‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম - একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (প্রথম পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (প্রথম পর্ব)

‘রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (প্রথম পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে একটা কাহিনী বহুকাল ধরেই নির্বাধায় প্রচলিত থাকতে থাকতে বর্তমানে সেটা প্রায় একটা প্রবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছে। সেই কাহিনীটি সংক্ষেপে হল – রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার পরে, রামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রশ্ন করেছিলেন – মানুষের কর্তব্য কি? উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন – আহার, নিদ্রা ও মৈথুন। সেই উত্তর শুনে রামকৃষ্ণ ঘৃণায় বঙ্কিমচন্দ্রকে নাকি খুব তিরস্কার করেছিলেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, আজ পর্যন্ত কেউই সেই কাহিনীটির উৎস অনুসন্ধান তো করেনই নি, এমন কি সেটির সত্যাসত্য নিয়ে যাচাই-ও করেন নি। কিন্তু যাঁরা বঙ্কিমের জীবন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অবগত রয়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের মত রক্ষণশীল ব্যক্তির পক্ষে ওই ধরণের কোন কথা বলা তো দূরের কথা, রামকৃষ্ণের সঙ্গে আদৌ তাঁর কোন দিন দেখা হয়েছিল কি না – সে বিষয়েই সন্দেহ করা যেতে পারে। এই প্রবন্ধে সে সম্বন্ধেই বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

‘রামচন্দ্র দত্ত’, ‘স্বামী সারদানন্দ’, ‘অক্ষয়কুমার সেন’ ও ‘শ্ৰীম’ (মহেন্দ্ৰ গুপ্ত) – রামকৃষ্ণের এই চারজন পার্ষদভক্তই তাঁদের রামকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় নিজের নিজের গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, কলকাতার বেনেটোলা-নিবাসী ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ‘অধরলাল সেনের’ বাড়িতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়েছিল। রামচন্দ্র দত্তই সর্বপ্রথম তাঁর গ্রন্থে মাত্র দুটি ছোট্ট বাক্য ব্যবহার করে সেই সাক্ষাতের কথাটি লিখেছিলেন। পরে স্বামী সারদানন্দ রাম দত্তের সেই লেখাটি নিয়ে তাতে নিজের একটু মন্তব্য জুড়ে সেটিকে আরেকটু বৃদ্ধি করেছিলেন। কিন্তু ‘মনে ময়লা’ধারী, ‘বিদ্যাবুদ্ধিহীন’ অক্ষয়কুমার সেনই প্রথম রামচন্দ্র দত্ত বর্ণিত রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্রের সেই সাক্ষাতের কথার উপরে নিজের কল্পনা জুড়ে ব্যাপারটাকে নোংরা করে তুলেছিলেন। আর সবশেষে শ্রীম তাঁদের সকলের লেখা থেকেই কিছু কিছু নিয়ে তাতে নিজের অবাধ কল্পনা মিশিয়ে ঐ সাক্ষাৎকারের কথাটিকে নোংরা তো বটেই, তাছাড়া আরো জটিল করে নিজের গ্রন্থের ২৬ পাতা ধরে লিখেছিলেন। এরপরে আরো অনেকেই সে সম্পর্কে কোন খোঁজ খবর না নিয়েই শ্ৰীমের কথাকেই অভ্রান্ত বিবেচনা করে নিজেদের বইতে সেসব কথা হুবহু তুলে ধরেছিলেন। সাহিত্যিক ‘অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত’ তো আবার শ্রীমের কথা ধার করে নিয়ে, তাঁর উপরেও টেক্কা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে আরো ছোট করেছিলেন। এখানে রামকৃষ্ণের ঐ চার পার্ষদভক্ত ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাৎ বিষয়ক লেখাগুলি নিয়ে পর পর আলোচনা করা হল।

রামচন্দ্র দত্ত তাঁর গ্রন্থে লিখেছিলেন, “কলিকাতার ভূতপূর্ব ডেপুটি কালেক্টর অধরলাল সেন, ইনি শাক্ত ছিলেন। অধরবাবুর বাড়িতে একদিন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহিত পরমহংস দেবের সাক্ষাৎ হয়। পরমহংস দেব তাঁহাকে বঙ্কিম (বাঁকা) বলিয়া রহস্য করিয়াছিলেন।” (শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবন বৃত্তান্ত) রাম দত্ত রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষাৎ সম্পর্কে শুধু এই কথাটাই লিখেছিলেন। এর অতিরিক্ত একটি বাক্যও তিনি নিজের লেখায় খরচ করেন নি। উক্ত রাম দত্ত রামকৃষ্ণের একেবারে প্রথম দিকের শিষ্য বা ভক্ত ছিলেন। রাম দত্ত রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাতের কথা লিখলেও, তিনি নিজে যে সেই সাক্ষাৎকার প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেটা কিন্তু কোথাও বলেন নি। তাছাড়া তিনি কার কাছ থেকে শুনে সেই সাক্ষাৎকারের কথা লিখেছিলেন, সেকথাও তিনি নিজের লেখায় বলেন নি। তবে তিনি সেসব বলুন বা নাই বলুন, তাঁর লেখাটি কতটা বাস্তব ছিল, সেটাই প্রথম বিচার্য বিষয়। রাম দত্তের গ্রন্থের সব লেখাই যে সত্যি নয়, ইতিহাসের খাতিরে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রমাণ তুলে ধরা যেতে পারে। নিজের গ্রন্থে রাম দত্ত তাঁর ‘বক্তৃতাবলী’তে লিখেছিলেন, “একদা … ভক্তিভাজন ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বাটিতে রামকৃষ্ণদেব আগমন করিয়াছিলেন। এই স্থানে পণ্ডিতপ্রবর শশধর তর্কচূড়ামণির নাম শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত তিনি গমন করেন। চূড়ামণি মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইয়া রামকৃষ্ণদেব বলিয়াছিলেন যে, ‘হ্যাঁগা, তুমি যে ধর্মপ্রচার করিতেছ, তোমার চাপরাশ আছে?’ চূড়ামণি মহাশয় কোন উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। ঠাকুর পুনরায় কহিলেন – ‘দেখ, যখন রাস্তায় অনেক লোক গোলমাল করে, তখন পাহারাওয়ালা আসিবা মাত্র সকলে সরিয়া পড়ে। লোকে কেন সরিয়া যায়? … তাঁহার যে চাপরাশ আছে। … সেইরূপ ভগবানের আদেশ বা ইচ্ছা না হইলে কেহ কখন লোকের মন হরণ করিতে পারে না।’ …” রাম দত্তের উক্ত লেখার প্রতিবাদ করে ‘শশধর তর্কচূড়ামণি’ তখন লিখেছিলেন, “রামকৃষ্ণের সহিত আমার অনেক দিনই দেখা সাক্ষাৎ হইয়াছে। প্রথমে তিনি আমার কলিকাতার বাসায় গিয়াছিলেন। তৎপর আমিও তাঁহার নিকট গিয়াছিলাম। শেষে তিনিও মধ্যে মধ্যে আসিতেন, আমিও মধ্যে মধ্যে তাঁহার নিকট যাইতাম। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা করিতে তোমার কোন চাপরাশ আছে কিনা, আমাকে এতটুকু জিজ্ঞাসা করিবার অধিকার আমি তাঁহাকে দিই নাই। সুতরাং ঐভাবে আমাকে ঐকথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন না এবং তিনি করেনও নাই। তিনি যে লেখাপড়া কিছু জানিতেন না এবং শাস্ত্রও পড়েন নাই, এ বিষয়ে তিনি বেশ ধারণা রাখিতেন, এবং আমি যে তখন ২৫/৩০ বৎসর পর্যন্ত যথাশক্তি শাস্ত্রের অনুশীলন করিয়াছি, তাহাও তিনি জানিতেন। আমাকে তিনি নিতান্ত অপাত্র বা তাঁহার অনুচরগণের একতম বলিয়াও মনে করিতেন না। কাজেই আমাকে ঐরূপ প্রশ্ন করা তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর নহে।” (সাহিত্য পত্রিকা, পৌষ-মাঘ, ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) এখন তর্কচূড়ামণির উপরোক্ত কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে রাম দত্তের রামকৃষ্ণ বিষয়ক ঐ লেখাকে আর সত্যি বলে গ্রহণ করা যায় না। তবে তর্কচূড়ামণির উপরোক্ত কথাকে অসত্য বলে মনে করারও কোন কারণ দেখা যায় না। কারণ, ‘ভূধর চট্টোপাধ্যায়’ নামে রামকৃষ্ণের আরেক ভক্ত, যিনি রামকৃষ্ণ-তর্কচুড়ামণির সেই প্রথম সাক্ষাতের সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন (রাম দত্ত নিজে কিন্তু সেখানে উপস্থিত ছিলেন না), ওই প্রসঙ্গে তিনিও যা লিখেছিলেন, তাতে “তোমার চাপরাশ আছে?” – এই ধরণের কোন কথাই কিন্তু পাওয়া যায় না। বরং রামকৃষ্ণের আরাধ্যা দেবী স্বয়ং দেবী কালীই তাঁর প্রিয় ছেলে শশধরের কাছে রামকৃষ্ণকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বলে তিনি নিজের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। ভূধর চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “একদিন আচার্যদেব (অর্থাৎ তর্কচূড়ামণি মহাশয়) তাঁহার কলিকাতায় আপন ভবনে বহুতর ধর্মপিপাসু শ্রোতৃবর্গে পরিবেষ্টিত হইয়া নানা বিষয়ে আলোচনা করিতেছেন, এমন সময়ে অকস্মাৎ পরমহংসদেব একজন শিষ্যসহ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমরাও সেই সময় তথায় উপস্থিত ছিলাম। আচার্যদেব ইতিপূর্বে তাঁহাকে কখন দেখেন নাই। … পরমহংসদেব তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন – ‘ভাই শশধর, দেখ, আজ মায়ের কাছে বসিয়া আছি, এমন সময় মা আমায় বলিলেন যে, হ্যারে রামকৃষ্ণ, আমার শশধরের সঙ্গে তুই একবার দেখা করলি নি? সেও যে আমার প্রিয় ছেলে। আজ তাঁহার কাছে যা। গিয়ে দেখা করে আয় গে। মা বললেন, আর থাকিতে পারিলাম না। অনেক দিন আসিব আসিব করিতে ছিলাম, আজ তা হইয়া গেল।’ …” (বেদব্যাস পত্রিকা, ১০ম সংখ্যা, ১২৯৪ বঙ্গাব্দ) রামকৃষ্ণ-তর্কচূড়মণির প্রথম সাক্ষাতের সেই বিবরণই ভূধর চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘সাধু দর্শন’ গ্রন্থেও অবিকল তুলে ধরেছিলেন। এখানে একথা বলা বাহুল্য যে, ভূধরের উপরোক্ত লেখার মধ্যে রামকৃষ্ণের যে মায়ের কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবতারিণী বা কালী। এই আলোচনা থেকে রাম দত্ত বর্ণিত রামকৃষ্ণ-তর্কচূড়ামণি বিষয়ক কথাটিকে অসত্য বলেই অনুমান করাই স্বাভাবিক ব্যাপার। রাম দত্ত তাঁর ‘পরমহংস দেবের জীবন বৃত্তান্ত’ গ্রন্থে রামকৃষ্ণের গলায় অসুখের সময়ে, রামকৃষ্ণের সঙ্গে তর্কচূড়ামণির সাক্ষাৎকার ও কথাবার্তার বর্ণনা দিয়েছিলেন। কিন্তু রাম দত্ত তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-তর্কচূড়ামণির ঐ সময়কার কথোপকথন নিয়ে যা লিখেছিলেন, সেটা ঠিক নয় বলে তর্কচূড়ামণি সেটার প্রতিবাদও করেছিলেন। (সাহিত্য পত্রিকা, পৌষ-মাঘ, ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) অতএব যে রাম দত্ত যখন তর্কচূড়ামণি সম্বন্ধে ওই ধরণের কাল্পনিক কাহিনী লিখতে পারেন, সেক্ষেত্রে তিনি যে বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধেও কোন বানানো কাহিনী লিখতে পারবেন না, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এখন কেউ কথা তুলতে পারেন যে, তর্কচূড়ামণির ব্যাপারে রাম দত্তের লেখায় কল্পনা থাকলেও বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কীয় লেখাটিতে কল্পনা নাও তো থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, থাকতেও তো পারে। তাছাড়া রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাতের কথাটা নিয়ে আরো কিছু সন্দেহের কারণ রয়েছে।
প্রথমতঃ, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর অসংখ্য লেখার কোথাও রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে কোনদিন একটি কথাও লেখেন নি। অথচ তাঁরা দু’জনে কিন্তু সমসাময়িক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, রামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্র অপেক্ষা বছর দেড়েকের বড় ছিলেন।
দ্বিতীয়তঃ, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সমসাময়িক বহু সাহিত্যিক ও সাহিত্য রসিকের কাছে তাঁর নিজের জীবনের কথা, এবং সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। তাঁরা তাঁদের স্মৃতিকথায় বঙ্কিমচন্দ্রের বলা সেসব কথা লিখে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই বঙ্কিমচন্দ্রের মুখ থেকে রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা শুনেছিলেন, এমন কোন বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না।
তৃতীয়তঃ, শশধর তর্কচূড়ামণির সঙ্গে রামকৃষ্ণের যে সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেটার বিবরণ ‘কেশবচন্দ্র সেন’ সম্পাদিত ‘দি ইণ্ডিয়ান মিরার’ কাগজে ১৮৮৪ সালের ২৬শে জুলাই তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। এর আগে রামকৃষ্ণ যখন ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’কে দেখতে গিয়েছিলেন, সেই সংবাদ ১৮৮১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর তারিখের ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায়, এবং একই বছরের ১১ই ডিসেম্বর তারিখের ‘দি ইণ্ডিযান মিরার’ কাগজেও প্রকাশিত হয়েছিল। আবার রামকৃষ্ণ যখন ‘বিদ্যাসাগর’কে দেখতে গিয়েছিলেন, সেই খবরও তখনকার ‘দি নিউ ডিসপেনসেশন’ কাগজে ১৮৮২ সালের ৩রা জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরে ‘রেভারেণ্ড যোসেফ কুক’, ‘মিস পিগট’ প্রভৃতি দক্ষিণেশ্বরে বামকৃষ্ণকে দেখতে গেলে, সেই খবর ১৮৮২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি তারিখের ‘দি নিউ ডিসপেনসেশন’ কাগজে বের হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্ৰ তাঁর শেষ বয়সে উপরোক্ত কারোর চেয়েই অখ্যাত ছিলেন না। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে রামকৃষ্ণের কোন সাক্ষাৎ ঘটলে, সেই খবর তখনকার ‘দি ইণ্ডিয়ান মিরার’ প্রভৃতি যে কোনও কাগজে অবশ্যই প্রকাশিত হ’ত। আর এই কারণেই সেই সংবাদ প্রকাশে কোন বাধা ছিল না যে, ঐ সব কাগজের কর্তৃপক্ষের কারোর সঙ্গেই বঙ্কিমচন্দ্রের কোন ধরণের অসদ্ভাব ছিল না। বরং কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে তাঁর রীতিমতো বন্ধুত্বের সম্পর্কই ছিল।

চতুর্থতঃ, শ্রীম তাঁর গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়েছিল। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র কেবল ‘ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত’ ছিলেন। এরও ৮ বছর আগে তিনি যখন শুধুই একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন, তখন তিনি ঠিক কি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, সেটার একটা পরিষ্কার ছবি ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ লেখা থেকে পাওয়া যায়। ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘কলেজ রি-ইউনিয়ন’ নামক ছাত্রদের একটি বার্ষিক উৎসব সভায় রবীন্দ্রনাথ প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রকে দেখেছিলেন। সেদিনের কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বঙ্কিমবাবুর খড়্গ নাসায়, তাঁহার চাপা ঠোঁটে, তাঁহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভারি একটা প্রবলতার লক্ষণ ছিল। বক্ষের উপর দুই হাত বদ্ধ করিয়া তিনি যেন সকলের নিকট হইতে পৃথক হইয়া চলিতে ছিলেন, কাহারও সঙ্গে যেন তাঁহার কিছু মাত্র গা-ঘেঁষাঘেষি ছিল না। এইটেই সর্বাপেক্ষা বেশি করিয়া আমার চোখে ঠেকিয়া ছিল। তাঁহার যে কেবল মাত্র বুদ্ধিশালী মননশীল লেখকের ভাব, তাহা নহে, তাঁহার কপালে যেন একটি অদৃশ্য রাজতিলক পরানো ছিল। এইখানে একটা ছোট ঘটনা ঘটিল। তাহার ছবিটি আমার মনে মুদ্রিত হইয়া গিয়াছে। একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত স্বদেশ সম্বন্ধে তাঁহার কয়েকটি স্বরচিত শ্লোক পড়িয়া শ্রোতাদের কাছে তাহার বাঙ্গলা ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিমবাবু ঘরে ঢুকিয়া এক প্রান্তে দাঁড়াইলেন। পণ্ডিতের কবিতার একস্থলে অশ্লীল নহে, কিন্তু ইতর একটি উপমা ছিল। পণ্ডিত মহাশয় যেমন সেইটিকে ব্যাখ্যা করিতে আরম্ভ করিলেন, অমনি বঙ্কিমবাবু হাত দিয়া মুখ চাপিয়া তাড়াতাড়ি সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। দরজার কাছ হইতে তাঁহার সেই দৌড়িয়া পালানোর দৃশটা যেন আমি চোখে দেখিতে পাইতেছি।” (জীবনস্মৃতি) ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই মে তারিখের ‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকা রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে লিখেছিল, “রামকৃষ্ণ লেখাপড়া শিক্ষা করেন নাই। লেখাপড়া শিখিলে পৌরোহিত্য ব্যবসা করিতে হইবে, এই ভয়ে সেদিকে কখন যাইতে চাহিতেন না। … অনেক ভাল ভাল গভীর ধর্মকথা তাঁহার মুখে শুনিতে পাওযা যায়, কোন কোন দৃষ্টান্ত কথা যদিও আমাদের কর্ণে অতি অশ্লীল এবং কুৎসিত ভাবব্যঞ্জক বোধ হয়, কিন্তু তাঁহার চরিত্রে কোন মন্দ ভাব না থাকায় সে সকল তিনি অম্লান বদনে বলিয়া থাকেন। তিনি বলেন, শরীরের সকল অঙ্গই সমান, তাহার মধ্যে মন্দ কি আছে। আবশ্যক হইলে দুই একটি গালাগালিও দিয়া থাকেন, কিন্তু তাহা শুনিতে তত কটূ বোধ হয় না। ধর্মবিষয়ে মতামত তাঁহার যাহাই হউক, তিনি একজন সরল সাধক ও প্রেমিক ভক্ত।” ‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকা রামকৃষ্ণের জীবদ্দশাতেই তাঁর মৃত্যুর ১১ বছর আগে তাঁর সম্বন্ধে উপরোক্ত কথাগুলি বলেছিল। রামকৃষ্ণ ঠিক কি ধরণের ‘অশ্লীল’ কথা বলতেন, সেটার একটা উদাহরণ, তাঁর পার্ষদ ও শিষ্যর লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। স্বামী সারদানন্দ তাঁর ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “স্ত্রী শরীরের বিশেষ গোপনীয় অঙ্গ, যাহার নাম মাত্রেই সভ্যতাভিমানী জুয়াচোর আমাদের মনে কুৎসিত ভোগের ভাবই উদিত হয় বা ঐরূপ ভাব উদিত হইবে নিশ্চিত জানিয়া আমাদের ভিতর শিষ্ট যাঁহারা, তাঁহারা ‘অশ্লীল’ বলিয়া কর্ণে অঙ্গুলি প্রদান পূর্বক পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করেন, সেই অঙ্গের নাম করিতে করিতেই এ অদ্ভূত ঠাকুরকে কতদিন না সমাধিস্থ হইয়া পড়িতে দেখিয়াছি।” (লীলাপ্রসঙ্গ, গুরুভাব, উত্তরার্ধ, পৃ- ৭১) রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করা পূর্বোক্ত লেখা এবং স্বামী সারদানন্দের উপরোক্ত লেখাটি পর পর পড়লে, বঙ্কিমচন্দ্র আদৌ রামকৃষ্ণকে কখনো দেখবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে তো মনে হয় না। শ্রীম লিখেছিলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – … শিবলিঙ্গ বোধে নিজের লিঙ্গ পূজা করিতাম। জীবন্ত লিঙ্গ পূজা। একটা আবার মুক্তা পরানো হতো। এখন আর পারি না।” (রামকৃষ্ণ কথামৃত, ৪র্থ ভাগ, পঞ্চদশ খণ্ড, ২য় পরিচ্ছেদ) এরপরে শ্রীম আরো লিখেছিলেন, “(শ্রীরামকৄষ্ণের ব্রহ্মযোনি দর্শন) স্বয়ং কৃষ্ণ রাধাযন্ত্র নিয়ে অনেক সাধন করেছিলেন। যন্ত্র ব্রহ্মযোনি – তারই পূজা ধ্যান। এই ব্ৰহ্মযোনি থেকে কোটী কোটী ব্রহ্মাণ্ড উৎপত্তি হচ্ছে অতি গুহ্য কথা। বেলতলায় দর্শন হতো – লক, লক, করতো। … বেলতলায় অনেক তন্ত্রের সাধন হয়েছিল। … সেই অবস্থায় ছেলেদের ধন ফুলচন্দন দিয়ে পূজো না করলে থাকতে পারতাম না।” (রামকৃষ্ণ কথামৃত, ৪র্থ ভাগ, ২৩তম খণ্ড, ৯ম পরিচ্ছেদ) ওদিকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থের বিংশতিতম অধ্যায়ের এক জায়গায় প্রসঙ্গতঃ ভাগবতের ২য় স্কন্দের ৩য় অধ্যায়ের ২০নং থেকে ২৪ নং শ্লোক উদ্ধৃত করেছিলেন। সেই উদ্ধৃতির ২২নং শ্লোকের প্রথম পংক্তিটি ছিল – “বর্হায়িতে তে নয়নে নরানাং লিঙ্গানি বিষ্ণোর্ন নিরীক্ষতো যে।” অপরের লেখা থেকে বঙ্কিমচন্দ্র উক্ত শ্লোকটির যে অর্থ উদ্ধৃত করেছিলেন, সেটি হল – “মনুষ্যদিগের চক্ষুদ্বয় যদি বিষ্ণুমূর্তি নিরীক্ষণ না করে, তবে তাহা ময়ূরপুচ্ছ মাত্র।” বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সেই উদ্ধৃতির ‘বিষ্ণু মূর্তি’ শব্দটির পাশে তারকাচিহ্ন দিয়ে পাদ-টীকায় লিখেছিলেন, “এখানে ‘লিঙ্গানি বিষ্ণোঃ’ অর্থে বিষ্ণুর মূর্তি সকল। অতি সঙ্গত অর্থ। তবে শিবলিঙ্গের কেবল সেই অর্থ না করিয়া কদর্য উপন্যাস ও উপাসনা পদ্ধতিতে যাই কেন?” তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বঙ্কিমচন্দ্র শিবলিঙ্গ অর্থে বিষ্ণুমূর্তির মত শিবমূর্তিকেও চেয়েছিলেন, এবং প্রচলিত শিবলিঙ্গ পূজার কাহিনীকে ও শিবলিঙ্গ পূজাকে ‘কদৰ্য উপন্যাস ও উপাসনা পদ্ধতি’ বলেছিলেন। যে বঙ্কিমচন্দ্র শিবলিঙ্গ পূজাকেই ‘কদর্য উপাসনা পদ্ধতি’ বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ কর্তৃক শিবলিঙ্গ বোধে এবং জীবস্ত লিঙ্গপূজা বোধে নিজের লিঙ্গ পূজা এবং ফুলচন্দন দিয়ে ছেলেদের ‘ধন’ পুজোর কথা শুনলে সেই বঙ্কিমচন্দ্র সেটাকেও যে ‘কদর্য উপাসনা পদ্ধতি’ বলতেন, সেবিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে কি? শ্রীমের লেখা অনুযাযী, রামকৃষ্ণ যে ‘রাধাযন্ত্র’ ‘ব্রহ্মযোনি’ ইত্যাদির কথা বলতেন, বঙ্কিমচন্দ্র সেসবেও কদাপি বিশ্বাস করতেন না। শ্রীম লিখেছিলেন, রামকৃষ্ণ বলতেন, “স্বয়ং কৃষ্ণ রাধাযন্ত্র নিয়ে অনেক সাধন করেছিলেন।” কেউ যদি বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থটি পড়েন, তাহলে তিনি জানতে পারবেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র ‘রাধাতত্ত্ব’ বা ‘ব্রজগোপীতত্ত্বে’ আদৌ কোনদিন বিশ্বাসী ছিলেন না। সে সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, “আমি ভূরি ভূরি প্রমাণের দ্বারা বুঝিয়াছি যে, এ সকল পুরাণকার কল্পিত উপন্যাস মাত্র, ইহার মধ্যে কিছু সত্যতা নাই।” রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ব্রহ্মযোনি থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি হচ্ছে। তিনি বেলতলায় সেই ব্রহ্মযোনি লক্ লক্ করতে দেখেছিলেন। ওদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিজ্ঞান রহস্য’ বইটি পড়লে দেখা যায় যে, তিনি কি গভীর ভাবে বিজ্ঞান শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তাই ওসব ব্যাপারে তিনি কোন ধরণের অন্ধ বিশ্বাসে চালিত না হয়ে, যুক্তি ও বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তার দ্বারাই চালিত হতেন। সে জন্যই তিনি তাঁর ‘বিজ্ঞান রহস্য’ গ্রন্থের ‘কতকাল মনুষ্য’ শিরোনামের প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছিলেন, “খ্রীষ্টানদিগের প্রাচীন গ্রন্থানুসারে মনুষ্যের সৃষ্টি এবং জগতের সৃষ্টি। … যেদিন জগদীশ্বর কুম্ভকাররূপে কাদা ছানিয়া পৃথিবী গড়িয়া ছয়দিনে তাহাতে মনুষ্যাদি পুত্তল সাজাইয়াছিলেন। খ্রীষ্টানেরা অনুমান করেন যে. সে ছয় সহস্র বৎসর পূর্বে। একথা খ্রীষ্টানেরাও আর বিশ্বাস করেন না। আমাদিগের ধর্মপুস্তকের কথার প্রতি আমরাও সেইরূপ হতশ্রদ্ধ হইয়াছি। বিজ্ঞানের প্রবাহে সর্বত্রই ধর্মপুস্তক সকল ভাসিয়া যাইতেছে।” এখন কথা হচ্ছে যে, বঙ্কিমচন্দ্র রামকৃষ্ণের ঐ ধরণের পূজা পদ্ধতির কথা বা তাঁর মুখ থেকে ‘অশ্লীল’ কথা বেরোয়, সেই ধরণের কোন শুনেছিলেন কি না? এটা খুবই স্বাভাবিক যে, বঙ্কিমচন্দ্র সেই সময়ের লোকমুখে রামকৃষ্ণের কথা এবং তিনি কি বলতেন ও কি করতেন, সেসব হয়ত শুনেছিলেন। কেননা বঙ্কিমচন্দ্র হাওড়া ও আলিপুরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট পদে নিযুক্ত থাকাকালীন কয়েক বছর ধরে কলকাতাতেই ছিলেন। কলকাতা থেকে দক্ষিণেশ্বর বেশী দূর নয়। কলকাতা থেকে অনেক লোকই তখন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে, এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ রামকৃষ্ণের কাছেও যেতেন। অতএব যে রামকৃষ্ণ বেলতলায় ব্রহ্মযোনি দর্শন হয়েছিল ইত্যাদি বলেছিলেন, তাঁকে দেখবার জন্য যুক্তিবাদী, বিজ্ঞান-ভিত্তিক চিন্তায় চিন্তিত, পণ্ডিতাগ্রগণ্য ও নীতিবাগীশ বঙ্কিমচন্দ্র গিয়েছিলেন, এটা নিতান্ত অসম্ভব বলেই মনে হয়।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ‘সরল সাধক’ পরমহংস দেব আপন সাধন পদ্ধতিতে কোন এক সময়ে লিঙ্গপূজা করে থাকলে, বা নিজের নির্মল মনে, সেই সময়ের মানুষের কানে ‘অশ্লীল’ শোনায় এমন কোন কথা কখনও উচ্চারণ করে থাকলেও, তিনি তো অন্য সকল সময়ে ভাল কথা বা ধর্ম কথাই বলতেন, এবং নিজের গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে দেব-দেবীর উপাসনাও করতেন। অতএব সেই সময়ে বা সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাতে কোথায় বাধা ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রভৃতির সঙ্গে পরমহংস দেবের সাক্ষাতের কথা কাগজে প্রকাশিত হলেও, রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষাতের কথা প্রকাশিত হয়নি কেন? কারণ, অক্ষয় সেন ও শ্রীমের লেখায় বলা হয়েছে যে, অধর সেনের বাড়িতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে এবং বেশ সমারোহের মধ্যেই তাঁদের উভয়ের মধ্যে নাকি সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটি ঘটেছিল। এই প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, শিকাগো ধর্ম-সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে ব্রাহ্ম-নেতা ‘প্রতাপচন্দ্র মজুমদার’ দেশে ফিরলে, হাওড়া স্টেশনে তাঁকে অভিনন্দন ও সম্বর্ধনা জানাবার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র সমুৎসুক হয়েছিলেন। অথচ সেই একই ব্যাপারে রামকৃষ্ণের প্রধান-শিষ্য ‘স্বামী বিবেকানন্দ’কে কোন অভিনন্দন জানানো তো দূরে থাক, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সম্বন্ধে কোথাও একটা কথাও বলেন নি। তাই এথেকেও বলা যেতে পারে যে, বাস্তবে রামকৃষ্ণের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের কোন আকর্ষণ‍ই ছিল না।

পঞ্চমতঃ, রাম দত্ত প্রভৃতি যে অধর সেনের বাড়িতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের দেখা হয়েছিল বলে লিখেছিলেন, সম্ভবতঃ সেই অধর সেনের সঙ্গে হয়ত বঙ্কিমচন্দ্রের কোন ধরণের সাক্ষাৎ পরিচয়ই ছিল না। শ্রীম লিখেছিলেন যে, অধর সেন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। তিনি বন্ধু ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন রামকৃষ্ণকে দেখাবার জন্য। অধর সেন ও বঙ্কিমচন্দ্র উভয়েই যে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন, একথা সত্যি। কিন্তু তাই বলে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব তো ছিলই না, এমন কি তাঁদের উভয়ের মধ্যে কোনদিন পরিচয়েরও সুযোগ হয়নি বলেই মনে হয়। ‘দীনবন্ধু মিত্র’, ‘জগদীশনাথ রায়’ প্রমুখ দু’-এক জন ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনে আর কোন বন্ধুই ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ লিখেছিলেন, “আমরা তাঁহার কি ছিলাম? যাঁহারা বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে থাকিতেন, তাঁহারা বঙ্কিমচন্দ্রকে কিভাবে দেখিতেন, তাহা প্রকাশ করিয়া বলা যায় না। তাঁহাকে সখা বলিবেন, সে স্পর্ধা কেহ রাখিতেন না।” (বঙ্কিম প্রসঙ্গ) অধর সেন বঙ্কিমচন্দ্র অপেক্ষা বয়সে ১৭/১৮ বছরের ছোট ছিলেন। অধর সেন ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম ৭ম শ্রেণীর ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হয়ে চট্টগ্রামে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে ঐ চাকরিরই ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উন্নীত হয়ে তিনি যশোহরে গিয়েছিলেন। এরপরে ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ঐ ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে থেকেই কলকাতায় কালেক্টরের অধীনে এসে কাজ করতে শুরু করেছিলেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে থেকেই তিনি কলকাতায় কাজ করেছিলেন। শ্রীম লিখেছিলেন যে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর শনিবার কৃষ্ণা চতুর্থী তিথিতে অধর সেনের বাড়ীতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিন্তু অক্ষয় সেন তাঁর গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, সেদিন কৃষ্ণা চতুর্থী তিথি ছিল না, সেদিন অমাবস্যা তিথি ছিল। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অধর সেন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে থেকে কলকাতার কালেক্টরের অধীনে কাজ করছিলেন, এবং মাসিক ৩০০ টাকা মাইনা পাচ্ছিলেন; ওদিকে বঙ্কিমচন্দ্র সেই একই সময়ে ১ম শ্রেণীর ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হয়ে হাওড়ায় ছিলেন, এবং ৮০০ টাকা মাইনা পাচ্ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সংশোধিত সরকারি উচ্চ চাকুরেদের ‘সিভিল লিষ্ট’ থেকে জানা যায় যে, ঐ সময়ে বঙ্গদেশে ১ম শ্রেণীর ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেকটর ছিলেন ৭ জন, ২য় শ্রেণীর ছিলেন ১১ জন, ৩য় শ্রেণীর ২০ জন, ৪র্থ শ্রেণীর ৪১ জন, ৫ম শ্রেণীর ৭২ জন, ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ৬১ জন, এবং ৭ম শ্রেণীর ৩৮ জন। তাঁরা ছাড়া ‘প্রবেশনারী’ বা ‘অফিসিয়েটিং অফিসার’ ছিলেন ৩১ জন, ‘স্পেশ্যাল ডেপুটি কালেক্টর’ ছিলেন ১৪ জন, এবং বিভিন্ন গ্রেডের সাব ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টরও সংখ্যায় প্রচুর ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র সেই সময়ে ওই শত শত দেশীয় ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরদের, এমন কি বহু সাহেব ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটেরও উপরে পদাসীন ছিলেন। ঐ সময়ে বঙ্গদেশে প্রথম শ্রেণীর যে ৭ জন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন, তাঁদের প্রথম ৫ জনই ইউরোপীয় ছিলেন, তাঁদের পরেই ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাই সেই সময়ের একজন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর নবীন কর্মচারীর সঙ্গে একজন ১ম শ্রেণীর প্রবীণ কর্ চারীর, তাও আবার বঙ্কিমচন্দ্রের মত গভীর ও রাসভারী প্রকৃতির মানুষের কি করে যে বন্ধুত্ব হতে পারে, সেটা সত্যিই রহস্যময়। তখন ওই ধরণের কোন বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, তখন একজন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর কর্মচারী একজন ১ম শ্রেণীর কর্মচারীর সামনে যেতেই সাহস পেতেন না। আর গেলেও, ‘স্যার’ ‘স্যার’ করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। সরকারি চাকরিতে ঐ গ্রেডের বা শ্রেণীর বিরাট পার্থক্য থাকলেও, তাঁদের উভয়ে যদি কখনও একই জায়গায় কাজ করতেন, তাহলেও তাঁদের মধ্যে অন্ততঃ পরিচয় হতে পারত। কিন্তু তাঁদের উভয়েই কখনোই এক জায়গায় কাজ করেন নি। অধর সেন ১৮৭৯ থেকে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম, যশোহর ও কলকাতায় কাজ করেছিলেন; আর বঙ্কিমচন্দ্র ঐ সময়ে হুগলী, হাওড়া, কলকাতা (অস্থায়ী আসিষ্ট্যান্ট সেক্রেটারি), আলিপুর. বারাসত, আলিপুর, জাজপুর ও হাওড়ায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। অতএব এটা থেকেও অনুমান করা যেতে পারে যে, তাঁদের উভয়ের মধ্যে কখনো কোন পরিচয়ই ছিল না। তবে অধর সেন তাঁর কর্ম-জীবনে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হলেও, তিনি একই সাথে একজন কবিও ছিলেন। নিজের দু’-একটা কবিতার বইও তিনি লিখেছিলেন। তাহলে সেই সাহিত্য সূত্রেই কি বঙ্কিমচত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল? ‘সাহিত্যিক’ হলেই তখন যে সকলেই বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে পাত্তা পেতেন, সেটা মোটেও নয়। তিনি সাহিত্য নিয়ে কারো ছেলেখেলাকে আদৌ বরদাস্ত করতেন না। এই প্রসঙ্গে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্রের কথা স্মরণ করলে জানা যায় যে, তিনি তাঁর সময়ের অক্ষম সাহিত্যিকদের কখনও ক্ষমা করেন নি, বা তাঁদের প্রতি কোন কৃপাও দেখান নি। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শনের’ তৃতীয় বছরের ৪র্থ সংখ্যায় (১২৮১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাস) দেখা যায় যে, অধরলাল সেনের ‘ললিতা সুন্দরী’ (১ম সর্গ) নামক একটি কবিতার বইয়ের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শনে উক্ত বইটির সমালোচনা প্রকাশিত হলেও, ওই লেখাটি যে আদতে বঙ্কিমচন্দ্রেরই ছিল, সেটা সঠিকভাবে বলা যায় না। কেন না, এখনও কোন কোন মাসিক পত্রিকায় কোন নতুন গ্রন্থের সমালোচনা সেই পত্রিকার সম্পাদকের চেয়ে অন্য লোকই বেশী করে থাকেন। তবে ওই লেখাটি যাঁরই হোক না কেন, তাতে কিন্তু অধর সেনের মোটেই কোন প্রশংসা করা হয় নি। বরং তাঁকে তিরস্কৃতই করা হয়েছিল। তাই ওই লেখাটিকে বঙ্কিমচন্দ্রের বলে ধরলেও, সেই লেখা থেকে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, যেটা থেকে বলা চলে যে অধর সেনকে বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিগতভাবে ভাবে চিনতেন। এরপরে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শনে অধর সেনের নাম আর কোথাও পাওয়া যায় না। পরে অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের মেজদা ‘সঞ্জীবচন্দ্রের’ সম্পাদিত বঙ্গদর্শনে (সঞ্জীবচন্দ্র ঐ সময়ে বঙ্গদর্শনের মালিকও ছিলেন) ১২৮৫ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় অধর সেনের ‘নলিনী’ কাব্যগ্রন্থের একটি অতি ছোট্ট সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে অবশ্য তাঁর কিছু প্রশংসা ও কিছু নিন্দা – উভয়ই ছিল। যাই হোক, বঙ্কিমচন্দ্র যে ধরণের গম্ভীর ও রাসভারী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, এবং অপরের রচনা সম্পর্কে তিনি যে ধরণের তীব্র ও নিরপেক্ষ সমালোচক ছিলেন, তাতে তরুণ বয়স্ক এবং সাহিত্যে ঐ ধরণের অল্প প্রতিভা-সম্পন্ন অধর সেন পরে যে সাহিত্য সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে গিয়েছিলেন, তা অন্ততঃ মনে হয় না। এমনকি সেই সময়ের কারো লেখা থেকেও সেই ধরণের কোন কথা জানা যায় না। অতএব অধর সেনের সাহিত্য জীবন এবং ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট জীবন উভয়ই আলোচনা করে এখন একথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে, অধর সেনের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, হয়ত কোন পরিচয়ই ছিল না।
(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

বই নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে নিনবই নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে নিন

আসুন বই নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে নেই ————————————————————— ১.হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে ৪ খানা বই আছে যা মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা। ২.মাথা পিছু বই পাঠের দিকে শীর্ষে হলো আইসল্যান্ড।

স্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দস্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দ

রানা চক্রবর্তীঃ ‘রোমাঁ রোলাঁ’ শ্রীঅরবিন্দকে ‘নব ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। (Prophets of the New India) ‘বুদ্ধিজীবী’ বলতে যদি তাঁদেরই বোঝায় যাঁরা নিজেদের ‘বুদ্ধি’ ও ‘প্রজ্ঞা’ দিয়ে জগৎকে বুঝতে

লেখাপড়া করে যে……..‌লেখাপড়া করে যে……..‌

স্বপন সেনঃ “লেখাপড়া করে যে,গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে”….! আচ্ছা বলুনতো কে লিখেছেন এই পংক্তিটি… ? বাংলা ভাষায় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী পড়ার বই প্রথম রচনা করেন ইনি। তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’ গ্রন্থটি

রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ রামচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমের জীবিতাবস্থাতেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দে) তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষ্যাতের ঘটনাটি লিখেছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাঁর লেখা যখন সঠিক