স্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দ - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ স্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দ

স্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দ


রানা চক্রবর্তীঃ ‘রোমাঁ রোলাঁ’ শ্রীঅরবিন্দকে ‘নব ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। (Prophets of the New India) ‘বুদ্ধিজীবী’ বলতে যদি তাঁদেরই বোঝায় যাঁরা নিজেদের ‘বুদ্ধি’ ও ‘প্রজ্ঞা’ দিয়ে জগৎকে বুঝতে চেষ্টা করেন, তবে ‘রোলাঁ’-প্রদত্ত শ্রীঅরবিন্দের এই আখ্যা সম্পূর্ণভাবে যুক্তিযুক্ত। বস্তুতঃ, বুদ্ধি দিয়ে জগতের অবস্থা-ব্যবস্থাকে বোঝবার এবং সেটার গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত করবার সাধনায় নবযুগে শ্রীঅরবিন্দ শুধু ভারতের নন, সমগ্র পৃথিবীতেই একরূপে তুলনাহীন। শ্রীঅরবিন্দকে ‘রোলাঁ’ আবার ‘স্বামী বিবেকানন্দের বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত উত্তরাধিকারী’ (‘the real intellectual heir of Vivekananda’), ‘নয়া বেদান্তের প্রকৃত ধারক ও বাহক’, ‘চিতা থেকে উত্থিত বিবেকানন্দের কণ্ঠ’ (‘voice of Vivekananda risen from the pyre’) বলেও বর্ণনা করেছিলেন (Prophets of the New India); অতএব, রোলাঁর মতে, ‘নব ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী শ্রীঅরবিন্দ’ স্বামী বিবেকানন্দেরই ‘উত্তরাধিকার’ বহন করেছিলেন। অবশ্য সেই উত্তরাধিকারকে তিনি যে নিজস্ব অবদানের দ্বারা আরো ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তুলেছিলেন, সেটাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তা না হলে তিনি ‘অরবিন্দ ঘোষ’ থেকে ‘শ্রীঅরবিন্দ’ হতে পারতেন না।

শ্রীঅরবিন্দ নিজেই স্বামী বিবেকানন্দের কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেছিলেন এবং স্বামীজীর জীবন ও দর্শনের যে মূল্যায়ন তিনি করেছিলেন, সেটার ছত্রে ছত্রে তাঁর এই স্বীকৃতি মিশে রয়েছে। স্বামীজীকে তিনি ‘নরপতি’ (‘king among men’) বলে অভিহিত করেছিলেন এবং ‘পুনর্গঠনের মাধ্যমে সংরক্ষণের’ (‘preservation through reconstruction’) উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত এবং প্রধান প্রবক্তা বলে বর্ণনা করেছিলেন। (Renaissance in India) এই দর্শন বহুলাংশে শ্রীঅরবিন্দেরই নিজস্ব ‘সমাজদর্শন’। তিনি লিখেছিলেন, “রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের চিরস্মরণীয় নামের সঙ্গে জড়িত আন্দোলন অতীতের ধর্ম ভাব ও ধর্ম সাধনার সার্থক সমন্বয়। ত্যাগ ও সন্ন্যাসধর্মের ওপর পুনরায় গুরুত্ব আরোপ করা হলেও এতে নতুন উপাদানের অভাব নেই।” (Renaissance in India) শ্রীঅরবিন্দ ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘আলিপুর বোমা মামলা’র বিচারাধীন বন্দী অবস্থায় ‘আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে’ পরপর পনেরো দিন তিনি স্বামী বিবেকানন্দের উপস্থিতিকে অনুভব করে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, এবং আরেকবার, ‘বরোদা’য় ‘হঠযোগ’-সাধনাকালেও তিনি অনুরূপ অনুভূতি লাভ করেছিলেন। ‘সত্যাশ্রয়ী’ শ্রীঅরবিন্দ স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি যে, ওই সকল ঘটনা ও স্বামীজীর শিক্ষা তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। শ্রীঅরবিন্দের মতে, স্বামী বিবেকানন্দই সমাজের জাতীয় জীবনের স্রষ্টা ও প্রধান নায়ক। তাঁর আদর্শই আজ ভারতের জাতীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে। (রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ, ‘ধর্ম’ পত্রিকা, ৩০শে ফাল্গুন, ১৩১৬ বঙ্গাব্দ) ১৯১৫ সালে শ্রীঅরবিন্দ লিখেছিলেন, “বিবেকানন্দ ছিলেন অতি শক্তিশালী মহাত্মা, অন্যতম পুরুষসিংহ। … তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বের প্রভাব এখনও আমরা অনুভব করি। কিভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা অবশ্য বলতে পারি না। হয়ত এমন কিছুর মধ্যে যা এখনও রূপ গ্রহণ করেনি। কিন্তু যখনই দেখি কোন কিছু মহৎ আলোড়নকারী অনুভবযোগ্য শক্তি ভারতের অন্তরাত্মার মধ্যে প্রবেশ করে ক্রিয়া শুরু করেছে, তখনই বলি, ঐ দেখ মাতার এবং মাতার সন্তানদের আত্মায় বিবেকানন্দ এখনও সঞ্চরমান।” (Bankim-Tilak- Dayananda) এই পর্যন্ত আলোচনা থেকে এটা ধারণা করা অবশ্য ঠিক হবে না যে, শ্রীঅরবিন্দের ‘দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি’ স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মোটেই পৃথক ছিল না। এই প্রসঙ্গে ‘ডক্টর কে. আর শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার’ বলেছিলেন, “(স্বামী) বিবেকানন্দের প্রতি তাঁর (শ্রীঅরবিন্দের) প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল আর (শ্রী) রামকৃষ্ণের প্রতি তাঁর প্রগাঢ়তম ভক্তি ছিল৷ তবে তিনি যে বিবেকানন্দের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেননি, সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই।” (Sri Aurobindo) তাই মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, ‘রোমাঁ রোলাঁ’ কর্তৃক ‘নয়া বেদান্তের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি’ বলে অভিহিত শ্রীঅরবিন্দ ঈশ্বর ও সন্ন্যাসধর্মের ধারণায় স্বামী বিবেকানন্দ থেকে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করতেন। বিষয়টি অবশ্য বর্তমান আলোচনার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কিত নয়৷
এই প্রবন্ধে যেটা গুরত্বপূর্ণ সেটা হল, পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে নব ভারতের এই দু’জন স্রষ্টার প্রতিক্রিয়া। ১৮৯৩ সালে, যে বছর স্বামী বিবেকানন্দ ‘চিকাগো ধর্ম সম্মেলনে’ ভারতের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের রচনা করেছিলেন, সেই বছরই বিলেত থেকে ভারতে ফিরেই শ্রীঅরবিন্দ তাঁর বন্ধু, ‘কে. জি. দেশপান্ডে’ সম্পাদিত এবং ‘বোম্বাই’ থেকে প্রকাশিত ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকার একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’কে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর লেখা সেই প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘পুরাতনের পরিবর্তে নতুন আলো’ (‘New Lamps for old’)। শ্রীঅরবিন্দ, ১৮৯৩ সালের ৭ই আগস্ট তারিখে প্রকাশিত ওই রচনাটির সূচনা করেছিলেন সেই পুরানো প্রশ্নটি দিয়ে – “একজন অন্ধ যদি আরেকজন অন্ধের হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তবে দু’জনেরই কি গর্তে পড়বার কোন আশঙ্কা থাকে না?” এবং একই সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, উক্ত সূত্রটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে প্রযোজ্য। (শ্রীঅরবিন্দের নিজের ভাষায়, “The title ‘New Lamps for Old’ intended to imply the offering of new lights to replace the old and reformist lights of the Congress” – ‘Sri Aurobindo on himself and on the mother’) কংগ্রেস তখন ভারতের সমগ্র জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব না করে একটা বিশেষ শ্রেণীরই স্বার্থ সাধন করে চলছিল – এটাই ছিল তাঁর সেই রচনার প্রতিপাদ্য বিষয়। এবং তিনি ওই ধারাবাহিক রচনাটির উপসংহার করেছিলেন এই বলে যে, “মাত্র সামগ্রিক সমাজভিত্তিক জনপ্রিয় আন্দোলনই মহান বলে পরিগণিত ও সফল হতে পারে, কিন্তু কোন সীমাবদ্ধ সঙ্কীর্ণ আন্দোলন কখনো সফল হতে পারে না।” এর কয়েক বছর পরে স্বামী বিবেকানন্দকেও অনুরূপভাবেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ‘শ্রেণী-চরিত্রের’ (class-character) সমালোচনা করতে দেখা গিয়েছিল। স্বামীজী কংগ্রেসের উদ্ভবকে স্বাগত জানালেও উক্ত সংগঠন যে জনজাগরণ সংঘটিত করে জাতীয় মুক্তির বাহন হবে, এরকম আশা মোটেই পোষণ করতে পারেন নি। শ্রীঅরবিন্দ জাতীয় মুক্তির জন্য ‘রক্ত ও অগ্নি শুদ্ধি’র (‘Purification by blood and Fire’) প্রয়োজনীয়তাকে অনভব করেছিলেন। (‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটি ধারাবাহিক প্রবন্ধের নাম) তাঁর সেই ‘শুদ্ধিমন্ত্র’কে স্বামী বিবেকানন্দের ‘ত্যাগ ও সেবার’ (‘renunciation and service’) প্রকারভেদ, এমনকি ভিন্ন নামকরণ বলেও বর্ণনা করা চলে। ‘সর্বহারার দল’ই যে দেশের ভবিষ্যৎ ভাগ্যনিয়ন্তা হবে, একথা শ্রীঅরবিন্দ বারবার বলে গিয়েছিলেন। ‘পুরাতনের পরিবর্তে নতুন আলো’ রচনায় তাঁর এই ধারণার সূত্রপাত দেখতে পাওয়া যায়; কিন্তু বোধহয়, দরিদ্রনারায়ণের মুক্তির জন্য স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত আন্দোলনের ফলে তাঁর সেই ধারণাটি দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। অন্ততঃপক্ষে শ্রীঅরবিন্দের ‘ভবানী মন্দির’ নামক পুস্তকটি পড়লে এই ধারণাই হয়। উক্ত ধারণাটির বিরোধিতা করা গেলেও ‘জাতীয়তাবাদ’ ও আনুষঙ্গিক ভাবের (ideas) পরিস্ফুটনে শ্রীঅরবিন্দের ওপরে স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাবকে অস্বীকার করা কিন্তু বড়ই কঠিন।

শ্রীঅরবিন্দ জাতীয়তাবাদকে মুক্তিপ্রয়াসী মানবাত্মার বিরতিবিহীন সংগ্রামের অন্যতম দিক বলেই বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর মতে, ঈশ্বর যখন মানুষকে বিশুদ্ধ ও স্বাধীন রূপেই সৃষ্টি করেছেন, তখন মানুষ কি আর মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে পারে? সুতরাং ‘জাতীয়তাবাদ’ (Nationalism) কোন ভাবাদর্শ বা আন্দোলন নয়; জাতীয়তাবাদ আসলে মানুষের একটা ‘ধর্ম’। অতএব, “তুমি যদি জাতীয়তাবাদী আখ্যা পেতে চাও, যদি জাতীয়তাবাদ-ধর্মকে অনুসরণ করতে চাও, তবে তোমাকে ধর্মভাবের বিশুদ্ধতা নিয়েই অগ্রসর হতে হবে।” (Speeches of Sri Aurobindo) একমাত্র ‘ঐকান্তিকতা’ই (spirit) শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারে; ফলে “মনের দিক দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ ও পূর্ণাঙ্গ মুক্তির মাধ্যমেই আমরা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্ত ও মহৎ বলে পরিগণিত হতে পারি।” (The Ideal of the Karmayogin) অতএব, শ্রীঅরবিন্দের সংজ্ঞায়, “স্বাধীনতা হলো আমাদের নিজস্ব সত্তার বিধিনিয়মকে মেনে চলার স্বাধীনতা, স্বাভাবিক পদ্ধতিতে পূর্ণ আত্মোপলব্ধির পথে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা, আমাদের নিজস্ব পরিবেশের সঙ্গে বাধাবিহীনভাবে সামঞ্জস্য বিধানের রীতিপদ্ধতি।” (The Ideal of Human Unity) মানবাত্মার মুক্তির ওপরে এই যে গুরুত্ব আরোপ (emphasis on the deliverance of human spirit), সেটা ‘ধর্মচিন্তা’ ও ‘রাজনীতি’র মধ্যে গভীর সম্পর্ক ভিত্তিক দার্শনিক তত্ত্বেরই পরিণতি। স্বামী বিবেকানন্দই যে এই দার্শনিক তত্ত্বের সূত্রপাত করেছিলেন, একথা ‘লালা লাজপত রাই’ প্রভৃতি চিন্তাশীল ব্যক্তিরা কোন কুণ্ঠা না রেখেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন। (Young India – Nationalist Movement, Lajpat Rai)
‘মানবাত্মার মুক্তি’ বা ‘আত্মিক মুক্তি’ – মানুষের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতার সকল রূপকেই নির্দেশ করে। ১৭৮৯ সালের ‘ফরাসী বিপ্লবের’ ভাবধারণার (‘Ideas of 1789’, Barker) উল্লেখ করে শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন, “স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী শব্দ তিনটি আঠারো শতকের আন্দোলন-তরঙ্গ-প্রসূত হয়ে আজও যে মানুষের জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করে চলেছে তার কারণ হল, শব্দগুলো সেই পরিণতিই নির্দেশ করে, যে পরিণতির উদ্দেশ্যে মানুষের বিবর্তন চিরকালই অগ্রসর হচ্ছে। এই যে স্বাধীনতা, যার দিকে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে অগ্রর হচ্ছি তা বন্ধনদশার মুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। … আমাদের দেশের দর্শনে সেই পরিণতিকেই মুক্তি বা মোক্ষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।” (Speeches of Sri Aurobindo) তাঁর মতে, পরাধীন ভারতে সেই মুক্তির দুটো দিক ছিল – ‘আভ্যন্তর’ ও ‘বাহ্যিক’। আমরা ভারতীয়রা আভ্যন্তর মুক্তির পথে চলেছিলাম; অপর দিকে আমাদের ইউরোপীয় ভাইয়েরা বাহ্যিক মুক্তির অভিমুখে এগিয়ে চলেছিলেন। তবুও আমরা সমান্তরাল ভাবেই চলেছিলাম। “তাঁরা আমাদের কাছে শিখেছেন আভ্যন্তর মুক্তিকে মর্যাদা দিতে, আর আমরা শিখেছি বাহ্যিক মুক্তিকে আকাঙ্ক্ষা করতে।” (Speeches of Sri Aurobindo) অতএব, শ্রীঅরবিন্দের মতে, কেবলমাত্র ‘পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা’ই – আভ্যন্তর ও বাহ্যিক মুক্তির সমবায়ে গঠিত ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ই – মানুষকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে পারে, কারণ – স্বাধীনতাই হল সম্প্রসারণের মূলমন্ত্র। ‘স্বাধীনতা ও সম্প্রসারণ’ (liberty and growth) সম্বন্ধে শ্রীঅরবিন্দের এই ধারণা স্বামী বিবেকানন্দকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্ততঃ তাঁদের দু’জনের চিন্তাধারা যে একই সূত্রে গাঁথা ছিল, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না।

পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আত্মিক প্রকৃতির বলে ঐক্য অভিমুখে প্রসারিত। অর্থাৎ, বিশ্বজনীনতা এই স্বাধীনতার মৌল প্রকৃতির অঙ্গীভূত। ‘ডক্টর কে. আর. আয়েঙ্গারের’ ভাষায়, “প্রথম থেকেই শ্রীঅরবিন্দ ব্যক্তি-মুক্তির মোহ থেকে সম্পূর্ণ মক্ত ছিলেন৷ জগৎকে তার ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করে একক মুক্তির প্রচেষ্টা অপেক্ষা অকাম্য আর কিছু শ্রীঅরবিন্দের ছিল না।” (Sri Aurobindo) ফলে তিনি জাতীয়তাবাদের বিমূর্ত লক্ষ্য স্বরাজকে ঐশ্বরিক ইচ্ছার পরিপূর্ণতা বলেই বর্ণনা করেছিলেন। (History of Freedom Movement, Vol. I, Dr. R. C. Majumdar) এমনকি রাজনীতি থেকে অবসরগ্রহণের বহু দিন পরেও, ১৯২১ সালে তিনি ঘোষণা করেছিলেন – “আমাদের যোগসাধনা আমাদের নিজেদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য। ব্যক্তি-মুক্তি এর লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হল সমগ্র মানবজাতির মুক্তি।” (The Yoga and its Objects) তাঁর এই ঘোষণা কি স্বামী বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত উক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয় না – “তুমি বা আমি মুক্তি লাভ করি, না করি, তাতে কি যায় আসে? আমাদের পক্ষে সারা জগৎকে যে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে হবে।” (Vivekananda – A Biography, Swami Nikhilananda) শ্রীঅরবিন্দের মতে, স্বাধীনতা তখন বিশেষ সঙ্কটে পতিত হয়েছিল এবং সেটার পিছনে মূল কারণ ছিল, ব্যক্তি ও ব্যক্তির মধ্যে, সম্প্রদায় ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই ঐক্যভাবের অভাব, একমাত্র যে ঐক্যভাবই স্বাধীনতাকে সার্থক করে তুলতে পারে। তাই তিনি বলেছিলেন, “যদি প্রকৃত আত্মিক ও মানসিক ঐক্যভাব গড়ে তোলা যেত তবে স্বাধীনতার কোন সঙ্কটই থাকত না।” (The Ideal of Human Unity) কারণ মুক্ত ব্যক্তিসমুদয় ঐক্যের আকর্ষণে নিজেদের সম্প্রসারণের সঙ্গে অপরের সম্প্রসারণের সামঞ্জস্যবিধান করতেন। স্বাধীনতা, ঐক্য এবং সম্প্রসারণের (growth) মধ্যে এই যে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নির্দেশ, এটা কি স্বামী বিবেকানন্দের ‘নয়া বেদান্তের’ই বাণী নয়?
শ্রীঅরবিন্দের তত্ত্ব ছিল, একটা জাতি হিসাবে ভগবৎ-ইচ্ছাপূরণের উদ্দেশ্যে ভারতকে তার নিজের পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রকৃত স্বাধীনতা এবং আত্মিক ঐক্যের উপলব্ধিই আত্মার পুনরুদ্ধারের মূল মন্ত্র। এই মন্ত্র আবার ভারতের মুক্তি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্প্রসারণের চাবিকাঠিও বটে। অন্যভাবে বলতে গেলে, অরবিন্দের মতে, ভারতের ক্ষেত্রে সম্প্রসারণের প্রকৃতি হবে সম্পূর্ণ আভ্যন্তর (growth from within)। সুতরাং শ্রীঅরবিন্দ যে ব্যক্তিধর্ম ও গোষ্ঠীধর্মের (‘individual and group Dharmas’) প্রতিবন্ধকহীন অভিযানের জন্য আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যকে সমর্থন করেছিলেন, সেটা সহজেই অনুমেয়। (White Umbrella, D. M. Brown) স্বভাবতই শ্রীঅরবিন্দ, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন, যদিও পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক বিজয়কে স্বাগত জানাতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন নি। (Prophets of the New India) তাঁর মতে, ‘অনুকরণ-প্রবণতা’ সম্পূর্ণ অ-ভারতীয় বৈশিষ্ট্য, এবং সেই কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে অনুকরণের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম ছিল। (The Spirit and Form of Indian Polity) ঐ অনুকরণ করতে গিয়ে, তৎকালীন ভারতবর্ষ, গীতার উপদেশ – “স্বধর্মে মৃত্যুও শ্রেয়” – সেটা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে নিজের মধ্যেই আরেকটি ইউরোপের সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তাই তিনি বলেছিলেন, “স্বধর্মে মৃত্যু নতুন জীবনের সম্ভাবনা আনে, আর পরধর্মাচরণে মৃত্যু ঘটলে সেটাকে আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।” (The Ideal of Karmayogin) তবে শ্রীঅরবিন্দ মোটেই ‘নৈরাশ্যবাদী’ ছিলেন না, কারণ ‘আশাবাদ’ই যে নয়া বেদান্তের মর্মবাণী। তাঁর সময়ের সকল অন্ধকার ও বিশৃঙ্খলার মধ্যেও তিনি নতুন ঊষার আলোকই দেখতে পেয়েছিলেন, যে ঊষা প্রভাতে রূপান্তরিত হলে ভারত জগৎকে দেখিয়ে দেবে যে – “সনাতন ভারত মৃত নয়। শেষ কথাটি সে আজও বলেনি। ভারত দেখিয়ে দেবে যে, সে এখনও বেঁচে এবং শুধু তার নিজের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যও তার কিছু করণীয় আছে।” (The Spirit and Form, above)

(তথ্যসূত্র:
১- Prophets of the New India, Romain Rolland.
২- Renaissance in India, Sri Aurobindo.
৩- Bankim-Tilak-Dayananda, Sri Aurobindo.
৪- Sri Aurobindo, R. K. Srinivasa Iyengar.
৫- Speeches of Sri Aurobindo.
৬- Vivekananda – A Biography, Swami Nikhilananda.
৭- White Umbrella, D. M. Brown.
৮- The Spirit and Form, above; Sri Aurobindo.
৯- The Ideal of Karmayogin, Sri Aurobindo.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)

হরানা চক্রবর্তীঃ ‘ঘোরী নগরী’ আফগানিস্থানে অবস্থিত হলেও ‘মহম্মদ ঘোরী’ জাতিতে আফগান ছিলেন না। তরাইন প্রান্তরে একদল আফগান যেমন তাঁর তুর্কী ফৌজের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, আরেকদল আফগান তেমনি পৃথ্বিরাজের পক্ষ

গাছেদের কথা বলাগাছেদের কথা বলা

জার্মান লেখক পিটার উললেবেনের বক্তব্য সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে। উনি বলছেন যে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করে থাকে গাছেরাও অনেকটা আড়ালে আড়ালেই ভূগর্ভস্থ মাইসেলিয়াল তন্তুর মধ্যে দিয়েই, অর্থাৎ মাটির নীচে

‘গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ’‘গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ’

১৫৭৪ খৃষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে মোঘলরা তাড়ায় প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন গৌড়েশ্বর দাউদ কররানি অতি সঙ্গোপনে নিজের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে সপ্তগ্রামের পথ ধরে উড়িষ্যার দিকে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর

‘ইলিয়াসশাহী’ বংশের পতন‘ইলিয়াসশাহী’ বংশের পতন

পিতা ‘সিকান্দার শাহের’ বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করবার পরে নিজের ষোলজন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের চোখ উপড়ে নিয়ে ‘গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ’ ইলিয়াসশাহী বংশের তখতে আরোহন করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনিই ইলিয়াসশাহী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান