রানা চক্রবর্তীঃ বিভিন্ন চৈতন্য জীবনীকারেরা নিজেদের লেখায় এমন অনেক কথা বলেছিলেন, যা চৈতন্য-জীবনের মূল আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। যে বিশ্বম্ভর ‘শৈব-গায়েনের’ পিঠে চড়ে আনন্দে নৃত্য করতেন, সেই বিশ্বম্ভরের দ্বিতীয় দেহ, সঙ্কর্ষণের অবতার ‘নিত্যানন্দ’কে দিয়ে ‘বৃন্দাবনদাস’ যে কাজ করিয়েছিলেন, তা অত্যন্ত নিন্দাজনক। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে সেন-বর্মণদের আমলে বঙ্গদেশের বৌদ্ধদের ওপরে যথেষ্ট অত্যাচার হয়েছিল; দেশে বৌদ্ধদের সংখ্যা তখন বেশ ভালো রকমই ছিল, প্রজাদের একটা বড় অংশ বিরূপ থাকবার ফলে উপরোক্ত দুটো রাজবংশই অনেকদিন রাজত্ব করতে পারে নি। চৈতন্যদেব ইতিহাসের সেই শিক্ষাকে নিজের জীবনে গ্রহণ করে জাত-পাতের বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। অথচ তাঁর দ্বিতীয় দেহ নিত্যানন্দ কি করেছিলেন –
“তবে নিত্যানন্দ গেলা বৌদ্ধের ভবন।
দেখিলেন প্রভু বসি আছে বৌদ্ধগণ৷৷
জিজ্ঞাসেন প্রভু কেহো উত্তর না করে।
ক্রুদ্ধ হই প্রভু লাথি মারিলেন শিরে৷৷
পলাইল বৌদ্ধগণ হাসিয়া হাসিয়া।
বনে ভ্রমে নিত্যানন্দ নির্ভয় হইয়া৷৷”
আরো পড়ুন- হেস্টিংস সাহেবের হানাবাড়ি
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৪৪)
নিত্যানন্দ শিরে লাথি মারা সত্ত্বেও বৌদ্ধরা ‘হাসিয়া হাসিয়া’ পলায়ন করেছিলেন। বৃন্দাবন এসব বলে আদতে বৌদ্ধদের প্রতি নিজের গভীর অবজ্ঞাই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, বৌদ্ধদের অবজ্ঞার চক্ষে দেখলেও নারায়ণের বিভিন্ন অবতারের কথা বলতে গিয়ে সেই বৃন্দাবনদাসই বলেছিলেন –
“রামচন্দ্ররূপে কর রাবণ সংহার।
হলধররূপে কর অনন্ত বিহার৷৷
বুদ্ধরূপে দয়া-ধর্ম করহ প্রকাশ।
কল্কিরূপে কর ম্লেচ্ছগণের বিনাশ৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ১৪)
বুদ্ধদেব যদি নারায়ণের অবতারই হন, তাহলে তাঁর শিষ্যদের হলধরের অবতার চৈতন্যদেবের দ্বিতীয় দেহ নিত্যানন্দ কেন ওভাবে অপমানিত করেছিলেন?
যে চৈতন্যদেব সমস্ত ধর্মের মধ্যে সত্যকে দেখতে পেয়েছিলেন, যিনি সমস্ত মন্দিবে মন্দিরে ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁর মুখ দিয়ে অন্য ধর্মগুরু সম্বন্ধেও নিত্যানন্দ যা বলিয়েছিলেন, সেটাও শোভন নয় –
“কাশীতে পঢ়াষ বেটা পরকাশানন্দ।
সেই বেটা করে মোর অঙ্গ খণ্ড খণ্ড॥”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ১১৫)
এই ভাষা প্রেম ও ভক্তির সাধক চৈতন্যদেবের মুখে বসিয়ে দিয়ে বৃন্দাবনদাস আদতে তাঁকে ছোটই করেছিলেন।
‘গীতা’য় বলা হয়েছে যে, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ঈশ্বর বার বার পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, ধর্মনিষ্ঠদের উদ্ধার এবং দুষ্কৃতকারীদের দমনের জন্যই তিনি আসেন। কিন্তু চৈতন্য-অবতারে তিনি কাদের দমন করবেন, প্রেম-ভক্তির অবতার কি কখনো সংহার করতে পারেন? কিন্তু তিনি সংহার না করলে যে গীতার বাণীও সার্থক হয় না। তাই কিঞ্চিৎ ইতঃস্ততঃ করেই তাত্ত্বিক ‘কৃষ্ণদাস কবিরাজ’ বলেছিলেন –
“পাষণ্ডী সংহারিতে মোর এই অবতার।
পাষণ্ডী সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার॥”
(চৈতন্যচরিতামৃত, পৃ- ৮৫)
অবশ্য সেই তত্ত্বজ্ঞই আবার গোপাল-চাপালের ব্যাপারে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, “সেই পাপী দুঃখ ভোগে না যায় পরাণ”। (চৈতন্যচরিতামৃত, পৃ- ৮৫)
জীবনীকারেরা ক্রুদ্ধ নিমাইয়ের যে পরিচয় দিয়েছিলেন, তাতে তাঁকে ‘অতিমানব’ করতে গিয়ে অমানব করে ফেলা হয়েছিল। সেই নিমাই শুধু ঘরের দ্রব্যসামগ্রীই কেবল ভাঙ্গচুর করেন নি, তিনি ঘর-বারও ভেঙ্গেছিলেন! সেবিষয়ে বৃন্দাবনদাস অবশ্য আশার বাণীই শোনাবার চেষ্টা করেছিলেন। নিমাইয়ের মহত্ব ছিল যে, তিনি কখনো নিজের মাকে আঘাত করেন নি – “তথাপিহ জননীরে না মারিল গিয়া” (চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৩৯)। ওদিকে ‘লোচনদাস’ এবং ‘জয়ানন্দ’ তো নিমাইকে দিয়ে নিজের জননীর মাথায় ‘ইষ্টক’ পর্যন্ত মারিয়ে ছেড়েছিলেন! কিন্তু তাত্ত্বিকের লেখায় সেই ধরনের কোন কিছুই পাওয়া যায় না। তাই চৈতন্যের বিষয়ে এই সমস্ত প্রায় পরস্পর বিরোধী কল্পিত কাহিনী পরিবেশন করবার কারণ কিছুই বোধগম্য হয় না। বাস্তবে চৈতন্যদেবের ওই ধরণের আচরণ কিন্তু কারো কল্পনারও অতীত। বঙ্গদেশে যাওয়ার কালে যিনি ‘লক্ষ্মীদেবী’কে নিজের গলার উপবীতটি দিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি জাত-পাতের পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়ে বৈষ্ণবরূপে সকলকে একাকার করে দিয়েছিলেন, তাঁকে ব্রাহ্মণ্যগৌরবে গৌরবান্বিত করবার প্রচেষ্টায় তাঁরই জীবনীকারেরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন। বৃন্দাবনদাস চৈতন্যদেবকে ‘বিপ্র’ বলে গৌরবান্বিত করতে চেয়ে লিখেছিলেন –
“জয় জয় দ্বিজকুলদীপ গৌরচন্দ্র।
…
জয় অধ্যাপক-শিরোরত্ন বিপ্ররাজ॥”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৬২)
‘চৈতন্যচরিতামৃত’ প্রণেতা তাত্ত্বিক ‘কবিরাজ গোস্বামী’ পর্যন্ত চৈতন্যদেবের দক্ষিণ ভ্রমণ যাত্রার সময়ে একজন সঙ্গী নিয়ে যাওয়ার বিষয়টির উল্লেখ করেছিলেন; মহাপ্রভুর সেই সঙ্গীর প্রধান গুণ এটাই ছিল যে, তিনি একজন কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন –
“কৃষ্ণদাস নাম শুদ্ধ কুলীন ব্রাহ্মণ।
যাঁরে সঙ্গে লৈয়া কৈল দক্ষিণ ভ্রমণ॥”
(চৈতন্যচরিতামৃত, পৃ- ৫৩)
এর আগে গোপ গৃহে যখন বিশ্বম্ভর উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন তাঁকে ব্রাহ্মণ দেখে গোপেরা সম্ভ্রমে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। বৃন্দাবনদাস তাঁর নিজের লেখায় সে সময়ের যে বিশ্বম্ভরের পরিচয় দিয়েছিলেন, তিনি তো ব্রাহ্মণ্যগর্বে গর্বিত ছিলেন না –
“বসিলেন মহাপ্রভু গোপের দুয়ারে।
ব্রাহ্মণ-সম্বন্ধে প্রভু পরিহাস করে॥
প্রভু বোলে ‘আরে বেটা! দধিদুগ্ধ আন।
আজি তোর ঘরের লইব মহাদান৷৷’ …”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৫৭)
যিনি নিজেই জাত-পাতকে অস্বীকার করেছিলেন, তিনিও কি ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতের শিষ্য গ্রহণ করতেন না? ‘মুকন্দ দত্ত’ তো তাঁর সহপাঠী ছিলেন। বৈদ্য ‘মুরারি গুপ্ত’ও তাঁর সতীর্থ ছিলেন। সুতরাং, তখনকার অধ্যাপকেরা যে বিভিন্ন জাতির মানুষদের শিক্ষা দিতেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। কিন্তু বৃন্দাবনদাস যা লিখেছিলেন, সেটা থেকে বিশ্বম্ভর সম্বন্ধে অন্য কথা মনে হয়। বিশ্বম্ভর বঙ্গদেশে যাওয়ার পরে, সেখানে তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়ে পড়ুয়ার দল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন –
“ভাগ্যবত যত আছে সকল ব্রাহ্মণ।
উপায়ন-হস্তে আইলেন সেই ক্ষণ॥”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৬৯)
ওদিকে ‘হরিদাসের’ কৃষ্ণভক্তির কথা স্মরণ করিয়ে বৃন্দাবন দাস নিজেই বলেছিলেন –
“… ‘জাতি-কুল-সর্ব নিরর্থক’ বুঝাইতে।
জন্মিলেন নীচ-কলে প্রভুর আজ্ঞাতে॥
অধম কুলেতে যদি বিষ্ণুভক্ত হয়।
তথাপি সেই সে পূজ্য, সর্বশাস্ত্রে কয়॥
উত্তমকুলেতে জম্মি শ্রীকৃষ্ণ না ভজে।
কালে তার কি করিবে নরকেতে মজে॥”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৮৫)
এই বৃন্দাবনদাসই আবার দেখিয়েছিলেন যে, বিশ্বম্ভর ব্রাহ্মণকে কি ভাবে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। গয়ার পথে বিশ্বম্ভরের জ্বর হয়েছিল। সেই জ্বর উপশমের ঔষধের ব্যবস্থা তিনি নিজেই করেছিলেন –
“তবে প্রভু ব্যবস্থিলা ঔষধ আপনে।
সর্ব দুঃখ খণ্ডে বিপ্রপাদোদক পানে॥
বিপ্রপাদোদকের মহিমা বুঝাইতে।
পান করিলেন প্রভু আপনে সাক্ষাতে॥
বিপ্রপাদোদক পান করিয়া ঈশ্বর।
সেইক্ষণে সুস্থ হৈলা, আর নাহি জ্বর॥”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৮৯)
যিনি ব্রাহ্মণের মহিমা প্রদর্শন করেছিলেন, সেই তিনিই কি কারণে সর্বজাতিকে এক করবার সাধনা গ্রহণ করেছিলেন? বৃন্দাবনদাস বর্ণিত সেই ‘বিপ্রপাদোদকের মহিমা প্রদর্শন’ আসলে চৈতন্যদেবের মূল চিন্তার পরিপন্থী। বিপ্রপাদোদকের মহিমা প্রদর্শন করতে গিয়ে বৃন্দাবনদাস চৈতন্যদেবের মহিমাকেই ক্ষুন্ন করেছিলেন। ইতিহাস বলে যে, চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানের পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই, যে বৈষ্ণব গোষ্ঠী সমূহের ব্রাহ্মণ নেতারা পুনরায় ব্রাহ্মণ্য মহিমা প্রতিষ্ঠায় ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন, চৈতন্যজীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে সেটারই স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। একথা কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে, নিজের বিপ্লবী মনোভাব সত্ত্বেও চৈতন্যদেব কিন্তু তৎকালে প্রচলিত সামাজিক আচার- আচরণকে ধূলিসাৎ করে নতুন চিন্তার বিরদ্ধে একটা বড় আকারের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি কখনোই করতে চান নি; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি নিজের জীবনের আচরণে এমন কোন কাজও করতে চান নি, যেটা তাঁর মূল আদর্শকে ব্যাহত করতে পারত। তাই ব্রাহ্মণদের তৎকালীন সামাজিক মর্যাদাকে তিনি ক্ষুন্ন করতে না চাইলেও, তাঁদের প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি করবার কোন উদ্দেশ্যও তাঁর ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, যে বৃন্দাবনদাস বিশ্বম্ভরকে দিয়ে বিপ্রপাদোদকের মহিমা কীর্তন করিয়েছিলেন, সেই বৃন্দাবনদাসই আবার ব্রাহ্মণ-বিষয়ক দুটো শ্লোক উদ্ধার করে কলিযুগের এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের অধঃপতিতরূপে প্রকাশ করেছিলেন – “রাক্ষসেরা কলিযুগ অবলম্বন করিয়া বিপ্রযোনিতে জন্মগ্রহণ করে; আর সেই বিপ্রকুলে জন্মিয়া কালপ্রভাবে যাঁহাদিগের সংখ্যা কৃশ বা ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে, সেই শ্রোত্রিয়কুলকে বাধা প্রদান করিতে থাকে।” (বরাহপুরাণে মহেশ-বাক্যম) এবং, “এ বিষয়ে অধিক আর কি বলিব, ব্রাহ্মণ হইয়াও যাঁহারা অবৈষ্ণব, প্রমাদনিবন্ধনও তাঁহাদের সম্ভাষণ ও স্পর্শন বিসর্জন করিবে।” (পদ্মপুরাণে মহেশ-বাক্যম) চৈতন্যদেব নিজেও বলেছিলেন যে, নিজে ধর্ম আচরণ করে তিনি অন্যকে শেখাবেন। ‘কৃষ্ণদাস কবিরাজ’ লিখেছিলেন –
“আপনি করিব ভক্তিভাব অঙ্গীকারে।
আপনি আচরি ভক্তি শিখাইমু সবারে৷৷
আপনি না কৈলে ধর্ম শিখান না যায়।”
(চৈতন্যচরিতামৃত, পৃ- ৭)
সুতরাং নিজের জীবনের আচরণে বিপ্র মহিমা কীর্তন করা বিশ্বম্ভরের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাঁর জীবনীকারেরাই সমকালীন ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে চৈতন্যদেবকে ছোট করে ফেলেছিলেন।
জীবনীকারেরা বালক-যুবক বিশ্বম্ভরকে দিয়ে বেশ কয়েকবার নারায়ণরূপ দর্শন করিয়েছিলেন। বাল-গোপাল ভক্ত বিপ্রকে বালক নিমাই প্রথমে স্বরূপ দেখিয়েছিলেন। বৃন্দাবনদাস লিখেছিলেন –
“সেই ক্ষণে দেখে বিপ্র পরম অদ্ভুত।
শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, অষ্টভূজ-রূপ৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ২৪)
সেই রূপ দেখানোর পরে চৈতন্যের মুখ দিয়ে সাবধান বাণীও উচ্চারণ করানো হয়েছিল যে, সেই গোপন কথা যেন কেউ জানতে না পারেন, জানতে পারলে – “করিব সংহার”। (চৈতন্যভাগবত, পৃ- ২৫) এখন প্রশ্ন হল যে, ওই রূপে দর্শন দেওয়াই বা কেন আর সংহারের ভয় দেখানোই বা কেন? প্রেম-ভক্তির অবতার বলে যাঁকে প্রতিষ্ঠিত করবার বাসনা, তাঁর মনে সংহার করবার প্রেরণাই বা জাগে কেন? ওসব করে, প্ৰেম বিলাতে যিনি এসেছিলেন তাঁকেই কি ছোট করা হয়নি?
দিগ্বিজয়ীর পরাজয়ের পরে সরস্বতী তাঁকে দর্শন দিয়ে নিমাইয়ের সত্যি পরিচয় জানিয়ে বলেছিলেন –
“সরস্বতী বোলেন শুনহ বিপ্রবর।
বেদ-গোপ্য কহি এই, তোমার গোচর৷৷
কারো স্থানে ভাঙ্গ যদি এ সকল কথা।
তবে তুমি শীঘ্র হবে অল্পায়ু সর্বথা৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৬৫)
কেবল সরস্বতীর কথাই নয়, বিশ্বম্ভর নিজেও দিগ্বিজয়ীকে বলেছিলেন –
“যে কিছু তোমারে কহিলেন সরস্বতী।
তাহা পাছে বিপ্ৰ! আর কহ কাহা প্রতি৷৷
বেদগুহ্য কহিলে হয় পরমায়ু ক্ষয়।
পরলোকে তার মন্দ জানিহ নিশ্চয়৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৬৭)
বেদগুহ্য কথা প্রকাশ্যে বললে পরকালেও যে বিপদ হতে পারে সেটা চৈতন্যের মুখ দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি দেবতার বাক্য শোনাবার জন্যও ভয় দেখাতে হয়েছিল! প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রেম-ভক্তি কি ভীতি প্রকাশের ওপর নির্ভরশীল? জগাই-মাধাই উদ্ধারের ক্ষেত্রেও চৈতন্য জীবনীকারেরা চৈতন্যদেবের প্রেম-ভক্তির জয় ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবং নিজেদের লেখায় সেই মহামানবের ব্যক্তিত্বকে ছোট করে ফেলেছিলেন। বৃন্দাবনদাস লিখেছিলেন –
“অবধূত নাম শুনি মাধাই কুপিয়া।
মারিল প্রভুর শিরে মুটুকী তুলিয়া৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ১৭০)
এরপরে নিত্যানন্দের মস্তক থেকে রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল। চৈতন্যদেব তা দেখে – “… ‘চক্র! চক্র! চক্র!’ প্রভু ডাকে ঘনে ঘনে,” (চৈতন্যভাগবত, পৃ- ১৭০)। সেক্ষেত্রে প্রেম-ভক্তির আদৌ জয় হয়েছিল কি? “মেরেছিস কলসীর কানা তাই বলে কি প্রেম দেবো না?” – এই বাক্যটিই তো সেক্ষেত্রে সঠিক কথা হতো। সেই জায়গায় চক্রকে আহ্বান করিয়ে চৈতন্যদেবের আদর্শকেই ক্ষুন্ন করা হয়েছিল। বৃন্দাবনদাসের সুদর্শন চক্র কেউ দেখতে পান নি, সুতরাং চৈতন্যদেবের দিক থেকে তখন প্রেম-ভক্তির অপমৃত্যু ঘটালেও জগাই-মাধাই যে চক্রের ভীতিবশতঃ পরিবর্তিত হয়েছিলেন – সেকথা বলা চলে না। কিন্তু, লোচনদাসের রচনায় সুদর্শন জগাই মাধাইয়ের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, তাঁরা ভীত-ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন –
“দেখিলেন জগাই মাধাই সুদৰ্শন।
কাঁপিতে লাগিল অঙ্গ – তরাসিত মন৷৷”
(চৈতন্যচরিতামৃত, লোচন দাস, পৃ- ১২০)
অবশ্য লোচনের নিত্যানন্দ সবদিক রক্ষা করে প্রেমের জয় ঘটিয়েছিলেন –
“কি করিল ভগবান ঐশ্বর্য প্ৰকাশে৷৷
করুণাতে উদ্ধার করিব ত্রিভুবন।
দীনহীন পতিত পামর দুষ্টজন৷৷
…
পতিত পাবন নামের গরিমা রাখিব৷৷”
(চৈতন্যচরিতামৃত, লোচন দাস, পৃ- ১২০)
কবিরাজ গোস্বামী বৃন্দাবনদাসের ওপরে বরাত দিয়ে সে বিষয়ে আর অগ্রসর হন নি। ওদিকে ‘বিশ্বনাথ চক্রবর্তী’ তাঁর গন্থে বিশ্বম্ভরকে মুক্তোর ঝালর যুক্ত সোনার পালঙ্কে শয়ান দেখিয়ে, একজন মহান ব্যক্তিত্বকে বিলাসী বানিয়ে সাধারণ মানুষের চোখে অনেক নিচে নামিয়ে ছেড়েছিলেন। ঐশ্বর্যে মুড়িয়ে দিলেই মানুষ ভগবানের নিকটবর্তী হয়ে যায়, এই ধরণের ভ্রান্ত ধারণা কি করে ভক্তদের হতে পারে! সবচেয়ে বড় কথা হল যে, বিশ্বম্ভর সোনার পালঙ্কে শয়ন করবার মতো ঐশ্বর্য কোথায় পেয়েছিলেন? ‘জগন্নাথ মিশ্র’ তো বলেছিলেন –
“সাক্ষাতেই এই কেনে না দেখ আমাত।
পঢ়িয়াও আমার ঘরে কেনে নাহি ভাত৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৩৩)
পরবর্তীকালে তিনি বহু শিষ্য পেয়েছিলেন আর তার ফলে প্রচুর উপার্জন হয়েছিল? প্রচুর শিষ্য পেয়েছিলেন – একথা সত্যি, কিন্তু বিত্তবান হয়েছিলেন কি? বঙ্গদেশে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল –
“ঘরে কিছু নাঞি আই চিন্তে মনে মনে।
কুড়ি সন্যাসীর ভিক্ষা হবে কেমনে?”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৬৮)
বিশ্বভরের দ্বিতীয় বিবাহের সময় বুদ্ধিমন্ত খান প্রভৃতি ভক্ত, বন্ধু ও শিষ্যেরা তাঁর বিবাহের ব্যয় নির্বাহ করেছিলেন। সাধারণ অবস্থার একটি দম্পতির জন্য সোনার খাটের ব্যবস্থা করে ভক্তরা নিজেদের মনোবাসনা চরিতার্থ করলেও তাতে ভক্তির পাত্রকে সম্মানিত করা হয়নি।
বিশ্বম্ভরের অলৌকিক শক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে বৃন্দাবনদাস একটি হাস্যকর বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন যেটা কখনই কোন ব্যক্তিত্বের জীবন-পদ্ধতি বলে স্বীকৃত হতে পারে না। তখনও বিশ্বম্ভরের বিবাহ হয় নি, সংসার চলত না, ওদিকে তিনি নাকি মাঝে মাঝেই কোথা থেকে এক তোলা, দুই তোলা সোনা নিয়ে এসে তাঁর জননীর হাতে দিতেন! শচীদেবী ভাবতেন –
“কিবা ধার করে, কিবা কোন সিদ্ধি জানে।
কোনরূপে কার সোনা আনে বা কেমনে৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ৪০)
এতে সংসার চালানো গেলেও, জীবনীকারেরা যাঁকে অবতার প্রমাণ করতে বসেছিলেন, তাঁর ব্যক্তিত্বের উদ্দেশ্যের মর্যাদা রক্ষা করা কিন্তু সম্ভব হয়নি। সম্ভবতঃ নিজের অনবধানবশতই বৃন্দাবনদাস এমন একটি মারাত্মক ভ্রম করেছিলেন, যেটা দিয়ে চৈতন্যদেবের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। জগাই-মাধাই তখন রাত্রিবেলা চৈতন্যদেবের গৃহের বাইরে দাঁড়িয়ে কীর্তন শুনতেন এবং মদ্যপান করতেন। ফলে ভক্তরা ভয়ে থাকেন, কিন্ত, তা বলে স্বয়ং চৈতন্যদেবও? জগাই-মাধাই বলেছিলেন –
“প্রভুরে দেখিয়া বোলে নিমাঞি পণ্ডিত!
করাইলা সম্পূর্ণ মঙ্গলচণ্ডী-গীত৷৷
গায়েন সব ভাল মুঞি দেখিবারে চাঙ।
সকল আনিঞা দিব যথা যেই পাঙ৷৷
দুর্জন দেখিয়া প্রভু দূরে দূরে যায়।
আর-আর পথ দিয়া সভেই পালায়৷৷”
(চৈতন্যভাগবত, পৃ- ১৭০)
দুর্জন দেখে দূরে দূরে থাকলে চৈতন্যদেবের আর কিছু বাকি থাকে কি!
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, যুগে যুগে ভক্তরাই তাঁদের ভক্তির পাত্রদের নীচে নামিয়ে আনেন। রাজনীতি, সমাজনীতি এবং ধর্মনীতির সকল ক্ষেত্রেই ওই একই কথা প্রযোজ্য। চৈতন্যের সমস্ত জীবনীগ্রন্থ থেকেই এই ধরণের আরও প্রচুর উদাহরণ দেওয়া চলে। বৃন্দাবনদাসকেই এই প্রবন্ধে প্রধান উপজীব্য করা হয়েছে এই কারণে যে, চৈতন্যের আদিলীলা রচনার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন ‘ব্যাস’। তৎকালীন নবদ্বীপের ভক্তদের মনোভাব জানবার সম্ভাবনা তাঁরই সর্বাপেক্ষা অধিক ছিল। মনে হয় যে, ভক্তদের সেই মনোভাব অনুসারেই ঘটনাগুলিকে প্রয়োজন মত বিকৃত করা হয়েছিল। সেটা করতে গিয়ে, ভক্তির অতিশয্যে চরিত্রকে যে আদর্শচ্যুত করা হচ্ছে, সে কথাটাও তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন। যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
(তথ্যসূত্র:
১- চৈতন্যভাগবত, বৈষ্ণবচরণ দাস।
২- চৈতন্যভাগবত, ঈশ্বর দাস।
৩- চৈতন্যভাগবত, বৃন্দাবনদাস ঠাকুর।
৪- চৈতন্যমঙ্গল, জয়ানন্দ, ডঃ বিমানবিহারী মুখোপাধ্যায় ও ডঃ সুখময় মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৫- চৈতন্যমঙ্গল, লোচনদাস ঠাকুর।
৬- চৈতন্যচরিতামৃত মহাকাব্য, কবিকর্ণপূর।
৭- চৈতন্যচরিতামৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ডঃ সুকুমার সেন সম্পাদিত।
৮- কাঁহা গেলে তোমা পাই, ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়।
৯- শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান, ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার।)