বাংলা সাহিত্যের বটগাছ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ বাংলা সাহিত্যের বটগাছ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যের বটগাছ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


শুধু অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টিই কি একজন সাহিত্যকারের মাপকাঠি। স্বয়ং ভাষার কাছেও তার দায় যে অপরিসীম। আসলে এমন বহু প্রিয় এবং বিশিষ্ট সাহিত্যকার আছেন যারা তাদের লিখনশৈলী এমন তারে বেঁধেছেন যা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে যুগের পর যুগ ধরে। ভাষার ব্যবহারে এরা অনুনকরণীয়। আবার এমনও সাহিত্যকার আছেন যারা নিঃসাড়ে কাজ করে যান পাল্টে দেন ভাষার ব্যবহার, এক নতুন যুগ নিয়ে আসেন আড়ম্বর ছাড়াই। তাদের হাতের কলমই তাদের ছেনি হাঁতুড়ি। এই শেষ দলের এক পরম শ্রদ্ধেয় নাম নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি একাধারে কবি, গদ্যকার, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক, সাংবাদিক – লিস্ট অনেক লম্বা। নীরেন্দ্রনাথ, বলা ভাল ‘নীরেন দা’র সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, সবারই কিছু না কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে। এখন তো, সেই স্মৃতিগুলোকেই উস্কে নেওয়া।

পুব বাংলায় জন্মেছিলেন তিনি। সেখানকার প্রকৃতির স্পর্শেই কেটেছে শৈশব। নিজের ভেতর সবসময় নিয়ে চলতেন সেই মাঠ, ক্ষেত, রেল স্টেশন। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখতেন। সেই নিয়েই একদিন কলকাতায় পা। ১৯৫৪। সিগনেট থেকে বের হল প্রথম কবিতার বই ‘নীলনির্জন’। তারপর কত বই, কত সম্মান পেয়েছেন তিনি। সে-বৃত্তান্ত এখন থাক। কবিতা, গল্প, সবেতেই যে তাঁর প্রধান নায়ক ছিল মানুষ, সে কথা বারবার দ্ব্যর্থহীন হয়ে বলেছেন তিনি।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মনে করতেন, ‘‘কঠিন ভাষা যারা বলে, শোনে ও বোঝে, সহজ ভাষা বলে শোনে ও বোঝে তার চতুর্গুণ মানুষ। আর তাই আমার কবিতা যদি অনেক লোকের কাছে পৌঁছে দিতে হয় তো ভাষার স্তর নির্বাচনে কোনও ভুল করলে আমার চলবে না, সহজ বাংলার জনপথ ধরেই আমাকে হাঁটতে হবে।’’ কবি, লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, বাংলা ভাষার নীতি-নির্ধারক হিসেবে তিনি যা কিছু করেছেন তার মূল নীতিই ছিল লেখা ‘‘আরও অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’’

‘বাঙ্গালার পাঠক পড়ান ব্রত’ নামের অস্বাক্ষরিত লেখায় বঙ্গদর্শন পত্রে মন্তব্য করা হয়েছিল – ছাপাখানা আসার আগে কথকেরা পড়তে-না-জানা মানুষের কাছেও বলার গুণে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিতেন, এখন লেখক সম্পাদকের দায়িত্ব পড়তে-জানা-মানুষদের পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা। আনন্দমেলা-র সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পাঠকদের রুচি গড়ে তুললেন। এখন পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যবর্তী যে বাঙালিরা বিশ্বের নানাখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাঁদের অনেকেই এই পত্রিকা পড়ে বাংলা ভাষায় মজেছেন। অনুবাদে বাংলা ভাষার সীমাকে যেমন তিনি সম্প্রসারিত করলেন তেমনি বাংলা ভাষার অল্পবয়স্ক পড়ুয়াদের ভাষাটির প্রতি মনোযোগী করে তোলার জন্য কাজে লাগালেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকার ও কবি শঙ্খ ঘোষকে। স্কুলে স্কুলে তখনও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মতোই তেতো বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হত, আনন্দমেলার পাতায় কিন্তু প্রকাশিত হত ‘বাংলা বলো’। মুখের সজীব বাংলার রীতি-নীতি তাই ‘আমেরিকা ফেরত’ পবিত্র সরকারের লেখার বিষয়। শঙ্খ ঘোষ ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে লিখতেন শব্দ নিয়ে খেলা। ‘বানানের শুদ্ধি-অশুদ্ধি বিচার’ নিয়ে এমন সহজ-গভীর বই বাংলায় দু’টি নেই।

আরো পড়ুন- আলাস্কান উড ফ্রগ, এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী এই ব্যাঙ

‘কবিতার ক্লাস’ নেওয়া মাস্টারমশাই নীরেন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হলেও, ওঁর আরেকটা কাজ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছিল কেন, আজও আছে। ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’। আনন্দবাজারের বানানবিধি, কাগজের প্রুফ দেখা, লেখার ধরন – সমস্ত কিছুকেই দুই মলাটে রেখেছিলেন তিনি। আজও, তরুণ সাংবাদিকদের কাছে এই বইটি সর্বক্ষণের সঙ্গী।

বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ নির্মাণের যে চেষ্টা তাঁর সম্পাদনায় আনন্দমেলার পাতায় শুরু হয়েছিল, পরে তা সম্প্রসারিত রূপ পেল। বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন নামের বিধিগ্রন্থ নীরেন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন। ঢাকা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত দু’খণ্ডের প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। চলিতের প্রতি, পথচলতি মানুষের প্রতি তাঁর বরাবর পক্ষপাত। তখন তিনি ‘ল কলেজের’ ছাত্র, আজ়াদ-হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাদের মুক্তির ছাত্র-আন্দোলনে পুলিশি হামলা। রাস্তার ওপর চাপ-চাপ রক্ত, ছেঁড়া বইখাতা, চপ্পলের পাটি, ভাঙা চশমা। নিহত হলেন তরুণ রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪৫-এর নভেম্বর মাসের সেই ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতা ‘শহিদ রামেশ্বর’। দেশ পত্রিকায় পাতা জুড়ে ছাপা হল। পথের মানুষদের সম্বন্ধে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল বলেই এক সময় জীবনানন্দের কবিতায় তিনি দেখেছিলেন ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি।’

১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানকার পাঠশালায়। পরে ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসা। শহরের মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা। ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবির পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, ভ্রমণ-কাহিনির লেখক, সম্পাদক এবং বানান-বিশেষজ্ঞ।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন নীরেন্দ্রনাথ। ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। তখন কবির বয়স ৩০। তার পর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’… অজস্র কবিতার বই। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি। ১৯৯০-এ বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একটা সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। সেই লেখাও পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর লেখা কবিতা ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল…’ বা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়…’ বাঙালির কাছে রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।

কবিতাই তাঁর মাতৃভাষা ছিল। তবে, খবরের কাগজে কাজ করার সুবাদে নানা রকমের গদ্যও লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ। তিনি নিজে মনে করতেন, ‘কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।’ বলতেন, ‘কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা। যেমন কলকাতার যিশু, উলঙ্গ রাজা, বাতাসি।’ এ প্রসঙ্গেই তিনি লিখেছিলেন, ‘এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।’

শুধু অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টিই কি একজন সাহিত্যিকের মাপকাঠি? স্বয়ং ভাষার কাছেও তাঁদের দায় যে অপরিসীম। আসলে এমন বহু প্রিয় এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক আছেন যাঁরা তাঁদের লিখনশৈলীকে এমন তারে বেঁধেছেন যা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে যুগের পর যুগ ধরে। ভাষার ব্যবহারে এঁরা অননুকরণীয়। আবার এমন সাহিত্যিকও আছেন যাঁরা নিঃসারে কাজ করে যান, পাল্টে দেন ভাষার ব্যবহার, এক নতুন যুগ নিয়ে আসেন আড়ম্বর ছাড়াই। তাঁদের হাতের কলমই তাঁদের ছেনি-হাতুড়ি। এই শেষ দলের এক পরম শ্রদ্ধেয় নাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সহজ তরঙ্গায়িত ভাষায় শক্ত কথা বলা, ছেলেখেলার মতন করেই ছুঁড়ে দেওয়া যুগান্তকারী প্রতিবাদ, এমনই এক জাদু জানতেন এই কবি ও সাহিত্যিক।

একজন “শিল্পীর ভূমিকা” কী তা তো নীরেন্দ্রনাথ নিজেই বলে গেছেন :-

“এখনও মূর্খের শূন্য অট্টহাসি, নিন্দুকের ক্ষিপ্র
জিহ্বাকে সে তুচ্ছ করে নিতান্তই অনায়াসে; তীব্র
দুঃখের মুহূর্তে আজও কী পরম প্রত্যয়ের শান্তি
শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে; সন্ধ্যামালতীর মৃদু গন্ধে”

বুঝতেই পারছেন নিন্দুক এবং নিন্দার মুখে স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার শিক্ষা আজও আমাদের পাথেয় এবং তাই থাকবে চিরটাকাল।

শুধু শিল্পী বা শিল্প নিয়েই নয়। নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন কবি, সমাজ এবং আগামীর প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ ছিলো অপরিসীম। সামাজিক বিভেদ, মসজিদ না মন্দির এই প্রসঙ্গে কবি নীরেন্দ্রনাথের মনে হয়েছে যে লেংটি পরা ক্ষুধার্ত, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে এই প্রশ্ন নিতান্ত অবান্তর, তিনি মনে করতেন :-

“পিতলের থালায় এক চিমটি নুন ছিটিয়ে
ছাতু ঠাসতে-ঠাসতে
তবুও যে তারা হাসছে, তার কারণ, তাদের
একজনের নাম হতেই পারত সিকান্দর শাহ্‌ আর
অন্যজনের সেলুকাস”

শুধু কি বড়দের জন্যেই লিখেছেন তিনি! ছোটোদের জন্য তাঁর সেরা উপহার অনন্দমেলার অসাধারণ সম্পাদনা। একসময় আনন্দমেলা বছরে একটি বার প্রকাশিত হত। ক্রমে ক্ষুদে, কচি-কাঁচাদের হাতে আনন্দমেলা পৌঁছাতে লাগলো প্রতি মাসে। অসাধারণ প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ধাঁধা, এবং বাংলা কমিকস সমৃদ্ধ এই কিশোর ম্যাগাজিন বহু ছেলে-মেয়ের বেড়ে ওঠার বছরগুলোর শ্রেষ্ঠ সহায় ছিলো। বহু বড়দের লেখকের কলম থেকে শিশু সাহিত্যের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন এই নীরেন্দ্রনাথ। তাঁর বদান্যতায় আমরা পেয়েছি বাংলায় অনূদিত টিনটিন! স্নোয়ির বদলে কুট্টুসকে, জনসন-রনসনকে! নিজেই নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন অনুবাদকের ভূমিকায়।

নীরেন্দ্রনাথ তখন আনন্দমেলার সম্পাদক। সুনীল গঙ্গোপাধ‍্যায়ের কাকাবাবুর উপন্যাস তখন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে আনন্দমেলায়। এক সংখ্যার অলংকরণে বড় গোলমাল করে ফেললেন শিল্পী। কাকাবাবুর গোঁফ আকতে ভুলে গেলেন। ব্যাপরটা যখন নজরে এল, ততক্ষণে ওই সংখ‍্যা ছেপে বেরিয়েও গেছে। একেবারে কেলেঙ্কারি ব্যাপার। প্রচুর অভিযোগের চিঠি জমা পড়তে থাকল আনন্দ মেলার দপ্তরে। প্রশ্ন সবারই এক – “কাকাবাবুর গোঁফ কোথায়”? নীরেন্দ্রনাথ পরবর্তী সংখ্যায় সে সমস্ত চিঠি ছাপলেন এবং উত্তরও দিলেন স্বভাব সিদ্ধ রসিকতার ভঙ্গিতে। চিঠির জবাব হিসেবে ছাপিয়ে দিলেন শিল্পীর আঁকা একজোড়া গোঁফ।

শুধুই কি সম্পাদকীয় রসিকতা? ‘বুধসন্ধ্যা’র সদস্যদের প্রতি অতি নগন্য চিঠি পত্রেও মেলে রসবান নীরেন্দ্রনাথের খোঁজ – “বুধসন্ধ্যার সদস্যদের প্রতি। চিংড়ি কলিং। অনেকদিন খাওয়া-দাওয়া হয়নি। বুধসন্ধ্যার বৈঠক সম্পর্কে, অনুমান করি, সদস্যদের আগ্রহও কমে যাচ্ছে। আগ্রহ বাড়াবার জন্য আগামী ২৩শে এপ্রিল তাই চিংড়ি দুপুরের আয়োজন করা হয়েছে। চিংড়ি ধরবেন সুনীল গঙ্গোপাধ‍্যায়। দুপুর এগারোটার মধ্যে থিয়েটার রোডের ফ্ল‍্যাটে চলে আসুন। চিংড়ি তো আছেই। তৎসহ দু’শো মজা”।

সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী ছিলেন আপাত গুরুগম্ভীর স্বল্পবাক ব্যক্তিত্ব। তাঁর চারপাশের সদা গুরুগম্ভীর এই বর্মটির জন্যেই অনেক সমকালীন সাহিত্যিকই তাঁকে সমীহ করে চলতেন। অথচ এই রমাপদেরই কিনা অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ! সম্পূর্ন বিপরীত স্বভাবের দুই ব্যক্তির মধ্যেও এমন বন্ধুত্ব সম্ভব! বাস্তবে হয়েছিল তাই। লোকে ওঁদের বলত – “মানিকজোড়”।

রমাপদ নীরেন্দ্রনাথ দুজনেই তখন চাকরি করেন আনন্দবাজারে। অফিসের ভিতর ধুমপান নিষিদ্ধ। তাই দুজনে মিলে মাঝে মাঝেই বেরোন ধুমপান করতে। দুজনেরই যখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, রমাপদ সিগারেট ছেড়ে দিলেন। তাই শুনে সিগারেট ছাড়লেন নীরেন্দ্রনাথও। এই বছরের জুলাই মাসে মারা গেলেন রমাপদ চৌধুরী। রমাপদের মৃত‍্যুতে বড় ভেঙে পড়েছিলেন নীরেন্দ্রনাথ। দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন – “রমাপদ চলে যাওয়ার পর এত নির্বান্ধব বোধহয় আর কখনও মনে হয়নি আমার। এখন একদম একা শয‍্যাশায়ী অবস্থায় আছি। আর ক্রমাগত এই কথাটা ভাবছি, আমি শিগগিরি যাব, গিয়ে আবার ওর সঙ্গে কথা বলব!” মাত্র মাস পাঁচকের ব‍্যবধানে নীরেন্দ্রনাথও চললেন রমাপদের সাক্ষাতে। এই না হলে বন্ধুত্ব!

এই নীরেন্দ্রনাথের উপর্যুপরি অনুরোধে শঙ্খ ঘোষ ‘কুন্তক’ ছদ্মনাম নিয়ে লিখেছেন “ভাষার খেলা”। নিজেও কিন্তু গদ্য লেখায় অত্যন্ত পটু ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ। সহজ ও শক্ত শব্দকে মিশিয়ে ভাষায় এক নতুন গতি এনে দিয়েছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি ছিলেন। বেশ কয়েকটা বাংলা অভিধানের প্রুফ রিডিং করেছেন নিজেই। শুধু লেখা নয় কেমন করে বাংলা উচ্চারণ করা হবে সেই নিয়েও বই লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন নবীনদের। আধুনিক বাংলা ভাষা আজ যে পরিণত চলন ও প্রকাশ পেয়েছে সেই যজ্ঞের সাগ্নিক পুরোহিত বলা চলে তাঁকে।

আজকের বাংলার দিকপাল সাহিত্যিকদের অনেকেই ছিলেন তাঁর স্নেহধন্য। একবার তো যুবক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে চা এবং সিগারেট দিয়ে একটা ঘরে বন্ধ করে বলে গেছিলেন, “লেখা না পেলে ছাড়া পাবি না।” স্নেহের শাসন এবং প্রশ্রয়ে তিনি ছিলেন কারোর পিতৃপ্রতিম আবার কারোর বড় দাদা।

এমনকি ৯৪-বছর বয়েসেও, এই কিছুদিন আগেও তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার পুজোসংখ্যার জন্যও লিখেছেন একটি অপূর্ব লেখা, ‘একটি একলা ঘুড়ির আখ্যান’।

জীবনের সায়াহ্নে বসেও সূর্যোদয় দেখলে মন ভালো হয়ে যেত বিরাট মাপের এই মানুষটার। প্রিয়জনের মৃত্যুতেও ভেঙে পড়েননি, কাজ করে গেছেন এক নতুন সকাল দেখার আশায়।

অবাক ব্যাপার, সেই বড়দিনের দিনটাতেই “কলকাতার যীশু” কবিতার কবির প্রয়াণ হলো! তাঁর স্মৃতিচারণায় কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, “জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন, এমন একজন স্রষ্টার জীবনাবসান সমস্ত বিচ্ছেদ বোধের মধ্যেও একটা সফলতার স্পর্ধা এনে দেয়।”

সত্যিই তো, নীরেন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়ে গেছেন ভাষাকে ভালোবাসতে, ভাষা ও তার ব্যবহার নিয়ে তলিয়ে ভাবতে, সৃষ্টির ঋজুতা ধরে রাখতে এবং জীবনকে ভালোবাসতে। জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা, বঞ্চনাকে ঠেলে সরিয়ে তাঁর “যাবতীয় ভালোবাসাবাসি” সেই জীবনের সঙ্গেই, তাই তিনিই কবিতার ছন্দে, আগামীকে বুঝিয়ে বলতে পারেন,

“এক-একবার মনে হয় যে
এই জীবনের যাবতীয় ভ্রমণ বোধহয়
ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু
ঠিক তখনই
আমার চোখের সামনে হঠাৎ খুলে যায়
সেই রাস্তা,
যার ধুলো উড়িয়ে আমি কখনও হাঁটিনি।”

একে একে তাঁর সামনেই চলে যাচ্ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা। একসময়ের স্নেহভাজন এই কনিষ্ঠদের মৃত্যু কখনই মেনে নিতে পারেননি তিনি। বারংবার শোনা যেত সেই খেদ। ঘনিষ্ঠ বন্ধু রমাপদ চৌধুরীর মৃত্যু যেন ডাক দিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। ডাকে সাড়া দিতে দেরি করেননি নীরেন্দ্রনাথ। আর কোনদিন সাড়া দিলেন? ২৫ ডিসেম্বর, কলকাতার যীশুর দিনে। সৃষ্টির কাছেই অবশেষে ফিরে গেলেন স্রষ্টা। মাঝখানে কেটে গেল তিনটে বছর। রয়ে গেছে স্মৃতি, সৃষ্টি। শরতের শহর আরও একবার উস্কে নেবে সেসব।

২০১৮ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত অসুখে প্রয়াত হন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। যদিও তিনিই বলে গিয়েছেন, ‘কোত্থাও যাব না আমি, এইখানে তোমার পাশে-পাশে/ থাকব চিরকাল’। স্মরণে ঋদ্ধ হন কবি, বেঁচে থাকুন বাঙালি মননে।

তাঁর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় তিনি সামন্ততান্ত্রিক জমিদার, জোতদার সমাজ ব্যবস্থাকে তীব্র কটাক্ষের বানে বিদ্ধ করেছেন। কবিতার শেষ লাইনে লেখা – “রাজা তোর কাপড় কোথায়” লাইনটি আজও মানুষের মুখেমুখে ফেরে। এই কাব্যগ্রন্থটির জন্য ১৯৭৪ সালে ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। এছাড়াও ১৯৫৮ সালে ‘উল্টোরথ পুরস্কার’, ১৯৭০ সালে ‘তারাশঙ্কর স্মৃতি’ এবং ১৯৭৬ সালে ‘আনন্দ শিরোমণি’ পুরস্কার পান। ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট. প্রদান করে।

এ-কালের অগ্রণী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বিশ শতকের প্রথম চতুর্থাংশ অতিক্রান্ত হবার আগেই তাঁর জন্ম; অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, সেই শতকের প্রান্তরেখা সম্পূর্ণ পেরিয়ে গিয়ে যখন নূতন শতকে ঢুকছেন, তাঁর পদক্ষেপ তখনও সমান দুঃসাহসী, তখনও জরার জং ধরেনি তাঁর কবিকণ্ঠে। এই রুগ্ন সমাজের ব্যাখ্যাতা তিনি, এই দুঃসময়ের ভাষ্যকার। প্রেম, প্রতিবাদ, করুণা, কৌতুক, ব্যঙ্গ, বেদনা, শ্লেষ ও সহানুভূতির এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছে তাঁর কবিতায়, যার দীপ্তি ও দ্যোতনা আমাদের গোটা জীবন জুড়ে ছড়িয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

পাকিস্তানের সরকার নির্ধারণ করে সেনাবাহিনী! জুলফিকর আলি ভুট্টোকে যেভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিলপাকিস্তানের সরকার নির্ধারণ করে সেনাবাহিনী! জুলফিকর আলি ভুট্টোকে যেভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল

১৯৭০ এর দিকে দক্ষিন এশিয়ার ভৌগোলিক মানচিত্রটি একটু আলাদা ছিল। ভারতের পশ্চিমে তখন পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব দিকে ছিল পূর্ব পাকিস্তান যা আজকের বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জুড়ে

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নিলালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিয়েও রহস্য দানা বাঁধতে দেখা গেছিল। সে রহস্যের মীমাংসা আজ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দ গেছিলেন একটা চুক্তিপত্র

টেরাকোটা সাহেবে’র কথাটেরাকোটা সাহেবে’র কথা

ইংরেজ সাহেব। কেমব্রিজে পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। গিয়েছিলেন বীরভূমের রবীন্দ্র তীর্থে। কিন্তু শান্তিনিকেতনে মন টিকল না। তুসা বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন যাদবপুরে। থাকতেন কলকাতার

ভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ

স্পাই গেম কথাটা বলা যতো সহজ বাস্তবে গুপ্তচর সংস্থার কাজ অনেক কঠিন। কোন দেশের এজেন্ট কোন সংস্থার হয়ে কাজ করছে তা বলা কঠিন। ইনটেলিজেন্স দুনিয়ায় অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট সংস্থার