সেমিকন্ডাক্টর থেকে মহাকাশ চুক্তি, মোদীর আমেরিকা সফরকালে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে যে চুক্তি গুলি হল - Ei Bangla
Ei Bangla আন্তর্জাতিক সেমিকন্ডাক্টর থেকে মহাকাশ চুক্তি, মোদীর আমেরিকা সফরকালে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে যে চুক্তি গুলি হল

সেমিকন্ডাক্টর থেকে মহাকাশ চুক্তি, মোদীর আমেরিকা সফরকালে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে যে চুক্তি গুলি হল


সম্প্রতি আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কুটনৈতিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সাদর অভ্যর্থনা জানান আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন সহ আমেরিকার সব বিশিষ্ট রাজনৈতিক বর্গ। এই সফরে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে যা ভবিষ্যতে দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।

আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে:–

** সেমিকন্ডাক্টর :– সমস্ত ইলেকট্রনিক জিনিসের ক্ষেত্রেই সেমিকন্ডাক্টর খুবই গুরুত্বপূর্ন জিনিস। আমেরিকান সংস্থা মাইক্রোন ভারতে সেমিকন্ডাক্টর অ্যাসেম্বল কেন্দ্র গড়ে তুলবে, এছাড়া সেমিকন্ডাক্টর পরীক্ষা ভারতেই হবে।

এর ফলে ভবিষ্যতে ভারতেই সেমিকন্ডাক্টর তৈরি হবে। এরজন্য মাইক্রোন গুজরাটে একটি কেন্দ্র তৈরি করবে, যাতে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার বা ২২,৫৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে ৮২৫ মিলিয়ন ডলার মাইক্রোন বিনিয়োগ করবে এবং বাকি বিনিয়োগ ভারত সরকার করবে।

** সিএমপি :– ক্রিটিক্যাল মিনারেলস পার্টনারশিপে আমেরিকা ভারতকে তাদের নতুন সদস্য ঘোষনা করেছে। বিশ্বের কোন দেশেই সমস্ত খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়না। প্রাকৃতিক ভাবে খনিজ সম্পদ বিশ্বের কয়েকটি দেশে প্রচুর পরিমানে রয়েছে। সেইসব দেশগুলো একটি জোট তৈরি করে ব্যাবসা করে। এর জন্য আমেরিকা ২০২২ সালে মিনারেল সিকিউরিটি পার্টনারশিপ বা এমএসপি তৈরি করে। ভারত এই জোটের এগারোতম সদস্য। ভারত ছাড়াও এই জোটে রয়েছে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ফিনল্যান্ড। খনিজ পদার্থের মধ্যে কোবাল্ট, নিকেল, লিথিয়াম সহ সতেরো ধরনের রেয়ার আর্থ খনিজ পদার্থ খুবই গুরুত্বপূর্ন। এই ধরনের খনিজ পদার্থ পৃথিবীতে খুব কম পরিমানেই পাওয়া যায়। সমস্ত ধরনের ইলেকট্রনিক জিনিস যেমন গাড়ি, মোবাইল, ল্যাপটপ, ফাইবার অপটিক, সোলার প্যানেল সহ প্রতিরক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এইসব খনিজ পদার্থ ব্যাপক পরিমানে দরকার হয়। যার কারনে সিএমপির সদস্য হওয়ার অর্থ এসব খনিজ পদার্থ সহজে পাওয়া যায়, যা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।

** মহাকাশ চুক্তি :— আমেরিকা ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর আর্টেমিস অ্যাক্রোডস নামে একটি মিশন শুরু করেছে যার লক্ষ্য মহাকাশ গবেষনা করে তা মানবজাতির কল্যানে ব্যাবহার করা। এই মিশন প্রথমে শুরু হয় আমেরিকা, কানাডা, ইটালি, জাপান, কানাডা, লুক্সেমবার্গ, ইউএই, ব্রিটেন এই আটটি দেশের সমন্বয়ে। বর্তমানে এই জোটে ভারত সহ সাতাশটি দেশ রয়েছে। এর আগে ২১ জুন ইকুয়েডর এই জোটে যোগ দেয়। এই মিশনের প্রাথমিক লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে চাঁদে পুনরায় মানুষকে পাঠানো এবং এরপর মঙ্গলে মানুষকে পাঠানো।

** সর্বাধুনিক প্রযুক্তি :– আমেরিকান ন্যাশানাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন, ইন্ডিয়ান ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির সাথে যৌথভাবে ৩৫ টি ভবিষ্যতের প্রযুক্তির উপর গবেষনা করবে, এই ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে।

** নতুন সংস্থা তৈরি :— জটিল প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আরও নতুন ভারতীয় সংস্থা তৈরি করতে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। একে ইনোভেশন হ্যান্ডশেক বলা হচ্ছে। গুগল, অ্যাপেল, মেটা, মাইক্রোসফটের মতোন আমেরিকার বড় বড় প্রযুক্তিগত সংস্থা গুলো ভারতীয় এইসব সংস্থাকে সাহায্য করবে।

প্রযুক্তিগত চুক্তি ছাড়াও আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে একাধিক চুক্তি হয়েছে। সামরিক দিক দিয়ে ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানের মতোন দেশ হওয়ায় ভারতকে সবসময় শত্রুর থেকে এগিয়ে থাকা দরকার। যার কারনে আধুনিক প্রযুক্তির জন্য আমেরিকার সাথে চুক্তি হয়েছে ভারতের।

** জিই এফ৪১৪ ইঞ্জিন :– আমেরিকা জেনারেল ইলেকট্রিকের তৈরি জিই এফ৪১৪ ইঞ্জিন ভারতে যৌথভাবে তৈরি করবে। ভারতে এই ইঞ্জিন তৈরি করবে হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যাল। আমেরিকা এউ ইঞ্জিনের ৮০ শতাংশ প্রযুক্তি ভারতকে দেবে। এর আগে ২০১২ সালে এই চুক্তি হবার সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল তখন আমেরিকা ভারতকে ৫৮ শতাংশ প্রযুক্তি দেবার কথা জানিয়েছিল। হ্যালের তেজস মার্ক ২ যুদ্ধবিমানে ব্যাবহার করা হবে এই ইঞ্জিন। ভারত ১২০-১৩০ টি তেজস মার্ক ২ বিমান তৈরি করবে। ইতিমধ্যেই তেজস মার্ক ২ তৈরির জন্য ভারত সরকার ৯০০০ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছে। ২০২৪ সালে প্রথম প্রোটোটাইপ তৈরি হবে।

** এমকিউ ৯বি :— বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কমব্যাট ড্রোন আমেরিকার জেনারেল অ্যাটমিকসের তৈরি এমকিউ ৯বি রিপার ড্রোন। ভারত ৩১ টি এমকিউ ৯বি ড্রোন কিনছে আমেরিকার থেকে, যার মধ্যে পনেরোটি ড্রোন ভারতীয় নৌবাহিনী এবং আটটি করে ড্রোন ভারতীয় বায়ুসেনা ও সেনাবাহিনী পাবে। ভারতের চীনের ও পাকিস্তানের সাথে যথাক্রমে ৩৫০০ কিলোমিটার ও ৩৩০০ কিলোমিটার সীমানা আছে। এই ড্রোন আসার ফলে ভারত এই সমগ্র সীমানা সহ চীন ও পাকিস্তানের ভিতর চারশো কিলোমিটার জুড়ে নজরদারি করতে পারবে।

** জাহাজ আপগ্রেডেশন :— প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে পরে রাশিয়া বরাবরই ভারতের পুরোনো বন্ধু। ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১ এর ভারত চীন, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে শুরু করে কার্গিল যুদ্ধ সবসময় রাশিয়া ভারতকে সাহায্য করেছে। যুদ্ধজাহাজ আপগ্রেডেশন ও রক্ষণাবেক্ষন ভারতে হয় তবে বড় ধরনের আপগ্রেডেশনের জন্য ভারতকে রাশিয়ার উপর নির্ভর থাকতে হয়। তবে এবার ভারত শুধু রাশিয়ার উপর নির্ভর করে থাকতে চায়না। সেজন্য আমেরিকার সাথে চুক্তি হয়েছে ভারতের। চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকান নৌবাহিনী লার্সেন এন্ড ট্রুবোর সাথে চেন্নাইয়ের কাট্টুপাল্লিতে মাস্টার শিপ রিপেয়ার পোগ্রাম শুরু করবে, এতে মাজগাঁও ডক লিমিটেড ও গোয়া শিপইয়ার্ড যুক্ত আছে।

** এছাড়া আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে ভিসা জটিলতা নিয়ে চুক্তি হয়েছে। বহু সংখ্যক ভারতীয় ছাত্র ছাত্রী আমেরিকাতে পড়াশোনা করে। তারা সেখানেই পরে কাজ খোঁজে। আমেরিকাতে ভারতীয়রা সাধারনত এইচওয়ান বি এবং এল ভিসাতে কাজ করে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় অনেকেরই পুনরায় ভিসার মেয়াদ বাড়েনা যার কারনে বাধ্য হয়ে তাদের ফিরে আসতে হয়। যার করনে নতুন এই চুক্তি অনুযায়ী ভিসা জটিলতা সমস্যার সমাধান করা হবে।

** আমেরিকা ভারতের ব্যাঙ্গালোর ও আমেদাবাদে নতুন দুটি দূতাবাস খুলবে যাতে ওইসব এলাকা ও পাশের শহরের মানুষের সুবিধা হবে ভিসা পেতে। ভারতও আমেরিকার সিয়াটেল সহ দুটি জায়গায় দূতাবাস খুলবে।

** আমেরিকা ও ভারত উভয়েই দুই দেশের ছাত্রদের উভয় দেশে এসে পড়ার বেশী সুযোগের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

** এসব চুক্তি ছাড়াও ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে দুই দেশের চীনের বিরুদ্ধে আরও সংঘবদ্ধ হবার ব্যাপারে কথা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চীনকে প্রতিরোধ করার জন্য ইন্দো প্যাসিফিকে ভারত, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথ সংগঠন কোয়াড রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা ভারতকে ব্লু প্যাসিফিক সংগঠনের সহযোগী হিসাবে আমন্ত্রন করেছে। ব্লু প্যাসিফিক আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও ব্রিটেনের মধ্যে একটি সংগঠন, এই সংগঠন প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে ছোট ছোট দ্বীপ দেশ গুলোর সাথে চীনের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ও বানিজ্যের ব্যাপার লক্ষ্য রাখে।

** আমেরিকা ভারতকে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ, নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ, ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সিতে সমর্থন জানিয়েছে।

** আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নভেম্বর মাসে সানফ্রান্সিসকোতে হওয়া এপেক বা এশিয়ান প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশনে আমন্ত্রন জানিয়েছেন।

** আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ক্যানসার, কিডনি, সুপারের রোগে কৃত্রিম প্রযুক্তি বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যাবহারের চুক্তি হয়েছে।

** ভারত ও আমেরিকা উভয় দেশই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক সাথে কাজ করবার জন্য সম্মত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

আমেরিকার হ্রদ থেকে উদ্ধার ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারের দেহআমেরিকার হ্রদ থেকে উদ্ধার ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারের দেহ

গত ৯ এপ্রিল নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সি ভারতীয় আমেরিকান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ৷ মঙ্গলবার তাঁর দেহ মিলেছে মেরিল্যান্ডের একটি ছোট হ্রদ থেকে ৷ দেহ উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ

IVF প্রযুক্তির সাহায্যে মহাকাশে জন্ম নেবে শিশু! অসাধ্য সাধন করবেন বিজ্ঞানীরাIVF প্রযুক্তির সাহায্যে মহাকাশে জন্ম নেবে শিশু! অসাধ্য সাধন করবেন বিজ্ঞানীরা

মহাকাশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার কোন শেষ নেই। প্রতিনিয়তই মহাকাশ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। এরই মধ্যে এবার শোনা গেল, মহাকাশেও কি শিশুর (baby) জন্ম হতে পারে? এই

খেলতে খেলতে মলদ্বার দিয়ে বল ঢুকে সোজা কিশোরের পেটে, অস্ত্রোপচার ছাড়া কিভাবে বেরোল সেই বলখেলতে খেলতে মলদ্বার দিয়ে বল ঢুকে সোজা কিশোরের পেটে, অস্ত্রোপচার ছাড়া কিভাবে বেরোল সেই বল

অস্ট্রেলিয়ায় ১৪ বছরের এক কিশোর খেলতে খেলতে হঠাৎই মলদ্বার দিয়ে গল্ফ ঢুকিয়ে ফেলে একটি গল্‌ফ বল। সেই বল চলে যায় সোজা বৃহদন্ত্রে। সে বল কোনও অস্ত্রোপচার ছাড়াই বার করে আনলেন

গৌতমবুদ্ধের অন্যতম বড় ভক্ত মগধের প্রথম শক্তিশালী সম্রাট বিম্বিসার কতোটা শক্তিশালী ছিলেন?গৌতমবুদ্ধের অন্যতম বড় ভক্ত মগধের প্রথম শক্তিশালী সম্রাট বিম্বিসার কতোটা শক্তিশালী ছিলেন?

বাহুবলী সিনেমার পর থেকেই ভারতের চলচ্চিত্র জগতে দক্ষিনি ছবির রমরমা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তেলেগু ইন্ডাস্ট্রি আরও একটি বিখ্যাত সিনেমা তৈরি করেছে যার নাম বিম্বিসার, এখানে ভারতের অন্যতম মহান শাসক বিম্বিসারের