গৌড়ের প্রথম ধারাবাহিক শাসক-বংশ - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ গৌড়ের প্রথম ধারাবাহিক শাসক-বংশ

গৌড়ের প্রথম ধারাবাহিক শাসক-বংশ


রানা চক্রবর্তীঃ হানাহানি ও রক্তপাতের সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গৌড়-বঙ্গ কিভাবে প্রথম নিজের ধারাবাহিক শাসক-বংশ পেয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ইতিহাসের পথে অনেকটা পিছনের দিকে হাঁটতে হবে। বখতিয়ার খিলজির হাতে নবদ্বীপের পতনের পরে একশো বছর সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও রাঢ় বাংলা তখনও স্বাধীন ছিল। তাই সেখানে নিজের অধিকার প্রসারিত করবার জন্য গৌড়-বঙ্গের তৎকালীন সুলতান ‘সামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ’ দক্ষিণ মুঙ্গের থেকে ‘জিয়াউদ্দীন উলুঘ খাঁ’কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রাঢ়-বাংলায় কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধে জয়লাভ করলেও উলুঘ খাঁ সেখানে কোন স্থায়ী অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। কিন্তু ফিরোজ শাহের পুত্র ‘বাহাদুর শাহ’ রাজা ‘দনুজমাধব’কে পরাজিত করে বঙ্গ অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। গৌড়-বঙ্গ থেকে লক্ষ্মণসেনের নিষ্ক্রমণের প্রায় এক শতাব্দী পরে সেই প্রথমবারের জন্য বঙ্গের উপরে স্থায়ীভাবে তুর্কী অধিকার প্রসারিত হয়েছিল। ওই যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে বৃদ্ধ দনুজমাধব দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে ‘চন্দ্রদ্বীপ’ রাজ্যের পত্তন করেছিলেন। গৌড়-বঙ্গের সুলতান ‘সামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ’ তখন বেশ সুখেই নিজের দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর রাজ্যের উপরে দিল্লী থেকে কোন ধরণের আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল না, আবার তাঁর প্রতিবেশী হিন্দুরা তখন নিজেদের নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। সেই সুসময়ে তিনি গৌড় থেকে পাণ্ডুয়ায় নিজের রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করে, নিজের নামে সেটার নামকরণ করেছিলেন – ‘ফিরোজাবাদ’। কিন্তু তাঁর নিজের অজান্তেই শত্রুরা তখন গোকুলে বাড়ছিলেন। একটা সময়ে তাঁর চারজন পুত্রই তাঁদের পিতাকে অতিরিক্ত বেশী সময় বেঁচে থাকতে দেখে, শেষে অধৈর্য্য হয়ে গৌড়ের চার প্রান্তে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বঙ্গের শাসনকর্তা বাহাদুর শাহ সবচেয়ে করিৎকর্মা ব্যক্তি ছিলেন; নিজের পিতা ও ভাইদের যুদ্ধে পরাজিত করে তিনি প্রথমে স্বাধীন হয়েছিলেন। পরে ১৩২২ খৃষ্টাব্দে সুলতান ফিরোজের মৃত্যু ঘটলে তিনি অতি সহজেই লখনৌতি অধিকার করে নিয়েছিলেন। গৌড়ের অধীনে তখন চারিটি প্রদেশ ছিল – ‘লখনৌতি’, ‘সোনারগাঁ’, ‘সাতগাঁ’ ও ‘বিহার’। সেগুলোর মধ্যে প্রথম দুটিতে বাহাদুর শাহ তাঁর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করলেও, শেষ দুটিতে তাঁর অন্য দুই ভাই রাজত্ব করছিলেন। তিনি সেই প্রদেশ দুটি অধিকার করবার আয়োজন করছেন শুনে, তাঁর এক ভাই ‘নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম’ সোজা দিল্লীতে চলে গিয়ে সেখানকার নতুন সুলতান ‘গিয়াসুদ্দীন তুঘলকের’ সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন, প্রতিদানে তিনি বাহাদুরকে তুঘলকের কাছে জীবিত ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভ্রাতৃদ্রোহী অমন একটি রত্নকে সপক্ষে পেয়ে গিয়াসুদ্দীন খুশিই হয়েছিলেন। এরপরে তিনি তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী ফৌজের দায়িত্ব দিয়ে নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিমকে গৌড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাহাদুরের তখন ঘরেও শত্রু, বাইরেও শত্রু অবস্থা। তা সত্ত্বেও তিনি লখনৌতির নগর প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে দিল্লীর ফৌজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধের পরে তিনি যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তখন তিনি নিজের মুষ্টিমেয় বিশ্বস্ত সৈন্যসহ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। দিল্লীর তুঘলকী ফৌজ অবশ্য সেখানেও তাঁকে রেহাই দেয় নি, তাঁর পিছু ধাওয়া করে শেষপর্যন্ত মধুপুরের জঙ্গলে গিয়ে তুঘলকী বাহিনী তাঁর নাগাল পেয়েছিল। যদিও বাহাদুর সেখান থেকেও পালাবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ঘোড়ার পা পাঁকে আটকে যাওয়ায় জন্য শত্রু তাঁকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে লখনৌতিতে নিয়ে আসতে পেরেছিল। বাহাদুরের গ্রেপ্তারে নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিমের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হয়েছিল; এরপরে দিল্লীশ্বর গিয়াসুদ্দীন তুঘলক তাঁকে লখনৌতি, এবং নিজের ফৌজের অধিনায়ক ‘বহরম খাঁ’কে সাতগাঁ ও সোনারগাঁর শাসনকর্তা রূপে নিযুক্ত করেছিলেন। বাহাদুরের গলায় দড়ি বেঁধে গিয়াসুদ্দীনের কাছে দিল্লীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গিয়াসুদ্দীন তুঘলকের নিজের দিনও তখন ফুরিয়ে এসেছিল। তাঁর পুত্ৰ ‘মুশা খাঁ’ তাঁকে হত্যা করে ‘মহম্মদ তুঘলক’ নাম নিয়ে দিল্লীর মসনদে আরোহণ করেছিলেন (১৩২৫ খৃষ্টাব্দ)। গিয়াসুদ্দীনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাহাদুর শাহ মুক্তি পেয়ে সোনারগাঁয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ওদিকে নাসিরদ্দীন ইব্রাহিম তখন বুদ্ধিমানের মত সেই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে আগের মতই লখনৌতিতে স্বপদে বহাল থেকে গিয়েছিলেন। তিনি দিল্লীর নতুন সুলতানের প্রতি নিজের আনুগত্য দেখালেও, বছর খানেক পরেই তাঁকে দিল্লীতে আহ্বান করে নিয়ে গিয়ে সুকৌশলে অপসারিত করা হয়েছিল। পিতৃহন্তক মহম্মদ তুঘলকের যোগ্য সহকারী হয়ে বাহাদুর শাহ তাঁদের উভয়ের যৌথ নামে মুদ্রা প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর সেই আনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে দিল্লীশ্বর তাঁকে পূর্বাঞ্চল জয়ের জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু কয়লার ময়লা যে ধুলেও কখনো যায় না! বছর তিনেক পরে বাহাদুর যখন জানতে পেরেছিলেন যে, বড় রকমের একটা বিদ্রোহ দমন করবার জন্য মহম্মদ তুঘলক মূলতানে গিয়েছেন, তখন তাঁর মনে স্বাধীনতার স্পৃহা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ স্বনামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন। যদিও মহম্মদ তুঘলক সেই ধরণের কোন সম্ভাবনার কথা আগে থেকে অনুমান করেই ‘বহরম খাঁ’কে বাহাদুরের নায়েব নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। এরপরে বহরম অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বাহাদুরের বিদ্রোহ দমন করে তাঁকে বন্দী করেছিলেন। তারপরে তাঁকে শুধু হত্যা করা হয় নি, তাঁর মৃতদেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে সেটার ভিতরে শুকনো ঘাস পুরে মহম্মদ তুঘলকের কাছে মূলতানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তা দেখে তুঘলক মহা খুশী হয়ে একটি জয়স্তম্ভের উপরে সেটিকে কয়েক দিন রেখে রোদে শুকিয়ে নিয়ে, তাঁর সম্ভাব্য সকল বিদ্রোহীকে সেটি দেখাবার জন্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রধান নগরীতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন।

এরপরে বাহাদুরজয়ী বহরম খাঁকে সোনারগাঁর শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হলেও, কিছুদিন পরেই দেখা গিয়েছিল যে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে, এবং তাঁর শিলাদার ‘ফকরুদ্দীন’ সোনারগাঁ অধিকার করে নিয়েছেন। সুলতান মহম্মদ তুঘলক তখন দেবগিরির কাছাকাছি কোন এক জায়গায় যুদ্ধে ব্যস্ত থাকলেও, তাঁকে দমন করবার জন্য আমীর ‘কদর খাঁ’কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফকরুদ্দীন ব্রহ্মপুত্রের ওপারে এক জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নিলেও গোপনে কদর খাঁর সৈন্যাধ্যক্ষদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গিয়েছিলেন। এরপরে একদিন তাঁর কাছে খবর গিয়েছিল যে, কদর খাঁ রাজ্যের সব অঞ্চল থেকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে সোনারগাঁ রাজকোষে জমা করছেন; যদিও তিনি সব আমীরকে জানিয়েছিলেন যে, ওই সমস্ত অর্থ তিনি দিল্লীতে পাঠাবেন, কিন্তু পাঠাবার কোন নাম করেন নি। ফকরুদ্দীন অমনই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কদর খাঁর অর্থ লোলুপতার জন্য তুঘলকী সৈন্যদের মধ্যে যে বিক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, তাঁকে সেটার সদ্ব্যবহার করতেই হবে। তাই গুপ্তচর মারফৎ তিনি নেতৃস্থানীয় সৈন্যাধ্যক্ষদের বলে পাঠিয়েছিলেন যে, তাঁরা যদি কদরকে সরিয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে তিনি শুধু সেই সঞ্চিত অর্থই নয়, সাথে আরো বহু অর্থই তাঁদের মধ্যে বন্টন করে দেবেন। প্রলোভনে কাজ হয়েছিল। কারণ, এরপরে এক দিন প্রত্যূষে দেখা গিয়েছিল যে, কদর খাঁ নিহত হয়েছেন, এবং ফকরুদ্দীন রাজদণ্ড হাতে নিয়ে সোনারগাঁর রাস্তায় আবার চলাফেরা করছেন। ফকরুদ্দীন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন, ফকির-দরবেশদের তিনি যথেষ্ট সম্মান দেখাতেন। তাই নতুন করে তখতে অরোহণের পরে একটি ফরমান জারী করে তিনি রাজ্যের সর্বত্র এই আদেশ প্রচার করেছিলেন যে, ফকির সেবার জন্য প্রতিটি গ্রাম থেকেই একটা নির্দ্ধারিত পরিমাণ অর্থ স্থানীয় রাজকোষে জমা দিতে হবে। ‘সইদা’ নামের একজন ফকিরকে তিনি এতটাই শ্রদ্ধা করতেন যে, শেষপর্যন্ত তাঁকেই তিনি সাতগাঁর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ফকির হোলেও সইদার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কারোর চেয়েই কম কিছু ছিল না। তিনি ফকরুদ্দীনের মুরশিদ ছিলেন, সেই কারণে প্রতিনিয়ত খোদার কাছে তাঁর জন্য দোয়া করতেন। কিন্তু তাই বলে শাগরেদের নফর হয়ে থাকাটা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। সেই কারণে একদিন সুযোগ বুঝে তিনি ফকরুদ্দীনের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে সাতগাঁর স্বাধীন সুলতান হয়ে বসেছিলেন। সেই খবর ছড়িয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার যেখানে যত ফকির ছিলেন, সবাই তাঁর রাজ্যে উপস্থিত ইসলামের জয়ধ্বনি করতে শুরু করেছিলেন। ওদিকে লখনৌতিতে ফকরুদ্দীনের কাছে সেই দুঃসংবাদ পৌঁছানোর পরে তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের উস্তাদকে দমনের জন্য সোনারগাঁয়ে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সইদার ফকিরবাহিনীও যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে হাজির হয়েছিল। কিন্তু সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত সিপাহীদের সামনে ফকির সৈন্যরা যুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারেন নি। ঘণ্টাখানেক যুদ্ধের পরে সইদা পরাজিত ও বন্দী হওয়া মাত্র তাঁর ফকির ফৌজ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছিল। ফকরুদ্দীনের আদেশে তাঁদের সবাইকে খুঁজে বের করে সাইদার সঙ্গে প্রকাশ্য রাজপথের উপরে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আরো পড়ুন- হোসেনশাহী বংশের উত্থান

এর আগে ফকরুদ্দীনের ইসলামপ্রীতির খবর পেয়ে একজন ‘কোরেশী’ সাধু তাঁর রাজ্যে এসেছিলেন ও গিয়াসপুরে গিয়ে ‘শেখ নিজামুদ্দীন আউলিয়া’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পরে শ্রীহট্টে গিয়ে নিজের আস্তানা স্থাপন করেছিলেন। তাঁর প্রচারে প্রভাবিত হয়ে বহু হিন্দু ইসলামে দীক্ষা নেওয়ায় তাঁর অনন্যসাধারণ শক্তির খবর দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই অসাধারণ শক্তিশালী শেখের দর্শন লাভের জন্য আফ্রিকান ভ্রমণকারী ‘ইবন বতুতা’ ১৩৪৫ খৃষ্টাব্দে গৌড়ে এসেছিলেন। তাঁর যাত্রাপথে কাইরো, বসরা, সিরাজ প্রভৃতি সমৃদ্ধশালী নগরী পড়েছিল; ইরাক, আফগানিস্থান, চীন প্রভৃতি দেশও তিনি ভ্রমণ করেছিলেন, কিন্তু কোথাও তিনি বাংলার মত পণ্যদ্রব্য এত সুলভ দেখতে পাননি। ইবন বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে সেই সময়ে প্রচলিত ‘দিল্লী রতি’তে পণ্যবস্তুর ওজন ও রৌপ্য দিনারে মূল্য লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। বর্তমান হিসাবে ১ দিল্লী রতি = ১/৩ মণ = ১২৫ কিলো, ও ১ দিনার = ৭ টাকা। এই হিসাবে সেই সময়কার পণ্যদ্রব্যের নিম্নলিখিত মূল্য নির্ধারণ করা যায় –
চাল: ১ টাকায় ১-১/৪ মণ,
ধান: ১ টাকায় ৪ মণ,
গব্যঘৃত: ১ টাকায় ১ সের ১০ ছটাক,
গোলাপজল: ১ টাকায় ২ সের,
চিনি: ১ টাকায় ১ সের ১০ ছটাক,
মিহি কাপড়: ১ টাকায় ১ গজ,
একটি ভেড়ার মূল্য: ১ টাকা ১২ আনা,
একটি গাভী: ২১ টাকা।
বাংলার বাজারে তখন যুবতী স্ত্রীলোক নিয়েও কেনাবেচা চলত। তাঁদের মূল্য নির্দ্ধারিত হত দৈহিক সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি দিয়ে। একদিন ইবন বতুতা দেখতে পেয়েছিলেন যে, একজন ধনী ব্যক্তি ৭০ টাকা মূল্যে একজন সুন্দরী যুবতীকে ক্রয় করলেন। তিনিও প্রায় সমমূল্য দিয়েই ‘অসুরা’ নামের একজন সুন্দরী রক্ষিতা সংগ্রহ করেছিলেন।

দিল্লীতে মহম্মদ তুঘলক নিজের বহু মূল্যবান পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবার জন্য তিনি ফকরুদ্দীনের মৌখিক আনুগত্য পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। ওই ভাবে দশ বছর সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে তুঘলক বংশীয় সেই অর্দ্ধোন্মাদ সুলতানের কল্পনাবিলাসের জন্য সমগ্র তুঘলকী সাম্রাজ্য যখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তখন সোনারগাঁয়ে ফকরুদ্দীনের মতোই লখনৌতিতে ‘আলাউদ্দীন মোবারক শাহ’ ও সাতগাঁয়ে ‘ইলিয়াস শাহ’ দিল্লীর সঙ্গে নিজেদের সব সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই স্বাধীন রাজ্য তিনটির উদ্ভবের সময় থেকেই পরস্পরের মধ্যে কলহ শুরু হয়েছিল। শেষপর্যন্ত ১৩৪২ খৃষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ অতি সহজেই আলাউদ্দীন মোবারককে পরাজিত করে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের অধীশ্বর হয়ে বসেছিলেন। তারপর থেকে তাঁর অধীনে পশ্চিমবঙ্গ ও ফকরুদ্দীনের অধীনে পূর্ববঙ্গের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে সেই যুদ্ধ চলবার পরে ইলিয়াস শাহ বিজয়ী হয়ে ১৩৫৭ খৃষ্টাব্দে সমগ্র গৌড়-বঙ্গের অধীশ্বর হয়ে বসেছিলেন। সেন বংশের নিষ্ক্রমণের প্রায় দেড় শতাব্দী পরে সেই প্রথম গৌড়-বঙ্গে একটি ধারাবাহিক শাসক-বংশের অভ্যুদয় ঘটেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ রামচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমের জীবিতাবস্থাতেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দে) তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষ্যাতের ঘটনাটি লিখেছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাঁর লেখা যখন সঠিক

প্রাচীন ভারতে তনয়াপ্রাচীন ভারতে তনয়া

রানা চক্রবর্তীঃ প্রাচীন ভারতবর্ষে পুত্র জন্মালে শাঁখ বাজত, কন্যা জন্মালে নয়। তাছাড়া ‘ভাইফোঁটা’, ‘জামাই ষষ্ঠী’ – সবই পুরুষকেন্দ্ৰিক অনুষ্ঠান। জন্মদিনও ছেলেদেরই বেশি হয়। ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’-এ বলা হয়েছে – যে নারী

অপারেশন ঘোস্ট স্টোরিস। আমেরিকার ইতিহাসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্পাই নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে এফবিআইঅপারেশন ঘোস্ট স্টোরিস। আমেরিকার ইতিহাসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্পাই নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে এফবিআই

দিনটা ২৬ জুন, ২০১০, অন্যান্য দিনের মতোই কর্মব্যাস্ত নিউইয়র্ক শহরের এক রেস্তোরাঁয় কালো চশমা পড়ে লাল চুলের এক মেয়ে প্রবেশ করে। সেখানে অনেকক্ষন ধরেই তার জন্য অপেক্ষা করছিল কালো জামা

পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনওপৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

এত বৃহৎ পৃথিবীতে রহস্য রোমাঞ্চের শেষ নেই। কোনো জায়গায় ছোট্ট একখানা জমির জন্য লড়াই চলে, তো কখনো একটা গোটা দেশকেই গ্রাস করে নেয় আগ্রাসী শক্তি। তবে আজ আমরা এমন এক