মানবদেহের জন্য বেশীরভাগ পরজীবী ক্ষতিকারক - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ মানবদেহের জন্য বেশীরভাগ পরজীবী ক্ষতিকারক

মানবদেহের জন্য বেশীরভাগ পরজীবী ক্ষতিকারক


পরজীবী শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক অর্থ। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় অন্য জীবের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা। এই প্রাণী জগতে এমন কিছু পরজীবী আছে যেগুলির বেঁচে থাকার জন্য মানুষের দেহ প্রয়োজন আবার এমন কিছু পরজীবী আছে যেগুলি মানুষের দেহ ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে তবে সুযোগ পেলেই বাসা বাঁধে মানুষের দেহে। শুধু বাস করে থাকে তা নয় এই পরজীবীগুলি মানুষকে মৃত্যুর মুখে পর্যন্ত ঠেলে দেয়। তাই বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে মানবদেহের জন্য বেশিরভাগ পরজীবী ক্ষতিকারক। আর এইরকমই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক কিছু পরজীবী হলো-

প্লাজমোডিয়াম

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গোটা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।

অনেকে এই রোগটিকে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ হিসেবেই বিবেচনা করে, কারণ এই রোগটি ম্যালেরিয়া মশা দ্বারা বাহিত হয় বলে। তবে বাস্তবটা একটু অন্যরকম অর্থাৎ এই অসুখটি সৃষ্টির পেছনে দায়ী হলো প্লাজমোডিয়ামের এই পরজীবীটি। এই পরজীবীটির সংক্রমণের কারণে মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।

কি কি লক্ষণ দেখা যায় এই রোগে?

মাথাব্যথা, পেট ব্যথা, উদরাময়, বমি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এই পরজীবিটির আক্রমণ অন্যান্য পরজীবীর মতো এতটা গুরুতর না হলেও খামখেয়ালি এবং অসতর্কতা মনোভাব মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে মানুষকে।

যেভাবে আক্রান্ত হতে পারেন

মানবদেহে ম্যালেরিয়া রোগের বাহক হল অ্যানোফিলিস মশকী। যখন কোন মানুষকে এই মশা দংশন করে তখন ওই মশার লালার মাধ্যমে কিছু প্লাজমোডিয়াম পরজীবী মানুষের দেহে প্রবেশ করে। এরপর যকৃত ও লোহিত রক্তকণিকায় প্লাজমোডিয়াম বিভিন্ন চক্র সম্পাদনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। যার ফলে শরীরের লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানুষের শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।

ফিতাকৃমি

ফিতাকৃমি একধরনের চ্যাপ্টাকৃমি। এই কৃমির ডিম বা লার্ভা খাবারের সাথে যদি কারও পেটে চলে যায় তাহলে সেগুলো অন্ত্রে পৌঁছে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, এবং সেখানেই ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে। যার ফলে দেখা দিতে পারে সিস্টিসারকোসিস নামক পরজীবী সংক্রান্ত সমস্যা। আর এই সিস্টিসারকোসিসের কারণে পরজীবী মানুষের মস্তিষ্কেও বাসা বাঁধতে পারে।

যে যে ক্ষতি করতে পারে

ফিতাকৃমি মানুষের গ্রহণকৃত খাবার থেকে পুষ্টি গ্রহণ করার কারণে মানুষদের শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আবার কিছু কিছু সময় এই কৃমিগুলি বেশি বড় হয়ে যাওয়ার কারনে অন্ত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর ফলে পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব প্রদাহ, এবং বমি হওয়ার ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

আবার কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ফিতাকৃমি বা তাদের ডিম অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যার ফলে চুলকানি, আমবাত, এবং শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা সৃষ্টি করে।

এছাড়াও আরও এক ধরনের ফিতাকৃমি আছে যারা মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডসহ শরীরের অন্যান্য অংশে স্থানান্তরিত হয়ে যায়, যার ফলে বিভিন্ন স্নায়বিক উপসর্গ, যেমন- খিঁচুনি, মাথাব্যথা ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

যেভাবে আক্রান্ত হতে পারেন

লেটুস বা কলমিদল শালুকে থাকা শামুকের লার্ভা খাওয়ার ফলে। ঠিক মতো সেদ্ধ না করে শুকরের মাংস, বা সুশি খাওয়ার ফলে। দূষিত জল পান করার ফলেও এই পরজীবীটি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন।

ফাইলেরিয়াল কৃমি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১২০ মিলিয়ন মানুষ ফাইলেরিয়াল কৃমি (একপ্রকার গোল কৃমি) দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই পরজীবীটি লসিকা নালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। এই পরজীবীটি গোদ রোগ সৃষ্টি করা ছাড়াও আরও অনেক রোগ সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের অন্ত্রে বাস করে না এই পরজীবী। এরা দেহের ভিতর প্রবেশ করার পর লসিকা নালিতে গিয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এরপর লসিকা নালিতে পূর্ণবয়স্ক হয়ে গেলে সেগুলি নালিতে প্রদাহ সৃষ্টির পর বন্ধ করে দেয় লসিকা নালি। আক্রান্ত রোগীদের আক্রান্ত জায়গার চামড়া ফুলে যাওয়া (হাত, পা, অণ্ডকোষ, স্তন)। এছাড়াও চামড়া লালচে ও চামড়া খসখসে হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দেয়।

যেভাবে আক্রান্ত হতে পারেন

স্যাঁতসেঁতে ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটার সময় এই পরজীবী ত্বকীয় কোষের মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

দূষিত জল পান করার ফলেও এই পরজীবীটি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন।

মশার দংশনের মাধ্যমেও এই পরজীবীটি প্রবেশ করতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ান প্যারালাইসিস টিক

বর্হিপরজীবী হিসেবে গন্য করা হয় টিকদের। এই সমস্ত বর্হিপরজীবীরা ভেতরে প্রবেশ না করেও জীবদেহের ক্ষতিসাধন করতে যথেষ্ট সক্ষম। উপর থেকেই তারা তাদের কার্যসিদ্ধি করতে সক্ষম। এরা ত্বকে কামড় দিলে তার থেকে সৃষ্টি হতে পারে বেশ কিছু বিপজ্জনক রোগ, এর মধ্যে অন্যতম হল লাইম ডিজিজ, রিকেটশিয়া ইত্যাদি। এই পরজীবীগুলির মধ্যে সব থেকে ভয়ঙ্কর হল অস্ট্রেলিয়ান প্যারালাইসিস টিক, যারা ‘ইক্সোডেস হলোসাইক্লাস’ নামে পরিচিত। এরা এমন এক নিউরোটক্সিন শরীরের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে, যার ফলে মানুষের পক্ষাঘাতের সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর যদি কোনোভাবে এটি ফুসফুসে পৌঁছাতে পারে তাহলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বন্ধ করে দিয়ে রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।

যেভাবে আক্রান্ত হতে পারেন

শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়াতেই রয়েছে এই অস্ট্রেলিয়ান টিকের অস্তিত্ব। কিন্তু চিন্তার বিষয় হল যে এর কোনো অ্যান্টিভেনম বা প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি।

স্ক্যাবিস মাইট

অনেকটা টিকের মতোই এই স্ক্যাবিস মাইট, মাকড়সার সদৃশ। তবে এরা ইক্সোডেস হলোসাইক্লাসের মতো মানুষের ত্বকের উপর থেকে কামড়ায় না। এরা সাধারণত ত্বকের উপর মল ত্যাগ করে। যার ফলে সৃষ্টি হয় ত্বকে চুলকানি ও জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা। তবে এই ক্ষেত্রে নখের আঁচড় আরও বেশি বিপদজনক। কারন এর ফলে আমাদের শরীরে টিস্যুর ছিদ্রের মাধ্যমে স্ক্যাবিসের মল শরীরে প্রবেশ করবে যার ফলে সৃষ্টি হবে রোগ। এই পরজীবীটি শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল মানুষদের পক্ষে অত্যন্ত বিপদজনক। এটি ত্বককে শক্ত এবং জীর্ণ করে দেয়।

যেভাবে আক্রান্ত হতে পারেন

এই রোগটি হল ছোঁয়াচে একটি রোগ। যারা এই রোগে আক্রান্ত তাদের সংস্পর্শে কোনো সুস্থ মানুষ আসলে সেই ব্যক্তির দেহে এই পরজীবী সহজেই স্থানান্তরিত হতে পারে। সেই জন্যই যাদের খোসপাঁচড়া আছে তাদের থেকে দূরে থাকা উচিৎ।

স্ক্রুওয়ার্ম

নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওয়ার্মের বৈজ্ঞানিক নাম Cochliomyia hominivorax। যা বিশ্লেষণ করলে ‘hominivorax‘, শব্দের মানে হল ‘মানুষখেকো’। এই লার্ভাগুলোর মানুষের মাংস ভক্ষণ করে থাকে। তাই এই লার্ভাগুলোর নামের সাথে মিল রয়েছে কাজের। একপ্রকার মাছি এই লার্ভাগুলো ধারণ করে। কোনো স্ত্রী মাছি যদি লার্ভাসমেত ক্ষত স্থানে বসে তাহলে একসাথে প্রায় শ’খানেক ডিম পাড়ে। আর সেই ডিমগুলো একদিনের মধ্যে ফুটে তার থেকে শূককীট বের হয় এবং ওইগুলো নিজের খাবার হিসেবে সেই ক্ষত থেকে মানুষের দেহের মাংসকে গ্রহণ করতে থাকে। এই শূককীটগুলো রক্তনালী, মাংসপেশি, স্নায়ুর মধ্যে গর্ত তৈরি করে আশ্রয় নিতে পারে। লার্ভা দ্বারা সৃষ্টি এই রোগকে বলা হয় মাইয়াসিস। যদি আবার এই লার্ভাগুলোকে কেউ শরীর থেকে সরিয়ে ফেলতে চায়, তাহলে সেগুলো গর্ত করে আরও গভীরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে।

সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮% মানুষ এই পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আর যারা এই পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরও বেঁচে আছে তারা স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। কারণ, তাকে এই পরজীবীর দল ক্রমশ জীবন্ত খেতে থাকে। যার ফলে শরীরের টিস্যু ও কোষ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে।

যেভাবে আক্রান্ত হতে পারেন

সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে দেখা পাওয়া যায় স্ক্রুওয়ার্মের। তবে বর্তমান দিনে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন জঙ্গলে এর প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও এর খোঁজ পাওয়া যায় ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনওপৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

এত বৃহৎ পৃথিবীতে রহস্য রোমাঞ্চের শেষ নেই। কোনো জায়গায় ছোট্ট একখানা জমির জন্য লড়াই চলে, তো কখনো একটা গোটা দেশকেই গ্রাস করে নেয় আগ্রাসী শক্তি। তবে আজ আমরা এমন এক

রামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্করামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্ক

রানা চক্রবর্তীঃ রাজা রামমোহন রায় ও হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর মধ্যে কি কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল? তাঁদের উভয়ের মধ্যে কেমন ধরণের সম্পর্ক ছিল? ‘ইলিয়ট ওয়াল্টার ম্যাজ’ই (Elliot Walter Madge) প্রথম তাঁর

‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ এবারে শ্ৰীম লিখিত গ্রন্থের রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম প্রসঙ্গে আসা যাক। রামচন্দ্র দত্ত, স্বামী সারদানন্দ, অক্ষয় সেন প্রমুখ তাঁদের গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গ দু’-এক কথায় বা অল্প কথায় লিখলেও, শ্রীম সেটার জন্য

‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)

হরানা চক্রবর্তীঃ ‘ঘোরী নগরী’ আফগানিস্থানে অবস্থিত হলেও ‘মহম্মদ ঘোরী’ জাতিতে আফগান ছিলেন না। তরাইন প্রান্তরে একদল আফগান যেমন তাঁর তুর্কী ফৌজের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, আরেকদল আফগান তেমনি পৃথ্বিরাজের পক্ষ