‘কররানি বংশের কথা’ - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘কররানি বংশের কথা’

‘কররানি বংশের কথা’


রানা চক্রবর্তীঃ আফগানিস্থানের ‘কুরম’ উপত্যকার অধিবাসী কররানিরা অন্য সব আফগানের মত হিন্দুস্থানে এসে প্রথমদিকে বিভিন্ন হিন্দু রাজা ও তুর্কী সুলতানের সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতেন। তুর্কীদের পতনের পরে ‘বহলোল লোদী’ যখন দিল্লীতে প্রথম আফগান রাজ্য সংগঠিত করেছিলেন, কররানিরা তাতে বিশিষ্ট ভূমিকার অভিনয় করেছিলেন। ইতিহাসের ক্রমানুসারে তারপর এসেছিল বাবরের ভারত অভিযান ও শের শাহের অভ্যুদয়। ‘তাজ খাঁ কররানি’ শেরের সৈন্যবাহিনীর এক উচ্চস্তরের অফিসার ছিলেন। তাঁর সাফল্যের ফলেই কররানিদের উন্নতির শুরু হয়েছিল। তাঁর তিন পুত্র – ‘ইসাদ’, ‘সোলেমান’ ও ‘ইলিয়াস’ – গঙ্গাতীরে তিনটি জায়গীর লাভ করে নিজেদের আরো উন্নতির জন্য চেষ্টা করতে শুরু করেছিলেন। আশপাশের গ্রামগুলি লুণ্ঠন ও সরকারী অর্থ আত্মসাৎ করে তাঁরা সকলেই নিজেদের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন, এবং দিল্লীশ্বর ‘আদিল শাহের’ সময়ে তাঁদের প্রত্যেকে এক একজন স্বাধীন সুলতানের মত আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের সবার মন্ত্রণাদাতা ছিলেন জ্যেষ্ঠাগ্রজ ‘তাজ খাঁ’। একটা সময়ে তিন কররানি আমীরের সেই বাড়াবাড়িতে স্তম্ভিত হয়ে আদিল শাহের রিজেন্ট ‘হিমু’ সসৈন্যে এসে তাঁদের সামরিক ও আর্থিক শক্তিকে চুরছমার করে দিলেও, তাজ ও সোলেমান নিজেদের সমস্ত সম্পদ নিয়ে গৌড়ে পালিয়ে যেতে সফল হয়েছিলেন। গৌড়ে তখন যে বিশৃঙ্খলা চলছিল, সেটা থেকে লাভবান হওয়ার আশায় সোলেমান সুলতান ‘গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ’র পক্ষ অবলম্বন করে মোঘল সেনাপতি ‘খান-ই-জাহানের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিহারের শাসনকর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন। এরপরে পাটনায় যখন তাঁর কাছে খবর গিয়েছিল যে, গৌড় প্রাসাদে পর পর দুটি গুপ্তহত্যার পরে একজন নতুন সুলতান ‘গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর’ মসনদে আরোহণ করেছেন, তখন তিনি দাদা তাজ খাঁকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই তৃতীয় গিয়াসুদ্দীনকে হত্যা করে তাজ খাঁ গৌড়, বঙ্গ ও বিহারের উপরে কররানি বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন (১৫৬৩ খৃষ্টাব্দ)।
কিন্তু মসনদে আরোহণের এক বছর পরেই তাজ খাঁর মৃত্যু হওয়ার জন্য সুলেমান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। এর আগে গৌড় নগরীর অপর পারে অবস্থিত ‘তাড়া’ নামক জায়গাটি তাঁর নিজস্ব জায়গীর ছিল, সেখান থেকেই তাঁর উন্নতির সূত্রপাত ঘটেছিল। সেই ক্ষুদ্র জায়গাকে নিজের সৌভাগ্যের সূচক বলে মনে করে তিনি গৌড় থেকে নিজের রাজধানী সেখানেই স্থানান্তরিত করেছিলেন। এরপরেই তিনি হিন্দুস্থানের সব আফগান অধিবাসীদের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠেছিলেন। পনেরো বছর ধরে অজ্ঞাতবাসে কাটিয়ে হুমায়ুন ভারতে ফিরে এসে অযোধ্যা পর্য্যন্ত সমগ্র ভূভাগের উপরে নিজের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার পরে যেখানে যত আফগান ছিলেন, সবাই গৌড়-বঙ্গে পালিয়ে এসে সুলেমানের কাছেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই আগে শের শাহের সৈন্যবাহিনীতে অফিসার ছিলেন বলে তাঁদের আগমনে সুলেমানের সামরিক বল যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। বিচক্ষণ রাজনীতিক ‘লুদি খাঁ’কে নিজের উজীর নিযুক্ত করে তিনি নবগঠিত রাজ্যের সংহতি বিধানে মন দিয়েছিলেন। মোঘলদের শক্তি যে কি প্রচণ্ড, সেটা বুঝতে পেরে লুদি খাঁ সব আফগান সর্দারদের ডেকে বলেছিলেন, “আগের মত নিজেদের মধ্যে আর কলহ কোরো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালিও না। তাতে মোঘলদের সুবিধা হবে। সারা হিন্দুস্থান থেকে বিতাড়িত হয়ে এই যে আশ্রয়টুকু পেয়েছ, সেটা থেকেও চ্যূত হয়ে পথে পথে ঘুরবে। তাই হুঁশিয়ার!” লুদি খাঁর সেই পরামর্শে আফগানেরা সর্বসম্মতক্রমে সুলেমান কররানিকে নিজেদের নেতা বলে মেনে নিয়ে একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়েছিলেন। সুলেমানও তাঁদের সকলকে মর্য্যাদানুযায়ী জায়গীর বা ফৌজী কাজ প্ৰদান করে নিজের আত্মপ্রসারে মন দিয়েছিলেন। কিন্তু আফগানদের অত উপদেশ দিয়েও লুদি খাঁ নিজে নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি। স্বজাতীয়দের হাড়ে হাড়ে তিনি চিনতেন। মোঘলরা যদি গৌড়ের দিকে এগিয়ে আসেন, তাহলে তাঁদের অনেককেই যে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এবং অনেকেই যে পিছন থেকে ছুরি চালাবেন, সেকথা বুঝতে পেরে তিনি সুলেমানকে মোগলদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলবার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই মোঘলবাহিনী গৌড়ে না এলেও সুলেমান তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাঁদের কাছে নিজের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁর রাজ্যের সর্বত্র আকবরের নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচার শুরু হয়েছিল। আকবরকে খুশী রাখবার জন্য তিনি মাঝে মাঝে দিল্লীতে মূল্যবান উপঢৌকনও পাঠাতেন। আকবর বা তাঁর রিজেন্ট বৈরাম খাঁ যে আফগানদের সেই ধূর্ততা বুঝতে পারেননি তা নয়, কিন্তু তাঁদের নিজেদেরই তখন বহু সমস্যা ছিল বলে তাঁরা সুলেমানের সেই মৌখিক আনুগত্যেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
ওদিকে উড়িষ্যার তখন মহা দুর্দিন চলছিল। অতীতে যে ‘গঙ্গা’ ও ‘গজপতি’ বংশ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তুর্কী আক্রমণ প্রতিহত করে রেখেছিলেন, তাঁরা তখন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিলেন। মহাবলশালী রাজা ‘প্রতাপরুদ্রের’ তিরোধানের পর থেকেই সেখানে যে হানাহানি ও প্রাসাদ চক্রান্ত শুরু হয়েছিল, সেটার একেবারে শেষ অধ্যায়ে ‘হরিচন্দন মুকুন্দদেব’ বিশ্বাসঘাতকতা করে সমগ্র উড়িষ্যা অধিকার করে নিয়েছিলেন। নিজের বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করলেও তিনি কিন্তু উড়িষ্যার পূর্ব গৌরবকে আর ফিরিয়ে আনতে পারেন নি। দিল্লীর শেষ আফগান সুলতান আদিল শাহের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ইব্রাহিম খাঁ শূর’ সব জায়গা থেকে বিতাড়িত হতে হতে শেষপর্যন্ত হরিচন্দন মুকুন্দদেবের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করেছিলেন। তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করে মুকুন্দদেব তাঁকে বসবাসের জন্য এক খণ্ড জমি ও ভরণপোষণের জন্য একটি ছোট জায়গীর প্রদান করেছিলেন। সুলেমান কররানির সঙ্গে ইব্রাহিম খাঁ শূরের সদ্ভাব না থাকবার জন্য তাড়া থেকে মুকুন্দদেবের কাছে তাঁকে বহিষ্কার জন্য বার বার অনুরোধ গিয়েছিল। কিন্তু সেই অনুরোধ উপেক্ষিত হওয়ার জন্য দুই রাজ্যের মধ্যে সম্বন্ধ যখন তিক্ত হয়ে উঠেছিল, তখন দিল্লীশ্বর আকবর মুকুন্দদেবের মিত্র হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। আসলে আকবরের প্রতি মৌখিক আনুগত্য প্রকাশ করা সত্বেও সুলেমান কররানি যে সব আফগানকে নিজের দলে টেনে নিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে গোপন চক্রান্ত চালাচ্ছিলেন, সেই খবর তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। তা থেকে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, তখন হোক তথবা পরে হোক, এমন একটা সময় অবশ্যই আসবে, যখন কররানিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো ছাড়া তাঁর অন্য কোন গত্যন্তর থাকবে না। তাই সেই সময়ে যাতে কররানিদের দুই প্রতিবেশী রাজ্যের কাছ থেকে যথোচিত সাহায্য পাওয়া যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে আকবর মুকুন্দদেবের কাছে উড়িষ্যায় এবং ‘লক্ষ্মীনারায়ণের’ কাছে কুচবিহারে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন। উভয় নরপতিই তাঁর অনুরোধ রক্ষা করে পারস্পরিক সামরিক সাহায্যের ভিত্তিতে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। উড়িষ্যার আগেকার গৌরব তখন ম্লান হয়ে পড়লেও ওই রাজ্যের আয়তন কিন্তু কিছুমাত্র হ্রাস পায় নি। তখন উত্তরে ভাগীরথীতীরে অবস্থিত ত্রিবেণী থেকে দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত জনপদের উপরে রাজা মুকুন্দদেব রাজত্ব করতেন। সেটাকে কোন রাজ্য বলা চলে না, সেটা ছিল একটা আস্ত সাম্রাজ্য। আয়তনে ও সামরিক শক্তিতে সেটি সমসাময়িক মোঘল সাম্রাজ্যের সমান ছিল। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকের ছুরিকাঘাতে একদিন সেই সাম্রাজ্যও প্রায় বিনা যুদ্ধে আফগানদের পদানত হয়েছিল। আফগান শরণার্থী ইব্রাহিম শূর যে সেই সময়ে কোন ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, সেটা বলা সম্ভব নয়; কিন্তু উড়িষ্যার যে অঞ্চলে তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, সেটির কাছাকাছি অবস্থিত ময়ূরভঞ্জ ও ছোট নাগপুরের জঙ্গলের ভিতর দিয়েই সুলেমান কররানির সৈন্যবাহিনী একদিন অতি সঙ্গোপনে উড়িষ্যায় গিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। তাঁদের দূরীভূত করবার জন্য মুকুন্দদেব নিজের দু’জন সৈন্যাধ্যক্ষ ‘ছোটরায়’ ও ‘রঘুভঞ্জ’কে উত্তর সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার পরিবর্তে তাঁদের উভয়েই নিজের প্রভুকে আক্রমণ করে বসেছিলেন! অসহায় মুকুন্দদেব তখন কোটসালা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে সেই বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি বিধানে অগ্রসর হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে ছোটরায় পরাজিত ও নিহত হলেও রাজা মুকুন্দদেবকেও শেষপর্যন্ত নিজের জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিল। তখন সারণগড় দুর্গের অধ্যক্ষ ‘রামচন্দ্র ভঞ্জ’ সমস্ত উড়িষ্যার দায়িত্ব গ্রহণ করে কররানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলে আফগানদের অগ্রগতি স্তিমিত হয়েছিল, এবং তাঁদের উড়িষ্যা জয়ের আশা লোপ পেয়েছিল। সুলেমান কররানি যখন দেখেছিলেন যে, সম্মুখ সমরে তাঁর পক্ষে রামচন্দ্র ভঞ্জকে পরাজিত করা কিছুতেই সম্ভব নয়, তখন তিনি শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করে তাঁকে হত্যা করেছিলেন। সেই সঙ্গেই ১৫৬৮ খৃষ্টাব্দে সমগ্র উড়িষ্যার উপরে আফগান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন থেকেই উড়িষ্যার সূর্য অস্তাচলে ডুবে গিয়েছিল। এর আগে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে শক্তি স্বাধীনতার বিজয় বৈজয়ন্তী উড্ডীয়মান রেখে ভারত গগনে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত কিরণ বিকিরণ করছিল, তার বুকের উপরে বিদেশীদের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়েছিল। তুর্কীদের প্রথম ভারত আগমনের পর থেকে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে উড়িষ্যার উপর দিয়ে অনেক আক্রমণ চলেছিল, কিন্তু গঙ্গাসম্রাটেরা সেগুলিকে শুধু প্রতিহতই করেন নি, শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁরা প্রত্যাক্রমণও চালিয়েছিলেন। সেই উড়িষ্যাও শেষপর্যন্ত বিদেশীদের পদানত হয়েছিল। যে আফগান সুলতান তাড়া প্রাসাদে বসে নিজের শেষ সময়ের জন্য দিন গুনছিলেন, তিনি গিয়ে উড়িষ্যার দুর্জয় দুর্গগুলিকে একে একে অধিকার করে নিয়েছিলেন। দারুভূত দেবতা জগন্নাথ কালাপাহাড়ের হাতে অপবিত্র হয়েছিলেন।

আরো পড়ুন- মুর্শিদাবাদের অতি প্রসিদ্ধ ‘ঝুড়ি দই’!

উড়িষ্যার পতন ও পুরীর মন্দির কলুষিত হওয়ার সংবাদ সমগ্র ভারতে দাবাগ্নির মত ছড়িয়ে পড়বার পরে ত্রিপুরা ও কুচবিহার সঙ্গে সঙ্গে কররানি রাজ্যের উপরে উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করেছিল। তৎকালীন ত্রিপুরাধীশ ‘বিজয়মাণিক্যের’ সৈন্যবাহিনী বঙ্গে প্রবেশ করে একটি বিস্তীর্ণ জনপদ অধিকার করে নিয়েছিল। সেই সুযোগে আরাকানরাজ এগিয়ে এসে চট্টগ্রাম দখল করে নিলেও ত্রিপুরী বাহিনী তাঁদের সেখান থেকে দূরীভূত করবার ফলে ওই বন্দরটির উপরে ত্রিপুরেশ্বরের বিজয়পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। সেই সব দুঃসংবাদ উড়িষ্যায় সুলেমান কররানির কাছে পৌঁছানোর পরে তিনি শশব্যস্ত হয়ে নিজের রাজ্যের রাজধানীতে ফিরে এসেছিলেন, এবং তৎক্ষণাৎ তিন হাজার অশ্বারোহী ও দশ হাজার পদাতিকসহ ‘মহম্মদ খাঁ’কে পূর্ব সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে ত্রিপুরী সৈন্যদের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। ওই যুদ্ধের প্রথমদিকে ত্রিপুরী সেনাপতি নিহত হলেও সৈন্যরা নিরুৎসাহ না হয়ে নিজের নিজের অধ্যক্ষের নেতৃত্বে আট মাস ধরে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। সুলেমান কররানিও যুদ্ধক্ষেত্রে স্রোতের পর স্রোত সৈন্য পাঠিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত আফগানরা যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছিলেন, এবং তাঁদের সেনাপতি মহম্মদ খাঁ ত্রিপুরা বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তাঁকে ও অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদেরকে পিঞ্জরাবদ্ধ করে রাজধানী রাঙামাটিয়ায় নিয়ে যাওয়ার পরে রাজা বিজয়মাণিক্যের আদেশে তাঁদের সবাইকেই চতুর্দশ দেবতার সম্মুখে বলি দেওয়া হয়েছিল। এরপরে বিজয়দীপ্ত ত্রিপুরী সৈন্যরা কররানি রাজ্য আক্রমণ করলে আফগানরা তাঁদের অগ্রগতি রোধে অসমর্থ হয়েছিলেন। ফলে আক্রমণকারীরা তখন সুবর্ণগ্রাম অধিকার করে নিয়ে লাক্ষা নদী পার করে গঙ্গাতীরে পৌঁছে নিজেদের জয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। সৈন্য ও সমরোপকরণের স্বল্পতার জন্য এরপরে তাঁরা আর অগ্রসর হতে না পারলেও, প্রভূত পরিমাণ অর্থ ও কয়েকটি সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে নিজেদের রাজধানীতে ফিরে গিয়েছিলেন। তারপরে রাজা বিজয়মাণিক্য সেই বিজয়ী সৈন্যদের শ্রীহট্টে পাঠিয়ে দিলে তাঁরা সেখান থেকেও প্রচুর ধনরত্ন লুণ্ঠন করে স্বরাজ্যে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। ওদিকে ত্রিপুরার মত কুচবিহারও যখন উড়িষ্যার পতনের জন্য ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিল, সেই সময়ে ‘কালাপাহাড়’ অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন। সুলতান মামুদের রণনীতি অনুসরণ করে তিনি কুচবিহারের সশস্ত্রবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে একদিন হঠাৎ কামাখ্যা মন্দিরে গিয়ে উপনীত হয়েছিলেন, এবং সেখানকার পুরোহিতদের আকুল আবেদন অগ্রাহ্য করে লগুড়াঘাতে দেবীমূর্তি চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই ধৃষ্টতায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে কুচবিহার বাহিনী কররানি রাজ্য আক্রমণ করলে আফগানরা তাঁদের প্রতিরোধ করতে অসমর্থ হয়েছিলেন। কুচবিহার বাহিনীর চাপে পিছু হঠতে হঠতে তাঁরা গৌড়ের অভ্যন্তরে বহু দূর পর্যন্ত চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু এরপরেই কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে কুচবিহার সেনাপতি ‘চিলারায়’ বন্দী হওয়ার ফলে সেই যুদ্ধের ধারা বদলে গিয়েছিল। আফগানরা তখন পাল্টা আক্রমণ শুরু করে কুচবিহার বাহিনীকে পিছনে ঠেলতে ঠেলতে একেবারে কুচবিহার রাজ্যের উপকণ্ঠে গিয়ে হাজির হলেও তাঁদের নিজেদের কোন সীমান্তই তখন বিপন্মুক্ত ছিল না। পশ্চিমদিক থেকে মোঘলরা তখন গৌড়ের দিকে এগিয়ে আসছিলেন, পূর্বদিকে ত্রিপুরী আক্রমণ প্রতিরোধ করা আফগানদের পক্ষে ক্রমে শক্ত হয়ে উঠছিল, আর দক্ষিণে তখনও উড়িষ্যার সামন্ত নরপতিরা অজেয় ছিলেন। সুলেমান কররানি হিসাব করে দেখেছিলেন যে, কুচবিহারের সঙ্গে আর বেশী দিন ধরে যুদ্ধ চালালে শেষপর্যন্ত তাঁকেই হয় তো বিলীন হয়ে যেতে হবে। তাই তিনি সন্ধির প্রস্তাব করে কুচবিহারে রাজা ‘নরনারায়ণের’ কাছে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন। তিনি সম্মতি দেওয়ার পরে বন্দী চিলারায় শুধু আফগান কারাগার থেকে মুক্তি পান নি, সুলেমানের এক কন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহও সম্পন্ন হয়েছিল।

কররানি বংশ

উড়িষ্যা জয়ের চার বছর পরে, ১৫৭২ খৃষ্টাব্দের ১১ই অক্টোবর তারিখে সুলেমানের মৃত্যু ঘটলে, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘বায়াজিদ’ তখতে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই যুবকের উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহারে উত্যক্ত হয়ে আফগান সর্দারেরা সুলেমানের এক জামাতা ‘হানসু’র নেতৃত্বে তাঁকে মসনদ চ্যুত করে হত্যা করেছিলেন। রাজ্যভোগ অবশ্য হানসুর অদৃষ্টেও ছিল না, তাঁর অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই উজীর লুদি খাঁ তাঁকে হত্যা করে সুলেমানের কনিষ্ঠ পুত্র ‘দাউদ’কে মসনদে অভিষিক্ত করেছিলেন। অতীত দিনের সেই হত্যাপর্ব আবার নতুন করে শুরু হয়েছিল। তখতে বসবার পরে দাউদ দেখেছিলেন যে, তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনীতে প্রায় দেড় লক্ষ পদাতিক, চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী, তিন হাজার হস্তী ও সহস্রাধিক রণতরী রয়েছে। সেই বিরাট বাহিনী ছিল বলেই তাঁর পিতা উড়িষ্যার মত দুর্দ্ধর্ষ শক্তিকে পরাভূত করতে পেরেছিলেন। সেসব দেখে তাঁর ধারণা হয়েছিল যে, তাঁর পিতা যে আকবরের ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকতেন, সেটা নিছকই তাঁর কাপুরুষতা ছিল। তাই আকবরের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে তিনি নিজের নামেই খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচার শুরু করেছিলেন। চরিত্রবলে দাউদ তাঁর জ্যেষ্ঠাগ্রজ বায়াজিদ অপেক্ষা কোন দিক থেকেই স্বতন্ত্র ছিলেন না। তাই পিতার কাছ থেকে পাওয়া বিশাল রাজ্য ও অতুলনীয় ঐশ্বর্য্য দিয়ে তিনি তাঁর জীবনকে পুরাপুরি ভোগ করতে শুরু করেছিলেন, সুরা ও নারী তাঁর নিত্য সহচর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সেসবের উপরে ছিল তাঁর সন্দিগ্ধচিত্ততা। তাঁর মনে হতে শুরু করেছিল যে, পিতৃব্য তাজ খাঁর পুত্র ‘ইউসুফ’ তাঁকে মসনদ থেকে সরাবার জন্য চক্রান্ত করছেন। তাই দুষমনকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয় ভেবে নিয়ে তিনি গুপ্তঘাতক দিয়ে তাঁকে হত্যা করিয়েছিলেন। অথচ ইউসুফ শুধু তাঁর পিতৃব্যপুত্র ছিলেন না, তিনি তাঁর পরম হিতৈষী লুদি খাঁর জামাতাও ছিলেন। সেই লুদি খাঁই তাঁকে মসনদে বসিয়ে তখন তাঁর রিজেন্টের কাজ করছিলেন। তিনি যখন ইউসুফকে হত্যা করিয়েছিলেন, লুদি খাঁ তখন মোঘল সেনাপতি ‘খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ’র সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্য বিহারে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী থাকলেও মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার কোন প্রয়োজন হয় নি, নিজের কূটনৈতিক চালেই তিনি মোঘলদেরকে বশীভূত করেছিলেন। নিজের এহেন হিতৈষীকে দাউদ ক্ষিপ্ত করে তুলেছিলেন। দাউদ কতৃক নিজের জামাতা হত্যার অপরাধ যে লুদি খাঁ কখনোই বরদাস্ত করবেন না, সেকথা বুঝতে পেরে দাউদ নিজের সমস্ত সৈন্যবাহিনীসহ লুদি খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। আসল শত্রু সামনে বসে রয়েছে জেনেও তিনি নিজেরই অপর এক সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে নিজে যুদ্ধ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন! যদিও শেষপর্যন্ত অবশ্য সেই যুদ্ধের কোন প্রয়োজন হয় নি। লুদি ভেবেছিলেন যে, মোঘলদেরকে সামনে দেখেও যদি তিনি সেই অর্বাচীন যুবকের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন, তাহলে খান-ই-খানান তাঁর দিকে একবার মুচকি হেসে সোজা গৌড়ের রাজধানীতে গিয়ে আকবরের পতাকা উড়িয়ে দেবেন। নির্বোধ দাউদ সেকাজ করতে পারতেন, কিন্তু লুদি খাঁর মত একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষে সেটা করা শোভনীয় ছিল না। যদিও তাঁর সেই ধৈর্য্য ও উদারতার কোন মর্যাদাই দাউদ দেন নি, সেই প্রৌঢ়কে নিজের শিবিরে আহ্বান করে তিনি তাঁকে শমন সদনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওদিকে মোঘল বাহিনী তখন পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে অদূরে নিজেদের শিবির স্থাপন করে যুদ্ধের জন্য তৈরী হচ্ছিল।
এর চার বছর আগে আকবর উৎকলাধীশ মুকুন্দদেবের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হলেও, সেই চুক্তি অনুযায়ী কোন কাজ করবার সুযোগ তাঁর হয় নি। কারণ মুকুন্দদেবকে হত্যা করেছিলেন তাঁর নিজেরই এক সৈন্যাধ্যক্ষ, সুলেমান কররানি বা তাঁর পক্ষীয় কেউ মুকুন্দদেবকে হত্যা করেন নি। তারপরেই অভিভাবকহীন উড়িষ্যা ক্ষীণ প্রতিরোধের পরে এত দ্রুতগতিতে আফগানদের অধিকারে চলে গিয়েছিল যে, আগ্রা থেকে সেখানে কোন সামরিক সাহায্য পাঠাবার সুযোগও আকবরের হয় নি। তাছাড়া আকবরের নিজের সমস্যাও তখন খুব একটা কম ছিল না। তখনও তাঁর শাসন বিজিত অঞ্চলগুলির কোথাও ভালভাবে শিকড় গাড়তে পারেনি, ফলে বিভিন্ন প্রান্তে তখন বিক্ষোভ লেগেই ছিল। তিনি কোন দিক সামাল দিতেন? তাই তাঁর প্রতি মৌখিক আনুগত্য দেখিয়ে সুলেমান কররানি উড়িষ্যায় নিজের অধিকার সম্প্রসারিত করছেন দেখেও তাঁর তখন কিছু করবার ভরসা হয় নি। তার উপরে কাবুলে তখন তাঁর ভাইকে আশ্রয় করে একটি গোপন চক্রান্ত চলছিল। সেসব সামাল দেওয়ার জন্য ‘মানসিংহ’ সেখানে ছিলেন, কিন্তু গৌড়ে সুলেমান কররানির মত সমৃদ্ধ সুলতান ও লুদি খাঁর মত বিচক্ষণ উজীরের সম্মুখীন হওয়ার মত শক্তিমান ব্যক্তি তখন মোগল সাম্রাজ্যে অন্য কেউ ছিলেন না। সেই সময়ে আফগানরা যদি শের শাহের মত কোন প্রতিভাশালী নায়কের অধীনে পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারতেন, তাহলে আকবরকে হয়ত তাঁর পিতা হুমায়ুনের মত আরেকবার ভারত ত্যাগ করতে হত। কিন্তু তাঁদের দুর্ভাগ্য এটাই ছিল যে, সেই সন্ধিক্ষণেই সুলেমান কররানি লোকান্তরিত হয়েছিলেন, দাউদ লুদি খাঁকে হত্যা করেছিলেন, এবং মোঘলেরা তরবারি-বন্দুক উঁচিয়ে বসে রয়েছে দেখেও তাঁদের চিরন্তন আত্মকলহ আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাঁদের দমন করবার জন্য আকবর খান-ই-খানান মুনাইম খাঁকে বিহারে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু লুদি খাঁর ক্ষুরধার কূটনীতির সামনে তিনি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ বিনা কারণে সেই লুদি খাঁকে হত্যা করে দাউদ নিজের নিজের দেহ থেকে ডান হাতটি কেটে ফেলেছিলেন। সেই খবর আগ্রায় পৌঁছানোর পরে আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে সেটাই তাঁর সুযোগ। তাই পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ নিজে চালাবার জন্য তিনি সোজা বিহারে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। মুঘল তখতে আরোহন করবার আঠারো বছর পরে সেই প্রথম তিনি পূর্বাঞ্চলে পদার্পন করেছিলেন। তাঁর আগমন সংবাদে দাউদ কররানি রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। নিছক হঠকারিতার বশে লুদি খাঁকে হত্যা করলেও তারপর থেকেই তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। তখন আকবর নিজেই রণাঙ্গনে এসে উপস্থিত হয়েছেন শুনে তিনি সোজা পাটনা দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কোথাও কোন যুদ্ধ হয়নি, অথচ তাঁকে অনুসরণ করে মোঘলবাহিনী পাটনার উপকণ্ঠে গিয়ে নিজেদের তাঁবু ফেলেছিল।

১৫৭৪ খৃষ্টাব্দের ৩রা আগষ্ট তারিখে আকবর নদীপথে সেখানে পৌঁছে নিজের ফৌজের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। যে প্রভূত পরিমাণ কামান, রণহস্তী ও নৌবাহিনী তাঁর সঙ্গে এসেছিল, তাঁর নির্দেশে তাঁরা পাটনা দুর্গের উপরে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি চালাতে শুরু করেছিল। ওপারে নদীর উত্তর তীরে ছিল হাজীপুর দুর্গ। পাটনা দুর্গ আক্রমণ করবার আগে আকবর সেই দুর্গের উপরে অভিযান চালাবার নির্দেশ দিলে, তিন দিনের দিন কয়েক ঘন্টা যুদ্ধের পরেই মোঘল ফৌজ ওই দুর্গটি অধিকার করে নিয়েছিল। এর ফলে দাউদের আশঙ্কা আরও বেড়ে গিয়েছিল, তিনি এই ভেবে ভীত হয়েছিলেন যে, পাটনা রক্ষা করা তাঁর সাধ্যে কুলাবে না। তাঁর পিছনে একটি বিশাল রাজ্য ও বিরাট সৈন্যবাহিনী থাকা সত্বেও তিনি আতঙ্কে এমনই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর যুদ্ধের কথা চিন্তা করবার শক্তি পর্যন্ত লোপ পেয়ে গিয়েছিল। তাই রাত্রির অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দুর্গাবাস থেকে বেরিয়ে এসে তিনি অতি সঙ্গোপনে নিজের রাজধানীর দিকে যাত্রা সুরু করেছিলেন। তাঁর সেনাপতি ‘গুজর খাঁ’ দুর্গরক্ষী সমস্ত সৈন্য নিয়ে জলপথে একই দিকে রওনা হয়েছিলেন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মোঘল ফৌজ দুর্গের উপরে কিছুক্ষণ ধরে কামান দাগবার পরেই বুঝতে পেরেছিল যে, সেখান থেকে কোন প্রত্যুত্তর আসছে না। এরপরে তাঁরা গোলাবৃষ্টি আরো বাড়িয়ে দিলেও শত্রুপক্ষ থেকে কোন উত্তর আসেনি। তারপরে অবিস্মৃত হয়েছিল যে, ওই দুর্গে কোন জনপ্রাণী নেই! দুর্গের মুক্ত দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মোঘল বাহিনী বিস্মিত নেত্রে দেখতে পেয়েছিল যে, সেখানে প্রভূত পরিমাণ রণসম্ভার পড়ে রয়েছে, আফগানরা সেগুলি ব্যবহারের কোন চেষ্টা পর্যন্ত করেন নি। নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাঁরা একবস্ত্রে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আকবর জানতেন যে শত্রুর শেষ না করে তাঁর থামবার কোন উপায় নেই। তাই তিনি নিজেই সৈন্যদের পুরোভাগে অবস্থান করে সোজা পূর্ব দিকে যাত্রা করেছিলেন। আফগানরা পালাচ্ছিলেন, আর মোঘলরা তাঁদের পিছন থেকে তাড়া করছিলেন। এক দিনে চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করবার পরে মোঘলরা দরিয়ারপুর গ্রামে পৌঁছে দেখতে পেয়েছিলেন যে, আফগানরা এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, পাটনা থেকে অল্প যা কিছু সমরসম্ভার তাঁরা নিজেদের সঙ্গে নিয়েছিলেন, বোঝা হাল্কা করবার জন্য সে সব পথের দু’পাশে ফেলে রেখে তাঁরা পালিয়েছিলেন। তাঁদের পরিত্যক্ত ২৬৫টি হস্তীসহ প্রভূত পরিমাণ রণসম্ভার মোঘলদের হস্তগত হয়েছিল। কিন্তু প্রাণভয়ে তাঁরা এমনই বেগে পালাচ্ছিলেন যে, কিছুতেই মোঘল বাহিনী তাঁদের নাগাল পাচ্ছিল না। শেষে ওভাবে আফগানদের তাড়া করে সুবিধা হবে না বুঝতে পেরে আকবর পাটনায় ফিরে গিয়ে ১৩ই আগষ্ট তারিখে ‘খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ’কে ২০ হাজার অশ্বারোহীসহ পূর্বাঞ্চলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু আফগানরা তখন কোথায়? খান-ই- খানান যতই এগিয়ে গিয়েছিলেন, আফগান গ্যারিসন অধ্যক্ষরা ততই বিনাযুদ্ধে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। মুঙ্গের, ভাগলপুর, কহলগাঁও সর্বত্রই সামরিক ছাউনিগুলির উপর থেকে আফগান পতাকা নামিয়ে দিয়ে মোঘলদের পতাকা তোলা হয়েছিল। কেউ তাতে বাধা দেননি, দাউদ বা তাঁর সেনাপতি গুজর খাঁর কোন সন্ধানও পাওয়া যায় নি। শেষপর্যন্ত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তেলিয়াগড়ি গিরিসঙ্কটের মুখে গুনা নামক জায়গায় পৌঁছে মুনাইম খাঁ দেখতে পেয়েছিলেন যে, সমগ্র আফগানবাহিনী সেখানে ব্যূহবিন্যাস করে অপেক্ষা করছে। বিনাযুদ্ধে মোঘলদের হাতে বিহার তুলে দিয়ে সুলতান দাউদ কররানি গৌড়ের সেই প্রবেশমুখে তাঁদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর নতুন রণনীতি। তাঁর নির্দেশে হাজার হাজার আফগান সৈন্য পরিখা খনন করে তার মধ্যে অবস্থান করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে ছিলেন অসংখ্য দেশী পাইক। ছদ্মবেশে সমস্ত আফগান ব্যূহ ঘুরে মুনাইম খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন যে, মাত্র বিশ হাজার অশ্বারোহী দিয়ে সেই ব্যূহ ভেদ করা কখনোই সম্ভব হবে না। তাই নিরাপদ দূরত্বে তাঁবু ফেলবার নির্দেশ দিয়ে তিনি আরও সৈন্য ও সমরসম্ভারের জন্য তৎক্ষণাৎ পাটনায় আকবরের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলেন। ওই ভাবে তেলিয়াগড়ির প্রবেশমুখে যখন মোঘল ও আফগানরা পরস্পরের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, এমন সময়ে একদিন কয়েকজন হিন্দু জমিদার খান-ই-খানানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, অদূরে রাজমহল পাহাড়ের গড়হি গিরিপথের ভিতর দিয়ে তাড়া ও গৌড়ে যাওয়ার জন্য আরেকটি গোপন পথ রয়েছে। সেই পথটি বেশ কিছুটা ঘোরানো বলে আফগানরা সেটার উপরে কোন গুরুত্ব দেন নি, সেখানে তাঁদের কোন সৈন্যও মোতায়েন নেই। সেই সংবাদটির সত্যাসত্য নির্দ্ধারণের জন্য খান-ই-খানান জনৈক অফিসারকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরে যখন তিনি দেখেছিলেন যে, হিন্দুরা তাঁকে বিভ্রান্ত করবার কোন চেষ্টা করেন নি, তখন তাঁর নির্দেশে এক ডিভিসন মোঘল সৈন্য তেলিয়াগড়ির উপরে তোপ দেগে ভুয়ো যুদ্ধের অভিনয় করতে শুরু করেছিলেন, আর নিজের বাকি সৈন্যদের নিয়ে তিনি রাজধানী তাড়ার দিকে রওনা হয়েছিলেন। সেই ঘোরাপথ দিয়ে মার্চ করতে করতে ১৫৭৪ খৃষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি আচমকা তাড়ায় পৌঁছানোর পরে সুলতান দাউদ কররানি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। মোঘল বাহিনীকে বাধা দেওয়ার মত সম্বল না থাকবার জন্য তিনি প্রাসাদ ত্যাগ করে গোপন পথে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। ওই ধরণের সহজ জয় খান-ই-খানান নিজেও আশা করেন নি, তাই তিনি সরাসরি দাউদের প্রাসাদে প্রবেশ না করে সন্নিহিত একটি খোলা মাঠে প্রথমে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই সংবাদটি তেলিয়াগড়িতে পৌঁছানোর পরে ভয়চকিত আফগান সৈন্যরা পরিখা থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণভয়ে চারিদিকে ছোটাছুটি করতে শুরু করেছিলেন। নিজেদের রাজধানীতে গিয়ে মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার মত মনোবল তাঁদের লোপ পেয়েছিল। কোথাও কোন যুদ্ধ হয়নি, কোন পক্ষের কোন সৈনিক একটি গুলি ছোঁড়েন নি, কোন সৈনিকের গায়ে একটু আঁচড়ও লাগে নি, অথচ সমগ্র বিহার, গৌড় ও বঙ্গের উপরে আকবরের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গেই গৌড় আরেকবার বিনাযুদ্ধে বহিরাগতের পদানত হয়েছিল।

(তথ্যসূত্র:
১- Tarikh-i-Sher Shahi, Abbas Sarwani, Elliot’s translation.
২- Tarikh-i-Salatin-i-Afghann, Ahmed Yadgar.
৩- Makhzan-i- Afghani, Niamatulla, Elliot’s translation.
৪- রাজমালা, থানেশ্বর ও শুক্রেশ্বর।
৫- Riyaz-us-Salatin, Ghulam Husain Salim.
৬- Akbarnama iii, Abul Fazl Allami.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

অপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারাঅপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারা

বর্তমানে একটা দেশ শাসন করে সরকার কিন্তু পূর্বে সেই শাসনভার ছিল রাজ রাজা ও সম্রাটদের হাতে। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে অনেক দয়ালু রাজার জনগণের প্রতি প্রেমের ব্যাখ্যা তো কিছু

সামুদ্রিক সাম্রাজ্যে ভারতবর্ষ চোল নৌ-বাহিনিসামুদ্রিক সাম্রাজ্যে ভারতবর্ষ চোল নৌ-বাহিনি

ভারতে নৌ শক্তির গুরুত্ব প্রথম উপলব্ধি করেছিল মৌর্যরা , তাঁদের একটি ছোটোখাটো নৌ-বাহিনিও ছিল । কিন্তু নৌ অভিযানের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবিস্তারের পথপ্রদর্শক ছিলেন চোল সাম্রাজ্যের দুই নৃপতি — প্রথম রাজরাজ চোল

লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধলাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ

৫ কোটি লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নোটিশ বোর্ড। এই রাস্তায় আর মানুষ যেতে পারবে না। যান চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ। এমনকি মানুষের বাইরে বেরোনোর সময়সীমাও বেঁধে

রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ রামচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমের জীবিতাবস্থাতেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দে) তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষ্যাতের ঘটনাটি লিখেছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাঁর লেখা যখন সঠিক