আমৃত্যু প্রতিবাদী থাকতে চাওয়া এক চলচ্চিত্রকার - মৃণাল সেন - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ আমৃত্যু প্রতিবাদী থাকতে চাওয়া এক চলচ্চিত্রকার – মৃণাল সেন

আমৃত্যু প্রতিবাদী থাকতে চাওয়া এক চলচ্চিত্রকার – মৃণাল সেন


আমরা কোনোদিনও চমকে উঠিনি, মৃণাল সেন এতদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে এই সত্যিকে নিয়েছিলাম। বস্তুত এতই স্বাভাবিকভাবে, যে তথ্যটি ভুলেই গেছিলাম প্রায়। মৃণাল সেন প্রয়াত হওয়ার পর আমাদের আবার হুঁশ ফিরল, আমরা তাঁকে অক্ষর ও মুখের কথা দিয়ে স্মরণ করতে থাকলাম।

ফরিদপুরে জন্ম ও বাল্য-কৈশোর কাটানো, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়া মৃণাল সেন গেলেন ১৯৪০-এর দশকের সেই ঘটনাবহুল কলকাতায়। ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’র চরিত্রটি বলেছিল, ‘এ প্রজন্ম দাঙ্গা দেখেনি, দুর্ভিক্ষ দেখেনি, দেশভাগ দেখেনি।’ কিন্তু মৃণাল সেন এ সবই দেখেছিলেন। প্রতিবাদী হয়েছেন তখন থেকেই। যোগ দিয়েছেন ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ বা ‘আইপিটিএ’তে। সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, কলিম শরাফী এবং অবশ্যই ঋত্বিক কুমার ঘটককে।

অনেক নির্মাতা যেমন প্রথম ছবিতেই পুরস্কার-টুরস্কার জিতে প্রথম ডুবেই শালুক পান, মৃণাল সেনের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। মৃণাল সেন তাঁর প্রথম দিককার ছবিগুলোর – ‘রাতভোর’, ‘নীল আকাশের নিচে’ – ব্যাপারে পরবর্তী জীবনে তেমন আগ্রহীও ছিলেন না। সহজ কারণ হচ্ছে, মৃণাল সেন নিজেকে তখনো যেন ঠিক খুঁজে পাননি। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য ছবি সে অর্থে ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০), যে ছবিতে দুর্ভিক্ষের উল্লেখ ছিল। বাংলার দুর্ভিক্ষের বিষয়টি তাঁর আরও দুটি ছবি ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘আকালের সন্ধানে’তে তিনি খুব বড়ভাবেই তুলে ধরেছেন।

মৃণাল সেন

মৃণাল সেন তবে যে ছবিটি মৃণাল সেনকে আলাদাভাবে চেনাল, তা হচ্ছে তাঁর ‘ভুবন সোম’। ‘ভারতীয় ফিল্ম ফিন্যান্স করপোরেশনের’ অর্থায়নে অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত এ ছবিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গের সূচনা বলা চলে। একজন কড়া আমলা হিসেবে উৎপল দত্তের অনন্য অভিনয় ও এক সরল গ্রাম্য তরুণী হিসেবে সুহাসিনী মুলের সাবলীল পর্দা উপস্থিতি ছাড়াও চলনে, বলনে, পোশাকে এ দেশের উপনিবেশোত্তর আমলাতান্ত্রিক আত্মম্ভরিতাকে এ ছবিতে একহাত নিয়েছেন মৃণাল সেন। সরল গ্রাম্য এক তরুণীর কাছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ আমলা ভুবন সোমের পরাজয় কেবল ব্যক্তিবিশেষের অহংয়ের পরাজয় নয়, মানবিক স্নেহের কাছে উচ্চম্মন্যতারও পরাজয়, আমলাতন্ত্রের অমানবিক নির্মমতার পরাজয় সহজিয়া মানবতার কাছে।

‘ভুবন সোম’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘কলকাতা ৭১’ বা ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে মৃণাল সেন আমাদের যে দেয়ালের সামনে দাঁড় করান, তা হচ্ছে উপনিবেশ শাসনোত্তর আমাদের বিকৃত এক রাষ্ট্র ও সমাজ, যে শাসনকাঠামো অবধারিতভাবেই সৃষ্টি করে চলেছে দুর্নীতি, অবক্ষয়, দারিদ্র্য। যা লালন করে, পোষণ করে অমানবিকতা, শ্রেণিশোষণ। একসময় সম্পদ ছিল, ঐতিহ্য ছিল, এখন রয়েছে কেবল ভগ্ন প্রাসাদের দৈন্য – ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘খণ্ডহর’। মৃণাল সেনের ছবিতে দারিদ্র্যের করাল রূপটা দেখি আমরা। এ দারিদ্র্য সর্বগুণবিনাশী ‘ওকা উরি কথা’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘আকালের সন্ধানে’। দারিদ্র্যই যেন ভিলেন, যা মানুষের সব মানবিক সম্ভাবনাগুলোকে কুরে কুরে নষ্ট করে দেয়।

গল্প বলার রীতির ক্ষেত্রে বাংলা সিনেমার যে ঐতিহ্য বলবৎ ছিল বা এখনো রয়েছে, সে রকম একরৈখিক বয়ানে গল্প বলার সিনেমা বানাতে চাননি মৃণাল সেন। পরিবর্তন চেয়েছেন কেবল বিষয়বস্তুতে নয়, প্রকরণের দিক থেকেও। ভাঙতে চেয়েছেন গল্প বলার প্রচলিত বয়ানকে, যা বিশ্ব চলচ্চিত্রে সেই ফরাসি নিউ ওয়েভ থেকেই প্রচলিত কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রে ছিল অনেকটাই নতুন। তাই কেবল বিষয়বস্তু নয়, বিষয়টাকে কীভাবে তুলে ধরা, ফ্রিজ শট, মাস্কিং, কখনো একাধিক ফ্লাশব্যাক, নেপথ্যে ধারাভাষ্য, অ্যানিমেশন অথবা নিউজ পেপার কাটিং দেখিয়ে একধরনের কোলাজ চলচ্চিত্র যেন নির্মাণ করে গেছেন মৃণাল সেন।

তবে কিনা যে তাপে অন্ন মিষ্ট, সে তাপে ব্যঞ্জন নষ্ট হতে পারে। তাঁর এসব প্রকরণ এক ছবিতে ভালোই লাগে, তবে আরেক ছবিতে তার ব্যবহার ক্লিশে লাগতে পারে। গিমিকের অভিযোগও উঠতে পারে। মৃণাল সেনের বিরুদ্ধে উঠেছেও। এবং পুনরাবৃত্তির ঝোঁক, বিশেষ করে, শেষ দিককার ছবিগুলোতে মৃণাল সেন যেন কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

মৃণাল সেনের সিনেমা হচ্ছে সিনেমা অব আইডিয়াজ, গল্পটা মূল নয়। গল্পের পেছনে মৃণাল সেনের বক্তব্যটাই প্রধান। একটার পর একটা ছবিতে মৃণাল সেন আমাদের যে পাথুরে বাস্তবতার কাছে এনে দাঁড় করান, সেখানে এই সত্যটাই মূল, যে সমাজ শ্রেণিবিভক্ত। মুন্সী প্রেমচান্দের ‘কাফন’ গল্পটির ভিন্ন এক দৃশ্যায়ন করলেন মৃণাল সেন তেলেগু ভাষায় ‘ওকা উরি কথা’। হতদরিদ্র চরিত্রটি বিশ্বাস করে শ্রম বৃথা, কারণ তা সম্পদশালীদের সম্পদ বৃদ্ধি করে মাত্র। তাঁর প্রথম রঙিন ছবি ‘মৃগয়া’তে দেখালেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইঙ্গিত ও কারণ। দেখালেন কীভাবে আদিবাসীদের সারল্যকে শোষণ করে ধুরন্ধর নাগরিক সভ্যতা। আর ‘কলকাতা ৭১’-এর তিনটি পর্বেই রয়েছে বঞ্চিতদের বেঁচে থাকার লড়াই ও দ্বন্দ্ব, যেখানে কুড়ি বছরের প্রতিবাদী এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

মৃণাল সেন যৌবনের শুরুতে একটি রাজনৈতিক কাজ হিসেবেই চলচ্চিত্রকে দেখেছিলেন, জীবনের শেষ ছবি অবধি তাই দেখে গেছেন। এই রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক বাস্তবের রেপ্লিকা হয়ে ছিল না, সিনেমাটিক ভাষাবদলও ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অনুজ ফরাসি নব্য তরঙ্গের উদ্দেশ্যও ছিল এমনটাই।

‘অপরাজিত’ মৃণাল সেনের কাছে সবচেয়ে সমকালীন ছবি ছিল। মৃণাল নিজে এই সমকালীনতার বিশ্বাসে চিরদিন স্থিত থাকতে চেয়েছেন। সমকালীনতা মানে, তিনি জানাচ্ছেন, সমসময়ের সাংবাদিক ধারাবিবরণী নয়, খ্রিস্টের জন্মের আগের ঘটনা অবলম্বনে লেখাও হয়ে উঠতে পারে চরম সমকালীন (যেমন তাঁর প্রিয় উপন্যাস ‘স্পার্টাকাস’), শুধু ইতিহাস সচেতন হতে জানতে হয়।

সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এ রকম এক দৃষ্টিতে দেখা মৃণাল সেনের স্বাভাবিকই ছিল। কারণ, তিনি জীবন শুরুই করেছিলেন একজন মার্ক্সবাদী হিসেবে। মার্ক্সীয় দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব, সেই থিসিস-অ্যান্টিথিসিস আর সিনথেসিসের এক প্রাথমিক পাঠ দেখি ‘জেনেসিস’ ছবিতে, যেখানে এক বিরান প্রান্তরে এক কৃষক, এক তাঁতি এবং এক রমণীর প্রতি তাদের অধিকারবোধে জেগে ওঠে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা, ‘ভাগ কর ও শাসন কর’-এর চিরন্তন সেই নীতির প্রকাশ।

মৃণাল সেন একটি বিশেষ সময়ের, বিশেষ প্রজন্মের অন্যতম শেষ প্রতিনিধি ছিলেন। এই সময়টি ছিল ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি চূড়ান্ত সময়। তেভাগা-তেলেঙ্গানা এদের স্মৃতিতে ছিল, উত্তর স্বাধীনতা পর্বে এরা কমিউনিস্ট বলেই নিষিদ্ধ হয়ে যান। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ উপন্যাসে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘টিচার’ গল্পে এই ‘ওল্ড কমিউনিস্ট’দের কথা আমরা পড়েছি।

সমর সেন, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আইপিটিএ গ্রুপ, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক – প্রত্যেকে ছিলেন সাম্যবাদী ভাবাপন্ন ইন্টেলেকচুয়াল ও কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার। আমরা এই বিশেষ প্রজন্মটির কথা বলছি। মৃণাল সেন এদের একজন ছিলেন।

মৃণাল সেন‘একদিন প্রতিদিন’ হচ্ছে ‘ভুবন সোম’-য়ের মতোই মৃণাল সেনের আরেকবার মোড় ফেরা। ফিরে এলেন তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে। বরং বলা চলে বাঙালি মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের সংকটের কাছে। বাড়ির তরুণী মেয়েটি রাতে বাড়ি ফিরে এল না। টান টান চিত্রনাট্য, গীতা সেন-শ্রীলা মজুমদারের দৃষ্টিকাড়া অভিনয় ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানব-অনুভূতিগুলো তুলে ধরে মৃণাল সেন আমাদের মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের পাশেই যে মুখ ব্যাদান করা এক বিশাল অন্ধকার খাদ রয়েছে, তার মুখোমুখি করলেন। মেয়েটি সারা রাত বাড়ি ফেরেনি। কোথায় ছিল সে? মৃণাল সেন বলেননি। কেবল আমাদের মধ্যবিত্তদের সম্মানের নিরাপত্তার প্রতি এক বিরাট প্রশ্ন ছুড়ে মেরেছেন। বিষয়টি আরও সূক্ষ্মতায় ফুটেছে ‘খারিজ’-এ। অর্থনীতির নোংরা সুতাগুলোর আড়ালে মধ্যবিত্তের দ্বিচারিতা যেন আরও নগ্নভাবে তুলে ধরলেন মৃণাল সেন। বরং যে মর্যাদাবোধ নিয়ে মৃত কাজের ছেলেটির গ্রাম থেকে আসা বাবা বিদায় নিল, তা যেন মধ্যবিত্তের সব ঠুনকো মর্যাদাবোধকেই এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে গেল। লন্ডনের গার্ডিয়ান লেকচারে সত্যজিৎ রায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘মৃণাল সেন হিটস সেফ টার্গেটস।’ বাঙালি মধ্যবিত্তদের নিয়ে মৃণাল সেন কিন্তু এসব ছবিতে খুব সফলভাবেই তাঁর টার্গেটগুলোর বিবেককে চাবুক মারতে সক্ষম হয়েছেন।

মৃণাল সেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানচিত্রে কাজ করেছেন একটি লম্বা সময় জুড়ে, অতএব তিনি সমকালীন হিসেবে যেমন পেয়েছিলেন কুরোসাওয়া-ডি সিকাকে, তেমনই কাহিয়ে দু সিনেমা গ্রুপকেও। চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড সহ ইউরোপিয়ন দেশগুলির নব্য তরঙ্গ ছিল মৃণালের সমকালীন, আশির দশকে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নতুন চলচ্চিত্র মৃণালের ছবি (‘আকালের সন্ধানে’ বা ‘খন্ডহর’)-এর পাশে হেঁটেছিল।

আমরা দেখেছি, মৃণাল সেনের ছবি এই বাংলা সাহিত্যের সমান্তরাল ধারাটিকে কীভাবে খুঁজে যাচ্ছিল একটি বিরাট সময় জুড়ে, তরুণ লেখক আশীষ বর্মন ছিলেন মৃণালের কাহিনিকার (‘আকাশ কুসুম’ বা ‘ইন্টারভিউ’), কমিউনিস্ট অমলেন্দু চক্রবর্তীর অবিরত চেনামুখ মৃণালের হাতে রূপ পেয়েছিল ‘একদিন প্রতিদিন’-এ। সাহিত্য থেকে সিনেমা, সিনেমা থেকে সাহিত্য- এই লাগাতার যাতায়াত প্রক্রিয়াটির একজন অনিবার্য অংশ ছিলেন মৃণাল।

কোনো কোনো ছবিতে মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের আরও গভীরে চলে যান মৃণাল সেন, প্রায় আস্তিত্বিক স্তরে। ‘একদিন আচানক’-এ নিরুদ্দেশ হওয়া অধ্যাপকের মেয়েটি ওই যে বলেছিল, ‘বাবা বুঝতে পেরেছিল বাবা খুব সাধারণ। আর সাধারণ হিসেবে সারা জীবন কাটানো খুব কষ্টকর। বাবা আর ফিরবে না।’ মৃণাল সেন যেন বারবারই মধ্যবিত্তকে তাদের লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চম্মন্যতার ঠুনকোপনা সম্পর্কে সচেতন করতে চাইছেন, এসব ছেড়ে তাদের সমাজ বদলানোর বিষয়ে সচেতন করতে চাইছেন, লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছেন।

আঙ্গিক নিয়ে এক বড় নিরীক্ষা করেছেন মৃণাল সেন অনেক ছবিতেই। বিশেষ করে ‘আকালের সন্ধানে’তে। গল্প বলার এ এক ভিন্নধর্মী বয়ান ‘আ ফিল্ম উইদিন আ ফিল্ম’। বিষয়টাও ওর প্রিয় এক বিষয় পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং বাংলার জনজীবনে এ মন্বন্তরের প্রতিঘাত। সেদিক থেকে তাঁর সবচেয়ে অমৃণালীয় ছবি হচ্ছে ‘খণ্ডহর’। শ্রেণির সংঘাত নেই, দারিদ্র্যের নির্মমতা নেই, বড় কোনো দ্বন্দ্বও নেই। তবে সবচেয়ে বিষণ্ন এক ছবি। এক ভগ্নস্তূপে এক বিষাদময়ী নারীর এক করুণ জীবনগাথা। গভীরভাবে মানবিক এক ছবি।

ঠিক প্রত্যক্ষ রাজনীতি নয়, মহাকালই যেন ছবির বিষয়, মৃণাল সেনের শেষের দিককার ওই ছবিটি ‘মহাপৃথিবী’। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ছে, বদলে যাচ্ছে পূর্ব ইউরোপ। বাড়ির ছেলেটি নকশাল আন্দোলনে মৃত। ছেলেটি, ছেলেটির মা, পরিবারটি, গোটা এক প্রজন্মই তো বিশ্বাস করেছিল সমাজতন্ত্রে, আত্মহত্যার ডায়েরিতে মায়ের অভিমান, ‘বুলু, তোরা কি সব মিথ্যে হয়ে যাবি?’ এ তো শুধু এক মায়ের প্রশ্ন নয়, শোষণহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখা কয়েক প্রজন্মেরই জিজ্ঞাসা ও অভিমান।

‘র‌্যাডিক্যাল’, ‘মার্ক্সবাদী’, ‘ডকট্রিনের’ এ রকম নানা বিশেষণই মৃণাল সেন পেয়েছেন তাঁর জীবদ্দশায়। সেসব হয়তো আংশিক সত্যও। তবে সবার ওপরে মৃণাল সেন একজন সৃজনশীল শিল্পী, একজন রাগী শিল্পী, যিনি দর্শকদের দিকে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দিতে ভালোবাসেন – ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’। আর সচেষ্ট থাকেন দর্শকের আত্মসন্তুষ্টিকে ভেঙে দিয়ে তাদের মানবিক বিবেকবোধকে জাগ্রত করতে। মৃণাল সেনকে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাই সব সময়ই স্মরণ করা হবে। স্মরণ করা হবে সিনেমাশিল্প মাধ্যমটির ওপর সুদক্ষ দখলের একজন নির্মাতা হিসেবে, যিনি সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন আমাদের বিবেক ও সমাজের কাছে সদাই কিছু তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিতে।

সবকিছুকেই গভীর মনযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মৃণাল, আত্মস্থ করেছিলেন, সেই কৈশোর থেকেই। আর তাই পরবর্তীতে এই সময়চেতনা নাড়ির স্পন্দনের মতোই তাঁর শিল্পমাধ্যমে জেগে থাকে। তাকে আলাদা করা যায় না। আবার তাকে কোনও সময়ের কোঠায় ফেলাও যায় না।

কোলকাতা শুধু কংক্রিটের জঙ্গল নয়। শুধু রাস্তা, বাড়ি, গাড়ি; মানুষ নয়। কোলকাতার নিজের একটা সত্ত্বা আছে, নিজের স্বতন্ত্র একটা পরিচিতি আছে। তার বুকে হয়ে চলা হাজার ঘটনার সে এক নির্বাক সাক্ষী। কোলকাতার এই দিকটাকে কেউ যদি তার লেন্সের মাধ্যমে সব থেকে ভালো করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তিনি হলেন মৃণাল সেন।

প‍্যারালাল ফিল্মের এই স্বর্ণযুগের এক বিশাল অঙ্গ, যিনি ছিলেন অনেক প্রথমের সাক্ষী, যার চলচ্চিত্রের মধ্যে এক অদ্ভুত চাপা ভাব মানুষকে আকৃষ্ট করে বারবার :- “It’s not art cinema, it’s reality cinema”।

মৃণাল সেন একজন মানুষের নাম যিনি কোলকাতাকে ভালোবেসেছিলেন, যিনি ছায়াছবির জগৎটাকে ভালোবেসেছিলেন।

মৃণাল সেনের শেষ ছবি আমার ভুবন, যে ছবিতে লেগে ছিল একটি বিষণ্ণ ফোকলোরের সুর। যে ছবি ছিল একেবারেই রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্রে। ২০০২ সালের পর মৃণাল আর ছবি করেননি। সালটা খুব গুরুত্বপূর্ণ– এর একবছর দুবছরের এদিক ওদিকে ৯/১১, গোধরা, ইরাক যুদ্ধ, ডিজিটাল বিপ্লব, বামপন্থার প্রায় বিলয়ের মতো ঘটনাগুলি ঘটে যাবে।

কলকাতা যোগাযোগ স্থাপনের ভাষা ভুলে গেছে কারণ সে মৃণাল সেনকে স্মরণ করতে গিয়ে কিছু নীরস, রংচটা, তথ্যে ঠাসা, ক্লিশেতম মুখের কথা ও অক্ষরের আশ্রয় নিচ্ছে। কলকাতা মৃণাল সেনের কাছে এমন কোনো সিনেমাটিক সম্পদের নজির গত তিরিশ বছরে রাখতে পারেনি যা থেকে প্রমাণ হবে, তার কাছে মৃণাল সেন ইতিহাসগতভাবে অস্তিত্ববান ছিলেন।

মৃণাল সেন মানেই একটা কমিটমেন্ট। স্ট্রেট লাইনে ভাবা। অনেকেই ভাবতে পারেন, ‘বড্ড ডিরেক্ট’। কিন্তু তিনি ভাবতেন, ‘আই মাস্ট মেক এ পয়েন্ট’। সময়ের উন্মত্ততাকে ধরেছেন তাঁর ক্যানভাসে। তাই দেখতে আজও টানে তাঁর কলকাতা ট্রিলজি, নকশাল আন্দোলন। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি শুধুমাত্র বাংলা নয়, গোটা দেশের চলচ্চিত্র ভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক সচেতনতার আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি। ব্রেখটের এপিক থিয়েটার এলিয়েনেশন এফেক্ট তত্ত্ব তাঁর শিল্পভাবনায় ছাপ ফেলেছিল। প্যারিসের নিউ ওয়েভ ফিল্ম মুভমেন্ট থেকে সাহস ও অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন তিনি। মৃণাল সেন এমনই একজন পরিচালক, যিনি বিশ্বাস করতেন, সিনেমা বিনোদনের জন্য নয়, ছবির মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষিত করা যায়। বাড়ির উঠোন থেকে ময়দান, গলি থেকে রাজপথ, শহরের বস্তি থেকে হাইরাইজ তাঁর সিনেমায় ম্যাজিক তৈরি করেছে। আর ভারতীয় ছবির এই ন্যারেটিভ তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্বের আঙিনায়।

মৃণাল সেনের জীবনবোধ কেমন ছিল? কিছুটা তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছেন তাঁর বিভিন্ন ছবিতে। ‘ইন্টারভিউ’, ‘খণ্ডহর’, ‘পুনশ্চ’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘ভুবন সোম’, ‘পদাতিক’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর মতো ছবি সেই তালিকায়। চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে নতুন রূপে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন পার্থিব জীবনকে। মানুষের প্রকৃত রূপ, তার ভিতরে থাকা লুকনো চেহারা টেনে বার করে আনতেন প্রতিটি ছবিতে। দর্শকদের বোঝাতে চাইতেন, আসলে জীবন কী ভাবে বইছে!

মৃণাল সেন চলে গেছেন, অর্থাৎ আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। সেই মুহূর্ত থেকেই। আর যদি পৃথিবীই না থাকে? যদি আমাদের মনে না রাখে পৃথিবী? আমরা পৃথিবীকে সিনেমার জন্য মনে রাখব। এখানেই অমরত্ব লাভ করেন মৃণাল সেন। তাঁর দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিরন্তর আলোচনা চলতে পারে, তর্ক হতে পারে, কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে, তাঁর নির্ধারিত ফ্রেমের ভিতর দাঁড়িয়েই আজ সময়ের পুনরাবিষ্কার সম্ভবপর। সময় পেরিয়ে এসে আজও ইতিহাসের বিস্তার এভাবেই সম্ভব হচ্ছে ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে দৈন্দদিনতায়। আমরা জানি, এই দুরূহ কাজটি যিনি সম্ভব করে তুলতে পেরেছেন বা পারেন, কালের সেই রাখালই কালজয়ী হয়ে ওঠার দাবি রাখেন। যেমন, মৃণাল সেন। তাঁর তাই সত্যিই কোনও মৃত্যুদিন হয় না।

অনেকেই বলেন, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো এমন এক চোখ নিয়ে চলে গেছেন মৃণাল সেন, সংলাপের জাদুকর, ক্যামেরার লেন্সে দুনিয়াদারিতে এক নিপুণ পরিচালক। ভাবনা বদলে দেওয়ার সেইসব মানুষেরই আজ বড় অভাব। তাই কি সিনেমার ফ্রেম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সাহস!

আর আমাদের বাঙালিদের কাছেই মৃণাল সেন এমন একজন প্রিয় শিল্পী হিসেবে বয়ে যাবেন, যিনি যত দিন খেলেছেন উইকেটের চারিধারে পিটিয়ে খেলেছেন, সব ধরনের শট খেলতে জানতেন। দুঃখজনকভাবে নব্বইয়ের ঘরে তিনি আটকে গেলেন। শতায়ু হতে পারলেন না। এ আক্ষেপ তো আমাদের আজীবন রয়েই যাবে!

আজ পরিচালক মৃণাল সেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার শ্রদ্ধার্ঘ‍্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (প্রথম পর্ব)‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে একটা কাহিনী বহুকাল ধরেই নির্বাধায় প্রচলিত থাকতে থাকতে বর্তমানে সেটা প্রায় একটা প্রবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছে। সেই কাহিনীটি সংক্ষেপে হল – রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের

রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ রামচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমের জীবিতাবস্থাতেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দে) তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষ্যাতের ঘটনাটি লিখেছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাঁর লেখা যখন সঠিক

গৌড়ের প্রথম ধারাবাহিক শাসক-বংশগৌড়ের প্রথম ধারাবাহিক শাসক-বংশ

রানা চক্রবর্তীঃ হানাহানি ও রক্তপাতের সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গৌড়-বঙ্গ কিভাবে প্রথম নিজের ধারাবাহিক শাসক-বংশ পেয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ইতিহাসের পথে অনেকটা পিছনের দিকে হাঁটতে হবে। বখতিয়ার খিলজির

দ্য হিস্ট্রি অফ ইসরায়েলে জামাই বলে উল্লেখ! মোসাদের এক দুর্ধর্ষ মিশরীয় এজেন্ট এঞ্জেলদ্য হিস্ট্রি অফ ইসরায়েলে জামাই বলে উল্লেখ! মোসাদের এক দুর্ধর্ষ মিশরীয় এজেন্ট এঞ্জেল

সময়টা ১৯৭৩ এর ৫ অক্টোবর, রাত একটার সময় কায়রো থেকে ইসরায়েলে তেল আভিবে মোসাদের হেড অফিসে ফোন আসে একটি। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যাক্তিটি নিজেকে এঞ্জেল হিসাবে পরিচয় দেয়, যা ব্যাক্তিটির