আজ যে নবাব, কাল সে ফকির - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ আজ যে নবাব, কাল সে ফকির

আজ যে নবাব, কাল সে ফকির


আচ্ছা পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতির নাম জানেন ? প্রায় সবাই বলবেন, কেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ…. !
আজ্ঞে না স্যার, উনি ছিলেন গভর্ণর জেনারেল। গোড়াতে ওদেশে রাষ্ট্রপতি পদটাই ছিল না। ১৯৫৬ সালে সৃষ্টি হয় এবং সেই চেয়ারে প্রথম বসেন এক বঙ্গসন্তান । চমকে গেলেন নাকি ? জন্ম যখন আমাদের মুর্শিদাবাদের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তখন তাঁকে বাঙালি ছাড়া আর কিইবা বলি ! তবে তাঁর আরো একটি পরিচয় আছে, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

১৮৯৯ সালের ১৩ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রটি স্নাতক হবার পর যোগ দিলেন তৎকালীন সিভিল সার্ভিসে। পদোন্নতি হয়ে একসময় হয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি। দেশভাগের পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান তাঁকে সেদেশের ডিফেন্স সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রায় ছ’বছর এই পদে ছিলেন তিনি। এরপর বাহান্ন সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তাঁকে সেখানে গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। উদ্দেশ্য পরিস্কার, বাঙালি হয়ে বাঙালিদের আন্দোলন যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। খুব বেশিদিন যদিও তাঁকে সেই পদে থাকতে হয়নি। বছর ঘুরতেই তাঁকে রাজ্য ও সীমান্ত অঞ্চলের মন্ত্রী (Minister Of State And Frontier Region) হিসেবে রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরিয়ে আনা হয়, সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব।

আরো পড়ুন- গৌড়ের প্রথম ধারাবাহিক শাসক-বংশ

ঘুঁটি তখন থেকেই সাজাতে শুরু করলেন ধুরন্ধর এই সিভিলিয়ান। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে লিয়াকত আলী খানকে দিয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করালেন আয়ুব খানকে। অথচ এই পদের জন্য যোগ্য মেজর জেনারেল ইসফাকুল মজিদ, যিনি পদমর্যাদা ও অভিজ্ঞতায় ছিলেন আয়ুব খানের সিনিয়ার। বিশ্বযুদ্ধে অসাধারণ দক্ষতা দেখানো এই বাঙালি জেনারেলের সামনে আইয়ুব খান চিরকালই নিজেকে ছোট মনে করতেন ।

এরপর ধূমকেতুর মতো তাঁর উত্থান। আর্মির সাথে হাত মিলিয়ে ৭ই আগস্ট, ১৯৫৫ তে অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ নিলেন তিনি । অসুস্থতার কারনে পাকিস্তানের তৃতীয় গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহাম্মদ আলী তখন ইংল্যান্ডে চিকিৎসাধীন। সেদিনই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য করলেন আরেক বাঙ্গালী প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মহম্মদ আলীকে!

২৩শে মার্চ, ১৯৫৬, নয়বছরের চেষ্টায় পাকিস্তানের নতুন সংবিধান কার্যকর হয় এবং গভর্নর জেনারেলের নাম বদলে হলো প্রেসিডেন্ট। আর এভাবেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল বঙ্গসন্তান #ইস্কান্দার_মির্জা হয়ে গেলেন সেদেশের প্রথম অনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ছয়মাসের মধ্যে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসলেন আরো এক বাঙালি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ঘরের দুই পোলাপান কে দেশের সর্বোচ্চ পদে দেখে আনন্দে ভেসে গেছিল সেদিন গোটা পূর্ববাংলা। কিন্তু তারা জানতো না, বিশ্বাস ঘাতকতার বীজ রয়েছে এদের একজনের রক্তে!
.
১০ই অক্টোবর, ১৯৫৭। প্রেসিডেন্ট প্যালেসে ডাকা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। উপস্থিত ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল আয়ুব খান সহ অন্যান্য বাহিনীর প্রধান । জোর করে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে সারা দেশে জারি করা হলো মার্শাল ল। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সামরিক শাসন জারী করলেন ইস্কান্দার মির্জা। সেই সাথে বোতল থেকে যে দৈত্যকে সেদিন মুক্ত করেছিলেন, আজও তাকে বন্দী করতে পারেনি পাকিস্তান !

তবে মির্জা আর খানের হনিমুন বেশিদিন টিকলো না। ২৭শে অক্টোবর ১৯৫৮। মাঝরাতে প্রেসিডেন্ট প্যালেস ঘিরে ফেললো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে মির্জাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করলো তারা। নয়া প্রেসিডেন্ট হলেন জেনারেল আয়ুব খান। জান বাঁচাতে ইস্কান্দর তার দ্বিতীয় বিবিকে নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে যান।

এরপর আর পাকিস্তানে ফিরতে পারেননি মিঞা সাহেব। এমনকি মৃত্যুর পরও পাকিস্তানে দেহ সমাধিস্থ করতে আপত্তি জানায় পাক প্রশাসন । শোনা যায় ইরানে তাঁকে কবর দেয়া হয়। তাঁর আত্মীয়দেরও পাকিস্তানের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি । দেশ থেকে পালিয়ে লন্ডনে তাঁর দিন কেটেছিল খুবই কষ্টে। সেখানে তিনি একটি ছোট পাকিস্তানি খাবারের দোকান চালাতেন। ভাবুন একবার, এক স্বাধীন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিদেশে ‘ধাবা’ চালাচ্ছেন !

১৯৬৯ সালে ১৩ই নভেম্বর, ৭০তম জন্মদিনের দিন লন্ডনেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে। এত বড় পরিবারের একজন মানুষকে এইভাবে দিন কাটাতে হবে, তিনি নিজেই কি ভেবেছেন কখনও… ?

এতো বড় পরিবার…..? ওহো এতক্ষণ তো বলাই হয়নি এনার বংশ পরিচয়। এই ইস্কান্দার ছিলেন মুর্শিদাবাদের এক নবাবের চতুর্থ বংশধর। কে ছিলো সেই নবাব আন্দাজ করতে পারেন ? ইস্কান্দর আলি মির্জার দাদুর বাবা ছিলেন খোদ মীরজাফর আলী খান, ইতিহাসের এক সেরা বিশ্বাসঘাতক! ‌‌

উপসংহার: ১৯২৮ সালে এদেশে পুনেতে জন্ম নেওয়া হুমায়ুন মির্জা পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও তার প্রথম স্ত্রী রিফাত বেগমের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড থেকে গ্রাজুয়েট হুমায়ুন মির্জা ছিলেন বিশ্বব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা। ১৯৮৮ সালে অবসরে যান।

ভারতের দুন স্কুলে পড়ার পর ব্রিটেন তারপর যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে এমবিএ ডিগ্রি নেওয়া হুমায়ুন মির্জা ‘ফ্রম পলাশি টু পাকিস্তান: দ্য ফ্যামিলি হিস্টরি অব ইসকান্দার মির্জা’ এবং ‘সান অব আ প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড এ্যায়া টু আ থ্রোন’ নামে দুটি বই লিখেছেন।

পিতা ইস্কান্দার মির্জা ও মীরজাফর আলী খানের বংশ নিয়ে লেখা ওই ঢাউশ বইয়ে পাকিস্তানের অনেক অজানা ইতিহাস, সামরিক শাসন জারি ও ইস্কান্দার মির্জাকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করা সহ নানা প্রসঙ্গ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পাকিস্তানের মাটিতে কখনো পা রাখেননি তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

ধর্মঠাকুর কে?ধর্মঠাকুর কে?

রানা চক্রবর্তীঃ পশ্চিমবঙ্গে ধর্মদেবতার পূজা এখন একান্তভাবে বর্ধমান বিভাগে সীমাবদ্ধ। তবে চব্বিশ পরগণা জেলায় ও কলকাতার কাছাকাছি অঞ্চলে, ধর্মদেবতার বিগ্রহ ও নিত্যপূজা এখনও একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় নি। পূর্ববঙ্গের স্থানে

রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিম – একটি বিতর্কিত অধ্যায়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ রামচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমের জীবিতাবস্থাতেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দে) তাঁর গ্রন্থে রামকৃষ্ণ-বঙ্কিম সাক্ষ্যাতের ঘটনাটি লিখেছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাঁর লেখা যখন সঠিক

পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধপৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জানিয়েছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর সবচেয়ে চিন্তার কারন ছিল জার্মানির ইউবোট। তিনি আরও জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন ব্রিটেনের যুদ্ধ হচ্ছিল তখন

ইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্যইউরোপীয়দের চোখে দেশী ভৃত্য

রানা চক্রবর্তীঃ ভারতে মোঘলদের হাত থেকে রাজ্যশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করবার সময়ে ঐতিহ্যসূত্র ধরে ইংরেজদের তাঁদের ভৃত্যমণ্ডলীকেও গ্রহণ করতে হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ভারতে মোঘল শাসনের ধার না থাকলেও, ভার