'কালাপাহাড়' - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘কালাপাহাড়’

‘কালাপাহাড়’


‘মোহিতলাল মজুমদার’ তাঁর ‘কালাপাহাড়’ কবিতায় লিখেছিলেন –
“শুনিছ না- ঐ দিকে দিকে কাঁদে রক্ত পিশাচ প্রেতের দল
শবভূক যত নিশাচর করে জগৎ জুড়িয়া কি কোলাহল!
দূর মশালের তপ্ত নিশ্বাসে ঘামিয়া উঠিছে গগন শিলা!
ধরণীর বুক থরথরি কাঁপে-একি তাণ্ডব নৃত্য লীলা।
এতদিন পরে উঠিল কি আজ সুরাসুর জয়ী যুগাবতার?
মানুষের পাপ করিতে মোচন, দেবতারে হানি ভীম প্রহার, কালাপাহাড়!”

কালাপাহাড় নামটির সাথে যাঁরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা তো বটেই, তার বাইরেও আরো অনেকেই পরিচিত রয়েছেন। অতীতের ও সাম্প্রতিক অতীতের বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান সব সাহিত্যিকেরা মুখরোচক করে কালাপাহাড়কে সাধারণের মাঝে উপস্থাপন করে গিয়েছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রলয় ও সংহারক মূর্তির বিজ্ঞাপন হিসেবে তাঁরা যে নামটি নির্দেশ করে গিয়েছেন, সেই নাতি হল কালাপাহাড়। কিন্তু কে ছিলেন এই কালাপাহাড়? কেনই বা তিনি অতটা হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন? কেনই বা তাঁর অত রাগ ছিল দেবালয়গুলোর ওপরে? এই প্রসঙ্গে কিছু লেখবার আগে জানিয়ে রাখা দরকার যে, কালাপাহাড় সম্বন্ধে ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা বা শোনা যায়, সেগুলোর মধ্যে কোনটা সত্যি, আর কোনটা মিথ্যা – সেটা যাচাই করা মুশকিল। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর বিভীষিকাময় কার্য্যকলাপের পিছনে বিভিন্ন কারণও দেখানো হয়। তাঁর কোন তৈলচিত্র নেই। তাই তিনি কেমন দেখতে ছিলেন সেটাও কারোর জানা নেই। তবুও, মোটামুটি ইতিহাস ঘেঁটে যা উঠে আসে সেগুলো দিয়ে তাঁকে নিয়ে একটি চিত্র খাড়া করা যেতে পারে।

কালাপাহাড়

বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজশাহী মতান্তরে নওগাঁ জেলার বীরজোয়ান গ্রামে ১৫৩০ খৃষ্টাব্দে এক কট্টর ব্রাহ্মন পরিবারে ‘রাজীবলোচন রায়’ ওরফে ‘রাজু ভাদুড়ী’, যিনি ইতিহাসে কালাপাহাড় নাম পরিচিত, তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা ছিলেন ‘নয়নচাঁদ রায়’, যিনি গৌড়ের ফৌজদার হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতেন। রায় ছিল তাঁদের পারিবারিক উপাধী, তাঁদের আসল পদবি ছিল ভাদুড়ী। অকালেই নয়নচাঁদ মারা যাওয়ার পরে রাজু তাঁর বিধবা মায়ের তত্ত্বাবধানে লালিতপালিত হয়েছিলেন। তিনি বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে রাজীবলোচন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু ছিলেন। তখন তিনি নিয়মিত বিষ্ণু পূজা করতেন। রাজীবলোচনের দিনাতিপাতের সমসাময়িক সময়ে দিল্লীর মসনদে আসীন ছিলেন ‘নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ুন’, আর বাংলায় তখন হোসেন শাহী বংশের গর্বিত স্বাধীন সুলতানি যুগ চলছিল। শেরশাহ হুয়ায়ুনকে মসনদ চ্যুত করবার পরে দিল্লী তখনকার মত মোঘল শাসনের বাইরে চলে গিয়েছিল, এবং তারপরে একটা সময়ে শেরশাহের স্বদেশী সেনাপতি সুলেমান খান কররানি বাংলা অধিকার করে নিয়েছিলেন। সুলেমান যখন গৌড়ের শাসক ছিলেন ঠিক সেই সময়ে রাজীবলোচন গৌড়ের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন, এবং অতি অল্পকালের মধ্যেই যুদ্ধবিদ্যায় নিজের পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে শাসকের সুনজরে পড়েছিলেন। সুলেমান খান কররানি একজন ব্যক্তি হিসেবে খুবই ধুরন্ধর প্রজাতির ছিলেন। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তিনি কোন কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি একজন ঝানু কূটনীতিক ছিলেন। মোঘলদের সাথে তাঁর সহনশীল নীতি থেকে যেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মোঘলদের সঙ্গে তিনি সরাসরি সামরিক শক্তিতে পেরে উঠবেন না। তাই মোঘল সম্রাটের মৌখিক বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে নিয়মিতভাবে তাঁদের উপহার উপঢৌকনাদি পাঠিয়ে তিনি শান্ত রাখতেন। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মোঘল শাসক মুনিম খানের মাধ্যমে তিনি যেমন সম্রাট আকবরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, তেমনি আবার তলে তলে ‘হযরত-ই-আলা’ উপাধি ধারণ করে তিনি নিজেকে মূলতঃ একজন স্বাধীন শাসক বলে পরিচিত করেছিলেন। রাজীবলোচন সুলেমানের শাণিত চক্ষুর আড়াল হতে পারেননি। সুলেমান তাঁকে গৌড়ের সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ সৈন্য থেকে উচ্চপদে তুলে এনেছিলেন, এবং একই সাথে তাঁকে একটি অসম এক প্রস্তাব দিয়ে বসেছিলেন।

এবারে, অন্য ঐতিহাসিকদের মতের দিকে নজর দেওয়া যাক। তাঁদের মতে রাজীবলোচন প্রথম থেকেই সুলেমানের বাহিনীতে ছিলেন না। তাঁদের মতে তিনি ছিলেন তৎকালীন কলিঙ্গ উৎকল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ‘গজপতি মুকুন্দদেবের’ সেনাপতি। ১৫৬৫ খৃষ্টাব্দে, রাজীবলোচন রায়ের নেতৃত্বাধীন গজপতি মুকুন্দদেব ও ভুরশুট সাম্রাজ্যের ‘রাজা রুদ্রনারায়ণের’ সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী ত্রিবেণীর যুদ্ধে বাংলার সুলতান সুলেমান কররানিকে পরাজিত করেছিল। সেই যুদ্ধে পরাজিত সুলেমান সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে রাজীবলোচন বা কালাপাহাড় যে আদতে হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন, সেটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই।

এবারে আসে তাঁর ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রসঙ্গ, এবং এখানেই ঐতিহাসিকেরা দুটি মতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। প্রথম মত অনুসারে, কররানিকে সন্ধী প্রস্তাবে রাজি করাতে গিয়ে রাজু ভাদুড়ী তাঁর সুন্দরী কন্যা ‘দুলারী বিবি’র প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। কারো কারো মতে কররানি নিজেই তাঁর কন্যাকে রাজুর জন্য টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কারণ, একজন যোগ্য সেনানায়ক হিসেবে রাজু ভাদুড়ীর যোগ্যতা নিয়ে তাঁর মনে কোন সন্দেহ ছিল না। কররানি জানতেন যে, রাজু ভাদুড়ী তাঁকে তাঁর সম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করতে পারেন। আবার কারো কারো মতে রাজু ভাদুড়ী নিজেই দুলারীর প্রেমে পড়েছিলেন। দ্বিতীয় মত অনুসারে, অর্থাৎ যাঁরা মনে করেন যে, রাজু ভাদুড়ী প্রথম থেকেই কররানির বাহিনীতে ছিলেন, তাঁদের মতে, কররানি রাজু ভাদুড়ীকে তাঁর কন্যার সাথে শর্ত দিয়ে বিবাহ করিয়ে নিজের রাজ্যকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কররানি নিজেই তাঁর সুন্দরী কন্যাকে বিবাহ ও গৌড়ের সেনাপতি পদের লোভনীয় প্রস্তাব রাজীব লোচনের সম্মুখে পেশ করেছিলেন। তিনি তাঁকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন যে, রাজীবকে তাঁর দরকার, তবে সেক্ষেত্রে দুটি শর্ত রয়েছে – (১) তাঁকে গৃহত্যাগী হতে হবে, এবং (২) তাঁকে ধর্মান্তরিত হতে হবে। সেই প্রস্তাব শুনে আপাতদৃষ্টিতে রাজীব হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তার একদিকে ছিল গৌড়ের সেনাপতি পদ এবং স্বয়ং সুলতান কররানির সুন্দরী কন্যাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার দু’-দুটি লোভনীয় প্রস্তাব, আরেকদিকে ছিল নিজের জাত আর ধর্ম বিসর্জন। এরপরে অনেক জল্পনাকল্পনা শেষে রাজীবলোচন রায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে কররানির কন্যাকে বিবাহ করে গৌড়ের সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কররানির কন্যা দুলারী বিবির সাথে যে রাজু ভাদুড়ীর বিবাহ হয়েছিল, সেটা নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। তবে, কিছু ঐতিহাসিকের মতে, রাজু ভাদুড়ী, শর্ত সাপেক্ষে ইসলাম ধর্ম অনুসারে সুলেমানের কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন, এবং সুলেমানের প্রধান সেনাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন; যদিও তিনি কখনোই নিজের ধর্মকে পরিত্যাগ করেননি। কিন্তু এক মুসলমানের কন্যাকে বিবাহের সুবাদে তৎকালীন বর্ণবাদী হিন্দুসমাজ তাঁকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর সেই কারণেই প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ হয়ে গিয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘মহম্মদ ফর্ম্মুলি’ নাম নিয়েছিলেন, এবং প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। আর তখন থেকেই তিনি কালাপাহাড় নামে পরিচিত হয়েছিলেন। সর্বসম্মত ইতিহাস বলে যে, ১৫৬৩ সাল থেকে ১৫৭২ সাল – এই দশ বছর ধরে কররানি বংশের পাশে ছায়ার মত থেকে তিনি বীরত্বের সঙ্গে মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গিয়েছিলেন।

এরপরে আবার ইতিহাসের মোড় এবং আবার ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত দেখতে পাওয়া যায়। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, প্রকৃতপক্ষে কালাপাহাড় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেই মনকষ্টে ভুগেছিলেন। তাঁর স্ত্রী সুলেমান কন্যাও নিজের পিতার সেই দুরভিসন্ধিমূলক কাজকে পছন্দ করেননি। শেষপর্যন্ত রাজীব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, একটি শুদ্ধি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরে যাবেন। তাই সেই উদ্দেশ্যে তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে শুদ্ধি অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। এককালের ধর্মপ্রাণ হিন্দু রাজীবলোচন রায় আশা করেছিলেন যে, পুরোহিতেরা তাঁকে আপন করে নিয়ে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসতে সাহায্য করবেন। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, সেটা সবসময় হয় না। পুরোহিতদের আদেশ ছিল যে, কোন যবন জগন্নাথ মন্দিরের ছায়াও মাড়াতে পারবে না। অতীতে যবন কর্তৃক অনেক মন্দির ধ্বংস হয়েছিল, মন্দিরের প্রভূত সম্পদ লুন্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং তাঁরা যবনদের আর কোন সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন না, তা তিনি আগে হিন্দুই থাকুন না কেন। তাই কালাপাহাড়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করা হয়েছিল, পাহাড়সম অপমানের বোঝা কাঁধে নিয়ে তিনি গৌড়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপরেই তিনি নিজের সেনাপতির পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডাদের মাধ্যমে তাঁর হিন্দু ধর্মে ফিরে যাওয়া আটকাতেও কররানির অদৃশ্য হাত ছিল। ওই ধরণের সিদ্ধান্তের জন্য তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের যথেষ্ট উৎকোচ দিয়েছিলেন। আবার কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, কালাপাহাড়ের হিন্দু ধর্মে ফিরে যাওয়ার মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন উৎকলের রাজা গজপতি মুকুন্দদেব। তিনিই পুরীর মন্দিরের পাণ্ডাদের সেই ধরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে রাজু ভাদুড়ীর যে আর হিন্দু ধর্মে ফেরা হয় নি, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। ওই ঘটনার পরেই তাঁর মধ্যে যে হিন্দু দেবালয় ও উচ্চ বর্ণের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই।
এরপরে, সুলেমান কররানি আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত নিজের রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। গৌড় থেকে নিজের রাজধানী তিনি ‘তাড়া’ বা ‘তাণ্ডা’য় স্থানান্তরিত করেছিলেন। আসাম থেকে উড়িষ্যার প্রতিটি রণাঙ্গনে রাজীব লোচন রায় বা ‘মহম্মদ ফর্ম্মুলি’ নিজের অসাধারণ সমরকুশলতার পরিচয় দিয়ে পুরো বাংলায় একজন পরাক্রমশালী সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। স্বজাতির কাছে বাজেভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তখন তাঁর মনে প্রতিশোধের বহ্নিশিখা জ্বলছিল। তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব মন্দির সেই প্রতিশোধ স্পৃহার বলি হয়েছিল; হিন্দুদের শিল্প সংস্কৃতির যাগযজ্ঞকে তিনি পিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত খুব কম মন্দিরই তাঁর গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছিল। একদিন যে পুরীর মন্দির থেকে তিনি হতোদ্যম হয়ে লজ্জার গ্লানি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন, সেই পুরীর জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করে তিনি এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছিলেন। ১৫৬৮ খৃষ্টাব্দে বলপূর্বক জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকে তিনি গরুর চামড়া দিয়ে তৈরী ঢোল ও বিশালাকায় ঘন্টা বাজিয়ে মন্দিরের ভেতরে শব্দের এক ধরণের বিচিত্র অণুরনন সৃষ্টি করেছিলেন। তাতে সেখানে উপস্থিত জনতা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এরপরে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার প্রতিমাকে বেদি থেকে উপড়ে ফেলে নিজের পায়ের তলায় পিষ্ট করে, তারপরে সেগুলিকে আগুনে দগ্দ্ধ করে কালাপাহাড় তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। তাছাড়া ওই মন্দির থেকে অনেক ধনদৌলত তাঁর হস্তগত হয়েছিল। পুরীর জগন্নাথ মন্দির ছাড়াও কোনাকের সূর্যমন্দির, আসামের কামাখ্যা মন্দির, ময়ূরভঞ্জের মন্দির ও মেদিনীপুরের মন্দিরগুলিও তাঁর আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মন্দিরের প্রতিমা ধ্বংস ও ধনসম্পদ লুটপাট – উভয় দিকেই তিনি আগ্রহী ছিলেন। এই তথ্যগুলোর মধ্যে কোনটা ঠিক, আর কোনটা ভুল সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে মন্দিরগুলো যে তাঁর প্রতিশোধের আগুনে পুড়েছিল, সেই তথ্য নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই। একমাত্র সম্বলপুরের মন্দিরের পুরোহিতেরা তাঁকে বুদ্ধি দিয়ে আটকাতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৫৬৪-৬৫ খৃষ্টাব্দে আকবরের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম বন্দরটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, সেই অবসরে সুলেমান কররানি উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন। মুকুন্দদেব তখন কোটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে সুলেমান কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জের অরণ্যসংকুল পথে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই সময়ে মুকুন্দদেব তাঁরই এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে নিহত হয়েছিলেন; এর ফলে ওই বিদ্রোহী সামন্ত এবং ‘রঘুভঞ্জ ছোটরায়’ উড়িষ্যার সিংহাসন দখল করবার একটা চেষ্টা করেও তাঁদের উভয়েই কালাপাহাড় কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। কোচরাজ নরনারায়ণ, সুলেমানের রাজত্বকালে গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু কালাপাহাড় একাধারে রাজা নরনারায়ণের ভাই এবং সেনাপতি ‘শুক্লধ্বজ’কে পরাজিত করে আসামের তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে নিয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি কামাখ্যা ও হাজোর প্রাচীন মন্দিরগুলিতে নির্বিচারে ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছিলেন। মোঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে কালাপাহাড় আমৃত্যু সংগ্রাম করে গিয়েছিলেন। বঙ্গদেশ ও বিহারে আকবরের বিরুদ্ধে আফগানদের যে বিদ্রোহ হয়েছিল, কালাপাহাড় তাতে যোগদান করেছিলেন, এবং অনুমান করা হয় যে, তিনি সেই যুদ্ধেই নিহত হয়েছিলেন (এপ্রিল ১৫৮৩ খৃষ্টাব্দ)। মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড়ের মৃত্যুর পরে তাঁকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সম্বলেশ্বর কলেজ বিল্ডিং-এর গায়ে অসংখ্য সমাধি দেখে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, সেগুলি কালাপাহাড়ের সহযোদ্ধাদের ছিল। ২০০৬ সালে একদল উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রোশে সেই সমাধিগুলি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

(তথ্যসূত্র:
১- The Cult of Jagannatha By Kanhu Charan Mishra.
২- Journal Of Asiatic Society Bengal, Old series, Vol. LXIX. 1900, pt. I. p. 189।
৩- Gloom and Bloom: The Case of Jagannatha Temples in Midnapore District, K.S. Behera।
৪- আমার নাম কালাপাহাড়। বিশ্বনাথ ঘোষ। সাহিত্যশ্রী।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

অপারেশন ঘোস্ট স্টোরিস। আমেরিকার ইতিহাসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্পাই নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে এফবিআইঅপারেশন ঘোস্ট স্টোরিস। আমেরিকার ইতিহাসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্পাই নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে এফবিআই

দিনটা ২৬ জুন, ২০১০, অন্যান্য দিনের মতোই কর্মব্যাস্ত নিউইয়র্ক শহরের এক রেস্তোরাঁয় কালো চশমা পড়ে লাল চুলের এক মেয়ে প্রবেশ করে। সেখানে অনেকক্ষন ধরেই তার জন্য অপেক্ষা করছিল কালো জামা

ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্বব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্ব

কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে গেলে ঠিক কি দেখতে পাবো আমরা ? হ্যাঁ এই মোক্ষম আর অমোঘ প্রশ্নটা শুধুমাত্র সাধারণ পাঠকদের মনের মধ্যেই নয় এমনকি খোদ মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মনের মধ্যেও ঘুরপাক খাচ্ছে

Dhanyakuria: বাসিরহাটের ঐতিহাসিক ধান্যকুড়িয়াDhanyakuria: বাসিরহাটের ঐতিহাসিক ধান্যকুড়িয়া

আজ থেকে প্রায় দুশো তিরিশ বছর আগের কথা। সুবিশাল এই রাজবাড়ি বানিয়েছিলেন ধান্যকুড়িয়ার (Dhanyakuria) জমিদার মহেন্দ্রনাথ গায়েন। সেসময় ফুলেফেঁপে উঠেছিল তাঁর পাটের ব্যবসা। মূলত ইংরেজদের সঙ্গেই চলত তাঁর লেনদেন। আর

মধ্যযুগের বরণীয় বৈষ্ণব সাহিত্যমধ্যযুগের বরণীয় বৈষ্ণব সাহিত্য

রানা চক্রবর্তীঃ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের প্রায় অর্দ্ধ শতাব্দী আগে ‘মালাধর বসু’ যখন তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনা করেছিলেন, তখন ‘কবীরের দোহা’ উত্তরাপথের অসংখ্য নরনারীর মনে এক নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছিল। মুসলমান পিতামাতার