রানা চক্রবর্তীঃ আকবরের মৃত্যুর পরে শাহজাদা সেলিম ‘জাহাঙ্গীর’ নাম নিয়ে মোঘল মসনদে আরোহণ করবার পরে রাজা মান সিংহ বাংলায় তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবার জন্য পুনরায় রাজমহলে ফিরে এসেছিলেন। তিনি আগের মতই স্বপদে বহাল থেকে বাংলার ফৌজদার থেকে গিয়েছিলেন, মোঘল সাম্রাজ্যও আগের মতই চলতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজধানী আগ্রায় নতুন বাদশাহের মনে তখন কোন শান্তি ছিল না। কারণ, বর্ধমানের জায়গীরদার মঞ্জিলের এক রূপসী ইরাণী তরুণী তখন তাঁর সমস্ত হৃদয় অধিকার করে ছিলেন। বাংলার বিদ্রোহ দমন সেই তরুণীকে জয় করবার তুলনায় তাঁর কাছে একেবারেই তুচ্ছ কাজ বলে পরিগণিত হয়েছিল। সেই তরুণীকে তাঁর যেকোন মূল্যে প্রয়োজন ছিল; সমস্ত মোঘল সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য্য তাঁর কাছে সঁপে দেওয়ার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে ছিলেন। রাজা মান সিংহ যদি সেই তরুণীকে জাহাঙ্গীরের কাছে পৌঁছে দিতে পারতেন, তাহলে জাহাঙ্গীর বোধহয় সবচেয়ে সুখী হতেন। কিন্তু মান সিংহ ছিলেন তৎকালীন মোঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ওমরাহ, তাই তিনি তাঁকে সেকথা বলতে সাহস করেন নি। তাই শেষপর্যন্ত অনেক চিন্তাভাবনা করে জাহাঙ্গীর মান সিংহকে বিহারে বদলি করে দিয়ে, নিজের ‘কোকলতাস’, অর্থাৎ ধাত্রী পুত্র ‘কুতুবউদ্দীন’কে বাংলার ফৌজদার করে পাঠিয়েছিলেন। সে সম্বন্ধে জাহাঙ্গীর নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “তেহেরানের অধিবাসী মীর্জা গিয়াস বেগ যখন তাঁর দুই পুত্র ও এক কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দুস্থানে আসছিলেন, সেই সময়ে পথে কান্দাহারে তাঁর আরেকটি কন্যাসন্তান ভূমিষ্ট হয়। ফতেপুরে তিনি মহামান্য বাদশাহ আকবরের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করেন ও একটি সরকারী চাকুরীতে নিযুক্ত হন। সেই কাজে প্রভুভক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে আগ্রা প্রাসাদের দেওয়ানপদ লাভ করেন। তাঁর বহু গুণ ছিল। অতি সুচারুরূপে তিনি সিকস্তা লিখতেন, এবং নানা কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতেন। কিন্তু একটি মহাদোষ তাঁর চরিত্রকে কালিমাময় করে তোলে। লোকের উপরে চাপ দিয়ে উৎকোচ আদায়ে তাঁর কোন জুড়ি ছিল না। আলিকুলি বেগ ইস্তালজু আগে ইরানের প্রাক্তন শাহ ইসমাইলের অধীনে সামান্য চাকুরী করতেন ও পরে হিন্দুস্থানে এসে খান-ই-খানানের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এক সময়ে মহামান্য সম্রাট আকবর যখন লাহোরে বাস করছিলেন সেই সময়ে এই ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করেন। অদৃষ্টের এরূপ বিধান ছিল বলেই মীর্জা গিয়াস বেগের যে কন্যার জন্ম কান্দাহারে হয়েছিল, তাঁর বিবাহ এই আলিকুলির সঙ্গে হয়। পরে আমি তাঁকে উপযুক্ত মনসব ও ‘শের-এ-আফগান’ উপাধি দিয়ে বাংলায় পাঠিয়ে দিই। সেখানে নিজস্ব জায়গীরের তত্ত্বাবধান করবার সময়ে সে অত্যন্ত অবাধ্য ও বিদ্রোহপ্রবণ হয়ে ওঠায় কুতুবউদ্দীন কোকলতাসকে বাংলায় পাঠাবার সময়ে তাঁর উপরে বিশেষ দৃষ্টি রাখবার জন্য নির্দেশ দিই। যদি শের-এ-আফগান বাধ্য ও কর্তব্যপরায়ণ থাকে তাহলে সে নিজের জায়গীরে বহাল থাকবে, কিন্তু এর বিপরীতধর্মী হলে তাঁকে বাদশাহ দরবারে পাঠিয়ে দিতে হবে। সে আসতে দ্বিধা করলে তাঁকে যথাযোগ্য শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব আমি কুতুবউদ্দীন কোকলতাসের উপরে দিই।” রাজমহলে পৌঁছে কুতুবউদ্দীন বর্ধমানে শের-এ-আফগানের কাছে আদেশ পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি যেন সত্বর রাজমহলে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু সেই জায়গীরদার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে সে আদেশ অমান্য করায় কুতুবউদ্দীন বাদশাহকে সে কথা জানিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে জাহাঙ্গীরের নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছিল যে, তিনি যেন সেই বেয়াদবির জন্য তাঁকে উপযুক্ত শাস্তি দেন। ওই নির্দেশ পেয়ে কুতুবউদ্দীন তাঁর ব্যক্তিগত সহচরদের সঙ্গে নিয়ে বর্ধমানে চলে গেলে শের-এ-আফগান দু’জন পার্শ্বচরসহ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সে সাক্ষাৎকারের সময়ে কিছুক্ষণ উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডার পরেই উভয় পক্ষের মধ্যে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয়েছিল। জাহাঙ্গীরের বর্ণনা অনুসারে, ওই হাতাহাতির সময়ে শের-এ-আফগান আগে কুতুবউদ্দীনের পাকস্থলীতে তরবারি চালিয়ে দিয়েছিলেন বলে তাঁর শাস্তি বিধানের জন্য সেখানে উপস্থিত ‘পীর খাঁ কাশ্মীরী’ ও অন্যান্য বীর মোঘল অফিসারেরা তাঁকে তৎক্ষণাৎ শমন সদনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপরে জাহাঙ্গীর লিখেছিলেন, “এই ঘটনার পরে গিয়াস বেগকে সম্মানজনক ‘ইমদউদ্দৌলা’ উপাধি দিয়ে তাঁর কন্যাকে বর্ধমান থেকে আগ্রা প্রাসাদে এনে পরলোকগত বাদশাহের অন্যতম বেগম রুকিয়া সুলতানার তত্বাবধানে রাখা হয়। বেশ কিছুকাল তিনি সেখানে সকলের অলক্ষ্যে বাস করেন।” কিন্তু অদৃষ্টের বিধান এটাই ছিল যে, তিনিই পৃথিবীর সম্রাজ্ঞী হবেন। তাই জাহাঙ্গীরের রাজ্যারম্ভের ষষ্ঠ বর্ষে নওরোজের দিন তাঁর সৌন্দর্যমুগ্ধ বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁকে নিজের হারেমে গ্রহণ করেছিলেন। তারপরে সেখানে দিন দিন তাঁর প্রভাব ও মর্য্যাদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। প্রথমে তিনি ‘নূরমহল’ বা ‘প্রাসাদজ্যোতি’ উপাধি পেয়েছিলেন। পরে বাদশাহ অনুভব করেছিলেন যে, সেই উপাধি তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়; তাই তিনি তাঁকে ‘নূরজাহান’ বা ‘জগজ্জ্যোতি’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। যিনি ভারত সম্রাটের হৃদয়েশ্বরী হয়েছিলেন, তাঁর আত্মীয়স্বজনদের পক্ষেও সাধারণ অবস্থায় থাকা সম্ভব ছিল না। তাই জাহাঙ্গীরের আদেশে তাঁদের প্রত্যেককে উচ্চ পদবী ও জায়গীর প্রদান করা হয়েছিল। তাঁর মহিষীর ব্যক্তিগত ক্ষমতা যাতে সবাই অনুভব করতে পারেন, সেজন্য তিনি রীতিমত ফরমান জারী করেছিলেন যে, মোঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে কোন নারী যদি কাউকে ভূমি দান করেন, তাহলে দানপত্রের উপরে নূরজাহান বেগমের সিল না থাকলে সেটা আইনতঃ গ্ৰাহ্য করা হবে না। পরে তাঁকে বাদশাহী ক্ষমতাও প্রদান করা হয়েছিল। বস্তুতঃ তিনি প্রায়ই প্রাসাদের অলিন্দে বসে আমীর ওমরাহদের প্রতি নির্দেশ দিতেন। বাদশাহের সঙ্গে তাঁর নাম জুড়ে দিয়ে সিক্কা প্রচারও করা হয়েছিল। এমনকি ওই সময়ের বাদশাহী ফরমানের উপরে তাঁর স্বাক্ষরও থাকত। জাহাঙ্গীর লিখেছিলেন, “নূরজাহানই সব! আমি এক সির সুরা ও আধ সির মাংস ছাড়া আর কিছুই চাই না।”
নূরজাহান হরণের জন্য কুতুবউদ্দীন কোকলতাস যেমন শের আফগানকে হত্যা করেছিলেন, শেরও তেমনি তাঁকে রেহাই দেন নি। ওই অনুগত ব্যক্তির মৃত্যুতে জাহাঙ্গীরের মন কয়েকদিন ভারাক্রান্ত ছিল, তারপরে তিনি বিহারের ফৌজদার ‘জাহাঙ্গীর কুলি খাঁ’কে বাংলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উক্ত জাহাঙ্গীর কুলি নিজের আগের জীবনে একজন ক্রীতদাস ছিলেন; আকবরের অনুগ্রহভাজন হয়ে নিজের বৃদ্ধ বয়সে তিনি বিহারের ফৌজদারী পদ লাভ করেছিলেন। কিন্তু বাংলায় পৌঁছাবার কিছু দিন পরেই, ১৬০৮ খৃষ্টাব্দের ৬ই মে তারিখে তাঁর মৃত্যু হলে ‘ইসলাম খাঁ’কে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করে পাঠানো হয়েছিল। বাংলার সুবাদার পদে তাঁর নিয়োগই শেষপর্যন্ত গৌড়-বঙ্গ থেকে ফৌজী যুগের অবসানের সূচনা করেছিল। উড়িষ্যার শেষ আফগান সুলতান কতলু খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ওসমানের নিধন তাঁর কর্মজীবনের সর্বাপেক্ষা বড় কীর্তি ছিল। সেই প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর লিখেছিলেন, “আমার রাজ্যারম্ভের সপ্তম বর্ষে, ১৬১২ খৃষ্টাব্দের ১২ই মার্চ তারিখে ইসলাম খাঁর কাছে থেকে সংবাদ আসে যে দুষমন পরাজিত হয়েছে – বাংলা ওসমান আফগানের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। সেই ঘটনা বর্ণনা করবার আগে বাংলার কিছু বিবরণ লিপিবদ্ধ করবার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলা একটি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড – দ্বিতীয় স্তরে অবস্থিত। দৈর্ঘে বন্দর চাটগাঁ থেকে গাঢ়ি পৰ্য্যন্ত ৪৫০ ক্রোশ, প্রস্থে উত্তরের পর্বত থেকে মান্দারণ পৰ্যন্ত ২২০ ক্রোশ। রাজস্ব ৬০ কোটি দাম। আগে এখানকার শাসকেরা আট হাজার অশ্বারোহী, এক লক্ষ পদাতিক, এক হাজার হস্তী ও চার-পাঁচশো জাহাজের নৌবহর রাখতেন। আফগান শের খাঁ ও তাঁর পুত্র সেলিম খাঁর সময় থেকে এই দেশটি আফগানদের অধিকারে ছিল। আমার মাননীয় পিতা হিন্দুস্থান মসনদের শোভা বর্দ্ধন করবার পর থেকে এই দেশকে বশে আনবার জন্য একটি ফৌজ নিয়োগ করেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে খান-ই-জাহান কর্তৃক শেষ আফগান সুলতান দাউদ কররানি নিহত ও তাঁর সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়। সেই থেকে মোঘল সাম্রাজ্যের কর্মচারীরা এই দেশ শাসন করছেন বটে, কিন্তু, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে আফগানদের উৎপাত বরাবর চলছে। মান সিংহ দীর্ঘকাল এই দেশের সুবাদার ছিলেন। আমি মসনদে আরোহণের প্রথম বছরে তাঁকে রাজধানীতে ফিরিয়ে এনে আমার কোকলতাস কুতুবউদ্দীনকে তাঁর জায়গায় নিয়োগ করি। … ইসলাম খাঁ বয়সে তরুণ ও শাসন বিষয়ে অনভিজ্ঞ হলেও এই দেশে শৃঙ্খলা এনেছেন। তাঁর অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব হল ওসমান আফগানের নিধন। আমার পিতার রাজত্বের সময়ে বাদশাহী ফৌজ এই ব্যক্তির সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়েও তাঁকে বশে আনতে পারে নি। স্থানীয় জমিদারদের আনুগত্য আদায় করবার জন্য ইসলাম খাঁ ঢাকায় বসবাস করে ওসমান ও তাঁর দুর্দ্ধর্ষ অনুচরবর্গকে বশীভূত বা নিধন করতে যত্নবান হন। সুজাৎ খাঁ সে সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এই কাজের দায়িত্ব সুজাৎ-এর উপরে ন্যস্ত করে আরও বহু অফিসারকে তাঁর সঙ্গে পাঠানো হয়। যখন তাঁরা ওসমানের দেশ ও দুর্গের কাছে গিয়ে পৌঁছান তখন কয়েকজন উপযুক্ত বাগ্মীকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, সে যেন বিদ্রোহ-প্রবণতা ত্যাগ করে একজন সৎ প্রজার মত আচরণ করে। কিন্তু সেই স্পর্ধিত উচ্চাকাঙ্খী আফগান এই সদুপদেশে কান দিল না; এ দেশকে নিজ অধিকারে আনা ছাড়া অন্য কোন পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। তাই সকল উপদেশ উপেক্ষা করে সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে এক গ্রাম্য নালার ধারে জলায় ঘেরা উচ্চভূমিতে নিজ সৈনাদের সন্নিবেশিত করে। সুজাৎ খাঁও তাঁকে আক্রমণের জন্য নতুন করে ব্যূহ বিন্যাস করেন। ওসমানের সেদিন যুদ্ধ করবার কোন ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু সে যখন শুনল যে বাদশাহী ফৌজ এগিয়ে আসছে, তখন নালার ধারে গিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরী হল। … ১৬১২ খৃষ্টাব্দের ৯ই মার্চ তারিখের প্রত্যুষে উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সেই দুঃসাহসী বিদ্রোহী এক ভীমদর্শন হাতীর পিঠে চড়ে এগিয়ে এসে আমাদের অগ্রবাহিনীর সামনে একেবারে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। বাদশাহী অফিসারেরা প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করলেন বটে কিন্তু একে একে ধরাশায়ী হতে লাগলেন। দক্ষিণ উইং-এর অধিনায়ক ইফতিকার খাঁ বীরত্বে কিছু কম ছিলেন না, কিন্তু তিনিও যুদ্ধে নিহত হলেন। তাঁর সৈন্যরা প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করে শেষপর্যন্ত নির্মূল হয়ে গেল। বাম উইং-এর কিশোয়ার খাঁ অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়ে শেষপর্যন্ত মৃত্যু বরণ করলেন। শত্রু পক্ষের বহু লোক আহত হলেও তাঁদের নায়ক ওসমান অদ্ভূত নৈপুণ্যের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে লাগল। যখন সে দেখল যে, আমাদের অগ্রবাহিনীর দক্ষিণ ও বাম উইং-এর কমাণ্ডারেরা নিহত হয়েছেন বটে কিন্তু মধ্য উইং অটুট রয়েছে তখন নিজের লাভ-লোকসানের কথা বিবেচনা না করে বীর বিক্রমে সেই উইংএর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সুজাৎ খাঁর পুত্র, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য লোকজন সিংহ ও ব্যাঘ্রের মত তাঁর সামনে গিয়ে মহা নির্ঘোষে যুদ্ধ করলে শত্রুপক্ষের অনেকে নিহত ও অনেকে সাংঘাতিকরূপে আহত হওয়ার পরে ওসমানের সেই বিরাটকায় হস্তী এসে জাৎ খাঁকে আক্রমণ করল। তিনি বর্শা দিয়ে হাতীটিকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করলেন; কিন্তু সেই ভীষণ জন্তু বর্শাকে কতটুকু গ্রাহ্য করে? সুজাৎ তখন তরবারি কোষমুক্ত করে তাঁকে দু’বার আঘাত করলেন। কিন্তু তাতে কি? পরে তিনি ছোরা দিয়ে আঘাত করলেও সে কোন কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ না করে অশ্বসহ সুজাৎকে ধরাশায়ী করবার চেষ্টা করল। অশ্ব থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময়ে সুজাৎ খাঁ চেঁচিয়ে উঠলেন – ‘জাহাঙ্গীর শাহ!’ ঠিক সেই সময়ে একজন সিপাহী এসে সেই ভীষণ জানোয়ারের সামনের পায়ে দু’মুখো তরবারি দিয়ে সজোরে আঘাত করায় সে পা বেঁকে নীচু হয়ে পড়ল। সুজাৎ ও সেই সিপাহী তখন হস্তীর আরোহী ওসমান খাঁকে মাটিতে ঠেলে ফেলে জন্তুটির মাথা ও শুঁড়ে বারবার তরবারি বিঁধতে থাকায় সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে পশ্চাদপসারণ করল। এত বেশী অস্ত্রাঘাতে সে বিদ্ধ হয়েছিল যে নিজ ব্যূহে পৌঁছাবার পরেই তার মৃত্যু হয়। সুজাৎ খাঁর ঘোড়া অক্ষত দেহে মাটি থেকে উঠে পড়লেও তিনি যখন তার পিঠে আরোহণ করতে যাবেন সেই সময়ে তাঁকে আবার ভূপতিত করবার জন্য শত্রু তাঁর পতাকাবাহীর দিকে আরেকটা হস্তী ঠেলে দিল। তাই দেখে সুজাৎ পতাকাবাহীকে সতর্ক করে চেঁচিয়ে উঠলেন – ‘মানুষের মত কাজ করো, আমি এখনও বেঁচে রয়েছি।’ আশপাশের সকল লোক তখন তরবারি, তীর ও ছোরা মেরে হাতীটিকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। সুজাৎ খাঁ পতাকাবাহীকে মাটি থেকে ওঠবার আদেশ দিয়ে আরেকটি ঘোড়া চেয়ে নিয়ে পতাকাসহ লোকটিকে বসিয়ে দিলেন। … এই ধস্তাধস্তির সময়ে একটি বন্দুকের গুলি বিদ্রোহী নায়কের কপাল ভেদ করে চলে যায়। কিন্তু যে হাত সেই গুলি চালিয়েছিল পরে যথোচিৎ অনুসন্ধান করেও তাঁকে খুঁজে বার করা যায় নি। গুলি লাগতেই ওসমান কিছুটা পেছিয়ে গেল, কারণ সে বুঝে নিয়েছিল যে মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু আশ্চর্য সৈনিক এই ওসমান! আঘাত সত্বেও সে আড়াই ঘড়ি ধরে তাঁর লোকদের যুদ্ধ চালাবার জন্য উদ্দীপনা জোগাল। যুদ্ধ ও হত্যা সমানভাবে চলতে লাগল। শেষপর্যন্ত শত্রু পরাজিত হয়ে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে যতক্ষণ না তাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত স্থানে গিয়ে পৌঁছাল, আমাদের সৈন্যরা তাঁদের অনুসরণ করতে লাগল। সেখানে পৌঁছেও তাঁরা অবিশ্রান্তভাবে তীর ও গুলি বর্ষণ করে আমাদের সৈন্যদের পক্ষে ভিতরে প্রবেশ অসম্ভব করে তুলল। ওসমানের সাংঘাতিক আঘাতের কথা তাঁর ভাই ওয়ালি ও পুত্র মামরেজের গোচরীভূত হোলে তাঁরা বুঝে নিল যে মৃত্যু আসন্ন। তাঁরা একথাও চিন্তা করল যে, এই পরাজয়ের পরে যদি নিজেদের দুর্গম স্থানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে একজনও সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে না। তাই সকল দিক বিবেচনা করে তাঁরা স্থির করল যে, কোন রকমে রাতটা সেখানে কাটিয়ে সূর্য্যোদয়ের আগেই নিজেদের কেল্লার দিকে সরে পড়বে। মধ্য রাত্রে ওসমান দোজখে চলে গেল। পরের ঘড়িতে দুষমনরা সব কিছু ফেলে রেখে তাঁর লাশ নিয়ে নিজেদের দুর্গের দিকে রওনা দিল। এই পলায়নের কথা শুনে সুজাৎ খাঁ চেয়েছিলেন যে, তাঁদের তাড়া করে নিঃশ্বাস ফেলবার সময় না দিতে, কিন্তু তাঁর সৈন্যরা একে রণক্লান্ত তায় নিহতদের কবর দেওয়া ও আহতদের শুশ্রূষা করবার দায়িত্ব থাকায় সেরূপ কিছু করা সম্ভব হল না। সেই সময়ে মোয়াজ্জিম খাঁর পুত্র আব্দুল ইসলাম কয়েকজন অফিসার, ছয়শো ঘোড়সোয়ার ও চারশো গোলন্দাজসহ এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। এই নতুন সৈন্যরা বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন শুরু করেছে দেখে তাঁদের নতুন নায়ক ওয়ালি সন্ধি প্রার্থনা করে সুজাৎ খাঁর কাছে দূত পাঠালেন। তিনি ও অন্যান্য অফিসারেরা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে নিজেদের শর্ত জানিয়ে দিলে পরের দিন ওয়ালি এবং নিহত ওসমানের পুত্র ও আত্মীয়রা বাদশাহী তাঁবুতে এসে ঊনপঞ্চাশটী হস্তী ও অন্যান্য দ্রব্য উপঢৌকন প্রদান করল। অধিকৃত দেশে প্রহরার জন্য কিছু সৈন্য রেখে সুজাৎ খাঁ ওয়ালিসহ সকল আফগান বন্দীকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের (ঢাকা) দিকে রওনা হলেন, এবং ৬ই সাফার তারিখে সেখানে পৌঁছে সুবাদার ইসলাম খাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনিই এই যুদ্ধের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন বলে আমি তাঁকে ছয় হাজারী মনসবদারীতে উন্নীত করি, এবং সুজাৎ খাঁকে রুস্তম উপাধি ও এক হাজারী মনসবদারী দিই।” ওসমানের নিধনের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর এক নায়ক চিরতরে ধরাধাম ত্যাগ করেছিলেন। সেই সাথে গৌড়-বঙ্গে আফগানদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধও চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
(তথ্যসূত্র:
১- Memoirs of Jahangir, Edited by Susil Gupta.
২- Jahangir: An Intimate Portrait of a Great Mughal, Parvati Sharma.
৩- The Emperor Jahangir: Power and Kingship in Mughal India, Lisa Balabanlilar.)