'পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান' - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’

‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’


রানা চক্রবর্তীঃ ১৯৪০-এর দশকে কেউ যদি সর্বদেশীয় মেয়েদের নামের মিলন যদি দেখতে চাইতেন, তাহলে তাঁর পুরানো কলকাতার একটি ষ্টীমার ঘাটে গেলেই চলত। সেখানে তখন থরে থরে গঙ্গার বুকের উপরে বাড়ির গীতা থেকে শুরু করে বিদেশের কেটি পর্যন্ত সাজানো থাকত; গীতার পাশে কেটি, কেটির পাশে মার্গারেট ইত্যাদি। তাদের মধ্যে কোন শ্রেণীবিভাগ ছিল না, তারা সবাই পাশাপাশি গঙ্গার বুকের উপরে দুলত। আর ওই ভাবে দুলতে দুলতে নাচতে নাচতে বাঁশি বাজিয়ে জল কাটিয়ে তারা বহুদূর চলে যেত। গঙ্গা এপার ওপার করত, যাত্রীদের তাঁদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিত। আবার অন্যত্র থেকে যাত্রী নিয়ে এসে সেই ঘাটে নামিয়ে দিত। আজও কলকাতায় সেই ঘাটটি রয়েছে, নাম হল – ‘চাঁদপাল ঘাট’। আজও ওই ঘাটের পুরনো কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে যাত্রীরা তাঁদের জুতো মচমচিয়ে ঘাটের হেলান সিঁড়ি দিয়ে উঠে অন্যত্র যাতায়াত করেন। অতীতে সেই সিঁড়ির মুখে একজন টিকিট-কালেক্টর দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁর কাছে ফেরীর টিকিট জমা করে দিয়ে যাত্রীরা কলকাতার জনারণ্যে মিশে যেতেন। অতীতে কলকাতার চাঁদপাল ঘাট শিয়ালদহ স্টেশনের মতই একটি স্টেশন ছিল। রেল-স্টেশন নয়, সেটি তখন ছিল ষ্টিমারের স্টেশন। তখন সেই স্টেশনে একটি ছোট টিকিট-ঘরও ছিল। সেটার মাথার উপরে একটা বোর্ডে লেখা থাকত – ‘ফেরি সার্ভিস বুকিং অফিস’। সেই ঘরে তখন কয়েকটি ছোট ছোট ফোকর ছিল, সেই ফোকরের ওধারে দুটি-তিনটি লোক সর্বদা যাত্রীদের সুবিধার্থে মোতায়েন থাকতেন। তারপরে ছিল দুটি গেট। একটা হেলানো সিঁড়ি সেই গেট থেকে কাঠের পাটাতন পর্যন্ত নেমে যেত। কিছুকাল আগেও ওই গেটের মাথার উপরে ষ্টীমারের মাসিক টিকিটের যাত্রীদের সুব্যবস্থার জন্য নির্দেশ লেখা থাকত। তখন সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেই কাঠের পাটাতনের উপরে কয়েকটি প্রাগৈতিহাসিক বেঞ্চি নজরে পড়ত। আর সেই বেঞ্চিতে বসে ঘাটের চারদিকে তাকালে একটা ঝরঝরে পুরনো দৃশ্যের উপরে চোখ পড়ত। তখন চাঁদপাল ঘাট চারদিকে ধূসর আচ্ছাদনে বহু বর্ণের ছোপ-পড়া একটা ফেরিস্টেশন ছিল। সেটার মাথার উপরে কাঠ দিয়ে উঁচু করা দুটি গম্বুজ ছিল। সেই গম্বুজের গায়ে ছিল শিল্পীর আঁকিবুকি। ওই সময়ে ঘাটের কাঠের পাটাতনের উপরে কয়েকটি ঝরঝরে মার্কা ঘরে অবশ্য ঘরণী না থাকলেও ঘরবাসীরা থাকতেন। সেই ঘরবাসীরা ছিলেন গঙ্গার মাঝি। সেই ঘরের মাথায় এক টুকরো কাঠের উপরে একটি বিবর্ণ লেখা চোখে পড়ত – ‘চাঁদপাল ঘাট, দি ষ্টিমনেভিগেশন কোম্পানী লিমিটেড’। ওই সময়ে হুগলী নদীর অজস্র ঢেউয়ের সঙ্গে জাহাজ, ষ্টীমার, নৌকাগুলি খেলা করে বেড়াত। বড় বড় নৌকা মাল বোঝাই করে অন্যত্র যাতায়াত করত। ষ্টীমার চলত। সেই সময়ে চাঁদপাল ঘাটের কাছ ঘেঁষেই বড় বড় জাহাজগুলি দাঁড়িয়ে থাকত।

আরো পড়ুন – নরখাদকের সাথে ইউরোপ মহাদেশের সম্পর্ক

চাঁদপাল ঘাটের কাছেই রয়েছে ‘বাবুঘাট’। আজও সেই ঘাটের মাথার উপরে ইঁটের দেয়ালের বুকে লেখা রয়েছে – ১৮৩০ সন। উক্ত ইংরেজি বছরে ‘বাবু রাজচন্দ্র দাস’ সেই ঘাটটি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন বলে, তাঁরই নামানুসারে ওই ঘাটের নাম হয়েছে – বাবুঘাট। এখন ওসব নাম ও সনের দিকে হয়ত কেউ লক্ষ্য করেন না। আর করলেও তাঁকে নিয়ে আর কোন চিন্তা এগোয় না। কিন্তু সেই ইংরেজি সন ধরে আরেক সনের গোড়ার দিকে পৌঁছে যাওয়া যায়।


১৬৯০ সালে জোব চার্ণক তৃতীয়বারের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর আগমনের পর থেকে ইংরেজদের নথিতে তৎকালীন কলকাতার কয়েকটি অঞ্চলের ঠিকুজি পাওয়া যায়। তা না হলে তৎকালীন কলকাতার অধিকাংশটাই তো ছিল জঙ্গল আর বাদাভূমি। সেখানে তখন ছিল দিনে বাঘ, আর রাতে ডাকাত। কিন্তু ওই জঙ্গলময় দেশের সেই জায়গাটিতে, অর্থাৎ আজকের চাঁদপাল ঘাটের জায়গাটিতে তখন কয়েক ঘর তন্তুবায় বাস করতেন। সেখানে তাঁদের পর্ণকুটীর আর প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র ছিল। সম্ভবতঃ গঙ্গা কাছে থাকবার জন্যই সেখান থেকে ব্যবসা করা সম্ভব হয়েছিল। যেখানে ব্যবসা লেনদেন হয় সেখানেই লোকজনের সমাগম ঘটে। তাই তখন সেখানে নিশ্চই বহুলোকের সমাগম ঘটত। বহুলোকই হয়ত তখন সেখানে এসে দিনকয়েক বসবাস করে যেতেন। তাই তখনকার দিনে ওই জায়গাটিকে হয়ত অনেক লোকে চিনতেন। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি কোথাও লোক থাকলেই তাঁদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসেরও দরকার হয়। তাই ওই সময়ে সেখানে একটি মুদির দোকান থাকাও কিছু অস্বাভাবিক নয়। হয়ত একটি নয়, অনেকগুলি দোকানই ছিল; তবে প্রাচীন নথিতে সেখানকার একটি মুদির দোকানের কথাই পাওয়া যায়। সেই দোকানের মালিকের নাম ছিল – ‘চন্দ্রনাথ পাল’। একদা চন্দ্রনাথ পাল ওই অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। কি কারণে, সেটা স্পষ্ট নয়। সেই চন্দ্রনাথ পালের নামানুসারেই চাঁদপালঘাট নামটি হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে এখন একটু অবিশ্বাসও জাগে। সামান্য একজন মুদির নাম কলকাতা শহরের বুকে অমর হয়ে রইল? কিন্তু অবিশ্বাস করলেও উপায় নেই। অবিশ্বাস করলে মুদি চন্দ্রনাথ পালকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া গেলেও চাঁদপালঘাট নামটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ চাঁদপালঘাট এখনও বর্তমান রয়েছে। অতীতের কলকাতায় ওই চাঁদপাল ঘাটই জাহাজ ভিড়াবার একমাত্র জায়গা ছিল। বলতে গেলে, সেটা ছিল সেকালের ‘গেটওয়ে অব ইণ্ডিয়া’। একদিন সেখানেই ভারতে কোম্পানি রাজত্বের প্রথম গভর্ণর জেনারেল ‘লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস’ পদার্পন করেছিলেন। সেদিন দূরে, ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের কেল্লা থেকে তোপ দেগে তাঁকে অভিবাদন জানানো হয়েছিল। তিনি কলকাতায় আসবার কিছু পরে কাউন্সিলের সদস্য ‘ফিলিপ ফ্রান্সিস’ও ওই ঘাটেই জাহাজ থেকে নেমেছিলেন। সেদিন ওই চাঁদপাল ঘাটে দাঁড়িয়েই তিনি মনে মনে এক-দুই করে দূরের কেল্লার তোপধ্বনি গুনেছিলেন। তাঁর বেলায় অবশ্য সেই তোপধ্বনি হেস্টিংসের সমান হয় নি। আর সেই কম-বেশি তোপধ্বনিকে কেন্দ্র করেই হেস্টিংস আর ফ্রান্সিসের মধ্যেকার ঐতিহাসিক শত্রুতার শুরু হয়েছিল। পুরানো কলকাতার এমন আরও অনেক ইতিহাসের শুরু ও শেষ ওই চাঁদপাল ঘাটেই হয়েছিল। কিন্তু সেই চন্দ্রনাথ পালের মুদির দোকানটা কোথায় ছিল? এখন আর সেই দোকানের কোন চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু তবুও বিশ্বাস করতে হয় যে, সেখানে একটা মুদির দোকান ছিল। এটাও বিশ্বাস করতে হয় যে, ওই সময়ে যে কোন কারণেই হোক সেই দোকানটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, আর চন্দ্রনাথ পালও অবশ্যই ছিলেন। কারণ প্রাচীন কলকাতার ইতিহাসে আজও তাঁর নাম রয়েছে।
(ছবিতে: জেমস বেইলি ফ্রেশারের আঁকা ১৮২৬ সালের চাঁদপাল ঘাট; সৌজন্যে – ব্রিটিশ লাইব্রেরি।)

(তথ্যসূত্র:
১- কলিকাতা সেকালের ও একালের, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
২- কলিকাতার কথা, প্রমথনাথ মল্লিক।
৩- কলিকাতার ইতিহাস, সুবলচন্দ্র মিত্র।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ১৫৮৭ খৃস্টাব্দের ১লা আগস্ট তারিখে বিসূচিকা রোগে ‘উজীর খাঁ হেরেবি’র মৃত্যু হওয়ার পরে আকবর বিহারের শাসনকর্তা ‘সৈয়দ খাঁ’কে বাংলায় বদলি করেছিলেন, এবং ‘মান সিংহ’কে পাঞ্জাব থেকে বিহারে নিয়ে

লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধলাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ

৫ কোটি লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নোটিশ বোর্ড। এই রাস্তায় আর মানুষ যেতে পারবে না। যান চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ। এমনকি মানুষের বাইরে বেরোনোর সময়সীমাও বেঁধে

মানবদেহের জন্য বেশীরভাগ পরজীবী ক্ষতিকারকমানবদেহের জন্য বেশীরভাগ পরজীবী ক্ষতিকারক

পরজীবী শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক অর্থ। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় অন্য জীবের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা। এই প্রাণী জগতে এমন কিছু পরজীবী আছে যেগুলির বেঁচে থাকার জন্য

শ্যামনগর মূলাজোড় শ্রী শ্রী ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরের অজানা মাহাত্ম্যশ্যামনগর মূলাজোড় শ্রী শ্রী ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরের অজানা মাহাত্ম্য

সায়নদীপঃ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার একটি শহর শ্যামনগর। নবদ্বীপ রাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বের মধ্যে থাকা এই অঞ্চল পূর্বে মূলাজোড় নামে পরিচিত ছিল। এখানকার প্রধান দর্শনীয় ধর্মীয় স্থান ৺ শ্রীশ্রী ব্রহ্মময়ী