‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম - একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)

‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ এবারে শ্ৰীম লিখিত গ্রন্থের রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম প্রসঙ্গে আসা যাক। রামচন্দ্র দত্ত, স্বামী সারদানন্দ, অক্ষয় সেন প্রমুখ তাঁদের গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গ দু’-এক কথায় বা অল্প কথায় লিখলেও, শ্রীম সেটার জন্য নিজের গ্রন্থের ২৬ পৃষ্ঠা ব্যয় করেছিলেন। শ্ৰীম তাঁর ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ গ্রন্থের পঞ্চম ভাগে প্রধানতঃ অক্ষয় সেনের লেখা অংশটি নিয়েই (অবশ্য মদের প্রসঙ্গটা বাদ দিয়ে) বানিয়ে বানিয়ে বড় একটি কাহিনী খাড়া করেছিলেন। অমাবস্যায় রামকৃষ্ণের মদের তিলক নেওয়ার প্রসঙ্গ এসে যেতে পারে বলেই হয়ত, অক্ষয় সেন ঐদিন অমাবস্যা তিথি ছিল বলে লিখলেও, শ্রীম কিন্তু সেটা পরিবর্তন করে কৃষ্ণা চতুর্থী করে দিয়েছিলেন। শ্রীম লিখেছিলেন যে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর তারিখে অধর সেনের বাড়িতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাৎকার হয়েছিল। সেদিন সেখানে বহু ব্রাহ্ম, কয়েকজন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় রামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রকে – ‘মানুষের কর্তব্য কি’ – এই প্রশ্নটি করলে, বঙ্কিমচন্দ্ৰ – ‘আহার, নিদ্রা ও মৈথুন’ – উত্তর দিয়েছিলেন। ওই ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র, ‘নবজীবন’ পত্রিকার সম্পাদক ‘অক্ষয়চন্দ্র সরকারের’ ভাষায় – “সাহিত্য-সম্রাটরূপে তখন তিনি কলকাতায় কলুটোলায় অবস্থান করিতেছেন।” আর ‘রবীন্দ্রনাথের’ ভাষায় – “এই সময় অক্ষয় সরকার মহাশয় নবজীবন মাসিক পত্র বাহির করিয়াছেন। … বঙ্কিমবাবু তখন বঙ্গদর্শনের পালা শেষ করিয়া ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন। প্রচার বাহির হইতেছে।” বঙ্কিমচন্দ্র ঐ সময়ে একপ্রকার হিন্দুধর্মের প্রচারকের ভূমিকা নিয়েই ‘নবজীবন’ ও ‘প্রচার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের নিজেরই ভাষায় – “নবজীবনে আমি হিন্দুধর্ম – যে হিন্দুধর্ম আমি গ্রহণ করি তাহার পক্ষ সমর্থন করিয়া নিয়মক্রমে লিখিতে ছিলাম। প্রচারেও ঐ বিষয়ে নিয়মক্রমে লিখিতে লাগিলাম।” শ্রীম যে ৬ই ডিসেম্বর বা অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাতের কথা বলেছিলেন, ঠিক ঐ অগ্রহায়ণ মাসেই রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘একটি পুরাতন কথা’ নামের একটি প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রকে তীব্র আক্রমণ করে লিখেছিলেন, “আমাদের দেশের প্রধান লেখক প্রকাশ্য ভাবে, অসংকোচে, নির্ভয়ে, অসত্যকে সত্যের সহিত একাসনে বসাইয়াছেন, সত্যের পূর্ণ সত্যতা অস্বীকার করিয়াছেন কোনখানেই মিথ্যা সত্য হয় না; শ্রদ্ধাস্পদ বঙ্কিমবাবু বলিলেও হয় না, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলিলেও হয় না।” অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমদিকে ভারতীতে রবীন্দ্রনাথের লেখা সেই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, এবং সেটি পড়ে ঐ অগ্রহায়ণ মাসেরই শেষের দিকে প্রকাশিত ‘প্রচার’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের পাল্টা উত্তর দিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা সেই প্রতিবাদ প্রবন্ধটির নাম ছিল – ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়’। এর আগে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর মূল প্রবন্ধে তাঁর পরিচিত দু’জন হিন্দুর দোষ-গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একজনের সম্বন্ধে বলেছিলেন, “তিনি যদি মিথ্যা কথা কহেন, তবে মহাভারতার কৃষ্ণোক্তি স্মরণ পূর্বক যেখানে লোক-হিতার্থ মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয় অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন।” উক্ত কথাটি নিয়েই রবীন্দ্রনাথ সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গ প্রশ্ন তুলে বঙ্কিমচন্দ্রকে আক্রমণ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সেই আক্রমণের উত্তর দিতে গিয়ে তাঁর প্রবন্ধে ঐ ‘কৃষ্ণোক্তি’ সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “ঐ কৃষ্ণোক্তির মর্ম পাঠককে এখন সংক্ষেপে বুঝাই। কর্ণের যুদ্ধে পরাজিত হইয়া যুধিষ্ঠির শিবিরে পলায়ন করিয়া শুইয়া আছেন। তাঁহার জন্য চিন্তিত হইয়া কৃষ্ণার্জুন সেখানে উপস্থিত হইলেন। যুধিষ্ঠির কর্ণের পরাক্রমে কাতর ছিলেন, ভাবিতে ছিলেন, অর্জুন এতক্ষণ কর্ণকে বধ করিয়া আসিতেছে। অর্জুন আসিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কর্ণ বধ হইয়াছে কি না। অর্জুন বলিলেন, না হয় নাই। তখন যুধিষ্ঠির রাগান্ধ হইয়া অর্জুনের অনেক নিন্দা করিলেন, এবং অর্জুনের গাণ্ডীবের অনেক নিন্দা করিলেন। অর্জুনের একটি প্রতিজ্ঞা ছিল – যে গাণ্ডীবের নিন্দা করিবে, তাঁহাকে তিনি বধ করিবেন। কাজেই এক্ষণে ‘সত্য’ রক্ষার জন্য তিনি যুধিষ্ঠিরকে বধ করিতে বাধ্য – নহিলে ‘সত্য’-চ্যুত হইবেন। তিনি জ্যৈষ্ঠ সহোদরের বধে উদ্যত হইলেন – মনে করিলেন, তারপর প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আত্মহত্যা করিবেন। এই সকল জানিয়া শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁহাকে বুঝাইলেন যে, এরূপ সত্য রক্ষণীয় নহে। এ সত্য লঙ্ঘনই ধর্ম। এখানে সত্যচ্যুতিই ধৰ্ম। এখানে মিথ্যাই সত্য হয়।” যাই হোক, আগ্রহী পাঠক-পাঠিকারা বঙ্কিম রচনাবলী থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ঐ প্রবন্ধটি পড়লে দেখতে পাবেন যে, তিনি কত ভদ্র ও সংযত ভাষায় এবং তাঁকে আক্রমণকারী রবীন্দ্রনাথের উচ্চ প্রশংসা করেই ওই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ঐ প্রবন্ধেরই এক জায়গায় প্রসঙ্গতঃ লিখেছিলেন, “যে কারণেই হউক, প্রচার প্রকাশিত হইবার পর আমি আদি ব্রাহ্ম সমাজ ভুক্ত লেখকদিগের দ্বারা চারিবার আক্রান্ত হইয়াছি। রবীন্দ্রবাবুর এই আক্রমণ চতুর্থ আক্রমণ। গড় পড়তায় মাসে একটি। এই সকল আক্রমণের তীব্রতা একটু পরদা পরদা উঠিতেছে।” বঙ্কিমের লেখার সূত্র ধরেই বলা যায় যে, ব্রাহ্মরা যখন গড়পড়তায় মাসে একটি করে এবং একটু একটুঁ করে পরদা পরদা উঠে বঙ্কিমচন্দ্রকে তীব্রভাবে আক্রমণ করছিলেন, এবং যেদিন বঙ্কিমচন্দ্র সত্য-অসত্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আক্রমণাত্মক প্রবন্ধের উত্তর লিখেছিলেন, বা লেখা সবে শেষ করেছিলেন, ঠিক সেই সময়েই ব্রাহ্মদের ও অন্যান্য গণমান্য ব্যক্তিদের সমক্ষে মানুষের কর্তব্য সম্বন্ধে তিনি ঐ ধরণের উত্তর দিয়েছিলেন, এটা কার্যত অসম্ভব পর্যায়ে পড়ে। তিনি ওই ধরণের কোন উত্তর দিলে সেদিন সেখানে উপস্থিত ব্রাহ্মদের মুখ থেকে সেকথা শুনে লেখক ব্রাহ্মরা নিশ্চই আবার বঙ্কিমচন্দ্রকে আক্রমণ করতেন। শ্রীম তাঁর গ্রন্থের তৃতীয় ভাগেও রামকৃষ্ণের মুখে বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে এমনি আরেকটি অসম্ভব কথা বসিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “একজন ভক্ত বলিলেন – শ্রীযুক্ত বঙ্কিম কৃষ্ণ চরিত্র লিখেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ – বঙ্কিম শ্রীকৃষ্ণ মানে, শ্রীমতী মানে না। কাপ্তেন – ঈশ্বর মনুষ্য হয়ে বৃন্দাবনে এসেছিলেন, রাধাকৃষ্ণলীলা, তা মানেন না? শ্রীরামকৃষ্ণ – (সহাস্যে) ও সব কথা যে খবরের কাগজে নেই, কেমন করে মানা যায়? একজন তাঁর বন্ধুকে এসে বললে, ওহে কাল ওপাড়া দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলাম সে বাড়িটা হুড়মুড় করে পড়ে গেল। বন্ধু বললে, দাঁড়াও হে, একবার খবরের কাগজখানা আনি। এখন বাড়ি হুড়মুড় করে পড়ার কথা কাগজে তো কিছুই নাই। – ‘ও সব কাজের কথা নয়।’ সে লোকটা বললে – ‘আমি যে দেখে এলাম।’ ও বললে, ‘তা হোক, যে কালে খবরের কাগজে নাই, সে কালে ও কথা বিশ্বাস করলুম না।’ ঈশ্বর মনুষ্য হয়ে লীলা করেন, এ কথা কেমন করে বিশ্বাস করবে? ও কথা যে ওদের ইংরেজি লেখাপড়ার ভিতর নেই। পূর্ণ অবতার বোঝান বড় শক্ত, কি বল? চৌদ্দ পোয়ার ভিতর অনন্ত আসা।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, ১৭ খণ্ড, ৩য় পরিচ্ছেদ) শ্রীমতী মানা না মানাটা অন্য কথা, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে সে সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু ‘ঈশ্বর মনুষ্য হয়ে লীলা করেন’, ইংরেজি বিদ্যার মধ্যে সেকথা নেই বলেই, বঙ্কিমচন্দ্র সেকথায় বিশ্বাস করতেন না, সেটা ঠিক তথ্য নয়। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র ‘শ্রীশ মজুমদার’কে ১৮৮৫ সালের ১০ই অক্টোবর তারিখের একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “কৃষ্ণচরিত্র মনুষ্যচরিত্র। ঈশ্বর লোকহিতার্থে মনুষ্য চরিত্র গ্রহণ করিয়া ছিলেন।” এছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থের প্রথমেও লিখেছিলেন, “কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং। আমি নিজেও কৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান বলিয়া বিশ্বাস করি। পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিণাম আমার এই হইয়াছে যে, আমার সে বিশ্বাস দৃঢ়ীভূত হইয়াছে।” তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজি বিদ্যালাভ করেই বরং ঈশ্বরের মানুষ হতে পারা সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা দৃঢ়ীভূত হয়েছিল।

এতক্ষণ ধরে রামচন্দ্র দত্তের লেখা একটি মাত্র কথা – অধর সেনের বাড়িতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের দেখা হলে রামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বঙ্কিম’ (বাঁকা) বলে রহস্য করেছিলেন – এই কথাটিকে নিয়ে স্বামী সারদানন্দ, ‘মনে ময়লা’ওয়লা অক্ষয় সেন, এবং শ্ৰীম কি ভাবে নিজেদের ইচ্ছামত কাহিনী লিখে বঙ্কিমচন্দ্রকে হেয় বা ছোট করেছিলেন, সেটা দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁদের সকলেরই, বিশেষ করে শ্রীমের লেখা কথাগুলিকে নিয়ে ঔপন্যাসিক ‘অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত’ তো আবার নিজের কল্পনা বিস্তারে সকলকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। অচিন্ত্যকুমার শ্রীমের গ্রন্থ থেকে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গের এক একটা কথা উদ্ধৃত করে সেগুলোর সঙ্গে নিজের কল্পনাকে জড়িয়ে দিয়ে নানা মন্তব্য করেছিলেন। অচিন্ত্যকুমার তাঁর কর্মজীবনে বিচারক ছিলেন। কিন্তু তিনি একজন অতি সাধারণ বিচারকের মতোই শ্রীম প্রভৃতির লেখার কোন সত্য মিথ্যা যাচাই করেন নি। উল্টে নিজে বানিয়ে তাঁদের কথার উপরে নানা মন্তব্য করে বঙ্কিমচন্দ্রকে আরও ছোট করেছিলেন। অচিন্ত্যকুমারের সেই ধরণের লেখাগুলি নিয়ে এখানে বেশী আলোচনার কোন প্রয়োজন নেই, শুধু একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। তিনি লিখেছিলেন, “ঠাকুর – বিশেষ করে তাকালেন আবার বঙ্কিমের দিকে, কোমল স্বরে বললেন, ‘আপনি যেন কিছু মনে কোরো না।’ সরল সপ্রতিভের মত বঙ্কিম বললে, ‘আজ্ঞে মিষ্টি শুনতে আসি নি।’ কিন্তু বঙ্কিম জানে তাঁর অন্তরের মধ্যে এর চেয়ে আর মিষ্টি নেই ৷ শক্তিশালী ওষুধের নাম জানি না, খেতে খুব ঝাঁঝালো, কিন্তু মধুরের মত কাজ করে আত্মগুণে,আরোগ্য এনে দেয়। তেমনি অর্থ জানি না মন্ত্রের, উচ্চারণও হয়তো ঠিক হয় না, কিন্তু আত্মগুণে কাজ করে, এনে দেয় নৈরুজ্য। তেমনি তিরস্কারের মধ্য দিয়েই আসুক সেই নামের পুরস্কার। ভক্ত ঈশ্বরের কাছে বিষয় চাইলেও ঈশ্বর তাঁকে তাঁর পাদপল্লবই উপহার দেন। হে প্রভু তোমাকে ত্যাগ কবে স্বৰ্গ চাই না। ব্রহ্মলোক চাই না। সার্বভৌম রসাধিপত্যও চাই না। চাই না যোগ সিদ্ধি। চাই না অপুনর্ভব। ক্ষুধার্ত শিশু বা অজাতপক্ষ বিহঙ্গ যেমন তার মা’র জন্যে উৎকণ্ঠিত, বিরহিণী স্ত্রী যেমন প্রবাসগত পতির জন্যে উৎকন্ঠিত, হে মনোহর অরবিন্দ নেত্র, তোমাকে দেখবার জন্যে আমিও তেমনি উৎকন্ঠিত হয়েছি।” (পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ) উদ্ধৃত অংশ থেকে লক্ষ্যণীয় যে, অচিন্ত্যকুমার রামকৃষ্ণের বেলায় ঠাকুর তাকালেন, বললেন, লিখেছিলেন; কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের বেলায় বঙ্কিম বললে, বঙ্কিম জানে, লিখেছিলেন। রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গে অচিন্ত্যকুমার বরাবরই বঙ্কিমচন্দ্রকে (শুধু বঙ্কিমচন্দ্রকে কেন, তিনি তাঁর গ্রন্থে পণ্ডিত বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি সকলকেই) এই ভাবে রামকৃষ্ণের সঙ্গে তারতম্য করে লিখেছিলেন। যাই হোক, অচিন্ত্যকুমার লিখেছিলেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র রামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শনেই নাকি বলেছিলেন, হে প্রভু, তোমাকে ছেড়ে আমি স্বর্গ, ব্ৰহ্মলোক, যোগসিদ্ধি প্রভৃতি কিছুই চাই না। তোমাকে দেখবার জন্য আমি উৎকণ্ঠিত। বাস্তবে রামকৃষ্ণকে দেখবার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের যদি অতই আগ্রহ থাকত, এবং তাঁকে ছেড়ে তিনি স্বর্গ বা মোক্ষ না চাইতেন, তাহলে এরপরে তিনি রামকৃষ্ণের সঙ্গে আর দেখা করেন নি কেন? বঙ্কিমচন্দ্র তো তাঁর শেষ জীবনে কলকাতাতেই বাস করতেন, আর রামকৃষ্ণও তো তখন কলকাতার পাশেই দক্ষিণেশ্বরে থাকতেন। সব চেয়ে বড় কথা হল, বঙ্কিমচন্দ্র যদি রামকৃষ্ণের অত বড় ভক্তই ছিলেন, তাহলে তিনি রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে কখনও কোথাও একটি কথাও বলেন নি কেন? আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের, তাঁর সমসাময়িক ‘ভূদেব মুখোপাধ্যায়’, ‘দীনবন্ধু মিত্র’, ‘হেমচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়’ প্রমুখের মতোই রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে কোনদিন কোন আগ্রহই ছিল না, এবং কোনদিন তিনি রামকৃষ্ণকে হয়ত দেখেনও নি।
এবারে ‘ভবতোষ দত্ত’ লিখিত ‘চিন্তানায়ক বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থের প্রসঙ্গে আসা যাক। ভবতোষ দত্ত-ও কোন ধরণের চিন্তা না করেই অচিন্ত্য সেনগুপ্তর মত শ্রীমকে অবলম্বন করে তাঁর গ্রন্থে লিখেছিলেন, “মানুষের কর্তব্য কি হওয়া উচিত, এ বিষয়ে পরমহংস দেব বঙ্কিমচন্দ্রের মত জিজ্ঞাসা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র উত্তরে জৈবক্রিয়াগুলিরই উল্লেখ করে ছিলেন বলে তিনি অত্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করেন।” দেখা যাচ্ছে যে, অক্ষয় সেন থেকে শুরু হয়ে অচিন্ত্য সেনগুপ্ত পর্যন্ত তাঁরা সকলেই বঙ্কিমের মুখে তিনটি জৈবক্রিয়ার কথাই বসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভবতোষ দত্ত আরেকটু বাড়িয়ে ‘জৈব- ক্রিয়াগুলি’ বলে সব জৈবক্রিয়াকেই বলেছিলেন। পাঠক-পাঠিকারা নিজেরাই চিন্তা করে দেখুন, একজন অতি বড় মূর্খকেও কেউ যদি কখনো জিজ্ঞাসা করেন যে, মানুষের কর্তব্য কি হওয়া উচিত? তাহলে সেই মূর্খও কি ভাববেন না যে, প্রশ্নকর্তা নিশ্চয়ই ঈশ্বর চিন্তা, পরোপকার, জীবে দয়া, গুরুভক্তি বা সৎ জীবন যাপন – এই ধরণেরই কোন কথা বিষয়ে জানতে চাইছেন? মানুষের কর্তব্য কি হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে খাওয়া, ঘুমনো প্রভৃতি জৈবক্রিয়ার কথা কেউই কখনোই বলবেন না। কারণ, মানুষ মাত্রেই জানেন যে, সেগুলো জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ সবারই জন্য অত্যন্ত সহজাত ব্যাপার। অতএব, মানুষের কর্তব্য কি হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্কিমের মত একজন জ্ঞানী মানুষ কখনোই আহার, নিদ্রা, মৈথুন বলতে পারেন না, এবং তিনি সেকথা বলেনও নি। আসলে যে অক্ষয় সেনের কথা স্বামী গম্ভীরানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী মাধবানন্দ প্রভৃতি সন্ন্যাসীরাও বিশ্বাস করতেন না, সেই বিকৃতমনা অক্ষয় সেনেরই সেটি নিজের বানানো কথা বা তাঁর ‘ময়লা’ মনের কথা ছিল। আর তাঁর মনে যে ‘ময়লা’ ছিল, সে তো স্বয়ং রামকৃষ্ণ দেবই নিজের মুখে বলে গিয়েছিলেন।
আগেই বলা হয়েছে যে, রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল, এমন কথা বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের মুখে থেকে শুনে তাঁর পরিচিত কেউই তাঁদের বঙ্কিম-স্মৃতি কথায় লেখেন নি। বঙ্কিমচন্দ্রের বিশেষ পরিচিত ‘শ্রীশ মজুমদার’, বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর ৮ বছর পরে, ১৩০৮ বঙ্গাব্দের মাঘ-ফাল্গুন সংখ্যার ‘সমালোচনী’ পত্রিকায় তাঁর ‘বঙ্কিমবাবুর প্রসঙ্গ – তৃতীয় প্রস্তাব’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “পরমহংস রামকৃষ্ণের সহিত বাবু অধরলাল সেনের গৃহে একদিন বঙ্কিমবাবুর সাক্ষাৎ ঘটে। পরমহংস কথায় কথায় বলিয়া ছিলেন – শুনিয়াছি আপনার বড় বিদ্যার অভিমান। বঙ্কিমবাবু তাহাতে ক্ষুব্ধ না হইয়া বরং ধর্মোপদেশ শুনিতে চাহিয়া ছিলেন। তাহাতেও পরমহংস নরম হন নাই। বঙ্কিমবাবু হাসিয়া সকল উড়াইয়া ছিলেন। তাঁহাদের অতঃপর আর কখন দেখাশুনা হইয়া ছিল কিনা, আমি অবগত নহি।” এখানে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রীশ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃই হয়ত তাঁর বেশ প্রশংসাই করেছিলেন। লক্ষ্যণীয় হল, তিনিও কিন্তু লেখেন নি যে, ঐ কথা তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে থেকেই শুনেছিলেন। শ্রীশ তাঁর ‘বঙ্কিমবাবুর প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর নিজের কথাবার্তা ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে অপরের কাছ থেকে শোনা কথাও লিখেছিলেন। সেই হিসাবে, তিনি হয়ত রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র সাক্ষাতের কাহিনীটি রাম দত্ত অথবা অক্ষয় সেনের বই-পড়া কারো মুখ থেকে শুনে, সেই কথাগুলোকেই নিজের পছন্দ মত করে সাজিয়ে নিয়ে লিখে থাকতে পারেন। এখন কেউ যদি বলেন, শ্রীশ যখন লিখেছিলেন, “পরে আর দেখা হয়ে ছিল কিনা আমি অবগত নহি” – তখন এ থেকে তো বলা যেতে পারে যে, রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সাক্ষাতের কথাটা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। হয়ত জানতেন। কিন্তু তাঁর সেই জানাটা তো রাম দত্ত কিংবা অক্ষয় সেনের বই পড়া কোন ব্যক্তির কাছে শুনেও হতে পারে! তিনি নিজে কিন্তু ঐ সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করেন নি, এবং বঙ্কিমচন্দ্রের মুখে শুনেও সেকথা তাঁর প্রবন্ধে লেখেন নি। বঙ্কিমচন্দ্রের মুখে সেবিষয়ে তিনি কিছু শুনে থাকলে, তাঁর প্রবন্ধের অপর ঘটনাগুলির মত সেটার সম্পর্কেও নিশ্চয় লিখতেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই তাঁকে সেকথা বলেছিলেন। তাছাড়া শ্রীশ প্রবন্ধে তাঁর জানা বলে বর্ণিত এমন অনেক কথা আছে, যেগুলো ঠিক নয়। কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক।
(১) শ্রীশ লিখেছিলেন, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এলবার্ট কলেজের পুরস্কার বিতরণী সভায় সভাপতি রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বক্তৃতা শোনা কালে একজন ‘দেশ বিশ্ৰুত’ ব্যক্তি হেসে হেসে এবং মাথা নেড়ে নেড়ে বক্তার প্রতিটি কথা অনুমোদন করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র সেদিন সভামঞ্চেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি সভার ঐ ‘দেশ বিশ্রুত’ ব্যক্তিকে দেখেই সম্ভবতঃ পরে তাঁর মুচিরাম গুড়ের জীবনীটি লিখেছিলেন। শ্রীশর একথা আদৌ ঠিক নয়। কারণ, ১৮৮৫ সালের অনেক আগেই বঙ্কিম তাঁর মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত লিখে ফেলেছিলেন।
(২) শ্রীশ লিখেছিলেন, “সত্য সত্যই বঙ্কিমবাবু কয় বৎসর দুই বার করিয়া প্রমোশন পাইয়া ছিলেন।” নিজের ছাত্রজীবনে বঙ্কিমচন্দ্র যে অত্যন্ত প্রতিভাধর একজন ছাত্র ছিলেন, একথা সত্যি। কিন্তু তবুও তাঁর ছাত্রজীবন নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, শ্রীশর লেখা কয়েক বছর দু’বার করে প্রমোশনের কথাটা আদৌ সত্যি নয়।
(৩) শ্রীশ লিখেছিলেন, ‘নবজীবন’ প্রকাশিত হওয়ার দু’মাসের মধ্যে প্রচারের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। এই কথাটিও ঠিক নয়। কারণ, নবজীবন বের হওয়ার ঠিক ১৫ দিন পরে সেটির প্রচার প্রকাশিত হয়েছিল।
শ্রীশর জানা বলে বর্ণিত উপরোক্ত ধরণের অসত্য কাহিনী তাঁর লেখা প্রবন্ধে আরো পাওয়া যায়। সুতরাং, তাঁর জানা কথার উপরে তেমনভাবে গুরুত্ব দেওয়া চলে না।
এই প্রবন্ধে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষাৎকারের প্রচলিত মিথ্যা গল্পের বিরুদ্ধে যেসব তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তি দেখানো হয়েছে, সে সব সত্ত্বেও কেউ যদি তর্কের ও অন্ধবিশ্বাসের খাতিরে স্বীকার করতে চান যে, আদতে অধর সেনের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় ছিল এবং অধর সেনের বাড়িতেই রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের দেখাও হয়েছিল; সেক্ষেত্রেও কিন্তু – মানুষের কর্তব্য কি হওয়া উচিত – এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্কিম – আহার, নিদ্রা, মৈথুন – বলেছিলেন, সেটাকে মেনে নেওয়া যায় না। এই যুক্তির সমর্থনে আরো কিছু তথ্য তুলে ধরা যেতে পারে।
(১) বঙ্কিমচন্দ্র এতটা অবিবেচক ছিলেন না যে, কৃষ্ণোক্তি স্মরণ পূর্বক মিথ্যাও কখনো কখনো সত্যি হয় লিখে তিনি যখন ফ্যাসাদে পড়েছিলেন, তাঁর সেই ফ্যাসাদের দিনেই তিনি বহু ব্রাহ্ম ও বিশিষ্ট ব্যক্তির সামনে উপরোক্ত মন্তব্য করে আবার একটি নতুন ফ্যাসাদ ডেকে আনবেন।
(২) আদি ব্রাহ্ম সমাজের সহকারী সম্পাদক ‘কৈলাসচন্দ্র সিংহ’ কিছুটা অশ্রদ্ধেয় ভাষায় ‘নব্য ভারত’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের একটা প্রবন্ধের সমালোচনা করবার পরে বঙ্কিমচন্দ্র কৈলাসচন্দ্রের সেই ভাষাকে ‘মেছোহাটার গালি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেকথা তিনি ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসেই তাঁর ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র যে সময়ে অপরের ভাষাকে ‘মেছোহাটার গালি’ বলেছিলেন, ঠিক সেই সময়েই তিনি নিজেই বহু সুধীজন সমক্ষে উপরক্ত কথা বলবেন, এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।
(৩) বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার সম্বন্ধে একদা নিজেই লিখেছিলেন, “ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না।”
তখনকার সভ্য সমাজে অহেতুক ‘মৈথুন’ শব্দটা উচ্চারণ করা যে ‘অশ্লীল’ ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অতএব বঙ্কিমচন্দ্র উপরোক্ত কথা বলতে পারেন না।
(৪) বঙ্কিমচন্দ্র যে কি ধরণের নীতিবাগীশ ও আদর্শবাদী একজন মানুষ ছিলেন, সেটার বিশেষ পরিচয় তাঁর লেখা ‘বহুবিবাহ’ নামক প্রবন্ধটি থেকে পাওয়া যায়। উক্ত প্রবন্ধটি তিনি ‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ রচিত ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার – দ্বিতীয় পুস্তক’-এর সমালোচনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয় উদাহরণ স্বরূপ প্রবোধচন্দ্রিকা নামক অশ্লীলতার ভাণ্ডার হইতে একটি অশ্লীল উপাখ্যান উদ্ধৃত করিয়া স্বীয় গ্রন্থকে কলঙ্কিত করিয়াছেন। সে উপাখ্যানটি এরূপ অশ্লীল যে, বোধ হয় সামান্য ইতর লেখকও তাহা উদ্ধৃত করিতে সাহস করিতেন না। … বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাহার একটি শব্দ পরিবর্তিত করিয়া লজ্জানুরোধের প্রমাণ দিয়াছেন – আর একটি শব্দ মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের লজ্জাহীনা লেখনী হইতে যেমন বাহির হইয়াছিল, বোধ হয় তেমনই আছে।” (বঙ্গদর্শন, আষাঢ়, ১২৮০ বঙ্গাব্দ) যে বঙ্কিম বিদ্যাসাগর সম্বন্ধেও উপরোক্ত কথা লিখতে পেরেছিলেন, সেই বঙ্কিম নিজে বহু সম্ভ্রান্ত ও গুণীজন সমক্ষে অম্লান বদনে ‘আহার, নিদ্রা, মৈথুন’ বলেছিলেন, একথা একেবারেই অবিশ্বাস্য।
(৫) বঙ্কিমচন্দ্রকে উচ্চশিক্ষিত ভেবে ‘সহজ সরল সাধক’ রামকৃষ্ণ দেব যদি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে থাকেন যে, মানুষের কর্তব্য কি বা কি হওয়া উচিত? – সেটার উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র ঐ কথা বললে বুঝতে হবে যে, তিনি সর্বজন সমক্ষে একদিকে নিজেকে যেমন অত্যন্ত হেয় প্রতিপন্ন করেছিলেন, অপর দিকে তেমনি সকলের সামনেই সবার শ্রদ্ধেয় রামকৃষ্ণ দেবের প্রতি রীতিমত নিজের অবজ্ঞাও প্রকাশ করেছিলেন। বঙ্কিমের জীবন অনুসরণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তিনি কোন মতেই নিজেকে কোথাও হেয় প্রতিপন্ন করবার মত মানুষ ছিলেন না। তাঁর নিজের দিক থেকে সাধুসন্তদের প্রতি কোন আকর্ষণ না থাকলেও তাঁদের প্রতি তাঁর বরাবরই কিন্তু শ্রদ্ধার ভাব ছিল। কারণ, বঙ্কিমের পারিবারিক গৃহ-দেবতা, যাঁর প্রতি তাঁর গভীর ভক্তি ছিল, সেই ‘রাধাবল্লভ’ এক সাধুরই দান ছিলেন। তাঁর পিতা ‘যাদবচন্দ্র’ নিজের প্রথম যৌবনে একজন সাধুর কৃপায় পুনর্জীবন লাভ করেছিলেন। এমনকি যাদবচন্দ্রের মৃত্যুর আগেও একজন সাধু তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন, এবং তখন তিনি যে সব ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, সেগুলো সবই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র সেসব কথা জানতেন। তিনি নিজেও তাঁর জীবনে বহু সাধুসন্ত, এমন কি হঠযোগী সাধুর দেখাও পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রতি তিনি কোনদিনই অবজ্ঞার ভাব প্রকাশ করেন নি। তাঁর রচনার মধ্যেও সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার ভাবই দেখতে পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন- রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

দানশীলা ও ধর্মপরায়ণা ‘রাণী রাসমণি’র বহু লক্ষ টাকা ব্যয়ে দক্ষিণেশ্বরে মন্দির স্থাপন, এবং সেই মন্দিরের পুরোহিত বা সাধু রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয়ই ভালোভাবেই জানতেন। কারণ, ১৮৮৪ সালের ডিসেম্বর (যে সময়টাকে শ্রীম রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমের সাক্ষাতের সময় বলেছিলেন) মাসের আগেই কোন কোন কাগজে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন পদ্ধতি ও তাঁর সহজ সরল উপদেশাবলী প্রকাশিত হয়েছিল, এবং সেগুলো লোকমুখে প্রচারিতও হয়েছিল। তাছাড়া রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের বিশিষ্ট বন্ধু কেশবচন্দ্র সেনের যে রীতিমত যোগাযোগ ছিল, সে কথাও বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চই জানতেন। তাই রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হলেও বঙ্কিমচন্দ্র সেই শ্রদ্ধেয় সাধুকে অতি অবজ্ঞা ভরে ঐ উত্তর দেবেন, এটা একেবারেই অসম্ভব বলে প্রতিপন্ন হয়। অতএব কেউ যদি একান্তই মেনে নিতে চান যে, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সত্যিই দেখা হয়েছিল, তাহলে এই প্রসঙ্গের প্রথম লেখক রামচন্দ্র দত্তের লেখাটাই বরং তাঁর পক্ষে স্বীকার করে নেওয়া মঙ্গলজনক। কারণ, যে ঘটনা কেউ প্রত্যক্ষ করেন নি, যে ঘটনার কোন নির্ভর যোগ্য সূত্রও পাওয়া যায় না, সেই ঘটনার ক্ষেত্রে নিজের চৈতন্যকে বিসর্জন দিয়ে কেবলমাত্র অক্ষয় সেনের মত মানুষের রুচি মাফিক লেখা, এবং তার উপরে আবার অপরের কল্পনার জাল বোনা কথা – এসব মেনে নেওয়া কিন্তু মোটেই যুক্তি সঙ্গত নয়। রামকৃষ্ণ মিথ্যা নয়, সত্যের পূজারী ছিলেন; আর তিনিই বলেছিলেন – “তোমাদের চৈতন্য হোক”।
(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

দ্য হিস্ট্রি অফ ইসরায়েলে জামাই বলে উল্লেখ! মোসাদের এক দুর্ধর্ষ মিশরীয় এজেন্ট এঞ্জেলদ্য হিস্ট্রি অফ ইসরায়েলে জামাই বলে উল্লেখ! মোসাদের এক দুর্ধর্ষ মিশরীয় এজেন্ট এঞ্জেল

সময়টা ১৯৭৩ এর ৫ অক্টোবর, রাত একটার সময় কায়রো থেকে ইসরায়েলে তেল আভিবে মোসাদের হেড অফিসে ফোন আসে একটি। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যাক্তিটি নিজেকে এঞ্জেল হিসাবে পরিচয় দেয়, যা ব্যাক্তিটির

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯০১ সালে গান্ধীজী বেলুড় মঠে স্বামীজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তবে সেবারে শ্রান্ত-ক্লান্ত গান্ধীজীর সঙ্গে বিবেকানন্দের দেখা হয় নি। কারণ, স্বামীজী তখন অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু

অপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাঅপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা

সময়টা ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন দুপুরবেলা, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি কার্গো বিমান। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক

রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ রামচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমের জীবিতাবস্থাতেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দে) তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষ্যাতের ঘটনাটি লিখেছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাঁর লেখা যখন সঠিক