নিমতলা ঘাটের কথা - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ নিমতলা ঘাটের কথা

নিমতলা ঘাটের কথা


রানা চক্রবর্তীঃ বলা হয় যে, নিজের মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষ নাকি তাঁর সমস্ত অপরাধ থেকেও মুক্তি পেয়ে যায়। কিন্তু মানুষের দেহের শেষচিহ্ন লীন হওয়ার সময়ে কেউ শ্মশানে গেলে কিন্তু সেকথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। কলকাতার নিমতলা ঘাটের কথাই ধরা যাক। সেই ঘাটে এখনও কত মনীষীর সমাধি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই পৃথিবীতে যিনি অমর, সেই বিশ্বের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেখানেই শুয়ে রয়েছেন। হয়ত তিনি কেওড়াতলা শ্মশানের পাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন, সেখানে মাথা উঁচু করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সমাধি-স্তম্ভ তাঁর স্মৃতি সগর্বে ঘোষণা করে চলেছে। ওই সব জায়গাতেই রয়েছে অতীতের হারিয়ে যাওয়া মানুষের উপস্থিতি, সেখানকার মাটিতে মিশে রয়েছে কত মনীষীর চিহ্ন। ভালো হোন মন্দ, শ্মশানভূমি যে কত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, তার কোন হিসাব নেই। শ্মশানের চুল্লি কখনও নিঃসঙ্গ হয়ে থাকে না। কারণ, মানুষের মৃত্যুরও কখনও শেষ নেই। তাই নিমতলা শ্মশান ঘাটের অফিসের সর্বদা কর্মচাঞ্চল্য দেখতে পাওয়া যায়। অথচ কলকাতার বুকে ওই শ্মশানভূমিটি নির্মাণের আগে বহু আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৮২৬ সালের ১লা জুলাই তারিখ থেকে ১৮২৮ সালের ২২শে মার্চ তারিখ পর্যন্ত পুরানো কলকাতার সংবাদপত্রগুলিতে সেই সব আন্দোলনের প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখতে পাওয়া যায়। পুরানো কলকাতার বুকে হিন্দুদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উপযুক্ত জায়গার জন্য সুদূর অতীতে যে একটা আন্দোলন হয়েছিল, সে বিষয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, কলকাতার সাথে এই আন্দোলন শব্দটি সুদূর অতীত থেকেই জড়িয়ে রয়েছে। যাই হোক, পাঠক-পাঠিকারা সেকালের একটি সংবাদপত্র থেকে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতাংশটি লক্ষ্য করুন –

নিমতলা ঘাট

“… শবদাহ বিষয়ে চন্দ্রিকে ও আর ২ বাঙ্গলা কাগজে এত পত্র প্রকাশ হইয়াছে যে তদ্বিষয়ে ক্লেশের বর্ণনা বা তম্নিবারণার্থে কোন উপায় দেখান প্ৰায় বাকী নাই। কিন্তু সকলের মৃত্যু এককালে হয় না প্রতিদিন কেহ না কেহ মরে যে মরে তাঁহার পরিবার বা যে ঐ শব লইয়া দাহ করিতে যায়, তাঁহারা তৎকালে ক্লেশের বিবেচনা করে কিন্তু পরে বিস্মৃত হইয়া থাকে এই প্রকারে এ শহরবাসী হিন্দুলোক সকলেই এক ২ বার দায়গ্রস্ত হইয়া থাকেন ও হইতেছেন বা হইবেন বিশেষতো যাঁহারা বর্ষাকালে মরেন তাঁহারদিগের পরিবারেরা বিশেষরূপে ক্লেশ বোধ করিতে পারেন। এ শহরে হিন্দু লোক দুই লক্ষ হইতে পারে। প্রতি মাসে আন্দাজ তিনশত লোক মরিয়া থাকে। কাশি মিত্রের ঘাটে গড়ে ১০ দশ জনের দাহ হয় কোন ২ সময়ে প্রতিদিন ২০ কুড়ি ২৫ পঁচিশ জন মরে আর ওলাউঠা হইলে ইহার দ্বিগুণ ত্রিগুণ চতুর্গুণ মরিয়া থাকে। শবদাহ স্থানের পরিমাণ আন্দাজ লম্বা ৪০ হাত চওড়া ১৬ হাত। জোয়ার হইলে ইহারে৷ অল্পতা হয় গঙ্গার জল বৃদ্ধি হইতেছে কিছুদিনের মধ্যে ইহাও জলমগ্ন হইবে ভাটা না পড়িলে দাহকর্ম হইবেক না জোয়ার কালে মৃত শরীর আসিয়া আসিয়া জমা হইবেক ভাটার অপেক্ষায় সে স্থলে অনাবৃত স্থানে কেহ ৬ কেহ বা ১২।১৮ ঘড়ী বসিয়া থাকিবে ভাটা পড়িলে উন্নত বড় ধনি মরারা ঐ অল্প স্থানে রাজা হইবেন অর্থাৎ তাঁহারা অগ্রেই স্থান পাইবেন অভাগায় অভাগারা অপেক্ষা করিবেক।”

এরপরে ১৮২৭ সালের ২৭শে জানুয়ারী ও ১৮২৮ সালের ২২শে মার্চ তারিখের দুটি সংবাদ লক্ষ্য করবার মত –
(১) “আমরা অত্যন্ত আহ্লাদপূর্বক প্রকাশ করিতেছি যে পূর্ব্বোক্ত বিষয়ে আমারদিগের অনির্বচনীয় যে ক্লেশ আছে তাহা নিবারণার্থে কোন কোন মহানুভব মহাশয়েরদিগের চেষ্টা দ্বারা উপযুক্ত উপায় হওনোযোগ হইয়াছে শুনিলাম যে নিমতলা হইতে বাগবাজার পর্যন্ত তিনটা শবদাহের নিমিত্তে স্থান হইবেক তাহা সম্পন্নার্থে এই শহরের ভাগ্যবান লোকেরদিগের মধ্যে একটা চান্দা হইয়াছে। …”
(২) “অবগত হওয়া গেল যে মোং নিমতলার ঘাটে যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার স্থান নির্মাণ হইতেছিল তাহা এক্ষণে প্রস্তুত হইয়াছে বিশেষতঃ গত সোমবার অবধি ঐ স্থানে শবের সৎকার করিতে আরম্ভ করিয়াছে ইহাতে অনেকের পরিশ্রম দূর হইয়াছে। – তিং নাং”
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কলকাতার বুকে নিমতলা ঘাটের শ্মশানক্ষেত্রের জায়গা ১৮২৮ সাল থেকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। অবশ্য এর বহু আগেই কলকাতার বুকে ‘কাশী মিত্রের ঘাটের’ উৎপত্তি ঘটেছিল, সেটিই হল কলকাতার সবচেয়ে পুরানো শ্মশান। যাঁর নাম ওই শ্মশানটি, সেই কাশী মিত্র, নবাবী আমলে ঢাকার নায়েব ‘রাজা রাজবল্লভের’ ভাগ্নে ছিলেন। ১৭৭৪ সাল থেকে কাশী মিত্রের নামে ওই শ্মশানক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কাশী মিত্র শ্মশানক্ষেত্রের পুরানো রেজিষ্টার থেকে দেখা যায় যে, ১৯১৩-১৪ সালের মধ্যে সেখানে ৪,৭১৬টি শবদাহ করা হয়েছিল, সেখানে ঐ একই সালে নিমতলা ঘাটে ১০,৩৪৪টি শবদাহ হয়েছিল। নিমতলা ঘাট শ্মশানক্ষেত্র সেদিনের চেয়ে বর্তমানে আরো প্রসারতা লাভ করেছে। তবে সেটির জন্ম থেকে বহু সংস্কারের পরে উক্ত শ্মশানটি বর্তমানের রূপ পেয়েছে। এই প্রসঙ্গে ১৮৫৭ সালে শ্মশানটির নতুন করে সংস্কারের কথা অবশ্য উল্লেখ্য। সেই বছর, কলকাতা কর্পোরেশনের কমিশনারেরা ৬,১৮০ টাকা ব্যয় করে ওই ঘাটের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। বাবু ‘রামনারায়ণ দত্ত’ তার মধ্যে ২,৫০০ টাকা কমিশনারদের হাতে অর্পণ করেছিলেন। তখন ওই অঞ্চলের তিনটি জায়গাকে ঘিরে উক্ত শ্মশানক্ষেত্রটি প্রস্তুত হয়েছিল। সেই সময়ে শ্মশানের তিন পাশে পনেরো ফুটের সমান উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে কেবলমাত্র গঙ্গার দিকের অংশটি খোলা রাখা হয়েছিল। প্রতিটি জায়গার অংশ ছিল – দৈর্ঘ্য x প্রস্থ = ১৬০ x ৯০। তারপরেও বারবার শ্মশানটির আরো অনেক পরিবর্তন করা হয়েছিল। সেগুলির মধ্যে ১৮৬৮ সালে শ্মশানের ডোমেদের থাকবার জন্য কতগুলি নতুন ঘর তৈরী করা হয়েছিল, এবং গঙ্গার দিকে নতুন করে দেওয়াল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৭৫ সালে পোর্ট কমিশনাররা অভিযোগ করেছিলেন যে, ওই শ্মশানঘাট থাকবার জন্য তাঁদের কাজকর্মের বড় অসুবিধা হচ্ছে, সেটি গঙ্গার বুকে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। সেইজন্য পরবর্তী এক বছরের মধ্যেই পোর্ট কমিশনারদের চেষ্টায় ওখানে আরেকটি সম্পূর্ণ নতুন শ্মশানঘাট তৈরী করা হয়েছিল, এবং আগের ঘাটটিকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছিল। সেই নতুন ঘাটটি তৈরী করবার জন্য ‘মেসার্স ম্যাকিনটোশ’ (Messers Mackintosh), ‘বার্ণ এণ্ড কোং’ ( Burn & Co.) কে বরাত দেওয়া হয়েছিল। ওই কাজের জন্য তখনকার হিসেবে ব্যয়ভার পড়েছিল মোট ৩০,০০০ হাজার টাকা। তারমধ্যে পোর্ট কমিশনারেরা ২৫,০০০ টাকা দিয়েছিলেন। তারপরেও ওই ঘাটটি বহুবার সংস্কার করা হয়েছিল। সব সংস্কার করতে গিয়ে তখনকার হিসেবে মোট ১৭,০০০ টাকা ব্যয় হয়েছিল। বাৎসরিক হিসাব দাখিল করলে সেই ব্যয়ের পরিমান দাঁড়ায় – ১৮৯১-৯২ সালে ৪,৫৮২ টাকা; ১৮৯২-৯৩ সালে ১,৮৯৪ টাকা; ১৮৯৪-৯৫ সালে ১,৭০০ টাকা; ১৯০৫-০৬ সালে ৫,১৪৪ টাকা; ১৯১২-১৩ সালে ২,৩৭৯ টাকা; ১৯১৩-১৪ সালে ২,০৭৯ টাকা।

বর্তমানে ওই শ্মশানক্ষেত্রটিতে কোন কিছুর অভাব নেই। বাস্তবে নিমতলা শ্মশান এক বিঘা জায়গা জুড়ে থাকলেও, শুধুমাত্র অতীতের যে সব মহাত্মারা সেখানে নিজেদের সর্বগ্রাসী আগুনে ভস্মীভূত করেছেন, তাঁদের স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখবার জন্য কলকাতার ওই বৃহৎ শ্মশানক্ষেত্রটি সংক্ষিপ্ত ও সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে। নিমতলার পুণ্যভূমিতে অতীতের বাংলার বহু মনীষীর বিলীয়মান স্মৃতি মাটির স্পর্শের মধ্যে আবার জেগে ওঠে। কোন শ্মশানক্ষেত্রই কখনও নিঃসঙ্গ থাকে না, তাই নিমতলার ঘাটেও লোকের আগমনের কখনো শেষ নেই – সারাদিন থেকে সারারাত্রি। সেখানে কারো চোখে যদি কখনও ঝিমুনিও চলে আসে, ওমনি আচমকা ‘বল হরি হরিবোল’ রব শুনে তাঁর ঘোর কেটে যাবে। সেখানে একটি অফিসও আছে, যেটি কখনও বন্ধ হয় না। সেখানে সবসময় শুধু কাজ আর কাজ। সেখানে সর্বদা শবদাহযাত্রীদের ভীড় লেগেই থাকে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ সেই ১৮২৮ সাল থেকে সেখানে ভস্মিভূত হয়ে চলেছেন, আর ভবিষ্যতেও হবেন। আগে প্রতিদিন ওই শ্মশানে যত শবদাহ করা হত, সেগুলোর সমস্ত ছাই নৌকায় করে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হত। কারণ, তখন মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দুর ধার্মিক দেহের অবশিষ্ট একমাত্র গঙ্গারই প্রাপ্য। এখন অবশ্য গঙ্গা দূষণ বন্ধ করবার জন্য অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতীত থেকে সুদূর পথ অতিক্রম করে কলকাতার নিমতলা শ্মশান ওএকটাই বদলে গিয়েছে, হয়ত ভবিষ্যতে আরো বদলাবে; কিন্তু বদলাবে না সেই অমোঘ সত্য – এই মায়ার পৃথিবীতে মৃত্যুই চূড়ান্ত বাস্তব।

(তথ্যসূত্র:
১- সেকালের সংবাদপত্রে কলকাতা, হরিপদ ভৌমিক সংকলিত।
২- কলকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র।
৩- কলকাতার ৩০০ বছরের ইতিহাস, অতুল সুর।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

আলাস্কান উড ফ্রগ, এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী এই ব্যাঙআলাস্কান উড ফ্রগ, এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী এই ব্যাঙ

আলাস্কান উড ফ্রগ। এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী ” সাত মাস ‘নিষ্প্রাণ’ দেহ, বরফে জমাট বেঁধেও দিব্যি জীবত থাকে এই ব্যাঙের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত এক ক্ষমতা। বা বলা ভালো, চরম

পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনওপৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

এত বৃহৎ পৃথিবীতে রহস্য রোমাঞ্চের শেষ নেই। কোনো জায়গায় ছোট্ট একখানা জমির জন্য লড়াই চলে, তো কখনো একটা গোটা দেশকেই গ্রাস করে নেয় আগ্রাসী শক্তি। তবে আজ আমরা এমন এক

‘গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ’‘গৌড়ের অধিকার নিয়ে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ’

১৫৭৪ খৃষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে মোঘলরা তাড়ায় প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন গৌড়েশ্বর দাউদ কররানি অতি সঙ্গোপনে নিজের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে সপ্তগ্রামের পথ ধরে উড়িষ্যার দিকে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নিলালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। আটটি ষড়যন্ত্রের প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিয়েও রহস্য দানা বাঁধতে দেখা গেছিল। সে রহস্যের মীমাংসা আজ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দ গেছিলেন একটা চুক্তিপত্র