রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম - একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ রামচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমের জীবিতাবস্থাতেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দে) তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষ্যাতের ঘটনাটি লিখেছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাঁর লেখা যখন সঠিক ছিল না, সেক্ষেত্রে বঙ্কিম তখন কোন আপত্তি তোলেন নি কেন? উত্তরে বলা যেতে পারে, রাম দত্ত ১২৯৭ বঙ্গাব্দে তাঁর রামকৃষ্ণ জীবনীতে এবং ১৩১২ বঙ্গাব্দে তাঁর বক্তৃতাবলীতে শশধর তর্কচূড়ামণি সম্বন্ধে লিখেছিলেন। তর্কচূড়ামণি রামকৃষ্ণের বিশেষ পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও রাম দত্তের ঐ লেখা বহু বছর তাঁর নজরেই পড়ে নি। পরে ‘পদ্মনাথ ভট্টাচার্য’ তর্কচূড়ামণিকে রাম দত্তের ঐ লেখার কথা বললে, তখন তিনি ১৩২৭ বঙ্গাব্দে সেটির বিরুদ্ধে নিজের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তেমনি রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের কোন আগ্রহ না থাকবার জন্যই রাম দত্তের বইটি তাঁর নজরে আসেনি। হতে পারে যে, অন্য কেউ বইটি পড়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে যে, তাঁর জীবিতাবস্থায় অন্য কেউ তাঁকে বইটি সম্পর্কে কিছু জানান নি। আর কেউ যদি জানিয়েই থাকেন, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র প্রতিবাদ নাও করতে পারেন। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলে তিনি সাধারণতঃ সেসবের কোন প্রতিবাদ করতেন না। আবার এমনও হতে পারে যে, তিনি হয়ত প্রতিবাদ করেছিলেন; কিন্তু তাঁর কথা গ্রহণ করা হয় নি। কেননা, রামকৃষ্ণ-ভক্তদের কারও কারও লেখার মধ্যে দেখা যায় যে, কেউ তাঁদের ভুল লেখার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ জানালেও সেটা আর সংশোধন করা হয় নি।
‘স্বামী সারদানন্দ’ তাঁর ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-শশধর তর্কচূড়ামণি প্রসঙ্গ এবং রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গ – দুটোই মূলতঃ রাম দত্তর লেখাকেই অনুসরণ করে লিখেছিলেন। তিনি শুধু রাম দত্তের লেখার উপরে বাড়তি নিজের একটু আধটু মন্তব্য বা কিছু অতিরিক্ত কথা যোগ করে দিয়েছিলেন। যেমন, তিনি রামকৃষ্ণ-শশধরের প্রথম সাক্ষাতের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “এ বৎসর (১৮৮৫ খ্রীঃ) রথের দিনে … পণ্ডিত শশধরকে দেখিতে যাইয়া ঠাকুর সেদিন পণ্ডিতজীকে নানা অমূল্য উপদেশ প্রদান করেন। শ্রীশ্রীজগদম্বার নিকট হইতে ‘চাপরাশ’ বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হইয়া ধর্মপ্রচার করিতে যাইলে উহা সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয় এবং কখন কখন প্রচারকের অভিমান অহংকার বাড়াইয়া তুলিয়া তাঁহার সর্বনাশের পথ পরিষ্কার করিয়া দেয়, এ সকল কথা ঠাকুর পণ্ডিতজীকে এই প্রথম দর্শন কালেই বলিয়া ছিলেন। এই সকল জ্বলন্ত শক্তি-পূর্ণ মহাবাক্যের ফলেই পণ্ডিতজী কিছুকাল পরে প্রচার কার্য ছাড়িয়া ৺কামাখ্যাপীঠে তপস্যায় গমন করেন, ইহা আর বলিতে হইবে না।” (রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ. গুরুভাব, উত্তরার্ধ) চাপরাশ পাওয়া সম্বন্ধে স্বয়ং তর্কচূড়ামণির প্রতিবাদের কথা আগেই বলা হয়েছে। এখন সারদানন্দের লেখার শেষাংশে তাঁর মন্তব্যটা সম্বন্ধে কিছু বলবার প্রয়োজন রয়েছে। সারদানন্দের ঐ মন্তব্য সম্বন্ধে আসামের গৌহাটি-নিবাসী ‘পদ্মনাথ দেবশর্মা’ তখন প্রতিবাদ করে লিখেছিলেন, “লীলা প্রসঙ্গকার কিরূপে অবগত হইলেন যে, পণ্ডিতজী বক্তৃতা ছাড়িয়া ৺কামাখ্যায় তপস্যার্থ গমন করিয়া ছিলেন? চূড়ামণি মহাশয় ধর্মবক্তৃতা প্রসঙ্গেই কামরূপেও আসেন এবং ৺কামাখ্যা দর্শনাদি করিয়া যান। আমরা জানি, তিনি ১৮৮৮-৮৯ অব্দে শ্রীহট্ট, কাছাড় অঞ্চলে বক্তৃতা করিয়াছিলেন। ফলতঃ এই সকল লেখক যে কত অসত্য এভাবে প্রচার করিয়াছিলেন, কে তাহার ইয়ত্তা করিবে?” (সাহিত্য পত্রিকা, মাঘ, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) সারদানন্দ লিখেছিলেন যে, ১৮৮৫ সালে তর্ক চূড়ামণির সঙ্গে রামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এই তথ্য সঠিক নয়। কারণ, ১৮৮৪ সালের ২৬শে জুলাই তারিখের ‘ইণ্ডিয়ান মিরার’ কাগজে রামকৃষ্ণ-শশধর তর্কচুড়ামণির একটি সাক্ষাৎকার ও কথাবার্তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তাঁদের মধ্যেকার কথাবার্তার যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা থেকে জানা যায় যে, তর্কচূড়ামণি রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হিন্দুর জাতিভেদ প্রথা উঠে যাওয়া উচিত কিনা? উত্তরে রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন যে, ফল পাকলে নিজে থেকেই গাছ থেকে পড়ে যায়, কিন্তু কাঁচা ফল তোলা ভাল নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রামকৃষ্ণ-তর্কচূড়ামণির ঐ সাক্ষাতের কথা রাম দত্ত তাঁর নিজের লেখার কোথাও বলেন নি। আর স্বামী সারদানন্দ, অক্ষয় সেন, শ্রীম প্রভৃতি যাঁরা রামকৃষ্ণ জীবন সম্বন্ধে লিখেছিলেন, তাঁরাও তাঁদের লেখায় রামকৃষ্ণ-তর্ক চূড়ামণির কথা বলতে গিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ-তর্ক চূড়ামণির ঐ সাক্ষাতের কথা কোথাও বলেন নি। তাঁরা কেবল রাম দত্তের লেখা ঐ রামকৃষ্ণ-তর্ক চূড়ামণির কথাকেই নিজেদের মত বানিয়ে নিয়ে তাঁদের লেখায় লিখেছিলেন। সারদানন্দ তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-তর্ক চূড়ামণির প্রথম সাক্ষাতের কথাটা যেমন রাম দত্তের লেখা থেকে নিয়েছিলেন, তেমনি তিনি রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গের ক্ষেত্রেও মূলতঃ রাম দত্তকেই অনুসরণ করেছিলেন। সারদানন্দ তাঁর গ্রন্থের এক জায়গায়, কোন এক প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণের বলা স্যাকরাদের সোনা চুরি করবার একটা গল্পের উল্লেখ করেই পাদটীকায় লিখেছিলেন, “ঠাকুরের পরম ভক্ত অধর সেনের ভবনে বঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক শ্ৰীযুত বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত যেদিন তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেদিন বঙ্কিমবাবু সন্দেহবাদীর পক্ষাবলম্বন পূর্বক ঠাকুরকে ধর্মবিষয়ে নানা কূট প্রশ্ন করিয়াছিলেন। ঠাকুর ঐ সকলের যথাযথ উত্তর দিবার পরে বঙ্কিমচন্দ্রকে পরিহাসপূর্বক বলিয়া ছিলেন, ‘তুমি নামেও বঙ্কিম কাজেও বঙ্কিম’। প্রশ্ন সকলের হৃদয়স্পর্শী উত্তর লাভে প্রীত হইয়া বঙ্কিমবাবু বলিয়াছিলেন, ‘মহাশয়, আপনাকে একদিন আমাদের কাঁটালপাড়ার বাটীতে যাইতে হইবে, সেখানে ঠাকুর সেবার বন্দোবস্ত আছে এবং আমরা সকলেও হরিনাম করিয়া থাকি।’ ঠাকুর তাহাতে রহস্যপূর্বক বলিয়াছিলেন, ‘কেমনতর হরিনাম গো, স্যাকরাদের মত নয় তো?’ বলিয়াই পূর্বোক্ত গল্পটি বঙ্কিমচন্দ্রকে বলিয়াছিলেন এবং সামান্য হাস্যের রোল উঠিয়াছিল।” এখানে দেখা যাচ্ছে যে, রাম দত্তের লেখা ঐ ‘বঙ্কিম’ (বাঁকা) কথাটা নিয়েই সারদানন্দও তাঁর নিজের মত করে গল্প বানিয়ে লিখেছিলেন, ‘তুমি নামেও বঙ্কিম কাজেও বঙ্কিম’। তবে রামকৃষ্ণ তাঁকে কেন বঙ্কিম (নামে এবং কাজেও) বলেছিলেন, সারদানন্দ নিজের বানানো গল্পে সেটারই একটা কারণ দেখিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র সন্দেহবাদীর পক্ষাবলম্বনপূর্বক রামকৃষ্ণকে ধর্মবিষয়ক নানা কূট প্রশ্ন করেছিলেন এবং রামকৃষ্ণও সেসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের একটাও প্রশ্ন এবং রামকৃষ্ণের একটাও উত্তরের উল্লেখ তাঁর নিজের লেখায় করতে পাবেন নি। তাই এটা থেকেও বলা যেতে পারে যে, তিনি রাম দত্তের কথাটার উপরে শুধু নিজের মন্তব্য জুড়ে দিয়েছিলেন, বা ঐ কথাটার একটা কারণ দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। আর বাকি কথাগুলো তাঁর নিজের বানানো ছিল। এবার সারদানন্দের লেখানুসারে বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক তাঁদের কাঁটালপাড়ার বাড়িতে রামকৃষ্ণকে আমন্ত্রণ করবার প্রসঙ্গে আসা যাক। ওই কথাটিও সারদানন্দ কোথা থেকে জেনে তাঁর লেখায় তুলে ধরেছিলেন, সেকথা তিনি বলেন নি। সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে যে, তর্কচূড়ামণি প্রসঙ্গের শেষাংশের মত সেটিও তাঁর নিজস্ব সংযোজন ছিল। সারদানন্দের ওই কথাকে অবিশ্বাস করবার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ, বঙ্কিমচন্দ্র ঐ সময়ে কাঁটালপাড়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একপ্রকার ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। কারণ, তিনি নিজেই লিখেছিলেন, “পিতৃদেবের স্বর্গারোহণের (১৮৮১) পর আমরা দুই জনের দুইটি সংকল্প কার্যে পরিণত করিলাম। আমি কাঁটালপাড়া ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় চলিয়া আসিলাম – সঞ্জীবচন্দ্র চাকুরি ত্যাগ করিলেন।” (সঞ্জীবনী সুধা) শ্রীম যিনি রাম দত্ত, অক্ষয় সেন ও সারদানন্দের লেখা থেকে ধার করে নিয়ে নিজের গ্রন্থটি লিখেছিলেন, তিনি সম্ভবতঃ সেকথা জানতেন বলেই, তাঁর গ্রন্থে কাঁটালপাড়ার প্রসঙ্গ তোলেন নি। তার বদলে তিনি শুধু লিখেছিলেন, “বঙ্কিম – একটি প্রার্থনা আছে। অনুগ্রহ করে কুটীরে একবার পায়ের ধুলো -”। সারদানন্দের লেখা উপরোক্ত কাহিনী অবিশ্বাস করবার আরো কারণ হল যে, তাঁর লেখা গ্রন্থে আরো কিছু বানানো এবং বিকৃত কাহিনী রয়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সারদানন্দ তাঁর গ্রন্থে ‘অভেদানন্দ’কে নিয়ে কাশীপুর বাগান বাড়ির একটি ঘটনা বিকৃত করে লিখেছিলেন বলে স্বামী অভেদানন্দ তাঁর ‘আমার জীবন কথা’ গ্রন্থে সারদানন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। এছাড়া অভেদানন্দ সেই বিষয়ে সারদানন্দকে একটি চিঠি লিখলে, তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে ভুলটি সংশোধন করে দেবেন বলে অভেদানন্দকে পাল্টা একটি চিঠিতে উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু সারদানন্দের মৃত্যুর পরেও ‘রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থের সেই ভুল আর সংশোধন হয় নি। ফলে পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ তাঁদের ‘মন ও মানুষ’ গ্রন্থে সারদানন্দের সেই ভুল স্বীকার করা চিঠির কথা মুদ্রিত করে দিয়েছিলেন। অতএব, সারদানন্দের গ্রন্থকে খোদ রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা ‘অভ্রান্ত’ বললেও, সেটির সব কথাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করা যায় না।

আরো পড়ুন-  ‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (প্রথম পর্ব)

১৩৫২ বঙ্গাব্দে রামচন্দ্র দত্তের লেখা ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবন কথা’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ৬ষ্ঠ সংস্করণের ভূমিকায় রাম দত্তেরই কাঁকুড়গাছি শ্রীরামকৃষ্ণ যোগোদ্যানের সম্পাদক ‘স্বামী মাধবানন্দ’ লিখেছিলেন, “পুস্তক-খানির পঞ্চম সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ায় ইহার ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হইল। পঞ্চান্ন বৎসর পূর্বে এই গ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়। সে সময়ে ইহাই ঐ বিষয়ে একমাত্র পুস্তক ছিল।” এরপরে মাধবানন্দ তাঁর লেখা ঐ ভূমিকায় পরবর্তীকালে লেখা হয়েছে বলে শ্রীমের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ এবং স্বামী সারদানন্দের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ’ বই দুটির নাম করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, তিনি নিজের বক্তব্যের কোথাও ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে বা ১৩০৭/০৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ৫৭৯+২ পৃষ্ঠার গ্রন্থ, ‘অক্ষয় সেনের’ লেখা ‘রামকৃষ্ণ পুঁথি’র কোথাও নামই করেন নি! সম্ভবতঃ, মাধবানন্দ জানতেন যে, অক্ষয় সেনের লেখা ওই গ্রন্থটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়, এবং সেটিকে রামকৃষ্ণকে নিয়ে বহু কাল্পনিক অসত্য কাহিনী রয়েছে। তাই তিনি বইটির নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত ছিলেন। অক্ষয় সেনের রামকৃষ্ণ পুঁথিতে যে ভুল বা কাল্পনিক কাহিনী রয়েছে, সেটা শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের প্রতিষ্ঠাতা ও রামকৃষ্ণ-শিষ্য স্বামী অভেদানন্দও তাঁর ‘আমার জীবন কথা’ গ্রন্থে লিখে গিয়েছিলেন। তবে তখন যোগোদ্যান আশ্রমের মাধবানন্দ বা বেদান্ত মঠের অভেদানন্দই শুধু নন, রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরাও অক্ষয় সেনের গ্রন্থের বহু কাহিনীকে, এমন কি তাঁর নিজের জীবনের ঘটনা বলে বর্ণিত কাহিনীকেও কখনো বিশ্বাস করেন নি। অক্ষয় সেন তাঁর বইয়ের এক জায়গায় লিখেছিলেন যে, কলকাতায় ‘দেবেন্দ্র মজুমদার’ নামের রামকৃষ্ণের এক ভক্তের বাড়িতে তিনি নিজের হাতে রামকৃষ্ণের পদ সেবা করেছিলেন।
“দক্ষিণেতর শ্রীপাদ শ্রীগুণধর
প্রসারণ কৈলা মম কোলে,
কমলার সেব্য পাদ সেবিয়া মিটানু সাধ
জনম সফল ধরাতলে।”
কিন্তু, ‘স্বামী গম্ভীরানন্দ’ তাঁর লেখা (রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রকাশিত) ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্ত মালিকা’ গ্রন্থে অক্ষয় সেনের কথা লিখতে গিয়ে ওই ঘটনাটি সম্পর্কে লিখেছিলেন, “ভক্ত-গোষ্ঠিতে ইহা বিদিত ছিল যে, ঠাকুর তাঁহাকে ঐভাবে শ্রীঅঙ্গ স্পর্শের অধিকার সাধারণতঃ দিতেন না। বলিতেন ‘মনের ময়লা’ কাটুক তারপর হবে।” অক্ষয় সেন লিখেছিলেন, রামকৃষ্ণের পা কমলারও সেব্য। কিন্তু গম্ভীরানন্দ নিজে রামকৃষ্ণ ভক্ত হলেও, অক্ষয় সেনের অতটা বাড়াবাড়ি হয়ত বরদাস্ত করতে পারেন নি। তাই তিনি তাঁর গ্রন্থে, অক্ষয় সেন সম্বন্ধীয় লেখায় অক্ষয় সেনের পুঁথি থেকে অক্ষয় সেনের ‘বানর বানর খেলা’ প্রভৃতি কয়েকটি লেখা উদ্ধৃত করলেও, উপরোক্ত কাহিনীর একটা কথাও উদ্ধৃত করেন নি। অক্ষয় সেনের মৃত্যুর পরে তাঁর গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় প্রকাশক রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে ‘স্বামী আত্মবোধানন্দ’ লিখেছিলেন, “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইল। … এই সংস্করণে স্থানে স্থানে সামান্য সংশোধন করা হইয়াছে।” আত্মবোধানন্দের লেখা ভূমিকা থেকেও দেখা যায় যে, তিনিও স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, অক্ষয় সেনের গ্রন্থের ১ম ও ২য় সংস্করণে ভুল ছিল, এবং তিনি তাঁর বিবেচনা মত সেসব ভুল ‘স্থানে স্থানে সংশোধন’ করে দিয়েছিলেন। আত্মবোধানন্দ রামকৃষ্ণ পুঁথির স্থানে স্থানে সামান্য সংশোধন করলেও স্বয়ং রামকৃষ্ণ মিশনেরই অন্যান্য সন্ন্যাসীরা (গম্ভীরানন্দ ছাড়াও) ঐ গ্রন্থের অসংশোধিত বহু ঘটনাকে কখনও বিশ্বাস করেন নি। যেমন, সারদানন্দ অক্ষয় সেনের সব কথাকে বিশ্বাস করেন নি বলেই, তিনি তাঁর রামকৃষ্ণ লীলা-প্রসঙ্গ গ্রন্থে অক্ষয় সেন বর্ণিত বহু কাহিনীকেই তাঁর গ্রন্থভুক্ত করেন নি। অক্ষয় সেন রচিত মনগড়া কাহিনীতে ভরা রামকৃষ্ণ পুঁথি গ্রন্থের
এক জায়গায় রয়েছে –
“একবার মহোৎসব অধরের ঘরে।
অনেক সম্ভ্রান্তবর্গে একত্রিত করে৷৷
ইদানীর নব্য সভ্য সবে পাশ করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রাপ্ত তাঁরা৷৷
চাটুজ্যে বঙ্কিম পদে মাজিষ্টর।
নব্য সভ্যদের মধ্যে ভারি নাম তাঁর৷৷
সবান্ধবে উপনীত আজিকার দিনে।
একদিকে সমাসীন ব্রাহ্ম ভক্ত গণে৷৷
তাঁহাদের মধ্যে বড় মিষ্ট-কণ্ঠ যিনি।
ত্রৈলোক্য সান্যাল নামে সুবিদিত তিনি৷৷”
এরপরেই অক্ষয় সেন যা লিখেছিলেন, সেটার সারাংশ হল, সেদিন ছিল অমাবস্যা তিথি, এবং রাত্রি তখন প্রায় ছয় দণ্ড। অমাবস্যায় রামকৃষ্ণের ‘ক্রিয়া-কাণ্ড আচরণ তান্ত্রিক বিধানে’ হত বলে, সেদিন তিনি বোতলে করে কিছু মদ নিয়ে এসেছিলেন, এবং সে মদ তাঁর ভক্ত নিরঞ্জন ‘গাত্রবস্ত্র আবরণে’ বগলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। রামকৃষ্ণ অমাবস্যায় কোন ‘ক্রিয়ায়’ কপালে মদের ফোঁটা পরতেন। তারপরে তিনি লিখেছিলেন,
“শ্রীপ্রভুর বেশভুষা-সজ্জা নিরীক্ষণে।
প্রথমে অবজ্ঞাভাব বঙ্কিমের মনে৷৷
ধনমান বিদ্যামদে হয় যে রকম।
অহঙ্কারে ধরাবোধ সরার মতন৷৷
শ্রীপ্রভু অন্তর্যামী বুঝিয়৷ অন্তরে।
সাদরেতে সম্ভাষণ করিলেন তাঁরে৷৷
কি মধুর শ্রীপ্রভুর বাক্যের মাধুরী।
বর্ণে বর্ণে খেলে তায় রসের লহরী৷৷
পরে জিজ্ঞাসিলা তারে গুণধর রায়।
মানুষের কার্য কিবা আসিয়া ধরায়৷৷
উত্তরে মার্জিত-বুদ্ধি কহিল বঙ্কিম।
মৈথুন আহার আর নিদ্রা এই তিন৷৷
অতি ঘৃণা সহকারে প্রভু তাঁয় কন।
সাজে না তোমার মুখে এ হেন বচন৷৷
তুমি ত ছেঁছড়া লোক হীন বুদ্ধি ভারি।
যে কার্য করিতে চিন্তা দিবা বিভাবরী,
কিংবা যেই কর্ম নিজে কর আচরণ,
তাহাই সভায় তুমি কৈলা উচ্চারণ৷৷
উপমা সহিত পরে কহেন ঠাকুর।
খাইলেই মূলা উঠে মূলার ঢেঁকুর৷৷
স্বভাব না থাকে চাপা স্বভাবের জোরে।
উপরেতে উঠে তাই যেমন ভিতরে৷৷
বঙ্কিমে দেখিয়া প্রভু সলজ্জ বদন।
ঈশ্বরীয় কথা পরে কৈলা উত্থাপন৷৷
তত্ত্বকথা আলাপনে কিছুক্ষণ যায়।
ব্রাহ্মগণে সঙ্গীতে ইঙ্গিত কৈলা রায়৷৷
একতারা খোল আর করতাল সনে।
সঙ্গীত আরম্ভ কৈলা ব্রাহ্ম ভক্ত গণে৷৷”
এর পরেই আবার তিনি লিখেছিলেন, ত্রৈলোক্যের মিষ্ট কণ্ঠে সকলে মোহিত হলেন। ওদিকে রামকৃষ্ণ আবেশ ভরে কীর্তন ও নৃত্য করতে লাগলেন। তাঁর ‘জগ বিমোহন নর্তন’ দেখে সকলেই তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিরঞ্জন রামকৃষ্ণের সঙ্গে নাচতে নাচতে তাঁর বগলে যে মদের বোতল লুকানো ছিল, সেটা পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেল। কিন্তু বোতলে কি ছিল, সেটা দেখবার জন্য সকলে গেলে, তাঁরা মদের গন্ধের বদলে ডি. গুপ্তর পাঁচনের গন্ধ পেলেন। ওই মদ পাঁচন হওয়ার কথাটা একজন পরের দিন ‘গিরিশ ঘোষ’কে বলেছিলেন। গিরিশ ঘোষ তখন মদ খাচ্ছিলেন। তিনি সেই কথা শুনে অবিশ্বাস করলে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সমস্ত বোতলের মদই ডি. গুপ্তর পাঁচন হয়ে গেল। এরপরেই অক্ষয় সেনের গ্রন্থে গিরিশ ঘোষের সমস্ত মদের বোতলের মদ কেবল জল হয়ে যাওয়ায় আরেকটি কাহিনী রয়েছে। তবে সারদানন্দ, এমন কি শ্রীমও অক্ষয় সেনের সেই মদ জল বা পাচন হওয়ার কথাকে আজগুবি বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই তাঁরা নিজেদের গ্রন্থে সেকথা উল্লেখ করেন নি। তবে শ্রীম সেকথা না লিখলেও, অক্ষয় সেনের লেখা থেকে – “উত্তরে মার্জিত বুদ্ধি কহিল বঙ্কিম / মৈথুন আহার আর নিদ্রা এই তিন”, এবং “তত্ত্বকথা আলাপনে কিছুক্ষণ যায়” – এই কথাগুলো নিয়ে আলোচনা করে বেশ বড় আকারের একটি কাল্পনিক কাহিনী রচনা করেছিলেন। শ্রীম তাঁর গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়ানোর জন্য রাম দত্ত এবং সারদানন্দের গ্রন্থ থেকেও রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গের কথাগুলি নিয়েছিলেন, এবং নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত অনেক কাহিনী রচনা করেছিলেন। সারদানন্দ তবুও অক্ষয় সেনের লেখার ওই বঙ্কিম ও গিরিশ প্রসঙ্গের সমস্তটাকেই অবিশ্বাস্য ও আজগুবি বলে বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তিনি তাঁর গ্রন্থে অক্ষয় সেনের লেখার কোন কথাই ব্যবহার করেন নি। রাম দত্ত তাঁর গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, রামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রকে বঙ্কিম (বাঁকা) বলে পরিহাস করেছিলেন। সারদানন্দ রাম দত্তের সেই লেখা পড়ে সেটার উপরে নিজের কথা কিছু যোগ করে তাঁর গ্রন্থের রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গটা লিখেছিলেন। রাম দত্তের সেই লেখাকে ভিত্তি করেই অক্ষয় সেন (যাঁর মনের ময়লা কাটেনি) স্থির করে নিয়েছিলেন যে, রামকৃষ্ণ যখন বঙ্কিমচন্দ্রকে বাঁকা বলে পরিহাস করেছিলেন, তখন বঙ্কিমচন্দ্রও নিশ্চয়ই রামকৃষ্ণের কোন প্রশ্নের বাঁকা উত্তর দিয়েছিলেন। অতএব নিজের কল্প বিশ্বাসের জোরে তিনি রামকৃষ্ণের মুখে – ‘মানুষের কাজ কি?’ প্রশ্নটি, এবং বঙ্কিমচন্দ্রের মুখে – ‘মৈথুন, আহার আর নিদ্রা এই তিন’ উত্তরটি বসিয়ে দিয়েছিলেন। মূলতঃ রাম দত্তের একই কথাকে নিয়ে সারদানন্দ এবং অক্ষয় সেন উভয়েই লিখলেও, অক্ষম সেন যে অমনটা লিখতে পেরেছিলেন, সেটার পিছনে একটা কারণই হতে পারে – তাঁর নিজের ‘মনে ময়লা’ ছিল বলেই।
শ্রীম তাঁর গ্রন্থের প্রতিটি ভাগের প্রথমেই লিখেছিলেন, “ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমুখে বাল্য, সাধনাবস্থা ইত্যাদি সম্বন্ধে অথবা ভক্তদের সম্বন্ধে নিজ চরিত যাহা বলিয়াছেন, – আর যাহা ভক্তেরা সেইদিনেই লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। শ্ৰীশ্ৰীকথামৃতে প্রকাশিত শ্রীমুখকথিত চরিতামৃত এই জাতীয় উপকরণ। শ্রীম নিজে যেদিন ঠাকুরের কাছে বসিয়া যাহা দেখিয়াছিলেন ও তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছিলেন, তিনি সেইদিন রাত্রেই (বা দিবাভাগে) সেইগুলি স্মরণ করিয়া দৈনন্দিন বিবরণে Diary-তে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। এই জাতীয় উপকরণ প্রত্যক্ষ (Direct) দর্শন ও শ্রবণ দ্বারা প্রাপ্ত। বর্ষ, তারিখ, বার, তিথি সমেত। … ঠাকুরের শ্রীমুখে ভক্তেরা নিজে যাহা শুনিয়াছিলেন, আর এক্ষণে স্মরণ করিয়া বলেন। এ জাতীয় উপকরণও খুব ভাল। … তবে চব্বিশ বৎসর হইয়া গিয়াছে। লিপিবদ্ধ থাকতে যে ভুলের সম্ভাবনা, তাহা অপেক্ষা অধিক ভুলের সম্ভাবনা। … শ্ৰীশ্ৰীকথামৃত প্রণয়নকালে শ্রীম প্রথম জাতীয় উপকরণের উপর নির্ভর করিয়াছেন। … ইং ১৯১০।” শ্রীম নিজেই বলেছিলেন যে, রামক্বষ্ণের কাছে বসে তিনি যে সব কথা শুনেছিলেন, পরে সেগুলোকেই লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে বসে সেসব কিছু লেখেন নি। শ্রীমের গ্রন্থের ৩০/৪০ পৃষ্ঠা করে লেখা, রামকৃষ্ণের এক এক সময়ের দীর্ঘ আলোচনা বা কথাবার্তা, তাই সেগুলোকে সঙ্গে সঙ্গে না লিখে পরে লিখলে, তাতে শ্ৰীমের নিজের অনেক কথাই যে ঢুকে যাবে, সে বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কেন না শ্রীম এমন কিছু শ্রুতিধর ছিলেন না যে, পরে ঐ অত কথা লেখবার সময়ে তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে হুবহু সেই কথাগুলোই লিখতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ, “লিপিবদ্ধ থাকাতে যে ভুলের সম্ভাবনা” – কথাটি বলে শ্রীম নিজেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, তাঁর ডায়রির লেখাতেও ভুল ছিল। তৃতীয়তঃ, প্রথম জাতীয় উপকরণের (রামকৃষ্ণের মুখের কথা শুনে সেই দিনই শ্রীম বা অন্য কোন ভক্তের লেখা ডায়রি) উপরে নির্ভর করে কথামৃত লেখা, শ্রীম ওকথা বললেও তাঁর বইয়ের অনেক লেখার মত রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গটিও কিন্তু মোটেই সেটা নয়। কেন না, একে তো শ্ৰীম নিজে সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেনই না; দ্বিতীয়তঃ, ওই প্রসঙ্গটি কারো ডায়রি থেকেও নেওয়া হয়নি। ওটা আসলে অক্ষয় সেন (মনের ময়লাওয়ালা), রাম দত্ত ও সারদানন্দের লেখা থেকেই কিছু কিছু করে তিনি নিয়েছিলেন। তার উপরে শ্রীম নিজের আরো কিছু লেখা যোগ করেছিলেন। সাধারণতঃ কোন ব্যক্তি নিজের ডায়রি অবলম্বন করে (ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নয়, একই বিষয় নিয়ে) কোন গ্রন্থ লিখলে, পর পর দিনের ঘটনাই পর পর লিখে থাকেন। সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। শ্রীম কিন্তু সেই অতি স্বাভাবিক পদ্ধতিটি নিজের ডায়রি লেখার ক্ষেত্রে গ্রহণ করেন নি। যেমন – তিনি, ১৮৮৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বর তারিখের ঘটনা তাঁর গ্রন্থের তৃতীয় ভাগে, ১৮৮৩ সালের ২৪শে ডিসেম্বর তারিখের ঘটনা তৃতীয় ভাগের কয়েক বছর পরে প্রকাশিত চতুর্থ ভাগে, আবার ১৮৮৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তারিখের ঘটনা চতুর্থ ভাগের ২২ বছর পরে প্রকাশিত পঞ্চম ভাগে প্রকাশ করেছিলেন। এই তথ্য পড়ে কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, তিনি অপরের কাছ থেকে পরে পরে যেমন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তেমনিভাবেই পরে পরে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু একথা শ্রীমের বই সম্বন্ধে আদৌ চলে না। কেননা শ্রীম তাঁর ডায়রি থেকে একই দিনের এক সময়ের ঘটনা একভাগে, আবার সেই দিনের অন্য সময়ের ঘটনা অন্য ভাগে প্রকাশ করেছিলেন। অথচ সেগুলোর মধ্যে বিষয় বস্তুর দিক থেকে যে তেমন কিছু পার্থক্য রয়েছে, সেটাও নয়। যেমন – শ্রীম তাঁর ডায়রি থেকে ১৮৮৫ সালের ২৮শে জুলাই তারিখের রাত্রি ৮টার পরের কথাগুলি তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে (১৯ খণ্ড, ২য় পরিচ্ছেদ) দিয়েছিলেন। আবার ঐ তারিখেরই বিকেল ৫টার কথাগুলো তার কয়েক বছর পরে প্রকাশিত তৃতীয় ভাগে দিয়েছিলেন। শ্ৰীম লিখেছিলেন যে, ঐদিন রাত্রি ৮টার পর ও বিকাল ৫টায় – উভয় সময়েই তিনি রামকৃষ্ণের সঙ্গে ছিলেন। প্রথম বারে তিনি একজন শোকাতুরা ব্রাহ্মণীর বাড়িতে রামকৃষ্ণের উপস্থিতির কথা লিখেছিলেন। আর দ্বিতীয় বারে, ‘গনু’র মায়ের বাড়িতে রামকৃষ্ণের উপস্থিতির কথা বলেছিলেন। শ্রীম প্রথমবারে লিখেছিলেন, ব্রাহ্মণীর বাড়িতে রামকৃষ্ণ গেলে ব্রাহ্মণীর ভাবোল্লাস হয়েছিল। আর পরে লিখেছিলেন – রামকৃষ্ণ গনুর মায়ের বাড়িতে ঐক্যতান বাজনা ও ছোকরাদের গান শুনেছিলেন। শ্রীম শুধু যে একই দিনের এক এক সময়ের ঘটনা এক এক গ্রন্থে দিয়েছিলেন, তা নয়, তিনি একই দিনের একই সময়ের ঘটনার কিছুটা এক ভাগে, আবার কিছুটা অন্যভাগে, এমনও করে গ্রন্থে তুলেছিলেন। যেমন – ১৮৮৩ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তারিখে বেলা ১টার সময়ের রামকৃষ্ণের কথা (কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ ও সমাধি সম্বন্ধে) শ্রীম তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ ভাগে (৭ম খণ্ড, ৫ম পরিচ্ছেদ) লিখেছিলেন, আবার ঐদিন ঐ একই সময়ের বেলা ১টার সময়েরই ঐ একই ব্যক্তির সঙ্গে কথা (জ্ঞান ও ভক্তি সম্বন্ধে) তিনি বহু বছর পরে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থের পঞ্চম ভাগে লিখেছিলেন (১২শ খণ্ড, ৩য় পরিচ্ছেদ)। তাই শ্রীমের ওই ধরণের লিখন পদ্ধতি দেখে এইটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি তাঁর বইয়ের বিক্রি দেখে তবেই বইয়ের সংখ্যা বাড়াবার জন্যই পরে পরে এক এক দিনের বা এক এক সময়ের ঘটনা ঐ ভাবে চিন্তা করে করে লিখেছিলেন। এবং ঐভাবে লেখা তাঁর পক্ষে খুব একটা কষ্টকর হয়নি। কেননা, রামকৃষ্ণের কথা বা উপদেশাবলীর সঙ্গে যিনি কিছুটা বা ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন, তাঁর পক্ষে রামকৃষ্ণের কথা নিয়ে ওই ভাবে বানিয়ে গল্প লেখাটা, খুব একটা কষ্টসাধ্য হয়নি। সেক্ষেত্রে রামকৃষ্ণের কথা বা উপদেশাবলীর পুনরাবৃত্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। শ্রীমের কথামৃতেও সেটাই ঘটেছে। এখন কেউ বলতে পারেন যে, রামকৃষ্ণ একই কথা বা উপদেশ পুনরাবৃত্তি করতেন বলে, তাঁর গ্রন্থেও সেটার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। কিন্তু, শ্রীম একই দিনের ঘটনার কিছুটা একভাগে, আবার কিছুটা বহু বছর পরে প্রকাশিত অপরভাগে লিখেছিলেন কেন? এ থেকেই মনে হয় যে, পরে তিনি তাঁর গ্রন্থের ওই অপর ভাগটি রচনা করবার জন্যই আগের দিনের লেখার জের টেনে বাড়িয়ে সেই ভাগ রচনা করেছিলেন। এবং তাঁর গ্রন্থের সেই ধরণের রচনাশৈলী দেখে এই সন্দেহ বা অ
©️রানা চক্রবর্তী©️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ১৫৮৭ খৃস্টাব্দের ১লা আগস্ট তারিখে বিসূচিকা রোগে ‘উজীর খাঁ হেরেবি’র মৃত্যু হওয়ার পরে আকবর বিহারের শাসনকর্তা ‘সৈয়দ খাঁ’কে বাংলায় বদলি করেছিলেন, এবং ‘মান সিংহ’কে পাঞ্জাব থেকে বিহারে নিয়ে

শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে এক দম্পতি নিজের পুত্র সন্তানের সঙ্গে বড় করেছিলেন এক কন্যা শিম্পাঞ্জীকে! কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে এক দম্পতি নিজের পুত্র সন্তানের সঙ্গে বড় করেছিলেন এক কন্যা শিম্পাঞ্জীকে! কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে সেখানে উল্লেখ করা রয়েছে মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল শিম্পাঞ্জি কিংবা হনুমান। অর্থাৎ বংশানুক্রমে ও কালের পরিবর্তনে এই শিম্পাঞ্জিরাই আস্তে আস্তে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সভ্য

‘রানী মুদিনীর গলির কথা’‘রানী মুদিনীর গলির কথা’

রানা চক্রবর্তীঃ একদা পুরানো কলকাতার যে গলিটির নাম ছিল ‘রানী মুদিনীর গলি’, পরবর্তীকালে সেটারই নাম হয়েছিল ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রীট’, আর সেটারই বর্তমান নাম হল ‘সিরাজুদ্দৌল্লা সরণি’। কলকাতার কিছু রাস্তার নাম

মুর্শিদাবাদের অতি প্রসিদ্ধ ‘ঝুড়ি দই’!মুর্শিদাবাদের অতি প্রসিদ্ধ ‘ঝুড়ি দই’!

মাটির ভাঁড় বা হাঁড়ি নয়, এখানে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো ঝুড়িতেই পাতা হয় দই। ব্যতিক্রমী চেহারা-চরিত্র-স্বাদ যুক্ত মুর্শিদাবাদের অতি প্রসিদ্ধ ‘ঝুড়ি দই’! বাঙালি সমাজে দুগ্ধজাত নানা ধরনের খাবারের মধ্যে গুণেমানে