‘গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ’ - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ’

‘গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ’


১৫৭৪ খৃষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে মোঘলরা তাড়ায় প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন গৌড়েশ্বর দাউদ কররানি অতি সঙ্গোপনে নিজের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে সপ্তগ্রামের পথ ধরে উড়িষ্যার দিকে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর সৈনিক ও সৈন্যাধ্যক্ষরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চারিদিকে পালাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রথমে এদিকে ওদিকে পালালেও পরে অধিকাংশ আফগান সৈনিকই বিভিন্ন পথ ধরে এদিক ওদিক দিয়ে শেষপর্যন্ত দাউদের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছিলেন। মোঘল সেনাপতি খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ দাউদের প্রাসাদে নিজের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে পলায়নপর আফগানদের ধরবার জন্য তাঁর সৈন্যাধ্যক্ষদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই নির্দেশ পালন করবার মত লোক তখন পাওয়া যায়নি। যুদ্ধ না করেও তাঁরা সবাই পথশ্রমে ক্লান্ত ছিলেন। আর তাঁদের অশীতিপর বৃদ্ধ নায়ক তখন যুদ্ধজয়ের আনন্দে বিভোর ছিলেন। তাই তাঁর আদেশ পালিত হয়নি, আর তিনিও কাউকে কিছু বলেন নি। এর ফলে মোঘলরা যেমন বিনাযুদ্ধে গৌড় জয় করে নিয়েছিলেন, আফগানরাও তেমনি বিনাবাধায় মেদিনীপুরে গিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হোতে শুরু করেছিলেন। ঠিক সেই সময়ে মোঘল শিবিরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন ‘রাজা টোডরমল’। তিনি জানতেন যে ঋণের শেষ, রোগের শেষ আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তাই দাউদকে অনুসরণ করবার জন্য তিনি মোঘল সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছিলেন, এবং নিজে বর্ধমানের মোঘল গ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে গড়-মান্দারণে অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন। সেখানে একদিন গুপ্তচর মুখে তাঁর কাছে খবর এসেছিল যে, দাউদ মেদিনীপুর জেলার দেবরা-কাসারি গ্রামে ব্যুহবিন্যাসের আয়োজন করেছেন। তাই তাঁকে ধরবার জন্য রাজা টোডরমল নতুন কয়েক ডিভিসন সৈন্য নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ওদিকে দাউদ দেখেছিলেন যে, দেবরা-কাসারি মোঘলের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ করবার পক্ষে উপযুক্ত জায়গা নয়। তাই তিনি সেখান থেকে সরে গিয়ে দাঁতনের এগারো মাইল দক্ষিণ-পূর্বে গড়-হরিপুর গ্রামে নতুন করে নিজের শিবির স্থাপন করেছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করে রাজা টোডরমল মেদিনীপুর শহরে গিয়ে পৌঁছানোর পরে মোঘল সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। তাঁরা যুদ্ধ করতে রাজী হননি। তাঁদের প্রশ্ন ছিল, বিনা যুদ্ধে যখন কররানি রাজ্য জয় করা গেছে তখন তাঁদের আবার যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার কারণ কি? তাই ওসব ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে তাঁরা ক’দিন নিজেদের তাঁবুতে বসে বিজয়োৎসব পালন করতে চেয়েছিলেন, তারপরে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে পরিবারবর্গের সঙ্গে দিন কাটাতে চেয়েছিলেন। টোডরমল তাঁদের অনেক বোঝানো সত্ত্বেও কিছুতেই তাঁদের মতিগতির কোন পরিবর্তন হয়নি। ওই ধরণের অনিচ্ছুক সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধে নামলে শেষপর্যন্ত কোন সুবিধা হবে না বুঝতে পেরে রাজা টোডরমল তাঁর সমস্ত ফৌজসহ গড়-মান্দারণ দুর্গে ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছে মোঘল সৈন্যরা হৈহল্লা নাচগানে মেতে উঠেছিলেন। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ বিহার ও গৌড় জয়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন। রাজা টোডরমল মেদিনীপুর থেকে গড়-মান্দারণে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন শুনতে পেয়ে তিনি নতুন এক ডিভিসন সৈন্য তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও যে কোন সুবিধা হবে, সেই ধরণের কোন ভরসা না থাকায় শেষপর্যন্ত তিনি নিজেই উড়িষ্যার দিকে রওনা হয়েছিলেন। টোডরমলকে পূর্বাহ্নেই তাঁর যাত্রার সংবাদ দেওয়া হয়েছিল। পূর্ব-চেটো গ্রামে উভয় সেনানায়কের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। সেখানে তাঁরা শুনতে পেয়েছিলেন যে, মোঘলরা মাসের পর মাস ধরে গড়িমসি করবার ফলে দাউদ কররানি নতুন করে সমরসজ্জা করে ফেলেছেন। তাঁর ছাউনি হরিপুর গ্রামে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে চতুর্দিকে প্রশন্ত গড় খনন করে জলপূর্ণ করা হয়েছে। সেই ছাউনিতে দাউদের ফৌজ আফগানদের চিরন্তন প্রথানুযায়ী গভীর পরিখা কেটে সেটার ভিতরে অবস্থান করছেন। মেদিনীপুর থেকে সেই নতুন ঘাঁটিতে পৌঁছাবার যে একটিমাত্র সড়কটি ছিল, সেটার সর্বত্র ছোট ছোট গুপ্ত ঘাঁটি তৈরী করে দু’পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দাউদ তাঁর বহু সৈন্যকে মোতায়েন করে রেখেছিলেন। মোঘল সংবাদ-বাহীরা যখন ওই সব খবর আনতে শুরু করেছিলেন, তখন সেগুলি শুধু মোঘল অফিসারদের মধ্যে চাপা থাকেনি, সাধারণ সৈনিকেরাও সেগুলি শুনেছিলেন এবং রীতিমত ভয় পেয়েছিলেন। সবাই মত ছিল যে, যুদ্ধের হাঙ্গামার মধ্যে না গিয়ে দাউদের সঙ্গে কোনরকম একটা সমঝোতা করে নেওয়া হোক। মোঘল সৈনিকেরা সেজন্য নিজেদের অফিসারদের কাছে নানাভাবে অনুরোধ উপরোধ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের পরিষ্কার কথা ছিল, কোথাও কোন যুদ্ধ না করেই যখন তাঁরা আফগানদের বিহার ও গৌড় থেকে তাড়াতে পেরেছেন, তখন উড়িষ্যার ওই জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে যুদ্ধ করবার কি দরকার? কিন্তু তাঁদের নায়কদ্বয় কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন। তাঁরা ঠিকই করে নিয়েছিলেন যে দাউদের সঙ্গে সব হিসাব মিটিয়ে নেবেন, আর সেজন্য তাঁরা নিজেদের বাহিনীর সমস্ত সৈনিকের জীবন বলি দিতেও রাজী ছিলেন। তবে তাঁরা ছিলেন আকবরের প্রবীণ রণনায়ক, কোন বেহিসাবী কাজ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁরা জানতেন যে ধূর্ত আফগানরা যখন পথের দু’পাশে মৃত্যুজাল রচনা করে রেখেছেন, তখন তাঁদের সেই পথ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। তাই নিজেদের কয়েকজন অফিসারকে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁরা একটি বিকল্প পথের সন্ধান করতে শুরু করেছিলেন, এবং স্থানীয় লোকদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানতে পেরেছিলেন যে, অনেক বেশী দীর্ঘ ও সংকীর্ণ হলেও হরিপুরে যাওয়ার জন্য আরো একটি পথ রয়েছে। মোঘল ইঞ্জিনীয়ারদের উপরে সেই পথটিকে প্রশস্ত করবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পরে উভয় সেনানায়ক সেই নতুন পথের উপর দিয়ে এগিয়ে মেদিনীপুরের নানজুরা গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন যে সেখান থেকে দাউদকে আক্রমণ করলে তাঁর সকল আয়োজন ব্যর্থ হবে ও তাঁর ব্যূহ বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। ওদিকে দাউদের কাছে সব খবরই গুপ্তচর মারফৎ পৌঁছাচ্ছিল। তিনি যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে মোঘলের সঙ্গে সেবারে জীবনমরণ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হবে, তখন তিনি প্রথমেই তাঁর পরিবারবর্গকে কটকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরে জঙ্গল থেকে সৈন্যদের নিজের মূল ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সমগ্র ফৌজসহ মোঘল ব্যূহ নানজুরার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে তিনি শত্রুর সঙ্গে নিজের শক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

আরো পড়ুন-  ‘বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক মূল্য’

মোঘল রাজপরিবারের মতই খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ ও রাজা টোডরমলের জ্যোতিষের উপরে অটুট আস্থা ছিল। তাই নিজেদের সাথে নামকরা একজন জ্যোতিষীকে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আগে পরামর্শ করে তবেই তাঁরা সব কাজে হাত দিতেন। সেই জ্যোতিষী যখন গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান দেখে গণনা করে তাঁদের বলেছিলেন যে, ওই দিনটি যুদ্ধ করবার পক্ষে অনুকূল নয়, তখন উভয় সেনানায়ক নিরস্ত হয়ে শুভ দিনের প্রতীক্ষায় বসে পড়েছিলেন। তাঁদের গোলন্দাজরা দূরপাল্লার কামান থেকে গোলা বর্ষণ করে শত্রুকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ওদিকে সুলতান দাউদ কিন্তু জ্যোতিষের ধার ধারতেন না। তাই দিনক্ষণের তোয়াক্কা না করেই তিনি হঠাৎ একদিন পরিখা থেকে নিজের সৈন্যদের টেনে বার করে মোঘল ব্যূহের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যুবক সুলতানের সেই হঠকারিতা দেখে মুনাইম খাঁ ও টোডরমল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, ওই ছোকরার তাঁবুতে কি কোন জ্যোতিষী নেই? এই ঘোর অদিনে কী কেউ যুদ্ধ শুরু করে? এই ছোঁড়া নির্ঘাত জাহান্নমে যাবে! কিন্তু তাঁদের আর চুপ করে বসে থাকবার কোন জো ছিল না। তাই খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ একপ্রকার বাধ্য হয়েই যুদ্ধ শুরু করবার আদেশ দিয়েছিলেন। এরপরে পাশের তুকারই প্রান্তরে মোঘল-পাঠানে প্রচণ্ড সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর বহুদিন আগে চৌসায় শের শাহের হাতে হুমায়ুনের পরাজয়ের পরে পূর্বভারতে সেই প্রথম মোঘল ও পাঠানেরা নিজেদের মধ্যে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ন হয়েছিলেন। চৌশা ও বিলগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি আফগানদের মনে সদাজাগ্রত থাকবার ফলে তুকারইতে যে তাঁরা মোঘলদের শেষ করে দিতে পারবেন, সে বিষয়ে তাঁদের মনে কোন সংশয় ছিল না। তাঁদের সেনাপতি ‘গুজর খাঁ’ তাঁর হস্তিবাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে মোঘল অশ্বারোহীদের আক্রমণ করেছিলেন। ওই হাতীগুলির শুঁড় ও দেহ অন্য জন্তুর চামড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়ার জন্য সেগুলিকে এক অদৃশ্যপূর্ব হিংস্র প্রাণীর মত দেখাচ্ছিল। ওই সব বীভৎস জন্তুদের দেখে মোঘলদের ঘোড়াগুলি এমনই শঙ্কাকুল হয়ে উঠেছিল যে, সেগুলির সওয়ারেরা নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করেও সেগুলিকে সংযত রাখতে পারেন নি। ভয়ব্যাকুল ঘোড়ার দল চারিদিকে ছোটাছুটি করতে থাকবার ফলে দেখতে দেখতে মোঘলদের ব্যূহ ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল, সৈন্যরা দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। ‘খান-ই-আলমের’ বাহিনীতে যে সব প্রবীণ সৈনিকেরা ছিলেন তাঁরাও নিজেদের ঘোড়াগুলিকে খাড়া রাখতে পারেন নি। তিনি যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন ও তাঁর সৈন্যরা দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে চারিদিকে ছোটাছুটি করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বিজয়োৎফুল্ল আফগান ফৌজ মোঘল ব্যূহের মধ্যভাগ বিদীর্ণ করে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, দাউদ কররানি তাঁদের সম্মুখে নতুন শের শাহরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণে সর্বাধ্যক্ষ মুনাইম খাঁ সহ সকল মোঘল অফিসার সর্বাঙ্গে আহত হয়েও যুদ্ধ চালাবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেই ভগ্ন ব্যূহের পুনর্বিন্যাস করা কিছুতেই আর সম্ভব হয়নি। তাঁদেরই পলায়মান অশ্বারোহীরা স্বপক্ষীয় যোদ্ধাদের ঠেলতে ঠেলতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঁচ মাইল দূরে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। দাউদ ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন যে, যুদ্ধের হাওয়া বদলে গিয়েছে। পাটনায় যদি তিনি ওভাবেই মোঘলদের আক্রমণ করতেন, তাহলে বাংলা ও বিহার তাঁর হাতছাড়া হয়ে যেত না। কিন্তু তাঁর তখন সেকথা ভেবে কোন লাভ ছিল না, তিনি জানতেন যে মোঘলরা পালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের তাঁকে খতম করতেই হবে। তাই দাউদ তাঁর শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈন্যদের নিয়ে ছিন্নভিন্ন মোঘলবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু মাইল খানেক যাওয়ার পরেই আফগান সৈন্যদের মনে পড়েছিল যে, মোঘলরা পালিয়ে গেলেও তাঁদের পরিত্যক্ত শিবিরে যে প্রভূত পরিমাণে রণসম্ভার পড়ে রয়েছে, সেগুলি তখনই হস্তগত না করলে আশপাশের গ্রামবাসীরা সেগুলিকে নিয়ে চলে যাবেন। তাই ওই লুঠের ভাগ নেওয়ার জন্য তাঁরা দাউদের নিষেধ সত্বেও পিছন দিকে ফিরেছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময়ে অবশ্য তাঁরা দাউদকে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন যে, কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসেই তাঁরা মোঘলদের সঙ্গে শেষ মোকাবিলাটা সেরে নেবেন। আর সেই লোভই শেষে আফগানদের কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল। পিছন দিকে ফিরে এসে মোঘল তাঁবুতে পৌঁছে অপৰ্য্যাপ্ত পরিমাণে দ্রব্যসম্ভার ও ভারবাহী পশুদের চারিদিকে বিক্ষিপ্ত দেখে তাঁদের মন আনন্দে নৃত্য করে উঠেছিল। সেগুলি সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁরা ভুলেই গিয়েছিলেন যে, শত্রুসৈন্য অদূরেই অবস্থান করছে। লোভী আফগানের সেই লুণ্ঠন প্রবৃত্তির জন্য মুনাইম খাঁ নতুন করে নিজের ব্যূহ বিন্যাসের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন, এবং পলায়নপর সৈন্যদের সঙ্ঘবদ্ধ করে শত্রুর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরী হয়েছিলেন। ওদিকে মূল যুদ্ধক্ষেত্রে রাজা টোডরমলের ব্যূহ তখনও অক্ষত ছিল, তিনি এক ডিভিসন আফগান সৈন্যের সঙ্গে সমানভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মুনাইম খাঁ সসৈন্যে সেখানে ফিরে এসে যখন আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে একটি গুলি লেগে আফগান সেনাপতি গুজর খাঁ নিহত হওয়ার ফলে তাঁদের শিবিরের সর্বত্র নৈরাশ্য দেখা দিয়েছিল। তারপরেও কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত আফগানরা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। হাজার হাজার আফগানের রক্তে তুকারই-এর মাঠ লালে লাল হয়ে গিয়েছিল, অসংখ্য আফগান সৈন্য মোঘলদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। খান-ই-খানানের আদেশে তাঁদের সবাইকে হত্যা করে মাথার খুলিগুলি দিয়ে পাহাড়ের মত উঁচু আটটি মিনার তৈরী করা হয়েছিল। এইভাবে তুকারই-এর প্রান্তরে আফগানদের সৌভাগ্যসূর্য্য চিরদিনের মত অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল।

তুকারই যুদ্ধে পরাজয়ের পরে দাউদ কটকে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় মোঘলদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার জন্য তৈরী হতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তখন এক অবর্ণনীয় শঙ্কায় তাঁর মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সর্বত্র তখনও তাঁর নামে খুৎবা পাঠ হচ্ছিল বটে, কিন্তু সেসব শেষের দিন যে আর বেশি দূরে নয়, সেকথা তিনি জানতেন। তিনি ভালোকরেই জানতেন যে, দু’দিন পরে সব দীপ নিভে যাবে, কেউ আর তাঁর নামও করবেন না। কেউ বলবেন না যে, তিনিই ছিলেন সেই সুলতান দাউদ কররানি যাঁর দোর্দ্দণ্ড প্রতাপে একদিন পূর্বভারতের আকাশ বাতাস কেঁপে উঠত। কেউ বলবেন না যে, তিনিই আকবরের সঙ্গে হিসাব মেলাবার যোগ্য অধিকারী ছিলেন। তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে রাজা টোডরমল তখন কটকের দিকে এগিয়ে আসছিলেন, কিন্তু তাঁকে সাহায্য দেওয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসছিলেন না। শেষে দুর্গমধ্যে প্রবেশ করে তিনি দ্বার রুদ্ধ করে মাসাধিক কাল ধরে টোডরমলের সঙ্গে সন্ধির কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং একই সঙ্গে গোপনে সৈন্য সংগ্রহও করে গিয়েছিলেন। কিন্তু টোডরমল ছিলেন অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, অতি সংগোপনে তিনি দাউদের সমস্ত গতিবিধির খবর রাখছিলেন। তিনি জানতেন যে, ব্যাধ বিতাড়িত বাঘ গুহার মধ্যে প্রবেশ করে যে রকম ক্ষিপ্তের মত আচরণ করে, দাউদও সেটাই করছেন। কিন্তু তাঁর নিষ্ক্রমণদ্বার যখন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি কত দিন আর ওভাবে সমর প্রস্তুতি চালাতে পারতেন? সেই কারণে টোডরমল কটক দুর্গের উপরে সরাসরি কোন আক্রমণ না চালিয়ে দাউদের কাছ থেকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব আসবার প্রতীক্ষায় দিন গুণতে শুরু করেছিলেন। অবশেষে দেখতে দেখতে সেই দিনও চলে এসেছিল। দাউদ যখন দেখেছিলেন যে, তাঁর কাছে যুদ্ধ করবার মত সম্বল আর নেই, তখন তিনি চূড়ান্ত সন্ধির প্রস্তাব করে রাজা টোডরমলের কাছে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু টোডরমলের পরিষ্কার কথা ছিল যে, সন্ধি নয়, দাউদকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আর কোন কিছুতে তিনি রাজী হননি। তিনি চেয়েছিলেন যে, দাউদ কররানি আর নিজেকে কোন স্বাধীন রাজ্যের সুলতান বলে দাবী করবেন না, তিনি নিজেকে মহামান্য শাহানশাহ বাদশাহ আকবরের বংশগত ভৃত্য বলে মনে করবেন। উপায়ন্তরবিহীন দাউদ শেষপর্যন্ত তাতেই রাজী হয়েছিলেন, কোন ধরণের শর্ত আরোপ না করে তিনি মোঘলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। রাজা টোডরমল যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, দাউদের সেই অঙ্গীকার আন্তরিক, তখন মেদিনীপুরে একজন বার্তাবাহককে পাঠিয়ে তিনি খান-ই-খানান মুনাইম খাঁকে কটকে চলে আসবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কারণ, পূর্ব ভারতের মোঘলবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে কেবলমাত্র তিনিই আকবরের প্রতিনিধিরূপে দাউদ কররানির আত্মসমর্পণ গ্রহণ করবার অধিকারী ছিলেন। এরপরে কটক দুর্গের সম্মুখে তাঁবু খাটিয়ে একটি সুসজ্জিত দরবার কক্ষ তৈরী করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে দাউদ কররানি তাঁর নিজের আমীরদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে সমবেত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সম্মুখে মুনাইম খাঁর পদপ্রান্তে তরবারি স্থাপন করে শপথ করেছিলেন যে, তখন থেকে তিনি নিজেকে বাদশাহ আকবরের অনুগত ভৃত্য বলেই মনে করবেন; ভবিষ্যতে তিনি আর কখনও তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না বা তাঁর শত্রুর দলে যোগ দেবেন না। এরপরে পূর্বব্যবস্থা অনুযায়ী দাউদের উপস্থিতিতে ও তাঁর সম্মতি নিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল যে গৌড়, বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার উপরে কররানি বংশের সব অধিকার লোপ পেয়ে শাহানশাহ বাদশাহ আকবরের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে চেঙ্গিজ বংশের চিরন্তন ঐতিহ্য অনুযায়ী বাদশাহ তাঁর অনুগত ব্যক্তিদের প্রতি সদয় ছিলেন বলে, দাউদ কররানি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই ব্যবস্থায় সম্মতি দেওয়ার জন্য তাঁকেই কটকের সামন্তপদে নিয়োগ করা হয়েছিল। ভারতে আকবরের রাজ্যারম্ভের চব্বিশতম বছরে ওই ভাবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার উপরে মোঘল অধিকার প্রসারিত হয়েছিল।

(তথ্যসূত্র:
১- Tabakat-i-Akbari, Nazimuddin Ahmed.
২- Akbarnama iii, Abul Fazl Allami.
৩- Tarikh-i-Sher Shahi, Abbas Sarwani, Elliot’s translation.
৪- Tarikh-i-Salatin-i-Afghann, Ahmed Yadgar.
৫- Makhzan-i- Afghani, Niamatullah, Elliot’s translation.
৬- Riyaz-us-Salatin, Ghulam Husain Salim.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

ইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্যইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্য

রানা চক্রবর্তীঃ ভারতে মোঘলদের হাত থেকে রাজ্যশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করবার সময়ে ঐতিহ্যসূত্র ধরে ইংরেজদের তাঁদের ভৃত্যমণ্ডলীকেও গ্রহণ করতে হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ভারতে মোঘল শাসনের ধার না থাকলেও, ভার

স্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দস্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দ

রানা চক্রবর্তীঃ ‘রোমাঁ রোলাঁ’ শ্রীঅরবিন্দকে ‘নব ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। (Prophets of the New India) ‘বুদ্ধিজীবী’ বলতে যদি তাঁদেরই বোঝায় যাঁরা নিজেদের ‘বুদ্ধি’ ও ‘প্রজ্ঞা’ দিয়ে জগৎকে বুঝতে

আমৃত্যু প্রতিবাদী থাকতে চাওয়া এক চলচ্চিত্রকার – মৃণাল সেনআমৃত্যু প্রতিবাদী থাকতে চাওয়া এক চলচ্চিত্রকার – মৃণাল সেন

আমরা কোনোদিনও চমকে উঠিনি, মৃণাল সেন এতদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে এই সত্যিকে নিয়েছিলাম। বস্তুত এতই স্বাভাবিকভাবে, যে তথ্যটি ভুলেই গেছিলাম প্রায়। মৃণাল সেন প্রয়াত হওয়ার পর

চীন, ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাথে নিজেদের মুদ্রাতে ব্যবসা করছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকী পূর্ব বনাম পশ্চিম! কোন পথে বিশ্ব রাজনীতি?চীন, ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাথে নিজেদের মুদ্রাতে ব্যবসা করছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকী পূর্ব বনাম পশ্চিম! কোন পথে বিশ্ব রাজনীতি?

১৫৫৫ সালে অর্থাৎ প্রায় চারশো বছর আগে ফ্রান্সের বিখ্যাত জ্যোতিষী নস্ত্রাদ্রামুস এমন কিছু ভবিষ্যত বানী করেছিলেন যা আজও মানুষকে অবাক করে দেয়। ওনার প্রায় অধিকাংশ ভবিষ্যত বানীই সত্য হয়েছিল যার