‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)

‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ ১৫৮৭ খৃস্টাব্দের ১লা আগস্ট তারিখে বিসূচিকা রোগে ‘উজীর খাঁ হেরেবি’র মৃত্যু হওয়ার পরে আকবর বিহারের শাসনকর্তা ‘সৈয়দ খাঁ’কে বাংলায় বদলি করেছিলেন, এবং ‘মান সিংহ’কে পাঞ্জাব থেকে বিহারে নিয়ে এসে তাঁকে আফগানদের দমন করবার জন্য বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পাটনায় পৌঁছে মান সিংহ দেখতে পেয়েছিলেন যে, গিধৌড়রাজ ‘পুরণমল’ ও খড়্গপুর-রাজ ‘সংগ্রামসিংহ’ মোগল-পাঠান যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে স্বাধীন হয়ে গিয়েছেন। আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকবার ফলে ‘সাহাবাজ খাঁ’ বা তাঁর উত্তরাধিকারী সেই জমিদারদের ধৃষ্টতা দেখেও না দেখলেও মান সিংহ কিন্তু তাঁদের উপেক্ষা করতে পারেন নি। তিনি জানতেন যে, ওই সব বিদ্রোহী গড় পিছনে রেখে আফগানদের দমন করতে গেলে তাঁরা পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে বিপদ ঘটাতে পারেন। তাই তিনি প্রথমেই গিধৌড় আক্রমণ করে সেখানকার মাটির দুর্গ ধুলিসাৎ করে দিয়েছিলেন; এর ফলে অসহায় রাজা পুরণমল আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে মান সিংহের কনিষ্ঠাগ্রজ ‘চন্দ্রভানু’র সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। অন্যদিকে আতঙ্কগ্রস্ত খড়্গপুররাজ বিনাযুদ্ধেই মান সিংহের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ওই ভাবে বিহারে তখন মোটামুটি শান্তি স্থাপিত হওয়ার পরে মান সিংহ মোঘলদের আসল শত্রু আফগানদের দমনের জন্য আয়োজন করেছিলেন। সেই সময়ে আফগানদের প্রধান নায়ক উড়িষ্যার কতলু খাঁ তখন আগের যুদ্ধের ধাক্কা সামলে নিয়ে নতুন উদ্যমে মোঘলদের সঙ্গে নিজের শক্তি পরীক্ষার জন্য আবার তৈরী হচ্ছিলেন। তাঁকে টক্কর দেওয়ার জন্য মান সিংহ বাংলার গোলন্দাজ বাহিনীকে পাটনায় নিয়ে গিয়ে ১৫৯০ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভাগলপুর ও বর্ধমানের পথ ধরে আরামবাগে পৌঁছে নিজের ছাউনি ফেলেছিলেন। বাংলার সালার-এ-সুবা সৈয়দ খাঁর কাছে এর আগেই তিনি অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি যেন সসৈন্যে সেখানে পৌঁছে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। ওদিকে কতলু খাঁ তখন গুপ্তচরমুখে মোঘলদের সব গতিবিধির খবর রাখছিলেন। মান সিংহের আরামবাগ শিবির থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত রায়পুর দুর্গ তখন তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। সেই জায়গাকে কেন্দ্র করেই তিনি মোঘলদের সঙ্গে মোকাবিলা করবেন বলে ঠিক করে নিয়েছিলেন। এরপরে দলে দলে আফগানরা সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ায় মোঘল-পাঠানরা পুনরায় পরস্পরের সঙ্গে চূড়ান্ত শক্তি পরীক্ষার জন্য তৈরী হতে শুরু করেছিলেন। তারপরে সেখানেই ‘বঙ্কিমচন্দ্রের’ অমর উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’র রোমাঞ্চময় কাহিনী অভিনীত হয়েছিল। সৈয়দ খাঁর কাছে সৈন্য চেয়ে মান সিংহ তাড়ায় যে পত্র পাঠিয়েছিলেন, সেটার জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন যে, তাঁর হাতে তখন যে ফৌজ রয়েছে, উত্তর-পূর্ব সীমান্তে আফগানদের জন্য তাঁদের তৈরী থাকতে হচ্ছে বলে তিনি দক্ষিণ সীমান্তে নতুন কোন সৈন্যবাহিনী পাঠাতে অক্ষম। তাঁর পত্রটি পড়ে মান সিংহ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, নিজের অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু করতে তিনি সাহস পাননি। অন্যদিকে তাঁর পক্ষে আগ্রা ফিরে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। কারণ, তিনি জানতেন যে, মোঘল-বাহিনীর মধ্যমণি বিনাযুদ্ধে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করছেন শুনতে পেলে আফগানরা তাঁর দুর্বলতার সন্ধান পেয়ে রাজধানী তাড়া পর্যন্ত এগিয়ে যাবেন; তারপরে তাঁদের সেখান থেকে পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে দিল্লীর দিকে মার্চ করাও বিচিত্র কিছু নয়। ফলে বাদশাহ আকবর সবদিক সামাল দিতে হিমশিম হবেন। মান সিংহের সামনে তখন তখন বহু সমস্যা ছিল। অত ঝুঁকি নেওয়ার লোকও মান সিংহ ছিলেন না। তাই তিনি সৈন্যবাহিনীর সংখ্যাল্পতার জন্য কতলু খাঁকে সরাসরি আক্রমণ করবার পরিবর্তে নিজে আরামবাগে অবস্থান করে পুত্র ‘জগৎ সিংহের’ উপরে আফগানদের প্রতিরোধের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই সময়কার ঘটনাবলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, “৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ কৃষ্ণপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনোদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারোহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। … নৈদাঘঝটিকা প্রধাবিত হইল এবং সঙ্গে অল্পকাল মধ্যে মহারবে নৈদাঘঝটিকা সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিধারা পড়িতে লাগিল। ঘোটকারূঢ় ব্যক্তি গন্তব্য পথের আর কিছুমাত্র স্থিরতা পাইলেন না; অশ্ববল্গা শ্লথ করাতে অশ্ব যথেচ্ছ গমন করিতে লাগিল। এইরূপ কিয়ৎদূর গমন করিলে ঘোটকচরণে কোন কঠিন দ্রব্য সংঘাতে পদস্খলন হইল। ঐ সময়ে একবার বিদ্যুৎ প্রকাশ হওয়াতে পথিক সম্মুখে প্রকাণ্ড ধবলাকার কোন পদার্থ চকি মাত্র দেখিতে পাইলেন। ঐ ধবলাকার স্তুপ অট্টালিকা হইবে, এই বিবেচনায় অশ্বারোহী লাফ দিয়া ভূতলে অবতরণ করিলেন। অবতরণ মাত্র জানিতে পারিলেন যে প্রস্তর নির্মিত সোপানাবলীর সংশ্রবে ঘোটকের চরণস্খলিত হইয়াছিল অতএব নিকটে আশ্রয়স্থান আছে জানিয়া অশ্বকে ছাড়িয়া দিলেন। … দ্বার খুলিয়া যাইবামাত্র যুবা যেমন মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন অমনি মন্দির মধ্যে অস্ফূট চীৎকারধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল ও তন্মুহূর্তে মুক্ত দ্বারপথে ঝটিকাবেগ প্রবাহিত হওয়াতে তথায় যে ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলিতেছিল তাহা নিভিয়া গেল। মন্দির মধ্যে মনুষ্যই বা কে আছে; দেবই বা কি মূর্তি, প্রবেষ্টা তাহার কিছুই দেখিতে পাইলেন না। আপনার অবস্থা এইরূপ দেখিয়া নির্ভীক যুবাপুরুষ কেবল ঈষৎ হাস্য করিয়া, প্রথমতঃ ভক্তিভাবে মন্দির মধ্যস্থ অদৃশ্য দেবমূর্তির উদ্দেশ্যে প্রণাম করিলেন। পরে গাত্রোত্থান করিয়া অন্ধকার মধ্যে ডাকিয়া কহিলেন, ‘মন্দির মধ্যে কে আছ?’ কেহই প্রশ্নের উত্তর করিল না; কিন্তু অলংকার ঝঙ্কার শব্দ কর্ণে প্রবেশ করিল। ‘আপনি কে?’ বামাস্বরে মন্দির মধ্য হইতে এই প্রশ্ন হইল। শুনিয়া সবিস্ময়ে পথিক উত্তর করিলেন, ‘স্বরে বুঝিতেছি যে প্রশ্ন কোন সুন্দরী করিলেন। আমার পরিচয়ে আপনার কি হইবে?’ মন্দির মধ্য হইতে উত্তর হইল, ‘আমরা বড় ভীত হইয়াছি।’ যুবক তখন কহিলেন, ‘আমি যে হই, আমাদিগের আত্মপরিচয় দিবার রীতি নাই। কিন্তু আমি উপস্থিত থাকিতে অবলা জাতির কোনপ্রকার বিঘ্নের আশংকা নাই।’ রমণী উত্তর করিল, ‘আপনার কথা শুনিয়া আমার সাহস হইল, এতক্ষণ আমরা ভয়ে মৃতপ্রায় ছিলাম। এখনও আমার সহচরী অর্দ্ধমূর্ছিতা রহিয়াছে। আমরা সায়াহ্নকালে এই শৈলেশ্বর শিবপূজার জন্য আসিয়াছিলাম। পরে ঝড় আসিলে, আমাদিগের বাহক, দাস-দাসীগণ আমাদিগকে ফেলিয়া কোথায় গিয়াছে তাহা বলিতে পারি না।’ যুবক কহিলেন, ‘চিন্তা করিবেন না, আপনারা বিশ্বাস করুন, কাল প্রাতেঃ আমি আপনাদিগকে গৃহে রাখিয়া আসিব।’ রমণী কহিল, ‘শৈলেশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’ … শৈলেশ্বর মন্দির হইতে যাত্রা করিয়া জগৎ সিংহ পিতৃশিবিরে উপস্থিত হইলে পর, মহারাজ মান সিংহ পুত্র প্রমুখাৎ অবগত হইলেন যে, প্রায় পঞ্চাশ‍ সহস্র পাঠান সেনা ধরপুর গ্রামের নিকট শিবির সংস্থাপন করিয়া নিকটস্থ গ্রাম সকল লুণ্ঠন করিতেছে এবং স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ বা অধিকার করিয়া তদাশ্রয়ে একপ্রকার নির্বিঘ্নে আছে। মানসিংহ দেখিলেন যে, পাঠানদিগের দুর্বৃতির আশু দমন নিতান্তই আবশ্যক হইয়াছে, কিন্তু একাৰ্য্য অতি দুঃসাধ্য। কর্তব্যাকর্তব্য নিরূপণের জন্য সমভিব্যাহারি সেনাপতিগণকে একত্রিত করিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিবৃত করিলেন এবং কহিলেন, ‘দিনে দিনে গ্রাম গ্রাম, পরগণা পরগণা দিল্লীশ্বরের হস্তস্খলিত হইয়াছে। এক্ষণে পাঠানদিগকে শাসিত না করিলেই নয়, কিন্তু কি প্রকারেই বা তাঁহাদিগের শাসন হয়? তাঁহারা আমাদিগের অপেক্ষা সংখ্যায় বলবান; তাহাতে আবার দুর্গশ্রেণীর আশ্রয়ে থাকিয়া যুদ্ধ করিবে; যুদ্ধে পরাজিত করিলেও তাঁহাদিগকে বিনষ্ট বা স্থানচ্যুত করিতে পারিব না; সহজেই দুর্গমধ্যে নিরাপদ হইতে পারিবে। কিন্তু সকলে বিবেচনা করিয়া দেখ, যদি রণে আমাদিগকে বিজিত হইতে হয়, তবে শত্রুর অধিকার মধ্যে নিরাশ্রয়ে একেবারে বিনষ্ট হইতে হইবে। … সৈয়দ খাঁর প্রতিক্ষা করা উচিত হইতেছে। অথচ বৈরী শাসনের আশু কোন উপায় করাও আবশ্যক হইতেছে। তোমরা কি পরামর্শ দাও?’ বৃদ্ধ সেনাপতিগণ সকলেই একমত হইয়া এই পরামর্শ স্থির করিলেন যে, আপাততঃ সৈয়দ খাঁর প্রতিক্ষায় থাকাই কর্তব্য। রাজা মান সিংহ কহিলেন, ‘আমি অভিপ্রায় করিতেছি যে, সমুদয় সৈন্য নাশের সম্ভাবনা না রাখিয়া কেবল অল্প সংখ্যক সৈন্য কোন দক্ষ সেনাপতির সহিত শত্রুর সম্মুখে প্রেরণ করিব।’ একজন প্রাচীন মোগল সৈনিক কহিলেন, ‘মহারাজ! যথা তাবৎ সেনা পাঠাইতে আশংকা তথা অল্প সংখ্যক সেনার দ্বারা কোন কার্য্য সাধন হইবে?’ মান সিংহ কহিলেন, ‘অল্প সেনা সম্মুখরণে অগ্রসর হইতে পাঠাইতে চাহিতেছি না। ক্ষুদ্রবল অস্পষ্ট থাকিয়া গ্রাম পীড়নাশক্ত পাঠান দিগের সামান্য দলসকল কতক দমনে রাখিতে পারিবে।’ তখন মোগল কহিল, ‘মহারাজ! নিশ্চিত কালগ্রাসে কোন সেনাপতি যাইবে?’ মান সিংহ ভ্রুভঙ্গি করিয়া বলিলেন, ‘কি! এত রাজপুত ও মোগলের মধ্যে মৃত্যুকে ভয় করে না এমন কি কেহই নাই?’ এই কথা শ্রুতিমাত্র পাঁচ-সাত জন মোগল ও রাজপুত গাত্রোখান করিয়া কহিল, ‘মহারাজ! দাসেরা যাইতে প্রস্তুত আছে।’ জগৎ সিংহও তথায় উপস্থিত ছিলেন; তিনি সর্বাপেক্ষা বয়োঃকনিষ্ঠ, সকলের পশ্চাতে থাকিয়া কহিলেন, ‘অনুমতি হইলে এ দাসও দিল্লীশ্বরের কার্য্য সাধনে যত্ন করে।’ …” এবারে কাহিনীর এই জায়গাতে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সমসাময়িক ঐতিহাসিক ‘আবুল ফজল আলামি’র শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি লিখেছিলেন, “শত্রুর সন্ধানে বেপরোয়াভাবে ঘুরতে ঘুরতে ১৫৯০ খৃষ্টাব্দের ২১শে মে সন্ধ্যার দিকে জগৎ সিংহ বিষ্ণুপুররাজ বীর হাম্বীরের রাজ্যের প্রত্যন্তভাগে এক প্রান্তরের মধ্যে বিশ্রাম করছিলেন। সারাদিন অসহ্য গরমের পরে এখন মৃদু হাওয়া বইছে ৷ তাই ক্লান্তি অপনোদনের জন্য সরাব পান করে তিনি কিছুটা বেঁহুশ হয়ে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর সৈন্যরা দেখে যে পাশের জঙ্গলের ভিতর থেকে ওমরের অধীনে একদল আফগান অশ্বারোহী বেরিয়ে এসে তাঁদের দিকে তীর বেগে এগিয়ে আসছে। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণ পরিহারের জন্য জগৎ সিংহের অধিকাংশ অনুচর ঘোড়ায় উঠে চম্পট দেয়, কেবল বিকা রাঠোর, মহেশ দাশ ও নাড়ু চরণ প্রমুখ কয়েকজন যোদ্ধা নায়ককে ঘিরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ শত্রুর সঙ্গে তাঁরা পেরে উঠবে কেন? তাঁদের সবাইকে শমন সদনে পাঠিয়ে আফগানরা রক্তাক্ত কলেবর জগৎ সিংহকে নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। … আজ আফগানদের কত আনন্দ! মান সিংহের পুত্রকে হস্তগত করে তাঁরা ষে সুবিধা পেয়েছে সমগ্র মোঘলবাহিনীকে পরাভূত করলে তার চেয়ে বেশী কিছু পেত না। পুত্রের মুক্তির জন্য মান সিংহ তাঁদের বহু শর্তই মেনে নেবেন। তাঁরা বলবে – ‘মোঘল সেনাপতি! বাংলা ছেড়ে চলে যাও, তোমার পুত্রকে অক্ষত দেহে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো।’ এই হিতবাক্যে তিনি যদি কর্ণপাত না করেন তাহোলে রণক্ষেত্রে গিয়ে দেখবেন যে উচ্চ স্তম্ভের উপরে পুত্রের মৃতদেহ লটকানো রয়েছে। মৃত জগৎ সিংহের চেয়ে জীবিত জগৎ সিংহের মূল্য আফগানদের কাছে অনেক বেশী। তাই তাঁর রক্তপাত বন্ধ করবার জন্য তাঁদের নায়ক বাহাদুর খাঁ সঙ্গে সঙ্গে শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেন। … আফগানরা মান সিংহকে চেনে নি। তাঁর কাছে গিয়ে যখন এই দুঃসংবাদ পৌছায় তখন চারিদিকে গুজব উঠেছে যে, জগৎ সিংহ আর ইহজগতে নেই। চিন্তাব্যাকুল সৈন্যাধ্যক্ষরা মান সিংহকে পরামর্শ দিলেন যে এর পর আর যুদ্ধ চালানো উচিত হবে না, সমগ্র বাহিনীসহ সেলিমাবাদে ফিরে যাওয়া কর্তব্য; পরে সৈয়দ খাঁর সৈন্যরা এসে পৌঁছালে তাঁদের নিয়ে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করা যাবে। কিন্তু মান সিংহ অটল। ‘রাজপুত আমি, যে আফগানকে তাঁদের পিতৃভূমি আফগানিস্থানে পঙ্গু করে দিয়েছি তাঁদের ভয়ে বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যাবো? রাজপুত নামে কলঙ্ক লেপন করব? জগৎ সিংহ গিয়েছে – যাক। তাঁর জন্য এক হাতে অশ্রুজল মুছব আর অন্য হাতে কতলু খাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করব।’ জগৎ সিংহের জীবনই রোমাঞ্চময়! আফগানরা যখন তাঁকে তাঁদের সুলতান কতলু খাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে উপহার দেওয়ার আয়োজন করছিল সেই সময়ে বিষ্ণুপুররাজ বীর হাম্বীরের সৈন্যরা এসে তাঁদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। মোঘল-পাঠান যুদ্ধে যখন তাঁদের প্রভু নিরপেক্ষ তখন তাঁরা কোন পক্ষের সৈন্যকেই নিজের রাজ্যের ভিতর দিয়ে যেতে দেবে না। আফগান সৈন্যাধ্যক্ষ বাহাদুর খাঁ তরবারি কোষবদ্ধ ও বন্দুক টোটাহীন করে বললেন – ‘বিষ্ণুপুররাজের সার্বভৌমত্ব আমরা স্বীকার করি। রাজা বীর হাম্বীরের প্রতি নেপথ্যে সেলাম জানাচ্ছি। আফগানদের দুষমন তিনি নন – মোঘল। তাঁর সঙ্গে আফগানরা যুদ্ধ করবে না, তাঁরা তাঁর রাজ্যের মধ্যে থাকতেও চায় না; শুধু বন্দী জগৎ সিংহকে নিয়ে এই রাজ্যের বাইরে যেতে পারলে সুখী হবে।’ কিন্তু এই প্রস্তাবে বিষ্ণুপুর সৈন্যাধ্যক্ষ অসম্মতি জানিয়ে বিদ্যুৎগতিতে জগৎ সিংহকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজ রাজধানীর দিকে চলে গেলেন।” এরপরে মল্লরাজ ‘বীর হাম্বীর’ বিশেষ চিকিৎসক নিয়োগ করে আহত রাজকুমারকে নিরাময় করে তুলেছিলেন, বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর ‘তিলোত্তমা’ বা ওসমান খাঁর প্রেমিকা ‘আয়েষা’ সেকাজ করেন নি।

আরো পড়ুন-‘অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বেসরকারি ব্যবসা’

মান সিংহের মানসিক দৃঢ়তা সেবার মোঘলদেরকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচলেও শক্তির ভারসাম্য কিন্তু আফগানদের হাতেই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁদের অদৃষ্ট মন্দ ছিল, তাই তাঁরা যখন ক্ষীয়মান মোঘল বাহিনীর উপরে চরম আঘাত হানবার আয়োজন করছিলেন, ঠিক সেই সময়েই তাঁদের শিবিরের উপরে বিষাদের কালো ছায়া নেমে এসেছিল। তাঁদের সর্বাধিনায়ক কতলু খাঁ লোহানি যখন পরবর্তী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন একদিন হঠাৎই তাঁর শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, এবং চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে অল্প রোগভোগের পরেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। জগৎ সিংহ তখনও বিষ্ণুপুর প্রাসাদে রোগশয্যায় শায়িত ছিলেন, সেটি ছিল তাঁর আঘাতের নবম দিবস। আফগান বীর শের শাহের তিরোধানের পরে কতলু খাঁ লোহানির মত প্রতিভাবান রণনায়ক আফগানদের মধ্যে আর কেউ জন্মান নি। মোঘলদের চাপে যে আফগান শক্তি ভারতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তাঁর নেতৃত্বের ফলে তাঁরা নতুন জীবন লাভ করেছিলেন, এবং মোঘলদেরকে পাণ্টা আক্রমণ করবার শক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। দাউদ কররানি যেক্ষেত্রে বিনাযুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মোঘলদের হাতে সমর্পণ করেছিলেন, সেক্ষেত্রে নামমাত্র সম্বল নিয়ে কতলু খাঁ আকবরের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং শেষপর্যন্ত উড়িষ্যার সার্বভৌম অধীশ্বর বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। প্রধানতঃ দক্ষিণ থেকে তাঁর এবং উত্তর থেকে মাসুম খাঁ কাবুলির প্রতিরোধের ফলেই পূর্ব ভারতের উপরে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করা অত দিনেও সম্ভব হয়নি, তাঁদের সামনে মোঘল সেনাপতিদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গিয়েছিল।
সেই কতলু খাঁ তখন পরলোকে ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের নবাব কতলু খাঁ আর ইহলোকে ছিলেন না। এরপরে আফগানদের চালিত করবার মত ক্ষমতা আর কার মধ্যেই বা ছিল? কতলুর বালক পুত্র ‘নাসির খাঁ’কে উড়িষ্যার মসনদে বসিয়ে অসহায় উজীর ‘খাজা ঈশা’ সন্ধির প্রস্তাব করে মান সিংহের কাছে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন। মোঘল সেনাপতির মনও তখন অবসাদগ্রস্ত ছিল, জগৎ সিংহকে নিয়ে তখন বিষ্ণুপুর প্রাসাদে যমে মানুষে লড়াই চলছিল। তার উপরে তাঁর সৈন্যসংখ্যা তখন একেবারেই নগণ্য ছিল। তাই সবদিক বিবেচনা করে তিনি খাজা ঈশার প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ার পরে ঠিক হয়েছিল যে, বালক নাসির খাঁ আকবরের করদ রাজারূপে উড়িষ্যা শাসন করবেন, তাঁর শাসনাধীন জনপদের সর্বত্র বাদশাহের নামে খুৎবা পাঠ করা হবে। কেবলমাত্র পুরীর মহামন্দির ও সন্নিহিত অঞ্চলের উপরে তাঁর কোন অধিকার থাকবে না, বাদশাহের হয়ে রাজা মান সিংহ বা তাঁর প্রতিনিধি সেখানকার শাসনব্যবস্থা পরিচালিত করবেন। এরপরে উক্ত শর্তে সন্ধি সম্পাদনের জন্য বালক সুলতান নাসির খাঁ উজীর সমভিব্যহারে ১৫০টি হস্তী ও বহু মূল্যবান উপহারসহ মান সিংহের তাঁবুতে গিয়ে তাঁকে কুর্নীশ করেছিলেন। রাজা মানসিংহ নাসিরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে বহু সদুপদেশ দিয়ে বলেছিলেন যে, মোঘলদের অনুগত থাকলে আফগানদের লাভ ছাড়া লোকসান কিছুই হবে না। নাসির ও খাজা ঈশা তাঁর সেকথা মেনে নিয়ে কটকে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁদের বিদায়ের পরে মান সিংহও শান্ত মনে পাটনার দিকে রওনা হয়েছিলেন।
কিন্তু আফগানরা আফগানই ছিলেন। তাঁরা তাঁদের রঙ বদলাননি। মোঘলদের সঙ্গে সন্ধি সম্পাদনের দুই বছর পরে উজীর খাজা ঈশার মৃত্যু হওয়া মাত্র আফগানরা আবার নিজ মূর্তি ধারণ করেছিলেন। নিজেদের চরম শত্রু মোঘলদের সাথে করা কোন সন্ধিই তাঁরা আর মানতে চাননি। ফলে আকবরকে বাদ দিয়ে উড়িষ্যার সর্বত্র তখন নাসির খাঁর নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচার শুরু হয়েছিল, একই সাথে আফগানরা আবার মোঘলদের সাথে যুদ্ধের জন্য তৈরী হতে শুরু করেছিলেন। মান সিংহ আফগানদের সকল দুর্গতির মূল ছিলেন বলে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন জগন্নাথক্ষেত্রের উপরে হামলা করে তাঁদের সেই নতুন অভিযান শুরু হয়েছিল। এর আগে তাঁরা মল্লরাজা বীর হাম্বীকে নিরপেক্ষ বলে স্বীকার করতেন, এবং সেজন্য তাঁকে সম্মানও করতেন। কিন্তু তিনি যেহেতু আফগানদের হাতে বন্দী জগৎ সিংহকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, সেহেতু পরবর্তী সময়ে আফগানরা তাঁকে আর নিরপেক্ষ বলে মেনে নেন নি। তাই আফগান সৈন্যরা তাঁর রাজ্যে প্রবেশ করে কয়েকদিন ধরে লুঠপাট চালিয়েছিলেন, ও পরে আরো এগিয়ে গিয়ে সুবর্ণরেখা নদী পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ অধিকার করে নিয়েছিলেন। ওদিকে পাটনায় মান সিংহের কাছে তখন সব খবরই পৌঁছাচ্ছিল। আফগানদের তিনি ভাল করেই চিনতেন, কিন্তু অত তাড়াতাড়ি যে তাঁরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেন – সেকথা তিনি ভাবতেও পারেন নি। তাই তাঁদের দমন করবার জন্য ১৫৯১ খৃষ্টাব্দের ৩রা নভেম্বর তারিখে তিনি আরেকবার পাটনা থেকে রওনা হয়েছিলেন। সেবারে বাংলার সালার-এ-সুবা সৈয়দ খাঁ সসৈন্যে এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দেওয়ার ফলে সেই সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে জলেশ্বর পর্যন্ত ভূভাগ অধিকার করতে মান সিংহের বিশেষ কোন অসুবিধা হয়নি। তারপর থেকেই বঙ্গদেশে আফগানদের সঙ্গে মোঘলদের বিরামহীন যুদ্ধ চলেছিল। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আফগানরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মোঘল শিবিরের উপরে আক্রমণ চালিয়ে তাঁদের অস্থির করে তুলেছিলেন। ওই ভাবে কয়েক মাস কাটাবার পরে ১৫৯২ খৃষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল তারিখে আফগানরা আবার উত্তরদিকে এগিয়ে গিয়ে সুবর্ণরেখা পার করলে সেখানেই উভয়পক্ষে মধ্যে বিরাটাকারে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। সেই যুদ্ধের গোড়ার দিকে মোঘলদের অবস্থা বেশ সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল, কিন্তু জগৎসিংহ ও তাঁর ভাই ‘দুর্জন সিংহের’ অপূর্ব রণনৈপুণ্যের জন্য আফগানরা শেষ পর্য্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন। তাঁদের নতুন সেনাপতি ওসমান খাঁ – আয়েষার প্রেমিক ওসমান – সেবারে অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপরে আফগানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে আরম্ভ করলে মোঘল সৈন্যরা তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করে জলেশ্বরে গিয়ে উপনীত হয়েছিলেন। সেখানে আবার আকবরের নামে খুৎবা পাঠ শুরু হয়েছিল, ও মোঘল সৈন্যরা নেচে গেয়ে বিজয়োৎসব পালন করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাংলার সালার-এ-সুবা সৈয়দ খাঁর মনে তখন শান্তি ছিল না। তনি অত প্রাণপাত করে আফগানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্ত্বেও, সবাই মান সিংহের নামেই জয়ধ্বনি করেছিলেন, তাঁর নাম ও বীরত্বের কথা কেউ মুখে পর্যন্ত আনেন নি! ঈর্ষা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। সেই ঈর্ষাদগ্ধ হৃদয়েই সৈয়দ খাঁ তখন শত্রুর কথা বিস্মৃত হয়ে হঠাৎই নিজের সৈন্যবাহিনীসহ তাড়ায় ফিরে যাওয়ার ফলে মান সিংহের অবস্থা তখন সংঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠলেও, তিনি নিজের সৈন্যদের নিয়েই আফগানদের বিরুদ্ধে এগিয়ে গিয়েছিলেন। মোঘল শিবিরের সেই মনোমালিন্যের সংবাদ হয়ত আফগানদের কাছে পৌঁছেছিল, কিংবা হয়ত পৌছায় নি। কিন্তু তাঁরা তখন এমনই ভীতিবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, ওসব দেখবার মনোবৃত্তিও তাঁদের ছিল না। এরপরে আফগানরা ঝিমিয়ে পড়লেও মান সিংহ কিন্তু বিশ্রাম পাননি; কারণ, খুরদারাজ ‘রামচন্দ্রদেব’ তখন তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। ওই সময়ে বিনা বাধায় ভদ্রক পর্য্যন্ত এগিয়ে গিয়ে মান সিংহ জানতে পেরেছিলেন যে, আফগানরা আবার সারনগড় দুর্গের কাছে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন। তৎকালীন উড়িষ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ সামন্ত নরপতি খুরদারাজের অধিকারের মধ্যে তখন সেই দুর্জয় দুর্গটি অবস্থিত ছিল। গোয়ালিয়র ও রোহটাস দুর্গের মতই সেটির সুদৃঢ় রক্ষাব্যবস্থা ছিল। তাই সেই দুর্গ জয়ের চেষ্টায় নিজের শক্তির অপব্যয় না করে মান সিংহ তখন সোজা কটকের দিকে চলে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে তিনি যতটা প্রতিরোধ আশা করেছিলেন সেসবের কিছুই পাননি; যে মুষ্টিমেয় আফগানরা সেখানে ছিলেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় তাঁর হাতে রাজধানী তুলে দিয়েছিলেন। এরপরে আউল ও আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র দুর্গও সহজেই তাঁর হস্তগত হয়েছিল। তারপর কয়েকদিন জগন্নাথক্ষেত্রে কাটিয়ে মানসিংহ সোজা খুরদারাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। রাজা রামচন্দ্রদেব দেখেছিলেন যে, আফগানদের পতনের ফলে তিনি অসহায় হয়ে পড়েছেন; আর তিনি এটাও জানতেন যে, বহু আফগান হয়ত তখন মোঘলদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তৈরী হচ্ছেন। তাই সেই অসম যুদ্ধে সাফল্যলাভ করা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে তিনি সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে তাঁর পুত্র ‘বীরবর’কে মানসিংহের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময়েই মোঘল সেনাপতির কাছে খবর গিয়েছিল যে, আফগানরা তাঁর পিছনদিকে আবার সক্রিয় হয়ে উঠে জলেশ্বর কেড়ে নিয়েছেন। তাই ওই পটভূমিকায় আফগানপক্ষীয় রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে সন্ধির আলোচনা অসঙ্গত বিবেচনা করে তিনি নিজের অর্দ্ধেক সৈন্যকে আফগানদের বিরুদ্ধে এবং বাকি অর্দ্ধেককে পুত্র জগৎ সিংহের নেতৃত্বে খুরদারাজের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই আচরণে হতাশ না হয়ে, যুবরাজ বীরবর কিন্তু মান সিংহের শিবিরে যাতায়াত চালিয়ে গিয়েছিলেন। মোঘল সেনাপতি লক্ষ্য করেছিলেন যে, খুরদারাজ আফগানদের ত্যাগ করে মোঘল পক্ষে যোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি নিজে যেচে এগিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি। তাতে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল যে, রামচন্দ্রদেব হয়ত ‘রাণা প্রতাপের’ মতই তাঁর সান্নিধ্য পরিহার করতে চাইছেন। অথচ সেই ধরণের করবার কোন কারণ তিনি খুঁজে পাননি। তিনি রামচন্দ্রদেবের চেয়ে কিছু কম হিন্দু ছিলেন না। কিছুদিন আগেই তিনি আফগানদের হাত থেকে জগন্নাথক্ষেত্র মুক্ত করেছিলেন; অথচ খুরদারাজ সেজন্য তাঁর প্রতি কোন কৃতজ্ঞতা জানানো দূরের কথা বরং আফগানদের সাহায্য করেছিলেন। তাই রামচন্দ্রদেবের শাস্তি বিধানের জন্য মান সিংহ যুবরাজ বীরবরকে রিক্তহস্তে তাঁর পিতার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেছিলেন। সারণগড় দুর্গ তাঁর প্রয়োজন ছিল, আর রাজা রামচন্দ্রদেবকেও তাঁর দরকার ছিল। তাঁর সেই আক্রমণে খুরদা রাজ্যের ক্ষুদ্রতর দুর্গগুলির একে একে পতন ঘটবার ফলে রামচন্দ্রদেব শেষপর্যন্ত খুরদা দুর্গে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তারপরে ওই দুর্গ অধিকারের জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আগ্রায় আকবরের কাছে সেই সংবাদ পৌঁছানোর পরে এক মিত্ররাজ্যের বিরুদ্ধে মান সিংহের সেই অহেতুক কঠোরতার জন্য তিনি রীতিমতো বিস্মিত ও বিরক্ত হয়েছিলেন। এরপরে দ্রুতগামী একজন দূতকে পাঠিয়ে তিনি মান সিংহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, রামচন্দ্রদেবের বিরুদ্ধে তখনই যেন বন্ধ করা হয়। রামচন্দ্রদেব ভারতের এক সুপ্রাচীন রাজবংশের সন্তান ছিলেন, তাঁর মর্য্যাদা ক্ষুণ্ণ করে আকবর চেঙ্গিজ বংশে কলঙ্ক লেপন করতে চাননি। মান সিংহের কঠোরতায় যেটা সম্ভব হয় নি, আকবরের কোমলতায় অনায়াসেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। বাদশাহের বাণী রামচন্দ্রদেবের কাছে পৌঁছানোর পরে তিনি ১৫৯৩ খৃষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারী তারিখে নিজের পাত্রমিত্রকে সঙ্গে নিয়ে মান সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মোঘল সেনাপতির মনোব্যথা তিনি জানতেন, তাই তাঁকে যে পংক্তিবহির্ভূত ব্যক্তি বলে তিনি মনে করেন না, সেটার প্রমাণ দেওয়ার জন্য নিজের এক কন্যার সঙ্গে তিনি তাঁর বিবাহে সম্মতি জানিয়েছিলেন। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্র বিবাহ বাসরে পরিণত হয়েছিল। বিবাহান্তে মানসিংহ তাঁর নতুন শ্বশুরকে মানপুর দুর্গ উপহার দিয়ে সম্মান জানিয়েছিলেন।
(পরের পর্বে সমাপ্ত)

(তথ্যসূত্র:
১- Tabakat-i-Akbari, Nazimuddin Ahmed.
২- Akbarnama iii, Abul Fazl Allami.
৩- Tarikh-i-Sher Shahi, Abbas Sarwani, Elliot’s translation.
৪- Tarikh-i-Salatin-i-Afghann, Ahmed Yadgar.
৫- Makhzan-i- Afghani, Niamatullah, Elliot’s translation.
৬- Riyaz-us-Salatin, Ghulam Husain Salim.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

ইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্যইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্য

রানা চক্রবর্তীঃ ভারতে মোঘলদের হাত থেকে রাজ্যশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করবার সময়ে ঐতিহ্যসূত্র ধরে ইংরেজদের তাঁদের ভৃত্যমণ্ডলীকেও গ্রহণ করতে হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ভারতে মোঘল শাসনের ধার না থাকলেও, ভার

পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনওপৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

এত বৃহৎ পৃথিবীতে রহস্য রোমাঞ্চের শেষ নেই। কোনো জায়গায় ছোট্ট একখানা জমির জন্য লড়াই চলে, তো কখনো একটা গোটা দেশকেই গ্রাস করে নেয় আগ্রাসী শক্তি। তবে আজ আমরা এমন এক

টেরাকোটা সাহেবে’র কথাটেরাকোটা সাহেবে’র কথা

ইংরেজ সাহেব। কেমব্রিজে পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। গিয়েছিলেন বীরভূমের রবীন্দ্র তীর্থে। কিন্তু শান্তিনিকেতনে মন টিকল না। তুসা বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন যাদবপুরে। থাকতেন কলকাতার

আধুনিক যুদ্ধের নিঃশব্দ স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদূত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রআধুনিক যুদ্ধের নিঃশব্দ স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদূত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র

মহাভারতের রয়েছে নারায়ণাস্ত্র, পাশুপাত অস্ত্র, ব্রহ্মদণ্ড অস্ত্র সহ এমনসব একাধিক অস্ত্রের বিবরণ যাদের সাথে হুবুহু মিল রয়েছে বর্তমান যুগের স্যাটেলাইট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের। মহাভারতের বিবরণ অনুসারে মানবজাতির