বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব)

বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ বিনা যুদ্ধে আকবরের হাতে বাংলা ও বিহার সঁপে দিয়ে ‘দাউদ কররানি’ যখন উড়িষ্যায় চলে গিয়েছিলেন তখন তিনি নিজের পিছনে এক বিরাট শূন্যতা ছেড়ে গিয়েছিলেন। সে যুগের সব দেশের মত দাউদ তাঁর সামন্ত নরপতিদের সাহায্যে পিতৃরাজ্য শাসন করতেন। তাঁরা জনসাধারণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ রক্ষা করে তাঁকে রাজ্য শাসনে সাহায্য করতেন। প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ, স্বনির্দিষ্ট ভূভাগের শান্তিরক্ষা, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ও আপৎকালে সসৈন্যে অধিরাজের পাশে দাঁড়ানো সেই সামন্তদের দায়িত্ব ছিল। তাঁদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী থাকত, অনেকের আবার নিজস্ব দুর্গও ছিল। তাঁরা সপরিবারে সেই সব দুর্গে বাস করতেন। আর যাঁদের দুর্গ ছিল না, তাঁরা গড়বন্দী প্রাসাদে থাকতেন। তখন শুধু গৌড়েই নয়, ভারতের সমস্ত অঞ্চলেই ওই সামন্ততন্ত্র শাসনব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। তৎকালীন বাংলায় সামন্ত নরপতিদের সংখ্যা যাই হোক না কেন, সম্মিলিতভাবে তাঁদের ‘বারো ভূঁইয়া’ বলা হত। অনুরূপ বারো ভূঁইয়ারা কামরূপ ও ত্রিপুরাতেও ছিলেন। এমনকি রাজস্থানের কোন কোন রাজ্যেও ছিলেন। তখন তাঁদের নিয়েই রাজার রাজসভা বা পার্লামেন্ট গঠিত হত। তাতে সামন্তরা থাকতেন; মন্ত্রী, সেনাপতি, রাজগুরু, রাজপুরোহিত সবাই থাকতেন। আপৎকালে পরামর্শের জন্য ছোট ছোট জায়গীরদারদেরও সেখানে আহ্বান করা হত। ভারতে হিন্দু রাজত্বের অবসানের পরে তুর্কীরা এসে ভারতের যে সব অঞ্চলের আধিপত্য লাভ করেছিলেন, তাঁরাও সেখানে প্রাচীন যুগের সেই সামন্ততন্ত্রকে চালিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাঁদের আমীরেরা পূর্বতন সামন্ত নরপতিদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। এরপরে আফগানরা এসে তুর্কী আমীরদের সরিয়ে দিয়ে সেই পদে স্বজাতীয়দেরকে নিয়োগ করেছিলেন। বাংলায় কররানি বংশের পতনের পরে দেখা গিয়েছিল যে, তাঁদের কয়েকজন সামন্তের বিক্রম অধিরাজের চেয়ে কম কিছু ছিল না। দাউদ কররানি মোঘলদের চাপে উড়িষ্যায় পালিয়ে গেলেও তাঁর সামন্তদের দাপটে আকবরের সুদীর্ঘ রাজত্বকালের মধ্যে মোঘল শক্তি বাংলায় ভালোভাবে নিজের শিকড় গাঁড়তে পারে নি। বিশেষ করে পূর্ব বাংলায়। কারণ, মোঘলবাহিনীর প্রধান দুটি অঙ্গ – অশ্বারোহী সৈনিক ও ভারী কামান – ওই জলময় ভূভাগে অচল ছিল। মোঘলদের কাছে কখনোই কোন শক্তিশালী নৌবহর ছিল না, তাঁদের সেনানায়কেরা জলযুদ্ধ সম্পর্কে অবগতও ছিলেন না। সেই কারণে ওই অঞ্চলের ভূস্বামীরা দীর্ঘকাল ধরে মোঘলশক্তিকে অগ্রাহ্য করে গিয়েছিলেন। দিল্লী থেকে একের পর এক ফৌজদার এসে পূর্ব বাংলার ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে গেলেও যুদ্ধশেষে দেখা গিয়েছিল যে, তাঁরা যেমন ছিলেন তেমনি রয়ে গিয়েছেন। ওই ভাবেই আকবরের রাজত্বকাল এবং জাহাঙ্গীর শাসনের অর্দ্ধাংশ চলেছিল। সেই সুদীর্ঘ সময়টা ধরে গৌড়ের ইতিহাস মুখ্যতঃ ভূস্বামীদের ইতিহাস ছিল বলে সেই সময়ের কয়েকজন শক্তিশালী ভূস্বামীর পরিচয় এই প্রবন্ধে দেওয়া হল।

বাংলার বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে বিষ্ণুপুররাজ ‘বীর হাম্বীরের’ মর্য্যাদা সবার উপরে ছিল। প্রায় সমগ্র বাঁকুড়া জেলা এবং মানভূম, বর্ধমান ও বীরভূমের কিছুটা অংশ নিয়ে গঠিত তাঁর রাজ্য উড়িষ্যা ও গৌড়ের প্রত্যন্ত প্রদেশে অবস্থিত হওয়ার ফলে সমগ্র তুর্কী আফগান যুগে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা প্রায়-স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। রাজ্যের দুই সীমান্তে দুই শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব রেখে তাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে গিয়েছিলেন। তৎকালীন বাংলার অন্যান্য ভূঁইয়া রাজার মত বীর হাম্বীর কোন ভুঁইফোড় রাজা ছিলেন না। তাঁর মল্লবংশের ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন ছিল। অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘আদিশূর’ যখন রাঢ় অধিকার করেছিলেন, ঠিক সেই সময়কার ‘রঘুনাথ মল্ল’ থেকে ওই বংশের একটি ধারারাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। তাঁরা কোনদিনই যেমন নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবী করেন নি, তেমনি আবার পুরাপুরি কোন রাজার অধীনও কোনদিন হন নি। কোনও না কোন শক্তিশালী রাজ বংশের সামন্তরূপে তাঁরা নিজেদের অধিকার চিরদিন অক্ষুণ্ণ রেখে গিয়েছিলেন। এর ফলে মাঝে মাঝেই অধিরাজ বদলালেও, তাঁরা কিন্তু বদলান নি। ওই ভাবেই মোঘল যুগের শেষভাগ পর্যন্ত সহস্রাধিক বছর ধরে চলবার পরেও দেখা গিয়েছিল যে, বিষ্ণুপুররাজের ‘দলমাদল’ কামানের ভয়ে মারাঠা বর্গীরা বিষ্ণুপুরকে পাশে রেখে কলকাতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। মধ্যযুগের গৌড়ে যত রাজবংশ রাজত্ব করেছিলেন, তাঁরা সবাই মল্লরাজাদেরকে উচ্চ সম্মান দিয়েছিলেন, কররানিরাও দিয়েছিলেন। দাউদ কররানি বাংলার মসনদে আরোহণ করেই আকবরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় উদ্যত হয়েছেন জানতে পেরে বীর হাম্বীর তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে একটি পত্রে লিখেছিলেন, “মোঘলদের সঙ্গে কলহ কোর না। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখো। তাতে তোমার লাভ বই লোকসান হবে না।” কিন্তু হিতৈষী রাজার সেই পরামর্শকে উপেক্ষা করে দাউদ আকবরকে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আহ্বান করলে বীর হাম্বীর নিরপেক্ষ থেকে গিয়েছিলেন, তিনি কোন পক্ষেই যোগ দেন নি। পরে কতলু খাঁর সৈন্যরা তাঁর রাজ্যে প্রবেশ করে মান সিংহের পুত্র জগৎ সিংহকে বন্দী ও আহত করেছেন শুনতে পেয়ে তিনি সেই যুবককে আফগানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে তাঁকে নিরাময় করে তুলেছিলেন। অন্য কেউ সেকাজ করলে আফগানরা হয়ত তাঁকে রেহাই দিতেন না, কিন্তু বিষ্ণুপুররাজের মর্য্যাদা এতটাই উচ্চ ছিল যে তাঁরা কিছু করতে সাহস পান নি। বীর হাম্বীরের সেই নির্ভীকতা ও উদারতার জন্য মানসিংহ তাঁর প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনিও নামমাত্রই মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে আগের মত রাজ্যশাসন চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর রাজত্বের গোড়ার দিকে সম্পূর্ণ বিনা কারণেই মোঘলদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল।
বাংলার বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান ঈশা খাঁকে ‘আবুল ফজল’ অন্যান্য সব ভূস্বামীর অগ্রগণ্য বলে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর পিতা ‘কালিদাস গজদানি’ যে কিভাবে ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ভাটি রাজ্য সংগঠিত করেছিলেন, সেসব বিবরণ ইতিহাসের কোথাও লিপিবদ্ধ নেই ৷ মূলে রাজপুত বৈশ্য কালিদাস শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহের রাজত্বকালে (১৪৪৫-৫৩) গৌড়ে গিয়ে আফগানদের সঙ্গে অহরহ মেলামেশা করতেন। সেই সময়ে ইসলাম গ্রহণ করবার ফলে তাঁর নতুন নাম হয়েছিল – ‘সোলেমান খাঁ’। তিনি ইসলাম কবুল করেছেন জানতে পেরে সুলতান ইসলাম সাহ যথেষ্ট খুশী হলেও তাঁর ভাটি জমিদারী যেভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, তাতে তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়েও পারেন নি। এরপরে সোলেমানকে দমন করবার জন্য তিনি ভাটিতে নিজের ফৌজ পাঠালে তাঁরা তাঁকে বন্ধুভাবে স্বগৃহে আমন্ত্রণ করে শমন সদনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, ও তাঁর পুত্র ঈশা ও ইসমাইলকে তুরাণী দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। সেই ব্যবসায়ীরা দুই ভাইকেই জাহাজে তুলে বিদেশে চালান করে দিয়েছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পরে কালিদাসের এক আফগান রমণীর সঙ্গে বিবাহ হওয়ার জন্য তাঁর পুত্র ঈশাকে মাতৃ পরিচয়ে আফগান বলা হত। এমনকি মোঘলরাও ঈশাকে আফগান বলতেন। সেই নয়া আফগান যখন অগ্রজের সঙ্গে বিদেশে ক্রীতদাসের জীবন যাপন করছিলেন, সেই সময়ে ইসলাম খাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তার কিছুদিন পরে হুমায়ুন এসে যখন দিল্লী অধিকার করে নিয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্রবিপ্লবের সময়ে ঈশার পিতৃব্য ‘কুতুবুদ্দীন’ তাঁর উভয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে বহু অন্বেষণের পর খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে এনে সুকৌশলে তাঁদের ভাটির জমিদারীতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ওই সময়ে হোসেন শাহ বংশীয়া ‘ফতেমা খানমের’ সঙ্গে ঈশার বিবাহ হওয়ার ফলে তাঁর মর্য্যাদা যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। বাংলায় কররানিদের পতনের পরে তাঁর সম্প্রসারিত ভাটিরাজ্যই মোঘল বিতাড়িত বহু আফগানের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই আশ্রয়প্রার্থী আফগানদের মধ্যে মাসুম খাঁ কাবুলি প্রধান ছিলেন। কররানিদের পতনের পরে অন্যান্য জমিদারের মত ঈশা খাঁও সেই রাজবংশের আনুগত্য থেকে মুক্ত হলেও মোঘলদের বশ্যতা স্বীকারে অসম্মত হয়েছিলেন। তাই তাঁকে দমন করবার জন্য ‘খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ’ ওই নদীবহুল ভূভাগে নৌবাহিনীর অধ্যক্ষ ‘মীর-নাওয়ারা শাহবর্দী’কে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে স্থলবাহিনীসহ সেখানে যাত্রা করেছিলেন। এরপরে ভাওয়ালে বাদশাহী ফৌজের ঘাঁটি স্থাপিত হলে তিনজন আফগান জায়গীরদার সেখানে গিয়ে খান-ই-জাহানের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা মোঘলদের শত্রু ছিলেন না, তাঁদের নায়ক ঈশা খাঁ ও তাঁর ডান হাত মাসুম খাঁ কাবুলি মোঘলদের আসল শত্রু ছিলেন। তাই তাঁরা বিদ্রোহপ্রবণ থাকলে অন্যদের সেই আনুগত্যের কোন অর্থ ছিল না ৷ তাই সবদিক চিন্তা করে শাহবর্দী ও মহম্মদ কুলির নেতৃত্বে খান-ই-খানান দুইটি শক্তিশালী জল ও স্থল বাহিনীকে সেই দুই শত্রুর বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শাহবর্দী আগে বিদ্রোহপ্রবণ থাকলেও তখন বাদশাহের অনুগত ভৃত্য হয়েছেন জানতে পেরে খান-ই-খানান তাঁর কাছে অনেক কিছু আশা করেছিলেন। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণেই শাহবর্দীর নৌবহর যুদ্ধের সময়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। তা সত্ত্বেও কস্তাল নামক জায়গায় প্রচণ্ড সংগ্রামের পরে মোঘল ফৌজ ঈশা খাঁকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছিল; তাঁর পরিত্যক্ত বহু রণসম্ভার তাঁদের হস্তগত হয়েছিল। কিন্তু মোঘলদের সেই সাফল্য একেবারেই সাময়িক ছিল। কারণ, ঈশা খাঁর দু’জন অনুচর – ‘মজলিশ দিলওয়ার’ ও ‘মজলিশ প্রতাপ’ – তাঁদের নৌবহরসহ সেখানে পৌঁছে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ শুরু করলে সেই আক্রমণে মোঘল পক্ষের বহু সৈনিক হতাহত হয়েছিলেন ও বহু সৈনিক নৌকায় চড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। মহম্মদ কুলি যথেষ্ট বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষপর্যন্ত আফগানদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তখন অবস্থা মোঘলদের প্রতিকূল দেখে খান-ই-খানান সেই যুদ্ধ অমীমাংসিত রেখেই নিজের রাজধানী তাড়ায় ফিরে গিয়েছিলেন, এবং কিছুদিন পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। এরপরে বাংলার পরবর্তী মোঘল ফৌজদার ‘সাহাবাজ খাঁ কম্বু’ তাড়ায় পৌঁছে চারিদিকে বিশৃঙ্খলা দেখতে পেয়েছিলেন। তখন দক্ষিণে কতলু খাঁ লোহানির নেতৃত্বে উড়িষ্যার আফগানরা আবার সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিলেন, এবং পূর্বদিকে মাসুম খাঁ কাবুলি ভাটি অঞ্চলে গিয়ে মোঘলদের উত্তর-পূর্ব বাহিনীর অধ্যক্ষ তরসুন খাঁকে আক্রমণের উদ্যোগ করছিলেন। এককথায় বাংলার সর্বত্র তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল। ওই সময়ে ভূষনার ‘কেদার রায়’ ও যশোহরের ‘প্রতাপাদিত্য’ প্রমুখ যে সব ভূস্বামীরা ছিলেন, তাঁরা কেউই মোঘলদের গ্রাহ্য করতেন না। সেই অবস্থায় সাহাবাজ খাঁর আবার নতুন করে বাংলা জয় করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। তাঁর জন্য শুধু আশার কথা এটাই ছিল যে, ততদিনে বিদ্রোহ-প্রবণ শাহবর্দী লোকান্তরিত হওয়ার ফলে তাঁর অধীনস্থ তিন হাজার নৌসৈন্য আবার বাদশাহী ফৌজে ফিরে এসেছিলেন, এবং ভূঁইয়া রাজদের মধ্যে কোন সংহতি ছিল না। সাহাবাজ লক্ষ্য করেছিলেন যে, মাসুম খাঁ কাবুলির নিজস্ব কোন রাজ্য না থাকলেও বিদ্রোহীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশী আক্রমণশীল। তাই তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে সাহাবাজ ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে ঈশা খাঁর রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। সেবারে খিজিরপুরের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে তাঁর সৈন্যদের পক্ষে সুবর্ণগ্রামে পৌঁছে সেখান থেকে ঈশার সদর কত্রাভুতে পৌঁছানো কিছু কষ্টসাধ্য হয় নি। তারপরে এগারসিন্ধু দুর্গ অধিকার করে সাহাবাজ ব্রহ্মপুত্র তীরে পৌঁছানোর পরে মাসুম খাঁ কাবুলি তাঁর সম্মুখীন হয়েছিলেন, এবং পরাজিত হয়ে একটি দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁকে বন্দী করবার জন্য সাহাবাজ খাঁ যখন নিজের জাল বিস্তার করছিলেন, এমন সময়ে ঈশা খাঁ এক বৃহৎ সৈন্যবাহিনীসহ সেখানে উপস্থিত হয়ে মোঘল ছাউনি টোকের উপরে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই ফাঁকে মাসুম খাঁ তাঁর নিজের সৈন্যদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অদূরে অবস্থিত মোঘলদের দ্বিতীয় সৈন্যাধ্যক্ষ তরসুন খাঁর বিচ্ছিন্ন বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তরসুন আকবরের একজন শ্রেষ্ঠ সৈন্যাধ্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও সেই অপ্রত্যাশিত আক্রমণের ফলে তিনি আহত ও বন্দী হয়েছিলেন। মাসুম খাঁ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে, মোঘলদের সঙ্গ ত্যাগ করে তিনি যদি শাহবর্দীর মত তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন, তাহলে তাঁরা তাঁকে মাথায় তুলে নেবেন। কিন্তু তরসুন তাঁর কোথায় রাজী হননি, তিনি বাদশাহের সঙ্গে বেইমানি করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তখন মাসুম খাঁ রুষ্ট হয়ে তাঁকে শমন সদনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় সাত মাস ধরে ওই ভাবে ঈশা খাঁর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে তাঁকে বশীভূত করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে সাহাবাজ শেষপর্যন্ত ভগ্নহৃদয়ে তাড়ায় ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই ব্যর্থতার কথা আকবরের কাছে পৌঁছানোর পরে তিনি বাংলা ও বিহারের সব মোঘল অফিসারদের আদেশ দিয়েছিলেন যে, যেমন করেই হোক ভাটির বিদ্রোহী জমিদারকে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু বিদ্রোহ তখন শুধু ভাটিতে নয়, বাংলার সর্বত্রই চলছিল। মোঘলরা নামেই বাংলা জয় করেছিলেন, কোন জমিদারই তাঁদের কাছে মাথা নীচু করেন নি। তার উপরে তখন উড়িষ্যা থেকে আফগানরা এসে পশ্চিম বাংলায় মাঝে মাঝে হামলা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বাদশাহ ঈশা খাঁর ধ্বংসের উপরেই গুরুত্ব দেওয়ার জন্য মোঘল অফিসাররা সেই কাজকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এরপরে তাঁদের সম্মিলিত বাদশাহী ফৌজ নিজেদের বিপুল রণসম্ভাব নিয়ে ভাটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। সেই ফৌজের প্রচণ্ড আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে মাসুম খাঁ কাবুলি তাঁর দু’টি তাঁদের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। সেই বিরাট মোঘল বাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার সাধ্য ঈশা খাঁরও ছিল না। তাই শত্রুর অনুগ্রহ লাভের আশায় আগের যুদ্ধে তিনি যেসব হস্তী ও কামান হস্তগত করেছিলেন, সেগুলিকে সাহাবাজ খার কাছে ফেরত পাঠিয়ে বাদশাহের প্রতি নিজের আনুগত্য জানিয়েছিলেন (১৫৮৫)। সেই সংবাদে আকবর খুশি হলেও তিনি ঈশা খাঁর প্রতি কোন ধরণের কোমলতা দেখাতে নিষেধ করেছিলেন। তাঁর সেই আদেশ মোঘল শিবিরে পৌঁছানোর পরে সৈন্যাধ্যক্ষরা নতুন উদ্যমে আবার আক্রমণ সুরু করেছিলেন। ঈশা খাঁ যখন দেখতে পেয়েছিলেন যে, আর সেই যুদ্ধ চালানো নিরর্থক, তখন তিনি সরাসরি বাদশাহের কাছে মূল্যবান উপঢৌকন পাঠিয়ে তাঁর অনুকম্পা ভিক্ষা করেছিলেন। সেই সময়ে মাসুম খাঁ কাবুলিও তাঁর নিজের পুত্রকে প্রতিভূ স্বরূপ আগ্রায় পাঠিয়ে দিয়ে মক্কায় তীর্থযাত্রা করেছিলেন। এরপরে সাত বছর আর কোন গোলমাল হয়নি। ওই সময়ে মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র বহু সমস্যা থাকবার জন্য আকবর ঈশা খাঁ ও অন্যান্য ভূস্বামীদের দিকে নজর দেওয়ার অবসরও পান নি। তারপরে ১৫৯২ খৃষ্টাব্দে মান সিংহ বাংলার ফৌজদার হয়ে এসে দেখতে পেয়েছিলেন যে, কোন ভূস্বামীই রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করেন নি, বরং সময়ের সদ্ব্যবহার করে তাঁদের সবাই নিজেদের সামরিক বল বাড়িয়ে মোঘলদের যথেষ্ট দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তখন তাঁদের পূর্বসুহৃদ আফগানরা তো ছিলেনই, তার উপরে পর্তুগীজরা এসে অনেকের ঘাড়ে ভর করেছিলেন। মাসুম খাঁ কাবুলি তাঁর যে পুত্রকে আগ্রায় প্রতিভূ করে পাঠিয়েছিলেন, তিনি চুপিচুপি সেখান থেকে বাংলায় পালিয়ে এসে নিজস্ব জমিদারী বেশ বাড়িয়ে ফেলেছিলেন। ওদিকে তাঁর পিতাও হজ শেষ করে ভাটিতে ফিরে এসেই যথেষ্ট ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন। মান সিংহ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁদের যদি তখনই শেষ করা না হয়, তাহলে একদিন তাঁরাই বাদশাহী শাসন খতম করে দেবেন। তাই তিনি সব আয়োজন সম্পূর্ণ করে ১৫৯৫ খৃষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর তারিখে ভাটির দিকে রওনা হয়েছিলেন। তাঁর আগমন সংবাদে আফগানরা গা ঢাকা দেওয়ায় তিনি বিনা বাধায় ভাটি রাজ্যের অর্দ্ধাংশ জয় করে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর সমস্যা শুধু ঈশা খাঁ ছিলেন না, আরো অন্যান্য বিদ্রোহীরাও ছিলেন। তাঁদের বিরোধীতার জন্যই মোঘল শক্তি বাংলার কোথাও তখন স্থিতিলাভ করতে পারছিল না। সেই বিদ্রোহীদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে গিয়ে মান সিংহ গুরুতর পীড়ায় শয্যাশায়ী হওয়ার পরে ঈশা খাঁ, মাসুম খাঁ কাবুলি প্রভৃতি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি রোগশয্যা থেকেই তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত করে গিয়েছিলেন, তাঁর পুত্র হিম্মৎ সিংহ সসৈন্যে ভাটিতে গিয়ে ঈশা খাকে এগার সিন্ধু দুর্গ আটক করে নিয়েছিলেন। তারপর থেকেই উভয় পক্ষের মধ্যে লুকোচুরি খেলা চলেছিল। পরের বছর ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে মান সিংহের অপর এক পুত্র দুর্জন সিংহ ঈশা খাঁর সদর কত্রাহু আক্রমণ করে স্থলযুদ্ধে আফগানদের পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু সেখানে কয়েক দিন ধরে যুদ্ধ চলবার পরেই ভাটি রাজ্যের সব অঞ্চল থেকে আফগান নৌবহর এসে দুর্জন সিংহকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছিল যে তিনি নিষ্ক্রমণের কোন পথ খুঁজে পাননি, শত্রু নিক্ষিপ্ত একটি গুলি এসে তাঁর বক্ষস্থল বিদ্ধ করবার ফলে তিনি ধরাশায়ী হয়েছিলেন। দুর্জন সিংহের মৃত্যুতে ঈশা খাঁ আপাতদৃষ্টিতে জয়ী হলেও এক অভূতপূর্ব আশঙ্কায় তখন তাঁর মন অভিভূত হয়ে পড়েছিল। মান সিংহ তখন সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। ঈশা খাঁ জানতেন যে, নতুন নতুন সৈন্য নিয়ে এসে তিনি শুধু বিদ্রোহ দমন করবেন না, পুত্রহত্যার প্রতিশোধও নেবেন। তাঁর সম্মুখীন হওয়ার মত শক্তি ঈশা খাঁর ছিল না। তাই ভয়ব্যাকুল চিত্তে তিনি মান সিংহের শিবিরে নিজের দূত পাঠিয়ে সন্ধির প্রস্তাব করলে মোঘল সেনাপতি প্রত্যুত্তরে তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, ঈশা যদি বিনা শর্তে মোঘলদের সামনে আত্মসমর্পণ করেন, তাহলেই তিনি তাঁর বিরুদ্ধে নতুন কোন অভিযান করা থেকে বিরত থাকবেন। মান সিংহের সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ঈশা খাঁ নিজে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার পরে তাঁকে আগ্রায় আকবরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাদশাহ আকবর সেই পরাজিত শত্রুর প্রতি কোন ধরণের রূঢ়তা দেখাবার পরিবর্তে তাঁকে ২২টি পরগণার জমিদারী ও ‘মসনদ-ই-আলা’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। ঈশা খাঁও তাঁর প্রতি আনুগত্য জানিয়ে ভাটিতে ফিরে এসেছিলেন। তারপরে তিনি আর কোন দিনই মোঘলদের বিরুদ্ধাচরণ করেন নি, কিন্তু ১৬০৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হওয়ার পরে তাঁর পুত্র ‘মুসা খাঁ’ আবার মোঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, ঈশা খাঁ হোসেন শাহ বংশীয়া ফতেমা খানম নামের এক তরুণীকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু পরে এক সময়ে তিনি শ্রীপুররাজ চাঁদ রায়ের রূপলাবণ্যময়ী কন্যা ‘স্বর্ণময়ী’র সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে হরণ করে ইসলামী প্রথায় বিবাহ করেছিলেন। অসাধারণ বুদ্ধিমতী সেই ‘সোনাবিবি’ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরে কিছু দিন ভাটি রাজ্য ভালভাবে পরিচালিত করলেও শেষপর্যন্ত আত্মরক্ষায় অসমর্থ হয়েছিলেন। আরাকানের মগেরা জলপথে কত্রাভু পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে তাঁকে তাঁর নিজের প্রাসাদে অবরুদ্ধ করলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত করেছিলেন; কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শত্রুকে আর ঠেকানো সম্ভব নয়, তখন তিনি হিন্দু পদ্ধতিতে জহরের আগুনে নিজের জীবনাহুতি দিয়েছিলেন।

ঈশা খাঁর ভাটি জমিদারীর পশ্চিমে আধুনিক ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার দুটি অংশ নিয়ে চাঁদ রায়ের জমিদারী শ্রীপুর গঠিত হয়েছিল। কররানি বংশের পতনের পরে অন্যান্য জমিদারদের মত চাঁদ রায়ও স্বাধীনতা অবলম্বন করে ঈশা খাঁর সঙ্গে একযোগে মোঘলদের বশ্যতা অস্বীকার করেছিলেন। তাঁদের উভয়ের মধ্যে সেই ঐক্য অক্ষুণ্ণ থাকলে আকবরের পক্ষে ওই বিদ্রোহ দমন করা আরো কষ্টকর হত, কিন্তু ঈশা চাঁদ রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ীকে হরণ করে সেই সম্ভাবনার উপরে নিজেই যবনিকাপাত করেছিলেন। ওই ঘটনার পরে চাঁদ রায় মোঘলদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করলেও এক অভাবনীয় ঘটনায় তাঁর জীবনাবসান হয়েছিল। মান সিংহের পুত্র হিম্মৎ সিংহ সপ্তগ্রাম থেকে কয়েকজন আফগানকে তাড়া করলে তাঁদের মধ্যে উড়িষ্যার নিহত সুলতান কতলু খাঁ লোহানির ভ্রাতুষ্পুত্র ওসমান প্রমুখ কয়েকজন আফগান সর্দার ১৫৯২ খৃষ্টাব্দে আশ্রয়ের সন্ধানে চাঁদ রায়ের সদর ভূষণার দিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে চাঁদ রায় তাঁর পুরানো বন্ধু ঈশা খাঁর বিশ্বাঘাতকতায় মর্মাহত হয়ে মোঘলদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করছিলেন। পলাতক আফগানরা ভূষণার চার ক্রোশ দূরে এসে পৌঁছানোর পরে তাঁদের কৌশলে বন্দী করে মোঘলদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তিনি তাঁদের স্বগৃহে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দু’জন আফগান সর্দার চাঁদ রায়ের বাড়ীতে এলে তিনি তাঁদের মধ্যে একজনকে বন্দী করেছিলেন, কিন্তু অপরজন তরবারি আস্ফালন করতে করতে সেখান পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাঁকে তাড়া করে চাঁদ রায় বেশ কিছু দূর চলে যাওয়ার পরে তাঁর আফগান ভৃত্যদের স্বজাতি-প্রেম মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, এবং তাঁরা বিনা দ্বিধায় তাঁদের প্রভুকে হত্যা করেছিলেন। তারপরে সব আফগানরা সম্মিলিত হয়ে ভূষণা দুর্গে ফিরে এলে দুর্গরক্ষীরা তাঁদের পুরোভাগে চাঁদের আফগান ভৃত্যদের দেখে মনে করেছিলেন যে, তাঁদের প্রভুও সম্ভবতঃ ফিরে এসেছেন। সেই বিশ্বাসে তাঁরা দুর্গদ্বার খুলে দেওয়ার পরে আফগানরা ভিতরে প্রবেশ করে লুঠপাট শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে চাঁদ রায়ের সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করলে তাঁরা শুধু দুর্গ নয়, শ্রীপুর রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে ঈশা খাঁর ভাটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। চাঁদ রায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র ‘কেদার রায়’ শ্রীপুরের অধীশ্বর হয়েছিলেন। নিজের পিতার মৃত্যুর জন্য তাঁর মন আফগানদের প্রতি তিক্ত হয়ে উঠলেও কোন মোঘল সৈন্যাধ্যক্ষ তখন তাঁর বশ্যতা গ্রহণ করবার জন্য এগিয়ে না আসায়, তিনি সম্ভাব্য সকল বিপদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য নিজের সামরিক বল বাড়াতে শুরু করেছিলেন। তাঁর পিতার নৌবহরকে যথেষ্ট সম্প্রসারিত করে সেটাকে ইউরোপীয় প্রথায় পুনর্গঠিত করবার জন্য তিনি ‘ডোমিনিগো কার্ভালো’ নামে একজন পর্তুগীজ এ্যাডমিরালকে অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছিলেন। সেই নৌবহর নিয়ে কার্ভালো সন্দ্বীপ জয় করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় মুরদের বিরোধীতার জন্য তিনি সেই জয় সংহত করতে পারেন নি। তাই তিনি সন্নিহিত দিয়াঙ্গার পর্তুগীজ অধিনায়ক ‘ম্যানোয়েল ম্যাণ্ডেসের’ সাহায্য গ্রহণ করলে মুরেরা তাঁর বশীভূত হয়েছিলেন। তাঁর সেই সাফল্যে উদ্বিগ্ন হয়ে তৎকালীন আরাকানরাজ ‘মেংরাজগি’ সন্দ্বীপ অধিকার করতে এসে কার্ভালোর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন (১৬০২, নভেম্বর)। তাঁর দেড়শো ছোট বড় আরাকানী নৌকা কার্ভালোর হাতে পড়েছিল। ওই অজ্ঞাতকুলশীল নাবিকের সেই অসাধারণ সাফল্যের সংবাদ লিসবনে পৌঁছানোর পরে স্বয়ং পর্তুগালরাজ তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই আরাকানীরা আবার সন্দ্বীপ আক্রমণ করলে তিনি ওই দ্বীপ ছেড়ে শ্রীপুরে চলে এসেছিলেন। তাঁর প্রভু কেদার রায় তখন মোঘল আক্রমণে বিব্রত ছিলেন। সেই সময়ে মাত্র তিনটি জেলিয়া নৌকা নিয়ে মোঘলদের একশো কোসার নৌবহর বিধ্বস্ত করে তিনি নিজের রণনৈপুণ্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। তাঁর বলে বলীয়ান কেদার রায়ের শক্তিতে বিস্মিত হয়ে বহু আফগান তখন নিজেদের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শ্রীপুরে চলে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ‘সোলেমান খাঁ’ প্রধান
ছিলেন। সোলেমানের মত একজন দুর্ধর্ষ বিদ্রোহী কেদার রায়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন জানতে পেরে মান সিংহ তাঁর একটি সৈন্যবাহিনীকে শ্রীপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা গিয়ে ভূষণা অবরোধ করলে কেদার রায় বীরবিক্রমে লড়েছিলেন, কিন্তু ওই যুদ্ধ চলাকালীন একদিন দুর্গের ভিতর গোলা বিস্ফোরিত হওয়ায় বহু সৈনিকসহ সোলেমান খাঁ নিহত ও তিনি আহত হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি একটি গোপন পথে দুর্গ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ভাটিতে গিয়ে ঈশা খাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন (১৫৯৬)। ভূষণা দুর্গ´ অধিকার করে মান সিংহ কেদার রায়কে ধরবার জন্য তাঁর নিজের নৌবহরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কার্ভালো তখন তাঁদের পরাজিত করলেও তারপরেই কেদার রায়ের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটেছিল। উপায়ন্তরবিহীন কার্ভালো তখন প্রথমে ঈশা খাঁর কাছে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে আশানুরূপ সাহায্য না পাওয়ার জন্য তিনি দিশাহারা হয়ে মান সিংহের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। এর কিছুদিন পরেই আরাকান-রাজের সঙ্গে তাঁর সন্ধি সম্পাদিত হওয়ায় তিনি মগদের সোনারগাঁ আক্রমণে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর এই বিশ্বাসঘাতকতায় রুষ্ট হয়ে মান সিংহ পরের বছর, অর্থাৎ ১৬০৩ খৃষ্টাব্দে আরাকানীদের দমনের পরে সরাসরি কেদার রায়কে আক্রমণ করেছিলেন। ফতেজংপুরে তখন তাঁদের উভয় পক্ষের মধ্যে যে প্রচণ্ড সংগ্রাম হয়েছিল, তাতে কেদার রায় আহত ও বন্দী হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁকে মান সিংহের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছিল। এরপরে কেদার রায়ের জমিদারী অধিকার করে মান সিংহ ‘মধু রায়’ নামের একজন অনুগত ব্যক্তিকে সেখানকার সামন্ত নিয়োগ করেছিলেন, এবং কেদার রায়ের আরাধ্যা দেবী ‘শিলামাতা’কে অম্বরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত)

(তথ্যসূত্র:
১- Tabakat-i-Akbari, Nazimuddin Ahmed.
২- Akbarnama iii, Abul Fazl Allami.
৩- Tarikh-i-Sher Shahi, Abbas Sarwani, Elliot’s translation.
৪- Tarikh-i-Salatin-i-Afghann, Ahmed Yadgar.
৫- Makhzan-i- Afghani, Niamatullah, Elliot’s translation.
৬- Riyaz-us-Salatin, Ghulam Husain Salim.
৭- Baharistan-i-Gaibi, Mirza Nathan.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’, (প্রথম পর্ব)‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’, (প্রথম পর্ব)

স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য জয় করে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে যে বক্তৃতাগুলি করেছিলেন, সেগুলোর অনেকটা জুড়েই সেই সময়ের যুবকদের উদ্দেশ্যে পরাধীন ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনে তৎপর হয়ে ওঠার দীপ্র আহ্বান

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবারপৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার

পৃথিবীতে অনেক ধরনের খাবার রয়েছে। কিন্তু দামি খবার তো কিছু রয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে দামি খাবারের নামটি তো সবারই জানতে ইচ্ছা করে। আপনাদের সুবিধার্থে দিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন (প্রথম পর্ব)ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রধানতঃ তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল, (ক) সশস্ত্র বিপ্লব – চরমপন্থা আন্দোলন, (খ) গান্ধীজীর নেতৃত্বে অহিংস গণ আন্দোলন, এবং (গ) নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর

বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিনবিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন

এটাই সেই ইঞ্জিন; ১ লাখ ৯ হাজার হর্সপাওয়ার শক্তি-সম্পূর্ণ Wartsila sulzer RTA96-C বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন! ● নির্মাতা কোম্পানি: Built in Finland ● এটার ওজন ২,৩০০টন এবং ৪৪-ফুট