদ্যম হিন্দুমনের কাছে সঞ্জীবনী সুধার মতো তাঁর আবির্ভাব। তিনি তাঁদের মধ্যে আত্মনির্ভরতার মনোভাব সৃষ্টি করেছিলেন, এবং তাঁদেরকে অতীতের প্রাণপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। তাঁর কাছে আমরা সকলেই ঋণী।” (Discovery of India, First Edition, P- 269) প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গান্ধীজী শুধু রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণকেন্দ্র বেলুড় মঠে যাননি, তিনি ভারতবষের বিভিন্ন প্রান্তে ও ভারতবর্ষের বাইরের অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের নানা শাখা কেন্দ্রেও গিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালের ১৩ই নভেম্বর তারিখে শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের কলম্বো কেন্দ্রে গিয়ে তিনি অভিভূত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “বিবেকানন্দের নাম যাদুমন্ত্রস্বরূপ। ভারতবর্ষের জীবনে তিনি অনপনেয় প্রভাব রেখে গেছেন।” (Gandhi’s work, Vol. 35, First Edition, P: 233-34 & 136) ১৯২৯ সালের ১৪ই মার্চ তারিখে রেঙ্গুনের রামকৃষ্ণ মিশনে অনুষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবে গান্ধীজী শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী নিয়ে একটি সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এবং তাঁর ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র ব্যাপক কর্মযজ্ঞের প্রশংসা করেছিলেন। বিবেকানন্দ যে তাঁর আচার্যের নির্দেশকে বাস্তবায়িত করে ভারতবর্ষ তথা সার্বিক মানুষের কল্যাণের পথটি প্রশস্ত করেছেন, সেকথাও সেদিন তিনি তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন। ১৯২৯ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে গান্ধীজী পোতনুরুতে বিবেকানন্দ লাইব্রেরীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, এবং ঐ বছরেরই নভেম্বর মাসে বৃন্দাবনে গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম দর্শন করেছিলেন। (Gandhi’s work, Vol. 40, First Edition, P- 144) কন্যাকুমারীতে গিয়ে গান্ধীজী গভীরভাবে তাঁর আত্মার শান্তি ও চিত্তের আনন্দ অনুভব করতে পেরেছিলেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বে গণ আন্দোলনে বিবেকানন্দের প্রভাব অপরিসীম ছিল, এবং সেটা ছিল প্রধানতঃ দুটি ক্ষেত্রে – (ক) জাতিভেদজাত অস্পৃশ্যতা বর্জনে, ও (খ) দারিদ্র্য দূরীকরণে। এই দুটি ক্ষেত্রে তিনি বিবেকানন্দের যন্ত্রণাময় চিন্তার উত্তরাধিকার নিয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সামাজিক অংশ এই দুটি সমস্যার সমাধানে নিয়োজিত ছিল। এজন্যই তিনি তাঁর হরিজন আন্দোলন ও চরকাতত্ত্ব প্রবর্তন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে নারী জাগরণের বিষয়ে গান্ধীজীর প্রয়াস বিবেকানন্দের চিন্তারই দ্যোতনা হয়ে দেখা দিয়েছিল। গান্ধীবাদী আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বয়েরই নামান্তর ছিল।

আরো পড়ুন- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন (প্রথম পর্ব)

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে ‘রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘লালা লাজপত রাই’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ’, ‘ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ’, ‘সরোজিনী নাইডু’, ‘সৈয়দ ফজল আলি’ প্রমুখরা বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন। ওই সময়ের সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যে ‘পি. মিত্র’, ‘সতীশ বসু’, ‘বারীন্দ্রকুমার ঘোষ’, ‘ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘মতিলাল রায়’ প্রমুখরা সশ্রদ্ধ চিত্তে বিবেকানন্দের দ্বারা নিজেদের অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন, এবং রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান এবং শাখা কেন্দ্রে নিয়মিত যাতায়াতের মাধ্যমে আরো বেশি বলিষ্ঠতর অভী মন্ত্রে রঞ্জিত হতে পেরেছিলেন।
পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও প্রসারে বিবেকানন্দের বৈদান্তিক চিন্তা যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, সেকথা একালের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ‘সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত’ খোলাখুলি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। জাতীয়তাবোধ তৈরী হয় দেশ ও দেশের মানুষকে কেন্দ্র করে। তাই বিবেকানন্দ প্রাথমিকভাবে দেশের পিছিয়ে পড়া অজ্ঞ, মূর্খ, কাতর, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষদের উন্নতি বিধানে, এবং শিক্ষা-সচেতনতার মধ্যে দিয়ে দেশাত্মবোধ যা জাতীয়তাবোধেরই নামান্তর – তার জাগরণে জোর দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের অভিমত সেটারই সম্পূরক –
(১) Vivekananda’s writings on nationalism have made a more powerful Impact than those of other writers because they have a broader base and also because they stem from a philosophy that might be called perennial. Although he was a Hindu monk, preaching a certain form of Vedanta, it is no catholic that men of all faiths, including atheists and agnostics, may draw inspiration from his writings, which preach Spirituality but do not recognize any heaven beyond the earth, and he never loses sight of the temporal forces-racial, economic and political-which sustain our quest for the beyond.” (Swami Vivekananda and Indian Nationalism, Subodh Chandra Sengupta, P- 61)
(২) Son of Solicitor, Vivekananda himself belonged to the upper stratum of society, and he spoke to many educated audiences both at home and abroad. But his eyes were fixed on the dumb, labouring millions of India on whom the future of the nation lay. It is the eradication of their poverty and illiteracy which was his first concern. No dogmas, said he, would satisfy the cravings of hunger; rather our leaders should first try to give a piece of better bread and a piece of better rag to the sunken millions. The upper classes are mummies, because their vitality has been sapped by centuries of parasitism and exploitation. The masses are like the sleeping Leviathan. The Leviathan will wake up one day; that is to say. The advent of the shudras will supersede the domination of Priestly Brahimins, warlike Kshatriyas and prosperous Vaishyas. This would mean a better distribution of material wealth, which might involve a lowering of the standard of culture. But if we place Swamiji’s exhortation about the awakening of the masses in the context of his philosophy as a whole, we cannot miss his emphasis on the antidote to this probable deterioration in culture. The masses should be raised from their abysmal poverty, but they should also be educated spiritually. That is the mission of India as a nation, and there she would find the panacea that has eluded Western materialism.” (Swami Vivekananda and Indian Nationalism, Subodh Chandra Sengupta, P: 72-73)
রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রকে দেশনায়কের পদে বরণ করে নিলেও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আসলে স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য ছিলেন। কবি ‘মোহিতলাল মজুমদার’ বলেছিলেন যে, নেতাজী স্বামীজীর মানসপুত্র ছিলেন। সুভাষচন্দ্র গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে, বিবেকানন্দ বেঁচে থাকলে তিনি তাঁরই শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন। কোনদিন মুখোমুখি দেখা না হলেও বিবেকানন্দের চিন্তা-ভাবনাকেই সুভাষচন্দ্র প্রগাঢ়ভাবে তাঁর নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছিলেন। প্রথম যৌবনে ‘গোগ্রাসে’ বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা ‘গিলবার’ মধ্য দিয়ে বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, সেটা ভারত থেকে তাঁর ‘মহানিষ্ক্রমণ’ পর্যন্ত অটুট ছিল। কটক থেকে কলকাতা, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কেমব্রিজ, ছাত্র বিক্ষোভ থেকে আই.সি.এস. হয়েও পদত্যাগ, মানবসেবা থেকে কলকাতার মেয়র, কংগ্রেস পরিত্যাগ, অসুস্থ অন্তরীণ অবস্থা থেকে অন্তর্ধান, আই.এন.এ. গঠন থেকে চির-অন্তর্ধান পর্যন্ত সুভাষের জীবনের প্রতিটি পর্বেই বিবেকানন্দের প্রভাব সুচিহ্নিত হয়ে রয়েছে। অমন প্রবল আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাস – যা কেবলমাত্র বিবেকানন্দের একজন যোগ্য উত্তরসূরীর পক্ষেই সম্ভব ছিল; সেই আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের উপরে ভর দিয়ে একাকী গোমো থেকে পেশোয়ার হয়ে আফগানিস্থান, সেখান থেকে ইউরোপ ঘুরে ডুবো জাহাজে জাপান, তারপরে আজাদ হিন্দ সরকার ও বাহিনীর দায়িত্ব নেওয়া, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে, নারীশক্তিকে সম্মান জানিয়ে ‘দিল্লী চলো’র আহ্বান – এ সবই সুভাষচন্দ্র নামক একটি মানুষের পক্ষে বিবেকানন্দের অমোঘ প্রভাবের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। যৌবনে সুভাষচন্দ্র রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিতে চাইলেও সেটা সম্ভব হয়নি। বিধির বাঁধনকে কাটতে পারেন নি বলেই আজাদ হিন্দ সরকার ও বাহিনীর দায়িত্ব নিয়ে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে তিনি নিজের মনের মণিকোঠায় সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন তিনি গভীর রাতে নিজের সামরিক বস্ত্র খুলে ফেলে পট্টবস্ত্র পরিধান করে সেখানকার রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা কেন্দ্রে গিয়ে গভীর ধ্যানে ডুবে যেতেন। সেই ধ্যান ছিল তাঁর অন্তরদেবতা-জীবনদেবতা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ধ্যান। তিনি তাঁর বাহিনী সমেত রেঙ্গুনে পৌঁছানোর পরেও সেই একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। শেষে পতন যখন সম্মুখে, শত্রুকবলিত রেঙ্গুন ত্যাগ করবার আগের দিন – যখন তাঁর আজীবনের স্বপ্ন ও আদর্শের গোটা আলেখ্য ঝুরঝুর করে কখনও বা সশব্দে, কখনও বা নিঃশব্দে ভেঙে পড়ছিল – যখন তাঁর সামনে ছিল শুধুই অন্ধকার – নিজের জীবনের সংকটের সেই চরমতম মুহূর্তেও সুভাষচন্দ্র শুচি, শুভ্র পট্টবস্ত্র পরিহিত যোগী হয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে তাঁর জীবনদেবতার সেবায়তনে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেদিন নিজের তন্ময়, তদগত চিত্তে সুভাষচন্দ্র ওই মন্দিরে রামকৃষ্ণ-শ্রীমা-বিবেকানন্দের সামনে মুখোমুখি বসে কি খুঁজেছিলেন? ভবিষ্যতের ঠিকানা? মনে হয় যে, তিনি সেদিন অমরত্বের ঠিকানা, ব্যর্থতার মাঝে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠবার, ও সুদীর্ঘকাল ধরে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর ব্যর্থতা-পরাজয় আজও উজ্জ্বল অলংকারে আবৃত হয়ে রয়েছে, আর ভবিষ্যতেও সেটা ঠিক তেমনি থাকবে। সুভাষচন্দ্রের অন্তিম পরিণতি আজও ইতিহাসের গাঢ় কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, তবে তিনি মানুষ-মানুষীর মর্মের নিভৃত বেদিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। সুভাষচন্দ্রের সৈনিক জীবনের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তাঁর উপরে স্বামী বিবেকানন্দের অমোঘ প্রভাবের প্রভাকে নিরীক্ষণ করা সম্ভব। বিবেকানন্দ ভালো করেই জানতেন যে, ইংরেজরা ভারতবর্ষকে সহজে স্বাধীনতা দেবে না, সেটা জোর করে আদায় করে নিতে হবে, এবং সেটার জন্য রক্তপাত অনিবার্য। তাই বিবেকানন্দ বীর্যবত্তার সঙ্গে বলেছিলেন, “ছবিখানা নিঁখুত করবার জন্য হলই বা একটু রক্তপাত।” (The Master as I saw him, Sister Nivedita, First Edition, P- 136) বিবেকানন্দের মত সুভাষচন্দ্রেরও দৃঢ় বিশ্বাস-প্রতীতি ছিল যে, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত না হলে জাতি কখনোই স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারবে না। তাই নিজের সহযাত্রী সৈনিকদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।” সেই প্রত্যয় তিনি তাঁর জীবনদেবতা বিবেকানন্দের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। গুরু ও শিষ্যের কাছে দেশের পরাধীনতার যন্ত্রণা একইরকম ভাবে শরীরিনী হয়ে উঠেছিল। তাই তার উৎসার ছিল বড় বেদনার। ১৯৪৪ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী তারিখে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক সুভাষচন্দ্র যখন তাঁর সৈন্যদের রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রামের জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় জানিয়েছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, “রক্তের ডাক এসেছে। ওঠো – জাগো! আর এক মুহূর্ত দেরী নয়। অস্ত্র হাতে তুলে নাও। তোমাদের সম্মুখে যে পথ, সে পথ আমাদের পূর্ববর্তী মহাপুরুষেরা রচনা করে গিয়েছেন। ঐ পথ দিয়ে আমরা অগ্রসর হব। শত্রু সৈন্যের সারিবদ্ধ ব্যূহ ভেদ করে আমরা আমাদের পথ করে নেব। আর যদি ঈশ্বর চান, আমরা শহীদের মৃত্যুবরণ করবো। এবং অন্তিম নিদ্রায় চুম্বন করে যাব ঐ পথকে যা আমাদের সেনাদলকে দিল্লী পৌঁছে দেবে। দিল্লীর পথ স্বাধীনতার পথ। চলো দিল্লী!” (The Spring Tiger, Hugh Toye, P- 103) সুভাষচন্দ্রের এই কথাগুলির মধ্যে বিবেকানন্দের কথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গতঃ বিবেকানন্দের দুটি উক্তিকে এখানে তুলে ধরা যেতে পারে –
(১) “পেছনে চেয়ো না। অতিপ্রিয় আত্মীয় স্বজন কাঁদুক, পেছনে চেয়ো না, সামনে এগিয়ে যাও।” (বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড, পৃ- ৩৫৯)
(২) “তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ মরণ, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। … অগ্রসর হও … পশ্চাতে চাহিও না। কে পড়িল দেখিতে যাইওনা, এগিয়ে যাও সম্মুখে। এরূপে আমরা অগ্রসর হইব। একজন পড়িবে, আর একজন তাঁর স্থান দখল করিবে।” (বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড, পৃ- ৩৬৭)
সবশেষে বিপ্লবী মহানায়ক ‘হেমচন্দ্র ঘোষের’ কথা উদ্ধৃত করে এই ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের ইতি টানা যাক। নিজের মৃত্যুর আগে হেমচন্দ্র ঘোয় ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক ‘স্বামী পূর্ণাত্মানন্দের’ সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে নিমগ্ন চিত্তে জানিয়েছিলেন, “রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ – এই ত্রয়ী এক মহাবিপ্লবের প্রতীক। সারা পৃথিবীর চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে তাঁরা এক বিরাট রেভ্যুলিউশন এনে দিয়েছেন। তাঁদের বিপ্লবে চাঞ্চল্য নেই, গতির চমক নেই। দু’-একটা শতাব্দী হয়তো চলে যাবে, এর বহিঃপ্রকাশ মানুষের চোখে ধরা পড়তে। কিন্তু এই বিপ্লবকে, যাকে ‘রামকৃষ্ণ বিপ্লব’ বলে আমি অভিহিত করতে চাই, তা থেমে নেই। সকলের অলক্ষ্যে তার কাজ ঠিক চলছে – মানুষের অন্তরের ঐশ্বর্যকে উন্মোচিত করে, মানুষের চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে মনুষ্যত্বে পৌঁছে দেওয়াই হল বিপ্লবের প্রকৃতি। আগামীকালের মানুষ দেখতে পাবে যে, এই নীরব বিপ্লবের তরঙ্গ সমগ্র জগৎকে প্লাবিত করে দিয়েছে।” (রাখাল বেনু পত্রিকা, চৈত্র-মাঘ সংখ্যা, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, পৃ: ২১৪-১৫) এই বিপ্লবের কর্মধারাই হল রামকৃষ্ণ মিশনের ভাবধারা আর ‘রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ’ এবং আরো আরো অনেককে নিয়েই তো রামকৃষ্ণ মিশন – যার প্রভাব অতীতের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক জীবনায়নের সর্বত্র প্রকাশিত হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়।

(তথ্যসূত্র:
১- ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, অমলেশ ত্রিপাঠী।
২- Patriot Prophet, Bhupendranath Datta.
৩- বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড।
৪- রাখাল বেনু পত্রিকা, মাঘ-চৈত্র সংখ্যা, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দ।
৫- রাখাল বেনু পত্রিকা, চৈত্র-মাঘ সংখ্যা, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ।
৬- বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, মোহিতলাল মজুমদার।
৭- শ্রীশ্রীমায়ের কথা, ২য় খণ্ড।
৮- শ্রীশ্রীমায়ের স্মৃতিকথা, স্বামী সারদেশানন্দ।
৯- শ্রীশ্রী সারদাদেবী, স্বামী গম্ভীরানন্দ।
১০- Prabuddha Bharata, Vol-IX.
১১- সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত।
১২- Letter of Sister Nivedita, Edited by Shankari Prasad Basu, First Edition, Vol-II.
১৩- উদ্বোধন, বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী সংখ্যা।
১৪- স্বামী সারদানন্দ, ব্রহ্মচারী প্রকাশচন্দ্র।
১৫- History of Ramakrishna Math and Ramakrishna Mission, Swami Gambhirananda.
১৬- Discovery of India, First Edition.
১৭- Gandhi’s work, Vol. 35 & 40.
১৮- Swami Vivekananda and Indian Nationalism, Subodh Chandra Sengupta.
১৯- The Master as I saw him, Sister Nivedita.
২০- The Spring Tiger, Hugh Toye.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রাচীন কালের কিছু জঘন্য পদ্ধতিস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রাচীন কালের কিছু জঘন্য পদ্ধতি

বর্তমান দিনের মানুষজন তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করে থাকে। তবে শুধু বর্তমান সময়ই নয় প্রাচীনকালে মানুষরা স্বাস্থ্য সচেতনার দিকে নজর দিত। যেমন- প্রাচীন রোমানরা। সেই সময়ে রোমের মতো

অপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাঅপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা

সময়টা ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন দুপুরবেলা, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি কার্গো বিমান। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক

আধুনিক যুদ্ধের নিঃশব্দ স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদূত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রআধুনিক যুদ্ধের নিঃশব্দ স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদূত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র

মহাভারতের রয়েছে নারায়ণাস্ত্র, পাশুপাত অস্ত্র, ব্রহ্মদণ্ড অস্ত্র সহ এমনসব একাধিক অস্ত্রের বিবরণ যাদের সাথে হুবুহু মিল রয়েছে বর্তমান যুগের স্যাটেলাইট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের। মহাভারতের বিবরণ অনুসারে মানবজাতির

‘চৈতন্য সাহিত্যে খর্বিত চৈতন্য চরিত্র’‘চৈতন্য সাহিত্যে খর্বিত চৈতন্য চরিত্র’

রানা চক্রবর্তীঃ বিভিন্ন চৈতন্য জীবনীকারেরা নিজেদের লেখায় এমন অনেক কথা বলেছিলেন, যা চৈতন্য-জীবনের মূল আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। যে বিশ্বম্ভর ‘শৈব-গায়েনের’ পিঠে চড়ে আনন্দে নৃত্য