শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ চৌশা থেকে হুমায়ুন নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে পালানোর পরে শের খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে আবার মোঘলদের সঙ্গে নিজের হিসাব মেটাতে হবে। তাই সেটার প্রস্তুতি হিসাবে সবার আগে তাঁর গৌড় থেকে মোঘলদের উৎপাটন করাটা সবচেয়ে দরকারি ছিল। সেই উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে সোজা গৌড়ে চলে গিয়েছিলেন। যে জাহাঙ্গীর কুলী খাঁকে হুমায়ুন মাসাধিক কাল আগে গৌড়ের ক্ষত্রপ নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন, তিনি নগরীর প্রবেশদ্বারে প্রাণপাত করে আফগানদের বিরুদ্ধে লড়েও শেষপর্যন্ত তাঁদের সংখ্যাধিক্যের জন্য সন্ধি প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শের তাতে সম্মতি দিয়েও তাঁকে নিজের শিবিরে আহ্বান করে তাঁর জীবনাবসান করেছিলেন। সেই সঙ্গেই পুনরায় গৌড়-বঙ্গের সর্বত্র শেরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চট্টগ্রামে তাঁর প্রতিনিধি ‘নওয়াজেশ খাঁ’ বেশ কিছুটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেও, শেষে বিরোধীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ার ফলে ওই বন্দরটি তাঁর হস্তগত হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার সেই জয় একেবারেই সাময়িক ছিল। কারণ কিছুদিন পরেই পর্তুগীজ এ্যাডমিরাল ‘ন্যূনো ফার্নান্দেজ ফায়ার’ নওয়াজেশ খাঁকে বন্দী করে বন্দরটির উপরে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু শেরের ভাগ্য তারকা তখন উর্দ্ধমুখী ছিল, তাই ওই ঘটনার কিছুদিন পরে পেগুতে গণ্ডগোল দেখা দেওয়ার ফলে পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম ছেড়ে সেখানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, এবং নওয়াজেশ খাঁ মুক্তি পেয়ে পুনরায় চট্টগ্রামের উপরে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শের শাহ শূর (শূরী) তখন সমগ্র বিহার, গৌড় ও বঙ্গের একচ্ছত্র অধীশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু হুমায়ুন যে আবার ফিরে আসবেন সে বিষয়ে তাঁর মনে কোন সন্দেহ না থাকবার জন্য তিনি একদিকে যেমন সেই বিস্তীর্ণ ভূভাগের উপরে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি মোঘলদের সঙ্গে শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতিও চালিয়ে গিয়েছিলেন। পাছে চেরোরাজ মহারথ তাঁকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করেন, তাই সেই ভয়ে নিজের অসংখ্য সৈনিকের জীবন বলি দিয়ে তাঁকে দমন করে তিনি পশ্চিম দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর অগ্রগতি প্রতিরোধ করবার জন্য হুমায়ুনও দিল্লী থেকে পূর্বদিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন। শেষে কনৌজের কাছাকাছি পৌঁছে গঙ্গার দুই তীরে দুই বাহিনী তাঁবু ফেলে পরস্পরের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেছিল। আফগানদের চেয়ে মোঘলরা সংখ্যায় অনেক বেশী ছিলেন; আট-বলদে টানা সাতশো কামানও তাঁদের কাছে ছিল। কিন্তু তাঁদের অধিনায়কের দৈহিক ও মানসিক জড়তাই শেষপর্যন্ত তাঁদের কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল। হুমায়ুন আফিম সেবন করতেন, ফুর্তি করতেন, যে ভৃত্যদলকে তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের খিদমদ নিতেন। একটা সময়ে তাঁর সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য অধৈর্য্য হয়ে উঠলেও তাঁর দিক থেকে কিন্তু কোন উদ্যমের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই দেখে একটা সময়ে ‘সুলতান মীর্জা’ প্রমুখ প্রবীণ মোঘল যোদ্ধারা একে একে সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে সরে পড়তে শুরু করেছিলেন; আর যাঁরা সেখানে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা বলাবলি করতে শুরু করেছিলেন যে, ওভাবে মাঠের মধ্যে বসে পোকা গোনবার চেয়ে ঘরে ফিরে গিয়ে তাস দাবা খেলা বেশি ভাল! হুমায়ুন যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওই ভাবে দলত্যাগের সেই হিড়িক চলতে থাকলে শেষপর্যন্ত তাঁকে নিজের বেগম ও নফরদের নিয়ে সেখানে একা পড়ে থাকতে হবে, তখন একদিন তাঁর বাহিনীকে শেষে নদী পার হওয়ার জন্য তিনি আদেশ দিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ ছিল যে, প্রথম দুই দিনে বাহিনীর সব সৈন্যরা নদীর অপর তীরে গিয়ে জমায়েত হবেন, পরে কামান ও অন্যান্য রণসম্ভার তাঁদের পিছনে যাবে। সেদিনটা ছিল মহরম – শোকের দিন – তাই আফগানরা নিশ্চয়ই সেদিন যুদ্ধ করবেন না ভেবে নিয়ে সেদিনই নদী পার হওয়া শুরু হয়েছিল। বাদশাহের অনুমানের ভিত্তিতে সেদিন, অর্থাৎ ১৫৪০ খৃষ্টাব্দের ১৭ই মে তারিখে মোঘলরা যখন নিজেদের পরিকল্পনানুযায়ী কাজ করছিলেন, শের শাহ তখন দূর থেকে তাঁদের গতিবিধির উপরে নজর রাখছিলেন। যেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, বাদশাহসহ অধিকাংশ সৈন্যরা স্বচ্ছন্দে নদী পার করে অপর পাড়ে পৌঁছে গিয়েছেন, অমনি তিনি আক্রমণের হুকুম দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত আফগান বাহিনী মোঘলদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শেরের পুত্র জামাল খাঁ মোঘল সৈন্যাধ্যক্ষ ‘মীর্জা হিন্দালের’ ব্রিগেডের সামনে পৌঁছে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন দেখে শের নিজে তাঁর সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ করবার কোন প্রয়োজন হয়নি। কারণ, আফগানদের সেই আচমকা আক্রমণের মুখে পড়ে মোঘলরা দিশেহারা হয়ে পালাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। শের খাঁর অধীনস্থ ‘খাওয়াস খাঁ’, ‘পরমজিৎ গৌড়’ প্রভৃতি বিচক্ষণ জেনারেলদের নির্দেশে সুশৃঙ্খল শেরশাহী ফৌজ কয়েক মিনিটের মধ্যে অক্লেশে মোঘল ব্যূহের মধ্যভাগ বিদীর্ণ করে একেবারে পশ্চাদ্ভাগে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। সেখানে মোঘলদের যে হাজার হাজার গোলাম ও তাঁবুদাররা ছিলেন, আফগান যোদ্ধাদের দেখে তাঁরা ভয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। মোঘল সৈন্যরা নিজেদের কামান বন্দুক সব ফেলে রেখে যে যেখানে পেরেছিলেন, সেখানে পালিয়ে গিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। সেটাই ছিল ভারতের ইতিহাস খ্যাত বিলগ্রামের যুদ্ধ! ওই যুদ্ধে কোন পক্ষ থেকেই একটাও গুলি ছোঁড়া হয়নি, একজনও সৈনিকও যুদ্ধে আহত বা নিহত হননি, অথচ সুশৃঙ্খল আফগান আক্রমণের সামনে পড়ে বিরাট মোগলবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বিনাযুদ্ধে সেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে দেখা গিয়েছিল যে, ভারতের রাজদণ্ড আরেকবার মোঘলদের হাত থেকে পাঠানের হাতে চলে গিয়েছে। এর আগে চৌশায় রাত্রিশেষে যখন অধিকাংশ মোঘল সৈনিক ঘুমে অচেতন ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে শের খাঁ তাঁদের উপরে অতর্কিত আক্রমণ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিলগ্রামে উজ্জ্বল দিবালোকে হুমায়ুনের বিশাল বাহিনী বিনাযুদ্ধেই তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিল। ওই জায়গার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল স্রোতস্বিনী গঙ্গা। আফগানদের হাতে তিন দিক থেকে ঘেরাও হওয়া মোঘল সৈনিকদের সামনে নিষ্ক্রমণের জন্য তখন সেই একটি মাত্র পথই খোলা ছিল। সেই পথ দিয়ে পালাবার আশায় তাঁরা হাজারে হাজারে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এবং অধিকাংশই নদীতে তলিয়ে গিয়েছিলেন। মোঘল বাদশাহ হুমায়ুন একটা হাতীর পিঠে চড়ে কোনক্রমে নদী পার হতে পেরেছিলেন। ওপারে পৌঁছানোর পরে কয়েকজন লোক দয়া পরবশ হয়ে তাঁর দিকে পাগড়ীর কাপড় ছুঁড়ে দিলে তিনি সেটা ধরে নদী তীরে উঠতে পেরেছিলেন। তারপরে একটি ঘোড়াও তিনি জোগাড় করতে পেরেছিলেন, সেটার পিঠে চড়ে তিনি যখন শেষপর্যন্ত আগ্রায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন তাঁর মস্তক ছিল অনাবৃত, পদযুগল ছিল নগ্ন।

আরো পড়ুন- ‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)

আগ্রায় ফিরে গিয়ে হুমায়ুন দেখতে পেয়েছিলেন যে, তাঁর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই – বিলগ্রাম প্রান্তরেই সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থায় শের খাঁ সেখানে উপস্থিত হলে তাঁর সম্মুখীন হওয়ার মত ক্ষমতা তখন হুমায়ুনের ছিল না। তিনি জানতেন যে, ওই অবস্থায় আগ্রায় অবস্থান করলে হয় তাঁকে অসহায়ভাবে বন্দীত্ব, নয়তো মৃত্যু বরণ করতে হবে। তাই ভয়ব্যাকুল হুমায়ুন তাঁর গর্ভবতী মহিষী ‘হামিদাবানু’ ও মুষ্টিমেয় অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে দেরি না করে পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোথায় যেতেন? তখনও পর্যন্ত মোঘল সাম্রাজ্যের পথঘাট, মাঠ, নগর, গ্রামপ্রান্তর সবই তাঁর ছিল; তখনও পর্যন্ত তিনি সব কিছুরই একচ্ছত্র অধীশ্বর ছিলেন, কিন্তু সে আর কতদিন? তাঁর শত্ৰু শের খাঁ তখন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছিলেন। হুমায়ুন জানতেন যে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে একবার বাগে পেলেই আফগানরা ধরে কোতল করবেন, কেউ তাঁদের বাঁচাতে পারবেন না। সারা হিন্দুস্থানের কোথাও তাঁদের আশ্রয় মিলবে না ৷ তাই নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হুমায়ুন অতি সাবধানে, অতি সঙ্গোপনে পথ চলতে শুরু করেছিলেন। শেষে ঐভাবে পথ চলতে চলতে তিনি যখন অমরকোট রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন হামিদা বানুর প্রসব বেদনা উঠেছিল। অমরকোটের রাজার কাছে সেই খবর গিয়ে পৌঁছানোর পরে তিনি পরম সমাদরে তাঁদের সবাইকে নিজের প্রাসাদে আশ্রয় দিয়ে রাজকীয় পরিচর্য্যার ব্যবস্থা করেছিলেন। এর কয়েকদিন পরে সেখানে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল, তিনিই ছিলেন ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা – ‘আকবর’। জন্মের পরে সেই শিশুর ভাগ্যরেখা গণনা করে অমরকোটের রাজজ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, একদিন তাঁর যশোতরঙ্গে সারা পৃথিবী প্লাবিত হবে। হুমায়ুন বিজয়ী শের শাহ দিল্লীর তখতে আরোহণ করবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আফগানরা আবার নতুন জীবন লাভ করেছিলেন। মোঘলরা প্রমাদ গুণেছিলেন। তখন যেখানে যত মোগল ছিলেন, হয় তাঁরা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ভারত ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, নতুবা বিভিন্ন নগরে বা প্রান্তরে আত্মগোপন করেছিলেন। ভারতব্যাপী সেই আলোড়নের মধ্যেই শের শাহ তাঁর সুযোগ্য পুত্র জালাল এবং দু’জন নিপুণ সৈন্যাধ্যক্ষ – নওয়াজেশ খাঁ ও পরমজিৎ গৌড়ের সাহায্যে সব অঞ্চলে নিজের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছিলেন। কোথাও নিজে, আবার কোথাও বা নিজের সৈন্যাধ্যক্ষদের পাঠিয়ে তিনি ছোট ছোট প্রতিবেশী রাজ্যগুলিও জয় করেছিলেন। সেকাজে যেখানে বাধা এসেছিল, সেখানে তিনি শাঠ্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এরপরে একদিন শেরের কাছে খবর এসেছিল যে, গৌড়ের ক্ষত্রপ ‘খিজির খাঁ’র মতিগতি ভাল ঠেকছে না। জাতিতে আফগান হলেও তিনি বাংলার শেষ হোসেনশাহী সুলতান মামুদ শাহের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তখন মামুদ শাহ জীবিত ছিলেন না, তাঁর দুই পুত্রও পরলোকে ছিলেন। সেই কারণে তিনি নিজেকে তাঁর শ্বশুররাজ্যের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী বলে মনে করতেন। যেভাবেই হোক, তাঁর মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে, উত্তরাধিকারসূত্রে গৌড় তাঁর বলেই শের শাহ তাঁকে সেখানকার তখতে বসিয়েছেন। তাই নিজের প্রভুর কথা মন থেকে মুছে ফেলে দিয়ে তিনি একজন স্বাধীন সুলতানের মত আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। সেই সংবাদ দিল্লীতে পৌঁছানোর পরে শের দ্রুতগতিতে গৌড়ে উপস্থিত হয়ে খিজির খাঁর হাতে বেড়ী পরিয়ে প্রকাশ্য রাজপথের উপর দিয়ে তাঁকে দিল্লীতে চালান করেছিলেন। কিন্তু তারপরেই খিজিরের আর কোন খবর পাওয়া যায় নি, কেউ তাঁকে আর কোনদিনই দেখতে পাননি; সম্ভবতঃ তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। গৌড়ের সেই অভিজ্ঞতা থেকে শের শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে, একজনের উপরে কোন বিস্তৃত অঞ্চলের দায়িত্ব অর্পণ করলে তাঁর হাতে এত বেশী পরিমানে সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত হয় যে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। তাই তিনি সমগ্র গৌড়-বঙ্গকে কতগুলি ছোট ছোট সরকারে ভাগ করে সম সংখ্যক শাসকের হাতে সেগুলি পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। ‘কাজী-কাজীলাৎ’ নামক উচ্চস্তরের এক কর্মচারী তাঁদের উপরে সর্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপরে শের শাহ মাত্র পাঁচ বছর জীবিত ছিলেন। নিজের রাজত্বের ওই অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে অনেকগুলি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল, বিজিত সাম্রাজ্যের সংহতি বিধানের জন্যও তাঁর বহু সময় ব্যয় হয়েছিল। তাই অত কাজের পরে তাঁর পক্ষে আর বিশেষ কিছু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল যে, প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে তাঁর সম্বন্ধে পরবর্তীকালে অনেকে অনেক কথাই লিখেছিলেন। আসলে শক্তিমানদের সম্বন্ধে এই ধরণের বহু গুজব রটে, কিন্তু সেগুলির ভিত্তি প্রায়ই শিথিল হয়।
বারুদের বিস্ফোরণে শের শাহের অকাল মৃত্যু হওয়ার পরে তাঁর পুত্র ‘ইসলাম শাহ শূর’ দিল্লীর মসনদে আরোহণ করে নিজের এক অনুগত ব্যক্তি ‘মহম্মদ খাঁ’কে সমগ্র গৌড়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশে কাজী-কাজীলাৎ পদটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরে ইসলাম খাঁ লোকান্তর গমন করবার পরে তাঁর শিশুপুত্র ‘ফিরোজ’কে হত্যা করে মাতুল ‘মোবারিজ খাঁ’, ‘মহম্মদ আদিল শাহ’ নাম নিয়ে দিল্লীর মসনদ আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু নরহত্যায় হাত সাফাই দেখিয়ে মসনদ অধিকার করলেও, সেই মসনদের নিরাপত্তা বিধানের শক্তি আদিলের ছিল না। তাই এরপরে একদিন আফগান সর্দারেরা তাঁর উপস্থিতিতেই দরবারের মধ্যে পরস্পরকে নিধন করতে শুরু করেছিলেন। সেদিন যে ক’জন ওই হানাহানির মধ্যে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁরা নিজের নিজের জায়গীরে ফিরে গিয়েই নতুন সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। গৌড়ের শাসক মহম্মদ খাঁও তখন সেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘সামসুদ্দীন মহম্মদ শাহ গাজী’ নাম নিয়ে নিজেকে স্বাধীন সুলতানরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করবার সাধ্য আদিল শাহের ছিল না, কিন্তু সামসুদ্দীন গাজী যখন পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে অবলীলাক্রমে জৌনপুর অধিকার করে নেওয়ার পরে সোজা দিল্লীর দিকে ধাবিত হয়েছিলেন, তখন তিনি আর নিশ্চেষ্ট থাকতে পারেন নি। তাঁর হিন্দু সেনাপতি ‘হিমু’ কালপির ত্রিশ মাইল পূর্বদিকে ছাপরাঘাট নামক জায়গায় মহম্মদ শাহ গাজীকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন (১৫৫৫ খৃষ্টাব্দ)। সেই যুদ্ধজয়ের পরে হিমুর পরামর্শে আদিল শাহ গৌড়-বঙ্গের দায়িত্ব ‘শাহবাদ খাঁ’র উপরে অর্পণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে পাশ কাটিয়ে মৃত সামসুদ্দীন গাজীর পুত্র ‘গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ’ এলাহাবাদের কাছে জুসি নামক জায়গায় নিজেকে পিতৃসিংহাসনে অভিষিক্ত করেছিলেন (১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ)। বিহার, গৌড় ও বঙ্গের সর্বত্র তাঁর নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচার শুরু হয়েছিল।
ওদিকে আফগানদের সেই গৃহবিবাদের সংবাদ তখন ইরাণে অবস্থানকারী হুমায়ুনের কাছে নিয়মিতভাবে পৌঁছাচ্ছিল। সেখানে তেরো বছর ধরে নির্বাসনের সময়ে তাঁর উপর দিয়ে যে সব দুঃখ দুর্বিপাক বয়ে গিয়েছিল, তাতে তাঁর প্রকৃতি কঠোর হয়েছিল, এবং তিনি আয়াস সহ্য করবার শক্তি অর্জন করেছিলেন। যখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সারা হিন্দুস্থানে আফগানরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে পরস্পরকে নিঃশেষ করছেন, তখন ছোট একটি সৈন্যদল সংগ্রহ করে তিনি সোজা দিল্লীর দিকে চলে এসেছিলেন। এরপরে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা ‘সেকেন্দার শূর’কে অতি সহজে পরাজিত করে তিনি ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী তারিখে ওই সুবা অধিকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেন একটি বিরাট ঐতিহাসিক মহীরুহের বীজ বপন করবার জন্যই ততদিন বেঁচেছিলেন, সেটির অঙ্কুরোদগম তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর ‘বৈরাম খাঁ’ সেই বীজে জল সিঞ্চন করতে শুরু করেছিলেন। শিশু আকবরের প্রতিভূ হয়ে তিনি গর্ভস্থ ভ্রূণটিকে লালনপালন করতে শুরু করেছিলেন। দেখতে দেখতে দুই প্রতিভূর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল। মোঘলপক্ষে আকবরের যেমন বৈরাম খাঁ ছিলেন, আফগান পক্ষে তেমনি আদিল শাহের ছিলেন হিমু বা ‘বিক্রমজিৎ’। ভারতে মোঘলদের পুনরাগমনের খবর পেয়ে আফগান সর্দারেরা তাঁদের নিজেদের মধ্যেকার বিভেদ ভুলে গিয়ে দিল্লীতে পৌঁছে সেই হিন্দু বীরের অধীনে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন। বৈরাম খাঁও সমস্ত মোঘল সৈন্যদের একত্রিত করে নিয়ে লাহোর থেকে দিল্লীর দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন। এরপরে পানিপথ প্রান্তরে সেই উভয় বাহিনীর মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে হঠাৎই শত্রুনিক্ষিপ্ত একটি গুলি লেগে হিমু নিহত হওয়ার ফলে আফগানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে আফগানদের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে সুলতান আদিল শাহ তৎক্ষণাৎ দিল্লী ছেড়ে গৌড়ের পথে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু শিয়রে শমন প্রস্তুত রয়েছে দেখেও গৌড়ের নতুন সুলতান গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর তাঁর পিতৃশত্রুকে মার্জনা করতে পারেন নি। আশ্রয়প্রার্থী স্বগোত্রীয়কে সাহায্য দানের পরিবর্তে তাঁর নিপাতের জন্য তিনি সসৈন্যে পশ্চিমদিকে এগিয়ে গেলে সুরজগড়ের কাছাকাছি ফতেপুর গ্রামে উভয় পক্ষের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। আদিল শাহের তখন জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ অবস্থা ছিল, তাঁর পিছনে ছিলেন মোঘলরা আর সামনে ছিলেন গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর। ১৫৫৭ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে গিয়াসুদ্দীনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি পরাজিত ও নিহত হওয়ার ফলে দিল্লীতে আফগান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আফগানরাই আফগানদের নিধন করে ভারতে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিয়েছিলেন।

এরপরে গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে,আদিল শাহকে যখন তিনি খতম করতে পেরেছেন, তখন আকবরের মত এক দুগ্ধপোষ্য শিশুর হাত থেকে দিল্লী কেড়ে নেওয়াটা তাঁর পক্ষে তেমন শক্ত কোন কাজ হবে না। তাই সেই আশায় তিনি ফতেপুর থেকে নিজের সৈন্যবাহিনীসহ জৌনপুরের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। দিল্লী জয়ের স্বপ্নে তিনি বিভোর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে মোঘল সেনাপতি ‘খান-ই-জামান’ তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়ানোর পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মোঘলরা আসলে কি বিষম জাতি। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুঙ্গেরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, এবং শেষপর্যন্ত মোঘলদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলেন। ওই সমঝোতা করতে গিয়ে কোন চুক্তিনামা অবশ্য সম্পাদিত হয় নি, কিন্তু শোন নদী দুই রাজ্যের সীমান্ত বলে উভয় পক্ষ থেকেই স্বীকৃত হয়েছিল। এরপরে গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর আরো যে তিন বছর জীবিত ছিলেন, সেই সময়ে তিনি গৌড়ে বসে ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে জৌনপুর, এবং দিল্লীতে বসে আকবর পশ্চিমে কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত সমস্ত ভূভাগের উপরে নিজের শাসনদণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কারো মনেই তখন স্বস্তি ছিল না। কারণ, সেই উভয় শক্তির সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব থেকে লাভবান হওয়ার আশায় সর্বত্র মালিক ও জায়গীরদারেরা স্বাধীন নরপতির মত আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের দমন করতে গিয়েই উভয়ের অধিকাংশ শক্তি ব্যয়িত হয়েছিল। সারা হিন্দুস্থান তখন ‘মুল্ক-উৎ-তায়াফিক’ হয়ে উঠেছিল। অপুত্রক অবস্থায় ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে গিয়াসুদ্দীন বাহাদুরের মৃত্যু হওয়ার পরে তাঁর ভাই ‘জালাল’, ‘দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীন’ নাম নিয়ে গৌড়ের তখতে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তিন বছর পরে তিনিও ইহলোক ত্যাগ করলে তাঁর বালকপুত্র মসনদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু সে কেবল সাত মাসের জন্য। কোন অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি সেই বালককে হত্যা করে গৌড়ের মসনদ আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসে তিনি তৃতীয় গিয়াসুদ্দীন নামে পরিচিত, তাঁর প্রকৃত নাম জানা যায় না। যদিও গৌড়ের মসনদ নিয়ে হত্যাপর্ব সেখানেই শেষ হয় নি। কারণ, এর একবছর পরেই, ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দে সেই নতুন গিয়াসুদ্দীনকে শমনসদনে পাঠিয়ে দিয়ে আফগান ভাগ্যান্বেষী ‘তাজ খাঁ কররানি’ গৌড়ে একটি নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
(সমাপ্ত)

(তথ্যসূত্র:
১- Gulshan-i-Ibrahimia, Firishta.
২- Tarikh-i-Salatin-i-Afghana, Ahmed Yadgar.
৩- History of Portuguese in Bengal, J. J. A. Campos.
৪- Akbarnama, Abul Fazl Allami.
৫- Makhzan-i-Afghani, Niamatullah, Elliot’s translation.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯৪০-এর দশকে কেউ যদি সর্বদেশীয় মেয়েদের নামের মিলন যদি দেখতে চাইতেন, তাহলে তাঁর পুরানো কলকাতার একটি ষ্টীমার ঘাটে গেলেই চলত। সেখানে তখন থরে থরে গঙ্গার বুকের উপরে বাড়ির

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নিলালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিয়েও রহস্য দানা বাঁধতে দেখা গেছিল। সে রহস্যের মীমাংসা আজ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দ গেছিলেন একটা চুক্তিপত্র

নজরুল-প্রমীলা বিবাহ প্রসঙ্গেনজরুল-প্রমীলা বিবাহ প্রসঙ্গে

রানা চক্রবর্তীঃ ইতিহাসে নজরুল পত্নী ‘প্রমীলা’ এক ‘pathetic’ চরিত্র। অপর পক্ষে নজরুল ইসলামের বিয়ে প্রথমে ঠিক হয়েছিল (মতান্তরে বিয়ে হয়েছিল) যে মহিলার সাথে, সেই ‘নার্গিস’কে বলা যায় ‘ট্র্যাজিক’ চরিত্র। আর

‘ঔরঙ্গজেব ও হীরাবাঈ’ (ঐতিহাসিক প্রেম ২)‘ঔরঙ্গজেব ও হীরাবাঈ’ (ঐতিহাসিক প্রেম ২)

রানা চক্রবর্তীঃ হাজার বার মাথা ঠুকেও ইতিহাসে প্রেমিক ঔরঙ্গজেবকে খুঁজে পাওয়া যায় না। শেষ শক্তিশালী মোঘল সম্রাট নিজেও ইতিহাস রক্ষার জন্য তেমন কোন যত্ন নেননি, বরং সবকিছু মুছে ফেলতেই চেষ্টা