‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ পরাধীন ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের উপরে ব্রিটিশ রাজরোষ নেমে আসবার কারণগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে সাজানো যেতে পারে –
(১) রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই ব্রিটিশ সরকারের প্রধান সন্দেহভাজন তালিকায় ছিলেন। তাঁর আবির্ভাব প্রসঙ্গ, তাঁর রচনাবলী পাঠ করে পরাধীন ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবীরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেজন্যই বিবেকানন্দ এবং তাঁর রচনাবলী ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন সময়ে সময়ে ব্যাপক রাজরোষের কবলে পড়েছিল। যদিও বিবেকানন্দ তখন জীবিত ছিলেন না, তবে তিনি জীবিত থাকলে ইতিহাসটা হয়ত অন্যরকমের হত। নিবেদিতার একটি চিঠি থেকে জানতে পারা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, অর্থাৎ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই স্বামীজীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়েছিল। ওই সময়ে বিবেকানন্দের লেখা চিঠিগুলোকে পর্যন্ত ‘সেন্সর’ করা হত। আমেরিকায় তাঁর ব্রিটিশ শাসনবিরোধী উক্তিগুলির জন্যই তৎকালীন বিদেশী শাসকেরা তাঁকে ‘কংগ্রেসওয়ালা’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এমনকি তৎকালীন খ্রীষ্টান মিশনারীদের প্ররোচনা, এবং ব্রিটিশ রেসিডেন্টের বাধাদানের ফলে তিনি কাশ্মীরে মঠ স্থাপনের জন্য কোন জমি পাননি। তখন তাঁর সম্পর্কে গোয়েন্দা বিভাগ যে গোপন রিপোর্ট তৈরী করেছিল, সেটি আজও সরকারী মহাফেজখানায় রক্ষিত রয়েছে। পাশ্চাত্য থেকে ভারতবর্ষে আসবার আগেই, লণ্ডনে থাকবার সময় থেকেই ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর উপরে নজর রাখতে শুরু করেছিল। তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে সেই নজরদারী শুধু দীর্ঘই হয়নি, সামগ্রিকভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের উপরে সরকারের রোষবহ্নিও নেমে এসেছিল। (Intelligence Report – Prepared for the Government of India, foreign Department in 1896; L/Pad S/19/Tem. No. 168)
(২) ভগিনী নিবেদিতা ব্রিটিশ সরকারের তালিকায় দ্বিতীয় সন্দেহভাজন ছিলেন। নিবেদিতার পত্রাবলী থেকে জানতে পারা যায় যে, একটা সময়ে বৈপ্লবিক চুরির অভিযোগ তুলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল। লর্ড মিন্টোর স্ত্রী লেডি মিন্টো নিবেদিতার কার্যকলাপ ও বৈপ্লবিক মানসিকতার হদিশ নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তাছাড়া ব্রিটিশ সরকারের চর ‘কর্নেলিয়া সোরাপজি’ও (তৎকালীন সমাজের নামী মহিলা) লেডি মিন্টোর সঙ্গে বেলুড় মঠে গিয়ে নিবেদিতার সম্বন্ধে নানা বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, এবং রামকৃষ্ণ পার্ষদদের কাছ থেকে তাঁর সম্বন্ধে নানা তথ্য জানতে চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়ের গোপন সরকারী রিপোর্ট থেকে এটাও জানা যায় যে, নিবেদিতার পিছনে তখন স্থায়ীভাবে গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়েছিল। তৎকালীন সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবার জন্য পুলিশ নানা সময়ে নানা ভাবে নিবেদিতাকে হেনস্থা করবার চেষ্টা করেছিল। সেই কারণেই তিনি পরাতপক্ষে ছদ্মবেশ ধারণ করে বিদেশে যাতায়াত করতেন। ওই সময়ের সশস্ত্র বিপ্লবীদের উপরেও তাঁর সক্রিয় প্রভাব ছিল। তখনও পর্যন্ত নিবেদিতা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিবেকানন্দের দেহত্যাগের পরে, তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে নিজের সব সম্পর্ক ছেদ করলেও, তৎকালীন সরকারী মহল কিন্তু সেটাকে সত্যিকারের বিচ্ছেদ বলে মনে করেনি। কেননা, রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে তাঁর আর কোন ধরণের সম্পর্ক নেই ঘোষণা করবার পরেও নিবেদিতা নিয়মিতভাবে বেলুড় মঠে, এবং বাগবাজারে শ্রীমা সারদা দেবীর কাছে যাতায়াত করতেন। এমনকি মিশনের মায়াবতী আশ্রমে গিয়ে তিনি গ্রীষ্ম ও শরৎ কালে অবস্থান করতেন। ওই সময়ে তাঁর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধও রামকৃষ্ণ মিশনের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মূলতঃ ওই সব কারণেই একদিকে নিবেদিতা নিজে যেমন রাজরোষের শিকার হয়েছিলেন, তেমনি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনও রক্ষা পায়নি। (India, 9th Feb. 1906)
(৩) ১৯০৬ সালে ‘স্বামী অভেদানন্দ’ পাশ্চাত্য থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে নানা জায়গায় অনেকগুলি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি ব্যাপক জনসম্বৰ্ধনা পেয়েছিলেন। তাঁর সেই বক্তৃতাগুলি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। তিনি আমেরিকার ব্রুকলিন ইনস্টিটিউটে তাঁর প্রদত্ত ছ’টি বক্তৃতায় তীব্রভাবে ব্রিটিশ শাসনের নিন্দা করেছিলেন, যেগুলো পরে তাঁর লেখা ‘India and her people’ নামের গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার সেই গ্রন্থটিকে ভারতীয় বিপ্লবীদের হাতে পৌঁছানো বন্ধ করবার উদ্দেশ্যে পাকাপাকিভাবে নিষিদ্ধ করবার কথাও ভেবেছিল। স্বামী অভেদানন্দ যে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী এবং স্বামী বিবেকানন্দের সতীর্থ ছিলেন – সেটা ব্রিটিশ সরকার ভালোভাবেই জানত। এরপরে স্বামী অভেদানন্দ স্বয়ং ‘লর্ড কার্জনের’ রোষবহ্নিতে পড়েছিলেন, এবং সেই কারণেই শেষপর্যন্ত ১৯১২ সালে তাঁর লেখা গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। (Intelligence Report – Prepared for the Government of India, foreign Department in 1896; L/Pad S/19/Tem. No. 168)
(৪) তৎকালীন সময়ের বিপ্লবীদের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ‘যুগান্তরের’ সম্পাদক ‘ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত’ যে আদতে স্বামী বিবেকানন্দের আপন ভাই, এবং বিবেকানন্দের মানস কন্যা নিবেদিতা যে তাঁর জামিনের জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন, সেটা ওই সময়ের নানা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার ধরেই নিয়েছিল যে, ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সমস্ত বৈপ্লবিক কার্যকলাপ আসলে রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা সমর্থিত। এই বিষয়ে চার্লস টেগার্টের রিপোর্টে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
(৫) ভারতের ইতিহাস বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেবব্রত বসু’ এবং ‘শচীন সেন’কে রামকৃষ্ণ মিশন শুধু আশ্রয়ই দেয়নি; শ্রীমা সারদাদেবীর নির্দেশে, এবং ‘স্বামী সারদানন্দের’ উদ্যোগে পরবর্তীকালে তাঁরা মিশনের সন্ন্যাসীও হয়েছিলেন। সেই বিষয়টিকে ব্রিটিশ সরকার এবং তাঁদের গোয়েন্দাবাহিনী কখনোই সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে ওই সূত্রে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি তাঁদের রোষবহ্নি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
(৬) ওই সময়ে কেবলমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবী পুরুষেরাই নন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত নারীরাও শ্রীমা সারদাদেবীর আশ্রয় পেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ১৮১৮ সালের ৩নং রেগুলেশনে গ্রেপ্তার হওয়া, তৎকালীন বঙ্গদেশের একমাত্র মহিলা বন্দিনী ‘ননীবালা দেবী’র কথা অবশ্য উল্লেখ্য। তিনি বিপ্লবী যুবকদের গোপন অস্ত্রের সন্ধান রাখতেন, এবং বিপ্লবীরা তাঁর কাছ থেকে নানা ধরণের সাহায্যও পেতেন। ১৯১৭ সালে তাঁকে পেশোয়ার থেকে গ্রেফতার করে কাশীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু অকথ্য অত্যাচার সত্ত্বেও তাঁর মুখ থেকে কোন গোপন সূত্র উদ্ধার না করতে পেরে তারপরে তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তিনি খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপরে তৎকালীন কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ‘মিঃ গোল্ডী’ তাঁকে বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যদি তিনি আহারাদি করেন তবে তাঁর যে কোন ইচ্ছা পূরণ করা হবে। তখন উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে, যদি তাঁকে বাগবাজারে শ্রীমা সারদাদেবীর কাছে রেখে আসা হয় তবেই তিনি আহার্য গ্রহণ করবেন। তখন পুলিশ তাঁকে সেই মর্মে একটি দরখাস্ত লিখে দিতে বলেছিল, এবং তিনি তৎক্ষণাৎ সেই দরখাস্ত লিখেও দিয়েছিলেন। কিন্তু মিঃ গোল্ডী তাঁর সামনেই সেই দরখাস্তটি ছিঁড়ে ফেলে দিলে আহত সিংহীর মত ননীবালা সেখানেই গোল্ডীর গালে একটি চড় কষিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরে অবশ্য তিনি দ্বিতীয় চড়টি মারবার আগেই সেখানে উপস্থিত গোয়েন্দা পুলিশের অন্যান্য কর্তব্যরত ব্যক্তিরা তাঁর হাত ধরে নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শ্রীমা সারদা দেবীর শুধুমাত্র ননীবালা দেবীর সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না, ওই সময়ের বাংলার প্রায় সমস্ত সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গেই তিনি যোগাযোগ রাখতেন। বিপ্লবীরা বাগবাজারে শ্রীমা সারদাদেবীর কাছে এসে তাঁর চরণ ছুঁয়ে তাঁকে প্রণাম করে বিপ্লবের কাজে নামতেন, এবং উদ্বুদ্ধ হতেন। এই প্রসঙ্গে ‘বাঘাযতীনের’ কথা প্রায় সকলেই জানেন। তখন যে সমস্ত বিপ্লবীরা সারদা দেবীর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন – দেবব্রত বসু (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ), শচীন সেন (স্বামী চিন্ময়ানন্দ), নগেন্দ্রনাথ সরকার (স্বামী সহজানন্দ), প্রিয়নাথ দাশগুপ্ত (স্বামী আত্মপ্রকাশানন্দ), সতীশ দাশগুপ্ত (স্বামী সত্যানন্দ), ধীরেন দাশগুপ্ত (স্বামী সম্বুদ্ধানন্দ), রাধিকামোহন অধিকারী (স্বামী সুন্দরানন্দ), বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় (স্বামী তপানন্দ), ইন্দ্রদয়াল ভট্টাচার্য (স্বামী প্রেমেশানন্দ), দীনেশ দাশগুপ্ত (স্বামী নিখিলানন্দ), অতুলচন্দ্র গুপ্ত (স্বামী অভয়ানন্দ)। এছাড়া যেসব বিপ্লবীরা তখন তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন কিন্তু সন্ন্যাসী হননি, তাঁরা হলেন – রামচন্দ্র মজুমদার, মাখনলাল সেন, বিজয়কুমার নাগ, দীনেশ মুস্তাফি, সুরেন কর, গৌরহরি ভট্টাচার্য, কর্ণাটকুমার চৌধুরী প্রমুখ।
(৭) ওই সময়ের বিপ্লবীদের মধ্যে বিবেকানন্দের গ্রন্থের প্রভাবের কথা সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার বিশেষভাবে অবগত ছিল। শুধু তাই নয়, সেই সময়ের ‘উদ্বোধন’ এবং ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় স্বামী বিবেকানন্দের এমন সব চিঠি ও বক্তৃতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, যেগুলো ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনীর সন্দেহের বিষয় হয়ে উঠেছিল। রাজরোষকে উপেক্ষা করেই রামকৃষ্ণ মিশন সেগুলি প্রকাশ করেছিল।
(৮) সেই সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন উৎসবেও সশস্ত্র বিপ্লবীদের সমবেত উপস্থিতি কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের নজর এড়িয়ে যায়নি। রামকৃষ্ণ মিশনের পত্রিকাতেও তাঁদের সেই উপস্থিতির কথা প্রকাশিত হয়েছিল।
(৯) তখনকার বিপ্লবীদের দ্বারা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও লিফলেটে বিবেকানন্দের প্রেরণার কথা প্রায়ই উল্লেখ করা হত। ব্রিটিশ সরকারও সেই বিষয়ে সজাগ ছিল। সেই সময়ের বিভিন্ন পুলিশ রিপোর্টেও এর বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
(১০) পরাধীন ভারতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ নামের শক্তি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, তখন তাঁদের নাম ব্যবহার করে সারা ভারতে, বিশেষতঃ বঙ্গদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। সেই সব প্রতিষ্ঠানের আড়ালে থেকে বিপ্লবীরা তাঁদের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে রামকৃষ্ণ মিশনের অনুমোদিত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও রামকৃষ্ণ মিশনের গভীর যোগ আছে বলে ব্রিটিশ সরকার ধারণা করে নিয়েছিল। তাই সেই সময়ের বিভিন্ন পুলিশ রিপোর্টে এই বিষয়ে বিষাক্ত মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রধানতঃ উপরোক্ত কারণগুলির জন্যই রামকৃষ্ণ মিশন তখন ব্রিটিশ রাজরোষ বহ্নির কবলে পড়েছিল। এছাড়া তৎকালীন খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারক, এবং ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষক পত্র-পত্রিকাগুলির প্রত্যক্ষ মদতও সেই বিষয়ে অনুঘটকের কাজ করেছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের জীবদ্দশাতেই তাঁর বিদেশী কয়েকজন শিষ্য, শিষ্যা ও অনুরাগী ভারতবর্ষে এসেছিলেন এবং এদেশে বসবাস করেছিলেন। মিস মার্গারেট নোবেল (পরবর্তীকালে ভগিনী নিবেদিতা), মিস ক্রিস্টিন, সেভিয়ার দম্পতি, মি. গুডউইন, মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড, মিসেস ওলিবুল প্রমুখরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা সকলেই ভারতের বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। শ্রীমতী সেভিয়ার, মিশন পরিচালিত আলমোড়ার মায়াবতী আশ্রমে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত নিজের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি তাঁর যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল, এবং এটাও শোনা যায় যে, তিনি নাকি নিজেই পুনায় গিয়ে বালগঙ্গাধর তিলকের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। ভগিনী ক্রিস্টিন নিবেদিতার সহযোগী হিসেবেই এই দেশের বহু গঠনমূলক কর্মে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আর তাঁদের সকলের উপরে, সেই সময়ের বিপ্লবী ক্রিয়াকর্মের একজন প্রধান প্রেরণা-উৎসাহদাত্রী রূপে নিবেদিতা এই দেশে অনেকদিন ধরেই সুপরিচিত হয়ে রয়েছেন। নিবেদিতার লেখা ‘Kali the Mother’ গ্রন্থটি শ্রীঅরবিন্দ রচিত ‘ভবানী মন্দির’ থেকে কোন অংশেই কম বিদ্রোহাত্মক ছিল না। একদা অরবিন্দ নিজেই এই কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বরোদার গাইকোয়াড় এবং রাজপুতনার রাজন্যবর্গের কাছে স্বয়ং উপস্থিত হয়ে নিবেদিতা তাঁদের ভারতবর্ষের বিপ্লবকে জয়যুক্ত করবার জন্য সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাজদ্রোহের অপরাধে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত গ্রেপ্তার হওয়ার পরে নিবেদিতা নিজেই আদালতে তাঁর জামিন হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে লাঠি খেলা, অসি চালনা প্রভৃতি প্রদর্শনীর আয়োজন করে তিনি তৎকালীন বাংলার শহরে ও গ্রামের সর্বত্রই প্রকাশ্যে বিপ্লববাদী কর্মে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। ১৯০৯ সালে তিনি মেদিনীপুরে গিয়েছিলেন, এবং সেখানে একটি ধর্মসভায় বক্তৃতা করবার সূত্রে ক্রমাগত পাঁচ দিন ধরে নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করেছিলেন। সেই সময়ের রাজনীতির সঙ্গে ওই রকম প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়বার ফলেই শেষপর্যন্ত ১৯০৮ সালে তাঁকে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সমস্ত ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করবার ঘোষণা করতে হয়েছিল। এরপরে ১৯১১ সালে নিবেদিতার মৃত্যুর পরে অনুষ্ঠিত তাঁর স্মরণ-সভায় তখনকার যেসব স্বনামধন্য বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ যোগ দিয়েছিলেন, সেটা থেকেই অনুমান করা যেতে পারে যে, তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তিনি কতটা ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন। ওই স্মরণ-সভায় ‘বিপিনচন্দ্র পাল’, ‘প্রভাস দে’ প্রমুখ সুপরিচিত নেতারা যোগদান করেছিলেন, এবং তাঁরা সকলেই নিজেদের বক্তৃতায় এই দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিবেদিতার অবদানকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ওই একই সময়ে ‘ডেইলি নিউজ’ পত্রিকার কলমে ‘র‍্যাটিক্লিফ’ নিবেদিতাকে এই দেশের জাতীয় আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী রূপে বর্ণনা করেছিলেন। এছাড়া ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলমেও তখন অনুরূপভাবেই নিবেদিতার প্রতি ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছিল। নিবেদিতা ও বিবেকানন্দের প্রতীচ্যের শিষ্য-শিষ্যা ও অনুরাগীদের নিয়ে ব্রিটিশ সরকার বিশেষ চিন্তিত থাকবার জন্যই তখন মিশনের নানা কেন্দ্রে ও সংশ্লিষ্টজনের উপরে ব্যাপক নজরদারি চালানো হয়েছিল।

সেই সময়ে ভারতবর্ষের বাইরে যেমন বেদান্ত সোসাইটি, এবং অন্যান্য বিদেশী শিষ্যবর্গের মাধ্যমে বিপ্লবী কর্মপ্রচেষ্টাকে প্রচ্ছন্নভাবে টিকিয়ে রাখবার চেষ্টা করা হয়েছিল, ভাবতের অভ্যন্তরে তেমনি মিশনের বিভিন্ন আশ্রমগুলিকে কখনো কখনো ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির গোপন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হযেছিল। রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম যুগে মিশন কর্তৃক অনুমোদিত ওই ধরণের আশ্রমের সংখ্যা ছিল এগারো, এবং তখন ভারতের যেসমস্ত অঞ্চলে সেই আশ্রমগুলি গড়ে উঠেছিল সেগুলি হল – এলাহাবাদেব মুঠিগঞ্জ, বেনারস সিটির লস্কর (বেনারসে আরো একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল), বৃন্দাবনের বংশীঘাট, সাহারানপুরের কনখল, পূর্ব বাংলার বরিশাল, পশ্চিম বাংলায় মুর্শিদাবাদের সারগাছি, মাদ্রাজের মাইলাপুর, কর্নাটকের ব্যাঙ্গালোর সিটি (গোল টেম্পল রোড), উত্তরাখণ্ডের আলমোড়ার মায়াবতী, এবং সব শেষে কলকাতার গোপাল নিযোগী লেনের উদ্বোধন কার্যালয়। উক্ত আশ্রমগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটিতেই বিপ্লবীরা তখন ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। মানিকতলা বোমা মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘উপেন ব্যানার্জী’, ‘হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল’ এবং ‘ইন্দ্র নন্দী’ – মায়াবতী আশ্রমে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত করেছিলেন। সেখানে থাকবার সময়েই তাঁরা ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ‘রামচন্দ্র প্রভু’র সংস্পর্শে এসেছিলেন। ইন্দ্ৰ নন্দী সেই সময়ের একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একদা স্বামীজী গ্রামবাংলার অধিবাসীদের মধ্যে গ্লোব, ম্যাজিক লণ্ঠন ইত্যাদির সাহায্যে শিক্ষা প্রচারের জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। ইন্দ্র নন্দীও স্বামীজী নির্দেশিত পন্থায় বাংলার মফঃস্বল অঞ্চলের দূববর্তী এলাকাগুলিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও বিপ্লবী প্রচারকর্ম চালিয়েছিলেন। তখন প্রচার কাজে মফঃস্বলে থাকবার সময়ে ইন্দ্ৰ নন্দী প্রায়শঃই মিশনেব কোনো না কোন আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হতেন। বঙ্গদেশেব বহু অঞ্চলেই তখন বামকৃষ্ণেব নামে বিভিন্ন আশ্রম গজিয়ে উঠেছিল। ওই সব আশ্রমগুলি মিশনের অনুমোদিত সংস্থা না হলেও, সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরা কিন্তু সেগুলিকে মিশন পরিচালিত আশ্রম বলেই জানতেন, এবং সঙ্গত কাবণেই সেই আশ্রমগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা খুব সহজেই গ্রামবাসীদের উপরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। ওই আশ্রমগুলির সঙ্গে নিষিদ্ধ রাজনীতির যোগাযোগ তৎকালীন পুলিশ মহলকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। পরবর্তীকালে অনুসন্ধান করে জানা গিয়েছিল যে, ১৯১৩ সালে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার সময়ে পূর্ব বাংলার প্রায় সব ক’টি জেলাতেই ওই ধরণের তথাকথিত রামকৃষ্ণ মিশন গজিয়ে উঠেছিল। পুলিশের সন্দেহ ছিল যে, ঢাকার নিষিদ্ধ ‘অনুশীলন সমিতি’ই সেই সব ভুঁইফোড় এবং অননুমোদিত আশ্রমগুলি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ১৯১০ সালের মধ্যেই অসংখ্য আশ্রম গড়ে উঠেছিল। ওই সব আশ্রমে রাজনৈতিক কর্মীরা আত্মগোপন করে থাকতেন। বিচারে বিপ্লবী ‘পুলিন দাসের’ দ্বীপান্তরের সাজা হওয়ার পরে, ঢাকার সশস্ত্র দলের অন্যতম প্রধান নেতা ‘মাখন সেন’ সেই আশ্রমগুলির সংগঠন ও ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে সবিশেষ জড়িত ছিলেন। তখন ওই কেন্দ্রগুলির রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা কালক্রমে এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, শেষপর্যন্ত পুলিশ কর্তৃপক্ষের চাপে পড়ে ১৯১৪ সালে মিশন কতৃপক্ষ প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ওই সব প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে বেলুড়ের কেন্দ্রীয় মিশনের কোনো ধরণের সংশ্রব নেই। কিন্তু সেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে বা পরেও মিশনের সঙ্গে কিন্তু ওই সময়ের রাজনৈতিক কর্মীদের যোগাযোগ কোন অবস্থাতেই একেবারে ক্ষীণ হয়ে যায়নি; আর সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ, মুখে অন্য কথা বললেও মিশনের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দও ভারতের বিপ্লববাদী কর্মধারার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। এই প্রসঙ্গে ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, অধ্যাপক ‘কামাখ্যা মিত্রের’ উদ্ধৃতি উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন যে, স্বামীজী নাকি কোনো এক সময়ে একথা স্পষ্ট করেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের তখন যে অবস্থা ছিল, তাতে সেই সময়ে বোমাই এই দেশের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় ছিল (What needs today is bomb)। তাই অনুমান করা যেতে পারে যে, সেই সময়ে বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা কিংবা এই দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরাও বিবেকানন্দের মনের সেই গোপন কথাটি টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই তখন তাঁরা প্রকাশ্যে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়লেও, গোপনে কিন্তু বিপ্লবী কর্মীদের সাহায্য করতে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। ওই সময়ে স্বামীজী প্রতিষ্ঠিত মায়াবতী আশ্রম থেকে যে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা প্রকাশিত হত, সেটির কোনো কোনো সংখ্যাতে আপত্তিকর অনেক কিছুই ছাপা হয়েছিল। এর উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ১৯০৯ সালের অক্টোবর সংখ্যার ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় শ্রীঅরবিন্দ, ‘দেবপ্রসাদ মুখার্জী’, এবং সেই সময়ের অন্যান্য পরিচিত বিপ্লবী কর্মীদের লিখিত বহু আপত্তিজনক বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। তাঁদের সকলেই তখন রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত ছিলেন, এবং দেবপ্রসাদকে তো তখন সুদূর বোম্বাই অঞ্চলের পুলিশও খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ‘স্বামী ব্রহ্মানন্দ’ মিশনের অধ্যক্ষ থাকাকালীন স্বরাজের আদর্শ প্রচারে সন্ন্যাসীরা বিশেষভাবে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন বলে পুলিশ সন্দেহ করেছিল। ওই সময়ে বেলুড় মঠের সঙ্গে বিপ্লবীদের যে একটা কিছু সাক্ষাৎ যোগাযোগ ছিল, সে ব্যাপারেও পুলিশের তরফে নিশ্চিতভাবে দাবী করা হয়েছিল। কলকাতা পুলিশ সন্দেহ করেছিল যে, ট্রিপ্লিকেনে থাকবার সময়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বয়ং ‘যুগান্তর’ প্রচারপত্র বিলি করবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন; এবং সেই সময়েই মাদ্রাজে ওই সব বিপ্লবী প্রচার-পুস্তিকাগুলি বিলি করা হয়েছিল। অবশ্য মাদ্রাজ পুলিশ সে ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের অভিমত মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। তাঁদের ধারণা ছিল যে, তুতিকোরিণের বিপ্লবী উকিল ‘এস. সোমসুন্দরম’ ভারতীয় বিপ্লবীদের সাহায্যেই সেগুলি মাদ্রাজে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাদ্রাজের সেই ঘটনাটিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, স্বামী ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে বিপ্লবীদের বরাববই অটুট যোগাযোগ ছিল। কলকাতার চোরবাগানের বিপ্লবী ‘নলিনীকান্ত দে’, ব্রহ্মানন্দের সহচর হিসেবে একদা পুরী গিয়েছিলেন, এবং তাঁরই সাহায্যে সেই সময়ে বিপ্লবী ‘ননীগোপাল সেনগুপ্তের’ দলকে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে তৎকালীন বিপ্লবী কর্মধারার প্রতি ব্রহ্মানন্দ এতটাই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন যে, ওই সময়ে ঢাকা অনুশীলন সমিতির বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও তাঁর কাছে বিপ্লবের নানা ব্যাপারে উপদেশ ও পরামর্শ গ্রহণ করতে উপস্থিত হয়েছিলেন। ‘জ্ঞানেন্দ্র ব্রহ্মচারী’ নামে মিশনের জনৈক সন্ন্যাসী আগে উল্লেখিত মাখন সেনের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। সেই জ্ঞানেন্দ্রর মাধ্যমেই আবার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বেলুড়ের বামকৃষ্ণ মিশনের কাজে সম্ভবতঃ ১৯২১ সালের শুরু থেকেই বিশেষ উৎসাহ সহকারে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। জ্ঞানেন্দ্র মিশনের অন্যান্য ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে তখন প্রায়শঃই দেশবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত করতেন। এর ফলে দেশবন্ধুর মাধ্যমে তৎকালীন মিশন কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ সেই আমলের ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির পরিমণ্ডলের আবর্তেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। মিশনের তৎকালীন সম্পাদক স্বামী সারদানন্দ অবশ্য সেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে নিজেকে অন্ততঃ প্রকাশ্যে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখলেও, মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ কিন্তু ওই ভাবে সব কিছুকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। পুলিশের গোপন রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, তিনি তাঁর কয়েকজন অনুগামী সহ অসহযোগ আন্দোলনের কাজে বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সম্ভবতঃ, তাঁরই দেখাদেখি মফঃস্বলের একাধিক জেলা আশ্রমগুলিও তখন অসহযোগ প্রচার কর্মে সোৎসাহে অংশগ্রহণ করেছিল। টেগার্ট অন্ততঃ বেশ জোরের সঙ্গেই নিজের রিপোর্টে সেকথা বলেছিলেন।

আরো পড়ুন- ‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’, (প্রথম পর্ব)

মিশনের অনুমোদনহীন মফঃস্বলের বিভিন্ন আশ্রমগুলির বৈপ্লবিক কর্মপ্রচেষ্টার কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলার জেলাগুলিতে মিশনের অনুমোদিত আশ্রমগুলিও তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে একেবারেই উদাসীন ছিল না। সেই সময়ে ওই আশ্রমগুলি স্থাপন করবার ব্যাপারে যাঁরা সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্বয়ং বিপ্লবী কর্মী ছিলেন। এই প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ বাঁকুড়া জেলার সুপরিচিত উকিল এবং বিবেকানন্দের একান্ত অনুগামী ভক্ত ‘চন্দ্ৰকান্ত সেনের’ কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ও ‘বয়কট’ প্রচারের কাজে যোগদান করে তিনি ১৯০৭-০৮ সালের মধ্যেই সবিশেষ খ্যাতি, এবং রাজরোষ বহ্নির কবলে পড়েছিলেন। ১৯১১ সালে বাঁকুড়ায় রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে তিনিই আবার অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এর পরের বছর ফরিদপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের যে সেবাশ্রম স্থাপিত হয়েছিল, সেই কাজে তখনকার পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন দু’জন ব্যক্তিও বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। ঐ একই বছরে আগরতলাতেও মিশনের একটি শাখাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। পার্বত্য ত্রিপুরার সশস্ত্র বিপ্লবী দলই সেই শাখা আশ্রমটি গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিল। মিশনের ওই কেন্দ্রে সেই সময়ে আত্মগোপনকারী অনেক রাজনৈতিক কর্মীই মাঝে মাঝে যাতায়াত করতেন। ১৯১১ সালের জানুয়ারি মাসে পুলিশের ইন্সপেক্টর ‘নৃপেন ঘোষ’কে হত্যার ব্যাপারে জড়িত ‘প্রিয়নাথ ব্যানার্জী’, এবং বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ‘নিশিকান্ত ঘোষ’ নামক দুই ব্যক্তি মিশনের ওই আশ্রমে নিয়মিত হাজিরা দিতেন। তখন মিশনের ওই সব শাখা আশ্রমগুলির সঙ্গে বিপ্লবী কর্মীরা একই সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কেন্দ্র বেলুড় মঠের সঙ্গেও নিজেদের যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। তৎকালীন পুলিশের রিপোর্ট অনুয়ায়ী সেই সময়ে বেলুড় মঠের সঙ্গেই সশস্ত্র বিপ্লবীদের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল; এবং সমকালীন সরকারী কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে একরকম সুনিশ্চিত ছিলেন যে, ওই সংসারত্যাগী বিপ্লবী রাজনৈতিক সন্ন্যাসী সমাজের একাংশ বেলুড়ে রীতিমত ট্রেনিং, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী সম্পর্কে বিভিন্ন উপদেশ ও সংবাদ সংগ্রহ করবার জন্য নিয়মিতভাবে সেখানে উপস্থিত থাকতেন। বাস্তবিক পক্ষে তৎকালীন বাংলার বিপ্লবী কর্মপ্রচেষ্টার বিভিন্ন পর্যায়ের কাজে স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করবার ব্যাপারেও মিশন সহায়তা করেছিল। ওই সময়ের প্রখ্যাত বিপ্লববাদী কর্মী ‘হেমচন্দ্র কানুনগো’ তাঁর স্মৃতিকথায় নানা ব্যাপারে মিশনের সতত সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করে গিয়েছেন। তাঁর মতে, তখন রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহের প্রয়োজন দেখা দিলেই বিপ্লবীরা রামকৃষ্ণ মিশনের সাহায্য নিতেন; কেননা মিশনের সন্ন্যাসীরা ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে খুব সহজেই রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। (বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, হেমচন্দ্র কানুনগো, পৃ- ১৪) বস্তুতঃ স্বাদেশিকতাকে ধর্মের পর্যায়ে উন্নীত করে ওই সময়ের ধর্ম-অভিলাষী জনসাধারণকে অতি সহজেই স্বদেশের রাজনৈতিক কর্মে নিয়োজিত করা সম্ভব ছিল। তখন সাধারণতঃ রামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দের জন্মজয়ন্তী পালন করবার জন্য মিশনের পক্ষ থেকে যেসব উৎসবের আয়োজন করা হত, সেই উপলক্ষ্যে বহু বিপ্লবী কর্মীই মিশনের কাজে যোগদান করতেন। কোনো কোনো সময়ে আবার মিশনের উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় যে ত্রাণ কার্য চালান হত, সেখানেও ওই সব রাজনৈতিক কর্মীরা জমায়েত হতেন। ওই সময়ের পুলিশের রিপোর্টেও মিশনের সেই ধরণের একাধিক সমাবেশ ও অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯০৮ সালের ১৩ই জুলাই তারিখে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে পুরীর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সেদিন ওই সমাবেশে উপস্থিত ভক্তবৃন্দের মধ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন সভাপতি সহ ‘মৌলবী লিয়াকত হোসেন’ এবং বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ জাতীয় নেতৃবৃন্দের ছবিও প্রকাশ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। মিশনের ওই উৎসবে প্রায় ১৫,০০০ যুবক যোগদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আলিপুর বোমা মামলায় সংশ্লিষ্ট দেবব্রত বসু (পরবর্তীকালে স্বামী প্রজ্ঞানন্দ), শচীন সেন (পরবর্তীকালে স্বামী চিন্ময়ানন্দ) ও ‘কুঞ্জলাল সাহা’ সেদিন বিশেষ উৎসাহ সহকারে অনুষ্ঠানের কাজে সাহায্য করেছিলেন। ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ‘সারদা চক্রবর্তী’, এবং ‘অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী’র বিপ্লবী দলের সদস্য ‘নগেন রায়চৌধুরী’ও ওই উৎসবে উপস্থিত থেকে সেদিন সমবেত জনতার মধ্যে ‘শ্রমজীবী সমবায়’ কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন প্রচারপত্র বিতরণ করেছিলেন। পরের বছরও মিশনের ঐ একই উৎসবে বহু বিপ্লবী কর্মী সমবেত হয়েছিলেন। সেবারে সেই অনুষ্ঠানে মৌলবী লিয়াকৎ হোসেন তাঁর নিজের বহু অনুগামীসহ দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন, এবং মিশনের মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যেই স্বদেশের কাজে যোগদান করবার জন্য সেখানে উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে নিজের অনুরোধ জ্ঞাপন করেছিলেন। ১৯১৩ সালে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ জন্মজয়ন্তী উৎসবে ওই সময়ের সুপরিচিত বিপ্লবী কর্মী মাখন সেন সেখানে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের আপ্যায়ন করেছিলেন। সেদিন তিনি ছাড়াও যশোরের ‘কিরণ মুখার্জী’, ‘সুরেশ সমাজপতি’, এবং ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় সংশ্লিষ্ট ‘মানিক গুহুমুস্তাফি’ ও ‘হেমচন্দ্র বসু’ প্রমুখ ব্যক্তিরাও ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মিশনের বিবেকানন্দ জন্মবার্ষিকী উৎসবেও বিপ্লবী কর্মীরা তখন সাগ্রহে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯১১ সালের জানুয়ারি মাসে সেই উপলক্ষ্যে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে যে উৎসব হয়েছিল, সেখানে বহু বিপ্লববাদী কর্মী অতিথি আপ্যায়ন এবং দরিদ্রনারায়ণের সেবায় স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেছিলেন। সেবারের ঐ অনুষ্ঠানে তৎকালীন ভারতের রাজনীতিতে আগ্রহী বহু বিদেশি অভ্যাগতরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ‘ফ্রান্সিস আলেকজাণ্ডার’ (Francis Alexander) নামের জনৈক ভদ্রলোকসহ বহু আমেরিকান ভদ্রমহিলাকেও সেদিন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। স্বামীজীর ৫০তম জন্মতিথি উপলক্ষ্যে ঢাকা মিশনে পরের বছর যে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেও রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অনেকের সমাবেশ ঘটেছিল। তখন ভেঙে যাওয়া অনুশীলন সমিতির বহু পরিচিত সদস্য সেবারে সেখানে নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের কাজে সাথে নিজেদের যুক্ত রেখেছিলেন। সেই সময়ে সরাসরি কোন প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, পুলিশ গোপনে সংবাদ পেয়েছিল যে ওই উৎসবের শেষে সেখানে একটি গোপন রাজনৈতিক সভারও আয়োজন করা হয়েছিল। উপরোক্ত উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়াও তৎকালীন বঙ্গদেশের বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীরা মিশন আয়োজিত বিভিন্ন ত্রাণ কার্যেও স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছিলেন। ১৯১৩ সালের শেষভাগে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বর্ধমানে মিশনের বন্যাত্রাণ কার্যে অমরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জীর মত সর্বজনবিদিত সশস্ত্র বিপ্লবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখনকার দিনের বিভিন্ন গোপন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, অমরেন্দ্র ওই দুর্গত এলাকাগুলিতে মিশনের শাখাকেন্দ্র স্থাপন করবার জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন। অমরেন্দ্র যে মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে রীতিমত পরিচিত ছিলেন একথা তখন অনেকেই জানতেন, এবং বেলুড়ে মিশন অনুষ্ঠিত বিভিন্ন উৎসব ও সমাবেশেও তাঁকে অনেকবারই বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবীরূপে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল। ওই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণকার্য পরিচালনা করবার জন্য মিশনের একটি নিজস্ব সংগঠন ছিল। সেই সংগঠনের সঙ্গে ঢাকার বিপ্লবী পুলিন দাসের বিশিষ্ট সহযোগী ‘প্রিয়নাথ দাস’, এবং কলকাতার বিপ্লবী কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ‘অমৃত হাজরা’ সহ অন্যান্য বহু যুবক ও যুগান্তর দলের ‘বসন্ত’ নামক জনৈক কর্মী প্রমুখ বিপ্লবীরাও যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে স্বামী সারদানন্দ সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত মাত্র চারজনের নাম প্রকাশ করলেও তাঁদের সম্পর্কে বিশদভাবে কিছু জানাতে অস্বীকার করেছিলেন।

ব্রিটিশ পুলিশ একটা সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তখনকার যেসব স্বনামখ্যাত রাজনৈতিক কর্মীদের প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন যোগাযোগ ছিল, তাঁদের নামের একটি তালিকা তৈরী করেছিল। সেই তালিকায় আলিপুর বোমা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত রাজদ্রোহী দেবব্রত বসুর নামও পাওয়া যায়। নিজের প্রথম জীবনে তিনি মিশনের কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, এবং পরবর্তীকালে তিনি সন্ন্যাসগ্রহণ করে স্বামী প্রজ্ঞানন্দ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আগে উল্লেখিত শচীন সেন এবং কুঞ্জলাল সাহাও মিশনের বেলুড় ও মাইলাপুর (মাদ্রাজ) কেন্দ্রের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। মানিকতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ‘ভবভূষণ মিত্র’ বেলুড় মঠের কর্তৃপক্ষের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। ওই মামলার তদন্ত চলাকালীন জানা গিয়েছিল যে, ১৯১০ সালে নিষিদ্ধ অনুশীলন সমিতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই বেলুড় মঠের কিছু গোপন সংস্রব ছিল। আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলার সূত্রে কলকাতার ১১৭নং আমহার্স্ট স্ট্রীটে যে পুলিশী তল্লাশী চালানো হয়েছিল, সেটার ফলে জনৈক ‘কুলচন্দ্র সিংহরায়ের’ লেখা একটি ডায়েরি পুলিশের হাতে পড়েছিল। ওই ডায়েরিতে যে গোপন সংকেতলিপি পাওয়া গিয়েছিল, সেটির পাঠোদ্ধার করে জানা গিয়েছিল যে, তৎকালীন অনুশীলন সমিতির সদস্য প্রায় জনা ত্রিশেক ছাত্র বেলুড় মঠের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা বিবেকান্দের কোনো এক জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে বেলুড় মঠের অনুষ্ঠানে প্রায় কর্মকর্তার ভূমিকায় কাজও করেছিলেন। এছাড়া ওই সাংকেতিক লিপিটি পাঠ করে আরো জানা গিয়েছিল যে, সেই সময়ের বাংলার বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ বেলুড় মঠকে তাঁদের বৈপ্লবিক রাজনীতির শিক্ষাপ্রসার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কলকাতা অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত চন্দননগরের ফণিভূষণ ঘোষকে ১৯১২ সালের ৫ই মে তারিখে বেলুড় মঠে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল। হাওড়ার বিপ্লবী ‘যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী’ও রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সদস্য ছিলেন বলে পুলিশের নথি থেকে জানতে পারা যায়। এছাড়া পূর্ণ দাসের সমিতির সঙ্গে যুক্ত ঢাকার ‘উমাচরণ সরকার’, এবং গোপালপুর ও কমলপুর ডাকাতির ব্যাপারে সন্দেহভাজন ‘রসিকচন্দ্র সরকার’ ও জনৈক ‘আশুতোষ দেব’ নামক বিপ্লবী কর্মীরা একদা সন্ন্যাসীরূপে বেলুড় মঠে প্রবেশের চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। ‘সারথি কেন্দ্র’ ও ‘যুবক মণ্ডলী’র সঙ্গে জড়িত বিপ্লবী যোগেন ঠাকুরও বেলুড় মঠের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন; যদিও তিনি পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দ কর্তৃক মঠ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত বিপ্লবী ‘তারাপদ বসু’ও কিছু দিনের জন্য বেলুড়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন। ঢাকার ‘নগেন্দ্রনাথ সরকার’, এবং হাওড়ার ডাকাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘নরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী’র অনুগামী ‘বীরেন সুর’ নামক জনৈক আর্য সমাজের সদস্যও যথাক্রমে বেলুড় ও মিশনের বেনারস কেন্দ্রে কিছুকাল দিনযাপন করেছিলেন। ১৯১৩ সালে রাজাবাজার বোমা মামলার সুবাদে তৎকালীন পুলিশ মহলে বারবার রামকৃষ্ণ মিশনের নাম উল্লেখিত হয়েছিল। মিশনের মায়াবতী আশ্রমে আবেক্ষাধীন একদা ঢাকা নিবাসী অতুল গুহ (পরবর্তীকালে স্বামী অভয়ানন্দ), ‘প্রফুল্ল চক্রবর্তী’ নামক অপর এক ব্যক্তিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই শেষোক্ত ব্যক্তির নাম, রাজাবাজার মামলায় অভিযুক্ত অমৃত হাজরার কাছে প্রাপ্ত একটি সংকেতলিপিতে উল্লেখিত হয়েছিল। ১৯১২ সালে দিল্লীতে ‘লর্ড হার্ডিঞ্জের’ উপরে বোমা নিক্ষেপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছিল। তখন ওই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যিনি পাঞ্জাব ও বাংলার বিপ্লবী নেতাদের মধ্যে সর্বদা যোগসূত্র বজায় রেখে চলতেন, সেই স্বনামধন্য নেতাও মিশনের কনখল-হরিদ্বার শাখার একজন উৎসাহী সদস্য ছিলেন। ওই ষড়যন্ত্রের কিছু পুস্তিকা ও কয়েকজন সভ্যের ফটোগ্রাফ, চন্দননগরের একটি বাড়িতে খানাতল্লাসী করবার সময়ে পুলিশ উদ্ধার করেছিল। উক্ত মামলার অপর এক আসামী ‘রঘুবীর শর্মা’র বাড়িতে তল্লাসী চালিয়ে পুলিশ চারজন সন্দেহজনক বাঙালীর নাম খুঁজে পেয়েছিল। তাঁদের কাছে কিছু ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারপুস্তিকা বিলি করবার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। সেই দলের মধ্যে কলকাতার সিটি কলেজের ছাত্র ‘অবনীন্দ্রনাথ ঘোষ’ মিশনের একজন উৎসাহী সভ্য ছিলেন। তিনি দুর্গাপুজোর সময় মিশনের বেনারস আশ্রমে কিছুকাল অতিবাহিত করবার পরে কনখল আশ্রমে বসবাস করেছিলেন। ঐ দলের অপর তিনজন ব্যক্তি ছিলেন – হাওড়ার ‘নীতিচন্দ্র রায়’, ‘সুশীলকুমার মিত্র’ এবং ‘অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী’। নীতিচন্দ্র বেলুড়, বেনারস এবং কনখলের মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রাক্তন বিচারপতি সারদা মিত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র ‘সুশীল মিত্র’ অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন, এবং বেলুড় মঠে নিয়মিতভাবে যাতায়াত করতেন। অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর সঙ্গে মিশনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। তাঁরা ছাড়াও রঘুবীর শর্মার বাড়ি তল্লাসী করবার সময়ে আরো একজনের নাম জানা গিয়েছিল। তিনি ছিলেন ‘হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য’, এবং বেলুড় মঠের সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোন ঘনিষ্ঠতা না রাখলেও প্রায়শঃই মিশনের দেরাদুন আশ্রমে উপস্থিত থাকতেন। ১৯১৩-১৪ সালের মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন আশ্রম তল্লাসী করে বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁরা প্রায় সকলেই মিশনের উত্তর ভারতের আশ্রমগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই সব ধৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘বলদেব রায়’ প্রথমে বেনারস এবং পরে কনখলের আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সতীশ দাশগুপ্তও বেনারসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে তাঁদের মধ্যে মধ্যে ‘বসন্ত বিশ্বাস’ই তখন সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত ছিলেন। দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। তিনি মিশনের বেনারস আশ্রমে কিছুকাল অতিবাহিত করেছিলেন বলে জানতে পারা যায়। সবশেষে এই প্রসঙ্গে ‘নেপালী বাবা’ নামের একজন রাজনৈতিক সন্ন্যাসীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি নিজে মিশনের অন্তর্ভুক্ত না হলেও মিশনের অনেক সন্ন্যাসীই কিন্তু তাঁর সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। ঢাকা নিবাসী বিখ্যাত বিপ্লবী ও মল্লযোদ্ধা ‘শ্যামাকান্ত ব্যানার্জী’ উক্ত নেপালী বাবার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। পরে তিনি সংসার ত্যাগ করে ‘সোহহং স্বামী’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তখনকার যেসব উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা ও বিপ্লবী কর্মীদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, গোয়েন্দা পুলিশ তাঁদের কয়েকজনের নামের একটি তালিকাও তৈরী করেছিল। তাঁরা হলেন –
(১) যুগান্তর দলের: রাসবিহারী বসু, অমরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ঋষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দ্রনাথ নন্দী, কুঞ্জলাল সাহা, দেবব্রত বসু (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ), শচীন্দ্রকুমার সেন (স্বামী চিন্ময়ানন্দ) এবং ভবভূষণ মিত্র।
(২) অনুশীলন সমিতির: মাখনলাল সেন, তুলসীচরণ দত্ত, যোগেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্ঞানরঞ্জন চ্যাটার্জী, দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, প্রিয়নাথ দাস, প্রফুল্ল চক্রবর্তী ও অতুল গুহ (স্বামী অভয়ানন্দ)।
এছাড়া সদ্য ওই সময়ে ইউরোপ প্রত্যাগত স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বামী সারদানন্দেব অনুজ যথাক্রমে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও নরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর নামও উপরোক্ত তালিকায় লিখিত ছিল।
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে ভাবেই হোক না কেন, পরাধীন ভারতবর্ষ তথা বঙ্গদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের উপরে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দেব মতাদর্শ, এবং সামগ্রিক ভাবে রামকৃষ্ণ মিশন অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। সেই কারণেই ১৯১৮ সালের সিডিশন কমিটির রিপোর্টের ২৪ সংখ্যক অনুচ্ছেদে পরাধীন ভারতবর্ষের রাজনীতির উপরে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ মন্তব্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। বিবেকানন্দের বেদান্ত ধর্মের প্রেরণায় শ্রীঅরবিন্দ কি ভাবে হিন্দুধর্ম ও স্বাদেশিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হযেছিলেন সেকথা তিনি নিজেই ১৯০৩ সালে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন। হিন্দুদের ‘শক্তি’ সাধনাকেই তিনি রাজনৈতিক বন্ধন মোচনের একমাত্র পথ বলে মনে করতেন; এবং কোনো এক সময় পর্যন্ত তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে, ওই শক্তি সাধনার পথেই জাপান পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। বস্তুতপক্ষে, পরাধীন ভারতে বাঙালির রাজনৈতিক চিন্তা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলেই বহু পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। লর্ড কারমাইকেলের দরবারী ভাষণে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি তাঁর তীব্র কটাক্ষ অন্ততঃ সেটারই সাক্ষ্য বহন করে। পরিশেষে সার্বিক পর্যালোচনার সূত্রে একথা বলা যেতে পারে যে, তৎকালীন রাজনীতিকে ধর্মের পর্যায়ে উত্তরণ করে রামকৃষ্ণ মিশন – রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের আদর্শ, স্বদেশ-সেবা ও ধর্মের মধ্যে এক অসাধারণ সমন্বয় সাধন করতে পেরেছিল। সেই কারণেই সম্ভবতঃ ওই সময়ের বিপ্লববাদী কর্ম প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত থাকবার ব্যাপারে মিশন কখনোই কোনো রকমের মানসিক দ্বিধার সম্মুখীন হয়নি। তখন সেই বিষয়ে মিশনের যতটুকু দ্বিধা ছিল, সেটার পিছনে হয়তো কেবলমাত্র বাস্তব কারণই ছিল, না হলে ওই সময়ের রাজনীতির সঙ্গে মিশনের অতটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কখনই সম্ভব হত না। রামকৃষ্ণ মিশন যেমন একদিকে যেমন পরাধীন ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে উৎসাহ দান করেছিল, অন্যদিকে তেমনি মিশনের প্রভাবেই সেই আন্দোলন কিছু পরিমাণে ভাঁটাও পড়েছিল। স্বদেশ এবং ধর্মের মধ্যে যোগসূত্র ঘটিয়ে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মতাদর্শ এককালের বহু অগ্নিহোত্রী বিপ্লবীকে ধর্মের পথে টেনে নিয়ে এসেছিল, এবং রামকৃষ্ণ মিশন সেই সব রাজনীতিভ্রষ্ট বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। ওই সময়ের বিশিষ্ট বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো পরবর্তীকালে সে বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তৎকালীন রাজনীতির পতন-অভ্যুদয় পথের সংঘর্ষে তখনকার বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের শেষ জীবনে ক্লান্ত ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। হেমচন্দ্রের মতে, বিপ্লবী জীবনের সেই সব দুঃখ ও হতাশা যখন বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল, অনেকে কেবলমাত্র তখনই আধ্যাত্মিকতার আকর্ষণে সংসার তথা রাজনীতির জগৎ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন গ্রহণ করেছিলেন। ওই সময়ে ধর্মই রাজনৈতিক দায়িত্ব এড়ানোর ও রাজরোষ থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র প্রকৃষ্ট আশ্রয়স্থল ছিল, এবং রাজনীতির সংকটময় পথ থেকে পিছলে বেরিয়ে আসবার জন্য ধর্মই তখন একমাত্র সম্মানজনক উপায় হিসেবে পরিগণিত হত। (বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, হেমচন্দ্র কানুনগো, পৃ- ১৭) সেকালের বহু প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় রাজনীতিক ওই ভাবেই অধ্যাত্ম জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ‘যতীন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘স্বামী নিরালম্ব’ নামে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন, এবং ‘সূর্যকুমার সেন’ (স্বামী নির্বাণানন্দ), ‘রাধিকামোহন অধিকারী’ (স্বামী সুন্দরানন্দ), ‘প্রিয়নাথ দাশগুপ্ত’ (স্বামী আত্মপ্রকাশানন্দ) ও ‘নরেন সেন’ (নরেন মহারাজ)-এর মত একদল প্রাক্তন বিপ্লবী রাজনীতির পথকে পরিত্যাগ করে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রয় গ্রহণ করে ভিন্ন ধারায় দেশ ও মানবসেবার কাজে অংশ নিয়েছিলেন। (বাংলায় বিপ্লববাদ, নলিনীকিশোর গুহ) সুতরাং তৎকালীন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি ব্রিটিশ রাজরোষ যে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক ছিল না, সেটা সার্বিক আলোচনা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। স্বাধীনোত্তর কালেও বহু বিপ্লবীই প্রকাশ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে তাঁদের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগের কথা জানিয়েছিলেন। আসলে বিবেকানন্দের বাণীতে উদ্বোধিত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে যোগাযোগ রাখবেন – তখন সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তাঁদের সেই যোগাযোগের পিছনে প্রধান তিনটি কারণ ছিল – (ক) শ্রীরামকৃষ্ণ-শ্রীমা সারদাদেবীর অধ্যাত্ম সাধনার স্পর্শে জাগরিত হওয়া ও শুদ্ধ চিত্তের অধিকারী হওয়া; (খ) জীবনদেবতা বিবেকানন্দকে প্রণতি জানানোর মধ্য দিয়ে অপরিমেয় শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠা; এবং (গ) ওই সময়ে বিবেকানন্দ যে দুর্জয় দুর্মর দুঃসাহসিক কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন তা আজও সকলকে চমকিত করে, “কেবল গলাবাজিতে কাজ হয়? বেপরোয়া হয়ে কাজ করতে হবে তাতে যদি গুলি বুকে পড়ে, প্রথমে আমার বুকে পড়ুক – পড়ুক গুলি আমার বুকে … শুধু বসে কাঁদুনি গাইলে কি হবে?” (লণ্ডনে বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ: ১৯০-১৯১) এসব কিছুই তখনকার বিপ্লবী যুবকদের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তিকে আঘাতের জন্য সর্বদা তাড়িত করেছিল, পরিণতিতে তাঁরা ফাঁসীর মঞ্চে জীবনের জয়গানকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করেছিলেন। স্বামীজী বলেছিলেন, “জগতে যখন জন্মেছিস তখন একটা দাগ রেখে যা”; আর সেই দাগ রাখতে গিয়েই হাজারো যুবক তখন আত্মবলিদান দিয়েছিলেন। তাই বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন রাজরোষের শিকার হয়েছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে নানা নথিপত্র ঘেঁটে তথ্য পেয়েছিলেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতরক্ষা আইনের মাধ্যমে রামকৃষ্ণ মিশনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, তৎকালীন ভারতীয় জনজীবনে-গণমানসে রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বাবগ্রাহী কর্মপ্রবাহ ও জনপ্রিয়তার সূত্রে এবং আমেরিকাবাসীরা সেই সিদ্ধানে ক্ষুব্ধ হবে ভেবে সেটা আর কার্যকর করা হয়নি। (রাখাল বেণু পত্রিকা, মাঘ-চৈত্র, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দ, পৃ- ২১৮) তবে সাদা পোশাকের পুলিশ কিন্তু বেলুড় মঠ সহ রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন নানা শাখা কেন্দ্রের উপরে সর্বক্ষণ নিজেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সজাগ বজায় রেখেছিল। এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য ও বিপ্লবীদের স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয় যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশনের ভূমিকা স্বর্ণবিভায় উজ্জ্বল ছিল। স্বভাবতই রাজরোষের আগ্নেয় উত্তাপ তাই বারে বারে রামকৃষ্ণ মিশনকে সেকালে ও উত্তরকালে স্পর্শ করেছিল। (History of the Freedom movement of India, Vol. II, Dr. Ramesh Chandra Majumder, Dr. Ramesh Chandra Majumder, P: 165-166)
(সমাপ্ত)

(তথ্যসূত্র:
১- স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড।
২- History of the Ramakrishna Math and Ramakrishna Mission, Swami Gambhirananda.
৩- The Extremist Challenge, Amalesh Tripathi.
৪- ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, অমলেশ ত্রিপাঠী।
৫- Dayananda the Man and his works, Sri Aurobindo, Vedic Mission.
৬- Militant Nationalist in India, Biman Bihari Majumdar.
৭- Tilak & Gokhale, A. Stanley Wolpert.
৮- Indian Nationalism and Hindu Social Reform, Vol. II, Charles Heilsath.
৯- Uttarpara Speech, 4th edition, Aurobindo Ghosh.
১০- State Committee for Compilation of History of Freedom Movement in India: Bengal Region, paper No. 49, Bundle No. 15, Political activities of the Sadhus up to 1909.
১১- Intelligence Report – Prepared for the Government of India, Foreign Department in 1896; L/Pad S/19/Tem. No. 168.
১২- India, 9th Feb. 1906.
১৩- বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, হেমচন্দ্র কানুনগো।
১৪- বাংলায় বিপ্লববাদ, নলিনীকিশোর গুহ।
১৫- লণ্ডনে বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৬- রাখাল বেণু পত্রিকা, মাঘ-চৈত্র, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দ।
১৭- History of the Freedom movement of India, Vol. II, Dr. Ramesh Chandra Majumder, Dr. Ramesh Chandra Majumder.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – প্রথম পর্বব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – প্রথম পর্ব

রামায়ন, মহাভারত, গ্রীক পুরান, নর্স পুরান, মিশরীয় পুরান, সুমেরীয় পুরান সহ প্রাচীন পৃথিবীর বিবিধ পৌরাণিক গাঁথায় আমরা পড়েছি অতিকায় রাক্ষসদের লোকগাথা। সেইসব রাক্ষসদের ক্ষুধা নাকি ছিল অসীম। যা খাবার দেওয়া

আধুনিক যুদ্ধের নিঃশব্দ স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদূত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রআধুনিক যুদ্ধের নিঃশব্দ স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদূত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র

মহাভারতের রয়েছে নারায়ণাস্ত্র, পাশুপাত অস্ত্র, ব্রহ্মদণ্ড অস্ত্র সহ এমনসব একাধিক অস্ত্রের বিবরণ যাদের সাথে হুবুহু মিল রয়েছে বর্তমান যুগের স্যাটেলাইট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের। মহাভারতের বিবরণ অনুসারে মানবজাতির

ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্বব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্ব

কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে গেলে ঠিক কি দেখতে পাবো আমরা ? হ্যাঁ এই মোক্ষম আর অমোঘ প্রশ্নটা শুধুমাত্র সাধারণ পাঠকদের মনের মধ্যেই নয় এমনকি খোদ মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মনের মধ্যেও ঘুরপাক খাচ্ছে

স্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দস্বামীজীর ছায়ায় শ্রীঅরবিন্দ

রানা চক্রবর্তীঃ ‘রোমাঁ রোলাঁ’ শ্রীঅরবিন্দকে ‘নব ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। (Prophets of the New India) ‘বুদ্ধিজীবী’ বলতে যদি তাঁদেরই বোঝায় যাঁরা নিজেদের ‘বুদ্ধি’ ও ‘প্রজ্ঞা’ দিয়ে জগৎকে বুঝতে