‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)

‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)


হরানা চক্রবর্তীঃ ‘ঘোরী নগরী’ আফগানিস্থানে অবস্থিত হলেও ‘মহম্মদ ঘোরী’ জাতিতে আফগান ছিলেন না। তরাইন প্রান্তরে একদল আফগান যেমন তাঁর তুর্কী ফৌজের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, আরেকদল আফগান তেমনি পৃথ্বিরাজের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবার জন্য দিল্লীতে চলে গিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ‘ফিরিস্তা’র বিবরণ অনুসারে ঘোরীর সৈন্যবাহিনীতে তুর্কী, তাজিক ও আফগানরা ছিলেন; পক্ষান্তরে পৃথ্বিরাজের বাহিনী রাজপুত ও আফগান সৈন্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। তখন ঐভাবে স্বদেশে ও বিদেশে দস্যুবৃত্তি করা এবং বিভিন্ন রাজ্যের সৈন্যবাহিনীতে চাকরি করাটা আফগানদের প্রধান উপজীবিকা ছিল। স্বদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তাঁরা বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। বহিরাগতরা গিয়ে তাঁদের দেশে রাজত্ব করতেন, আর তাঁরা অন্যের দেশে গিয়ে ভাড়াটে সৈনিকের কাজ করতেন। তাঁরা নিজেরাও যে কোন রাজ্য বা দেশ চালাতে পারেন, এমন কথা তখন কোন আফগানই ভাবতে পারতেন না। অবশেষে পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল। মধ্য-এশিয়া থেকে ‘তৈমুর লং’ অবলীলাক্রমে দিল্লী লুণ্ঠন করে চলে গিয়েছিলেন দেখে দলে দলে আফগান উপজাতিরা ভারতের তুর্কী সাম্রাজ্যের দুর্বলতা বুঝতে পেরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজেদের বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিলেন। সেই উপজাতিদের সংঘবদ্ধ করে ১৪০২ খৃষ্টাব্দে ‘বহলোল লোদী’ দিল্লীর শেষ সৈয়দ বংশীয় সুলতানের কাছ থেকে ওই নগরীটি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। সেই থেকে ভারতে প্রথম আফগান রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তখন থেকেই বাঘ রক্তের স্বাদ পেয়েছিল। আফগানদেরও যে রাজ্য হতে পারে, সেকথা বুঝতে পেরে তাঁদের সর্দারেরা চারিদিকে রাজ্য প্রতিষ্ঠা বা জায়গীর অধিকারের জন্য ঘুরতে শুরু করেছিলেন। এরপরে পাঞ্জাব, অযোধ্যা, জৌনপুর – সর্বত্র তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই আফগান ভাগ্যন্বেষীদের অন্যতম নায়ক ছিলেন ‘ফজলী খাঁ’র পুত্র ‘ফরিদ’। বহলোল লোদীর নেতৃত্বে তাঁর স্বজাতিরা যখন দিল্লী অধিকার করেছিলেন, ফরিদের পিতামহ তখন স্বদেশ ছেড়ে হিন্দুস্থানে চলে এসেছিলেন। জৌনপুরের তৎকালীন হিন্দু রাজা ‘জয়মল্লের’ আনুকূল্যে সেই পরিবারটি সাসারামে একটি জায়গীর পেয়েছিলেন, এবং চুক্তিনামা অনুসারে জয়মল্লকে প্রয়োজনের সময়ে সৈন্য সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই সৈনিকদের সঙ্গে কাজ করবার সময়ে ফরিদ একদিন একাই একটি বাঘকে মারবার ফলে তাঁর নতুন নাম হয়েছিল – ‘শের খাঁ’। ঠিক সেই সময়ে দিল্লীশ্বর ‘ইব্রাহিম লোদী’র একজন সৈন্যাধ্যক্ষ ‘মোবারক লোহানি’ যখন প্রভুর বিরুদ্ধাচারণ করে বিহারে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন শের তাঁর প্রতি নিজের সমর্থন জানিয়ে তাঁর বালক পুত্র জালালের গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরে মোবারক লোহানির অকালমৃত্যু হওয়ার ফলে বালক জালাল বিহারের সুলতান বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। কিন্তু বাবরের আগমনে যেসব আফগান সর্দারেরা তখন দিল্লী থেকে পালিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা সেই সঙ্কটের সময়ে একজন বালকের নেতৃত্বের উপরে নিজেদের ভরসা রাখতে পারেন নি। তাই তাঁদের সবাই মিলে জালালকে সরিয়ে দিয়ে দিল্লীর লোদী মসনদের শেষ দাবীদার ‘মামুদ’কে বিহারের মসনদে বসিয়েছিলেন। শেরও তখন সেই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে সম্মিলিত আফগান বাহিনীর হয়ে বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সবাইকে পরাজিত করে বাবর যখন জালাল লোহানিকে তাঁর হৃতরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তখন তিনি নিজের রাজনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে বাবরের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে লোহানির উজীরের পদ লাভ করেছিলেন। ওই ঘটনার কিছু দিন পরে গৌড় প্রাসাদে একটি বিষম বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গিয়েছিল। অজ্ঞাত এক আততায়ীর হাতে গৌড়েশ্বর ‘নসরৎ শাহ’র মৃত্যু হওয়ার ফলে তাঁর বালকপুত্র গৌড়-বঙ্গের মসনদে আরোহণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবনাবসান ঘটিয়ে তাঁর পিতৃব্য ‘গিয়াসুদ্দীন মামুদ’ সেই মসনদ অধিকার করে নিয়েছিলেন। এর ফলে হাজীপুরের শাসনকর্তা ‘মকদুম শাহ’ ক্ষিপ্ত হয়ে গৌড়-বঙ্গের নতুন সুলতানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। ওদিকে শের শাহের অভিভাবকত্ব আগে থেকেই বালক জালালের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তার উপরে তিনি যখন জানতে পেরেছিলেন যে, মকদুম শাহর গচ্ছিত অর্থে শের সৈন্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন, তখন তিনি তাঁকে নিধন করবার জন্য গুপ্তঘাতক নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার জন্য জালালের পক্ষে নিজের রাজ্যের রাজধানীতে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল, ফলে তিনি গৌড়ে পালিয়ে গিয়ে সুলতান গিয়াসুদ্দীন মামুদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওদিকে গিয়াসুদ্দীন দেখেছিলেন যে, সেটাই বিহারের উপরে তাঁর আধিপত্য স্থাপনের একটা মহা সুযোগ। তাই জালালকে স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তিনি ‘ইব্রাহিম খাঁ’র নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনীকে শেরের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন (১৫৩৪ খৃষ্টাব্দে)। কিছুদিন পরে সুলতান জালালও তাঁর নিজের ফৌজ নিয়ে ওই বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। শের খাঁর সামনে তখন মহা বিপদ উপস্থিত হয়েছিল। হয়হস্তীপদাতিক দিয়ে গঠিত সেই বিশাল বাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার মত সম্বল তাঁর একেবারেই ছিল না। তার উপরে তাঁর পশ্চিম সীমান্ত থেকে যে কোন সময়ে বিপদ উপস্থিত হতে পারত। তাই তিনি পুরোপুরি আত্মশক্তির উপরে নির্ভর করেই গিয়াসুদ্দীন ও জালালের সম্মুখীন হওয়ার জন্য মনোমত স্থান ও উপযুক্ত সময়ের জন্য দিন গুণতে শুরু করেছিলেন। এরপরে একটা সময়ে মুঙ্গের পার করে লক্ষ্মীসরাইয়ের কাছাকাছি কোন একটি জায়গায়, নদীপাহাড় বেষ্টিত সুরজগড় প্রান্তরে পৌঁছে সেই সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতিদ্বয় তাঁদের তাঁবু ফেলেছিলেন। শের খাঁও তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীসহ সেখানে পৌঁছে ব্যূহ বিন্যাসের আদেশ দিয়েছিলেন। তারপরে উভয় পক্ষই মাসাধিক কাল ধরে সেখানে চুপচাপ বসে ছিল; ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কেউই নিজের বিরোধীদের আক্রমণ না করে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে শুরু করেছিলেন। শেষপর্যন্ত এক রাতে শের খাঁ সুযোগ বুঝে শত্রুর উপরে ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। সংখ্যায় বহু গুণ হলেও অস্ত্র ধারণের কোন সুযোগ না পাওয়ার জন্য তাঁরা সেই আচমকা আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সেনাপতি ইব্রাহিম খাঁ নিহত হয়েছিলেন। সুলতান জালাল কোনক্রমে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে গৌড়ে ফিরে যেতে পেরেছিলেন। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসের উপরে সেই ‘সুরজগড়ের যুদ্ধের’ ফল সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। সেখানে মুষ্টিমেয় অশ্বারোহীদের নিয়ে শের খাঁ গৌড় ও বিহারের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে শুধু যে বিহারের সর্বময় অধীশ্বর হয়ে বসেছিলেন তা নয়, তখন থেকেই তিনি ভবিষ্যতের ভারতের ইতিহাসের উপরে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করবার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। একজন অসাধারণ প্রতিভাশালী সৈন্যাধ্যক্ষ ও বিচক্ষণ কূটনীতিজ্ঞ না হলে, সুরজগড়ে সেদিন তাঁর পক্ষে কিছুতেই জয়লাভ করা সম্ভব হত না। ওই যুদ্ধের ফলে বিহার থেকে জালাল লোহানির শাসনের অবসান ঘটেছিল, এবং সবাই শের খাঁকে ওই রাজ্যের অধীশ্বর বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু – পশ্চিমে মোঘল ও পূর্বে গৌড় – এই দুই প্রবল শক্তির চাপে শেরের সেই নূতন রাজ্য কতদিন টিকে থাকবে – সেই প্রশ্নটাই তখন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাই পরের দুই বছর ধরে তিনি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সৈন্যবল বৃদ্ধি করেছিলেন। হুমায়ুন তখন গুজরাট যুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ করে দিল্লীতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বটে, কিন্তু গুজরাটে আবার বিদ্রোহবহ্নি জ্বলে উঠেছে শুনে শের বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেই আগুন পুরোপুরি নেভানোর জন্য হুমায়ূনকে আবার অবশ্যই সেখানে যেতে হবে। যেহেতু তখন দিল্লীর দিক থেকে তাঁর কোন বিপদের সম্ভাবনা ছিল না, সেহেতু তিনি গৌড়শ্বর মামুদ শাহের সঙ্গে নিজের হিসাব মেটাবার জন্য সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীসহ পূর্বদিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন (১৫৩৬ খৃষ্টাব্দ)।

সুরজগড়ের যুদ্ধে পরাজয়ের পরেই মামুদ শাহ বুঝে গিয়েছিলেন যে, একদিন না একদিন তাঁকে শের খাঁর বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় নামতেই হবে। তাই সেটার প্রস্তুতি হিসাবে তিনি রাজমহল পাহাড়ের পশ্চিমদিকস্থ সব ভূভাগ থেকে নিজের সৈন্যদের সরিয়ে নিয়ে এসে বিহার ও গৌড়ের প্রত্যন্ত প্রদেশে অবস্থিত ‘তেলিয়াগড়ি গিরিবর্ত্মে’ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। নিজের বেশীরভাগ স্থল ও নৌসৈন্যকে সেখানে তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখলেও, একক শক্তিতে সকল আফগানের সাহায্যপুষ্ট শের খাঁর সম্মুখীন হওয়াটা তাঁর পক্ষে শক্ত হবে বুঝতে পেরে তিনি বন্ধুর সন্ধান করতে শুরু করেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, পর্তুগীজ ফিরিঙ্গিরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে তাঁর রাজ্যে এসে ব্যবসা করলেও তাঁরা ভালো লড়াইও করতে পারেন; তাঁদের নিজের দলে পেলে তাঁর শক্তি বাড়বে চিন্তা করে নিয়ে তিনি তাঁদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর কথা ঠিক করে নিয়েছিলেন। এর ফলে, দুই বছর আগে যে পর্তুগীজ মিশনকে মামুদ শাহ মুসলমান জাহাজ লুঠ করবার অপরাধে গৌড় কারাগারে আটকে রেখেছিলেন, তখন তিনি তাঁদেরই শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশে সব পর্তুগীজ বন্দীকে মুক্তি দিয়ে তেলিয়াগড়িতে পাঠানো হয়েছিল, এবং তাঁদের নেতা ডি’মেলো মারফৎ গোয়ার পর্তুগীজ ভাইসরয় ‘ন্যুনো ডি’কুন্হা’র কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল। এরপরে আবহাওয়া আরো অনুকূল করবার জন্য সুলতান মামুদ শাহ পর্তুগীজদের সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রামে কুঠী স্থাপনের জন্য সনদ দিয়েছিলেন। মামুদ শাহের সব কথাই গুপ্তচরদের মারফত শের খাঁর কাছে পৌঁছেছিল। তাই মামুদ শাহকে আর বেশী সময় দেওয়া উচিত হবে না বুঝতে পেরে তিনি তাঁর নিজের বাহিনীসহ পাটনা থেকে রওনা হয়ে তেলিয়াগড়ি গিরিবর্ত্মে পৌঁছে দেখতে পেয়েছিলেন যে সেখানকার পথ বন্ধ! গিয়াসুদ্দীন মামুদ তাঁর চেয়েও একটি বৃহত্তর সৈন্যবাহিনীকে সেখানে প্রস্তুত রেখেছিলেন, তাঁর সমস্ত রক্ষাব্যবস্থা সেই গিরিবর্ত্মকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল। সব দেখে শের খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওই জায়গাটি তাঁর পক্ষে যুদ্ধের অনুকূল নয়, সেখানে যুদ্ধ করলে জয় পরাজয় সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে যাবে। তাছাড়া কোন বড় রকমের সম্মুখযুদ্ধে তিনি অভ্যস্তও ছিলেন না। ছদ্মবেশে সমস্ত অঞ্চলটি ঘুরে শের যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেখানে শত্রুব্যূহ ভেদ করাটা তাঁর পক্ষে সহজসাধ্য হবে না, তখন তিনি তাঁর পুত্র জালালের অধীনে কয়েক রেজিমেন্ট সৈন্যকে সেখানে রেখে দিয়ে, মূল বাহিনীসহ অতি সংগোপনে ঝাড়খণ্ডের পথ ধরে গৌড় নগরীর দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই গতিবিধির কথা কিন্তু মাসুদ শাহের সৈন্যাধ্যক্ষরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন নি। তাই কয়েক দিন পরে যখন তাঁদের কাছে খবর গিয়েছিল যে, শের খাঁ গৌড় নগরীর দ্বারদেশে গিয়ে উপনীত হয়েছেন, তখন তাঁরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। মামুদের প্রায় সকল সৈন্যাধ্যক্ষই সঙ্গে সঙ্গে তেলিয়াগড়ি ত্যাগ করে রাজধানীর দিকে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের সুলতান সেই খবরে এমনই ভগ্নোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন যে, সোজাসুজি যুদ্ধের আদেশ দিতে ইতস্ততঃ করতে শুরু করেছিলেন। এমনকি পর্তুগীজরা পর্যন্ত সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েও তাঁর মনোবল বাড়াতে পারেন নি। শেষপর্যন্ত তেরো লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা মূল্য দিয়ে তিনি শের খাঁর কাছ থেকে সন্ধি ক্রয় করেছিলেন। সেই সন্ধির ফলে গৌড় নগরীর প্রবেশদ্বার তেলিয়াগড়ি গিরিপথ আফগানদের হাতে চলে গিয়েছিল। সন্ধিপত্র যথারীতি সম্পাদিত হলেও গিয়াসুদ্দীন মামুদ কিন্তু তাতে কোন স্বস্তি পাননি। তিনি জানতেন যে, আগুনকে তিনি ছাই চাপা দিয়ে রেখেছেন, আর সেটা যে কোন মুহূর্তে বেরিয়ে পড়ে তাঁকে পুড়িয়ে দিতে পারে। তাই তিনি নতুন করে নিজের সামরিক বল বাড়ানোর জন্য পর্তুগীজদের কাছে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পর্তুগীজরা তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন যে, সুলতান যদি পরের বছর, অর্থাৎ ১৫৩৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন, তাহলে তাঁকে প্রার্থিত সাহায্য পাঠানো সম্ভব হবে। শের খাঁর দাপটে ভীতিবিহ্বল মামুদ শাহ হুমায়ুনের কাছেও তখন সাহায্যের জন্য কোন আবেদন পাঠিয়েছিলেন কিনা জানা যায় না, কিন্তু শের শাহের অভ্যুত্থানের সংবাদ দিল্লীতে পৌঁছানোর পরে হুমায়ুন বিচলিত না হয়ে পারেন নি। তাই কিছুদিন পরেই গুজরাট যুদ্ধ শেষ হলে তিনি সসৈন্যে গিয়ে বিহারের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত চূনার দুর্গ অবরোধ করেছিলেন। তা দেখে শের খাঁর ভয় হয়েছিল যে, হুমায়ুনের নির্দেশে হোক বা তাঁর অভিযানের সুযোগ নেওয়ার জন্যই হোক, মামুদ শাহ তাঁকে পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করতে পারেন। তাই সেই সম্ভাবনাকে সমূলে বিনাশ করবার জন্য তিনি পুত্র জালালের অধীনে একটি সৈন্যবাহিনীকে গৌড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েক মাস ধরে তাঁরা ওই নগরী অবরোধ করে রাখবার ফলে নগরমধ্যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল, শেষপর্যন্ত মামুদ শাহ উন্মুক প্রান্তরে বেরিয়ে এসে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই যুদ্ধে পরাজিত ও আহত হয়ে তিনি সদলবলে উত্তর বিহারে পলায়ন করবার পরে গৌড়ের উপরে শের শাহের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে ঠিক সেই সময়ে হুমায়ুন চূনার দুর্গ অধিকার করে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। শোন নদীর তীরে মানেরের নিকটবর্তী দারেশপুর গ্রামে গৌড়েশ্বর গিয়াসুদ্দীন মামুদ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, মোঘলরা গৌড় আক্রমণ করলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের সাহায্য করবেন। কিন্তু হুমায়ুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গৌড়ে ফেরবার পথে কহলগাঁও পৌঁছে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, আফগানরা তাঁর দুই বন্দী পুত্রকে হত্যা করেছেন। এরপরে সেই শোকে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আর তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হোসেনশাহী বংশও গৌড়-বঙ্গের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করেছিল।
চূনার দুর্গের পতনের পরে শের খাঁ হুমায়ুনের সঙ্গে সন্ধি স্থাপনের একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু গৌড়েশ্বর মামুদ শাহের প্ররোচনায় তিনি সে কথায় কান না দেওয়ার ফলে শের মাত্র পাঁচশো অশ্বারোহী সমেত দ্রুতগতিতে গৌড়ে পৌঁছে নিজেকে সমগ্র গৌড় রাজ্যের স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচার শুরু হয়েছিল। সেই অপ্রত্যাশিত সাফল্য সত্ত্বেও শের খাঁ জানতেন যে, তিনি গৌড় ও বিহারের সর্বময় অধীশ্বর হলেও হুমায়ুন যেভাবে এগিয়ে আসছেন তাতে শেষপর্যন্ত হয়ত তাঁর পক্ষে আত্মরক্ষা করা সহজসাধ্য হবে না। তাই গৌড় নগরীর প্রবেশদ্বার তেলিয়াগড়ি গিরিবর্ত্মে´ একটি শক্তিশালী ফৌজ রেখে দিয়ে তিনি রাজকোষে সঞ্চিত ছয় কোটী স্বর্ণমুদ্রাসহ সব ধনসম্পদই রাতারাতি রোহটাস দুর্গে পাচার করে দিয়েছিলেন। হোসেন শাহের সময় থেকেই সেই অর্থ ছাড়া অত বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন জমা হয়ে উঠেছিল যে, সেগুলি বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য শেরের পুত্র জালালকে অন্য জায়গা থেকে ভারবাহী পশু সংগ্রহ করতে হয়েছিল। শের খাঁ নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, মোঘলরা গৌড়ে পৌঁছে খালি পোড়ামাটি ছাড়া আর অন্য কিছু যেন দেখতে না পান। তাঁর আদেশ পেয়ে আফগান সিপাহীরা গৌড়ের রাজপ্রাসাদ, সরকারী দফতরখানা ও বড় বড় হর্মগুলিকে অস্ত্র ও অগ্নি সংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়েছিলেন, এবং গৌড় নগরীর সমস্ত কূপ ও জলাশয়গুলিকে আবর্জনায় ভরে দিয়েছিলেন। এর ফলে সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে সেখানে বাস করা শক্ত হয়ে উঠেছিল। তারপরে মোঘলরা সেখানে গিয়ে পৌঁছালে তাঁদের সঙ্গে আফগানদের যে যুদ্ধ হবে, তাতে কেউ ধনপ্রাণ নিয়ে টিকে থাকতে পারবেনা না বুঝতে পেরে, নগরবাসীরা দলে দলে গ্রামাঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন – গৌড় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল (১৫৩৯ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাস)। হুমায়ুনের অভিযাত্রীবাহিনী একটি আস্ত চলমান নগরী ছিল। তাঁর লক্ষাধিক সৈনিক ও অফিসারদের জন্য কয়েক হাজার দাসদাসী সেই বাহিনীর পশ্চাদভাগে চলতেন। চেঙ্গিজ খাঁর সময় থেকেই তিনশো বছর ধরে একটানা রাজ্যশাসনের ফলে ওই ধরণের বিলাসের ঐতিহ্য মোঘল বাহিনীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। একে তো তাঁর সেই বাহিনী বৈচিত্র্যেভরা ছিল, তার উপরে এগিয়ে আসবার সময়ে হুমায়ুন তাঁর অধিকৃত জনপদগুলির উপরে নিজের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে করতে এগোচ্ছিলেন, সেসবের ফলে তাঁর অভিযানের অগ্রগতি খুবই মন্থর হয়ে পড়েছিল। শের খাঁ যেক্ষেত্রে চূনার থেকে গৌড়ে দু’দিনে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে হুমায়ুনের কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত গৌড়ে পৌঁছে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, আফগানরা সেই নগরীকে শ্মশানে পরিণত করে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। ওই নগর অধিকার করবার জন্য তাঁকে কোন যুদ্ধ করতে না হলেও, পথঘাট সাফ ও বাড়ীঘর পুননির্মাণের জন্য কম আয়াস স্বীকার করতে হয় নি। তবে তাঁর সৈন্যদের পরিশ্রমের ফলে গৌড় আবার নিজের রূপ ফিরে পেয়েছিল। হুমায়ুন দেখেছিলেন যে, গৌড়ের মত সুরম্য জায়গা ভারতে খুবই কম রয়েছে, তাই তিনি ওই নগরীর নাম বদলে নিজের নামে নতুন নামকরণ করেছিলেন – ‘জিন্নতাবাদ’। উল্লেখ্য যে, হুমায়ুনের প্রকৃতব নাম ছিল – ‘জিন্নতবানি আসিয়ানি’। (আকবরনামা, প্রথম খণ্ড) কিন্তু শুধু রাজধানী হাতে এলেই রাজ্য অধিকার করা হয় না। তাই হুমায়ুন দিকে দিকে নিজের লোক পাঠিয়েছিলেন, বড় বড় অফিসারদের জায়গীর দিয়েছিলেন, সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সামরিক চৌকী বসিয়েছিলেন। সেসবের মাঝেই আমোদ প্রমোদ চলেছিল। একটা সদ্য বিজিত রাজ্যে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য যা কিছু করবার প্রয়োজন হয়, সেগুলোর সবই তিনি করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনদিক সামাল দিতেন? থিতু হওয়ার আগেই রাজ্যের অন্যান্য প্রান্ত থেকে আফগানদের হামলার খবর প্রায়ই আসতে শুরু করেছিল। তাঁর আগমনে শের খাঁ গৌড় ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে দক্ষিণ বিহার পুনরধিকার করে বারাণসী-বাহরাইচ অঞ্চলে একটি সুসম্বন্ধ সামরিক ছাউনি তৈরী করে নিয়েছিলেন। তাঁর অশ্বারোহীরা তখন চারিদিকে লুঠতরাজ করে বেড়াচ্ছিলেন, আর মাঝে মাঝে গৌড়ের উপকণ্ঠেও গিয়ে হাজির হচ্ছিলেন। তবে হুমায়ুনের কাছে তখন সবচেয়ে বেশি ভাবনার কথা ছিল যে, তাঁর নিজের ভাই ‘মীর্জা হিন্দাল’ তাঁকে নিপাত করবার জন্য আগ্রায় তৈরী হচ্ছিলেন। ওদিকে যে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি জিন্নতাবাদে এসেছিলেন, সেখানকার স্যাঁতসোঁতে গরম হাওয়া তাঁদের সহ্য হচ্ছিল না, তাই তাঁরা সবাই দেশে ফেরবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই সব কারণে আর বেশী দিন গৌড়ে থাকা উচিৎ নয় বুঝতে পেরে হুমায়ুন দিল্লী ফেরবার ব্যবস্থা করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু কার হাতে তিনি গৌড়ের দায়িত্ব দিতে পারতেন? তাঁর জনৈক উপপত্নী ‘বাইকে বেগমের’ পছন্দের লোক ‘জাহির বেগ’কে তিনি সেকথা বলবার পরে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “মহামান্য বাদশাহ আমাকে এই দোজখের শাসনকর্তা করবার চেয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলে বেশি খুশী হতাম।” হুমায়ুনের তখন দেরী করবার উপায় ছিল না, তাই শেষে আর কোন দায়িত্বশীল লোক না পেয়ে তিনি ‘জাহাঙ্গীর কুলী বেগের’ উপরে গৌড় রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়ে দিল্লীর দিকে রওনা হয়েছিলেন। হুমায়ুনের বাহিনীর পাঁচ হাজার অশ্বারোহী জাহাঙ্গীর কুলীকে সাহায্য করবার জন্য গৌড়ে থেকে গিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন- শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

জুলাই মাসের অবিশ্রান্ত বারিধারার মধ্যে হুমায়ুন গঙ্গার দক্ষিণ তীর দিয়ে দিল্লীর দিকে চলতে শুরু করেছিলেন। জিন্নতাবাদ থেকে পাটনার ওপারে মুঙ্গের পর্যন্ত দীর্ঘ পথে তিনি কোথাও কোন বাধা পাননি। কিন্তু এরপরেই আরো কিছু দূর অগ্রসর হয়ে বকসারের চার মাইল পশ্চিমে কর্মনাশা নদীর তীরে চৌশা গ্রামে পৌছে হুমায়ুন দেখতে পেয়েছিলেন যে, শের খাঁর সৈন্যরা তাঁকে আক্রমণ করবার জন্য পূর্ব দিক থেকে এগিয়ে আসছেন। তাঁদের দেখে তিনি থমকে দাঁড়ানোর পরে শের খাঁও দুই মাইল দূরে তাঁবু ফেলেছিলেন। তখন যেখানে যত আফগান ছিলেন তাঁরা যে শেরের হয়ে লড়বেন, সেকথা বুঝতে পেরে হুমায়ুন আরো সৈন্য পাঠাবার জন্য আগ্রায় চিঠে লিখেছিলেন। শেরও আক্রমণের উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। উভয় পক্ষের সৈন্যরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকলেও, কেউই কাউকে দীর্ঘদিন ধরে আক্রমণ করেন নি। এরপরে একদিন হুমায়ুন তাঁর তাঁবুতে বসে আমীর ওমরাহদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন, এমন সময়ে একজন বার্তাবহ শের খাঁর একটি পত্র নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই পত্রে শের খাঁ তাঁকে লিখেছিলেন যে, তিনি মহামান্য সম্রাটের বংশবদ ভৃত্য ফরিদ ছাড়া আর কিছুই নন, হিন্দুস্থানের বাদশাহের সঙ্গে লড়াই করবার স্পর্দ্ধা তিনি রাখেন না। তাঁর মত নগণ্য ব্যক্তির সেই ধরণের কোন সাহস বা সম্বল নেই। তিনি শুধু বাদশাহের অধীনে গৌড় রাজ্যের তুচ্ছ শাসনকর্তা হয়ে আজীবন তাঁর খিদমত করতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করবেন। চতুর আফগানের সেই কথায় বিভ্রান্ত হয়ে হুমায়ুন পত্রবাহককে জানিয়েছিলেন যে, একটি শর্তে তিনি শের খাঁর প্রস্তাবে রাজী হতে পারেন, সেটা হল যে, শের খাঁ মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধের মহড়া চালিয়ে স্বেচ্ছায় নিজের পরাজয় বরণ করে তাঁর সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে যাবেন, আর বাদশাহী ফৌজ কিছুদূর পর্যন্ত তাঁদের তাড়া করবে। ওই একটি মাত্র শর্ত পালিত হলেই তিনি শের খাঁর সমস্ত আর্জি মঞ্জুর করে আগ্রায় ফিরে যাবেন। শের খাঁ জানিয়েছিলেন যে, হিন্দুস্থানের বাদশাহের ইজ্জত রাখবার জন্য তিনি নিজের জানও দিতে রাজি আছেন। এরপরে হুমায়ুনের শর্তের ভিত্তিতে উভয়পক্ষে মধ্যে সন্ধি সম্পাদিত হলে, শের খাঁ কোরাণ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, আজীবন তিনি বাদশাহের অনুগত দাস হয়ে থাকবেন। সেই সংবাদ যখন উভয় শিবিরের সৈন্যরা জানতে পেরেছিলেন, তখন তাঁদের সবার মুখে হাসি ফুটেছিল, সারা দিন ধরে মোঘল পাঠানের কোলাকুলি চলেছিল। দিনান্তে সন্ধ্যার সময়ে সিপাহীরা পরস্পরের তাঁবুতে গিয়ে পানভোজন পর্যন্ত করেছিলেন। ওই ঘটনার কিছুদিন আগে থেকেই ‘মহারথ’ নামের এক যোদ্ধার নেতৃত্বে চেরো সম্প্রদায় বকসারের আশপাশে ব্যাপকভাবে লুঠতরাজ চালাচ্ছিলেন। বহু চেষ্টা করেও সুলতান জালাল লোহানির সৈন্যরা তাঁদের দমন করতে পারেন নি। জালালের নিষ্ক্রমণের পরে শের শাহের সৈন্যদের সঙ্গেও তাঁদের কয়েকবার খণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু তাতেও তাঁরা অজেয় থেকে গিয়েছিলেন। যেদিন হুমায়ুনের সঙ্গে শেরের সন্ধি সম্পাদিত হয়েছিল, সেদিন উভয় শিবিরে একটা গুজব উঠেছিল যে, মহারথ সেদিন রাত্রেই আফগানদের আক্রমণ করবেন। তাই সেই যোদ্ধার সম্মুখীন হওয়ার জন্য শের শাহ তাঁর উৎকৃষ্টতম অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে নিজের তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ওই ভাবে এক দিন গিয়েছিল, দু’দিন গিয়েছিল, কিন্তু মহারথ কোথায়? কোথায় তাঁর চেরো যোদ্ধার দল? তৃতীয় দিন রাত্রি দ্বিপ্রহরের পরে শের খাঁ আবার চেরোদের দমন করতে বের হয়েছিলেন। সেদিন মাইল পাঁচেক দূরে গিয়ে তিনি তাঁর অনুগত অফিসারদের একান্তে ডেকে বলেছিলেন, “বন্ধুগণ! আমাদের সামনে যে বিপদ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার তুলনায় মহারথ কিছুই নয়। বাবর বেইমানি করে আফগানদের লোদী সাম্রাজ্য গ্রাস করেছিলেন, হুমায়ুন এখন সেই ভিত্তির উপরে একটি নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলছেন। আমরা এখনই যদি তাঁকে শেষ করতে না পারি তাহলে আফগান জাতি হিন্দুস্থান থেকে চিরদিনের মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এখন আর লোদী নয়, লোহানি নয়, শূর নয়, কোন উপজাতি নয় – আমরা সকলেই আফগান। আমরা যদি সঙ্ঘবদ্ধ হই, হুমায়ুনকে হিন্দুস্থান ত্যাগ করতেই হবে। আমাদের পথ ন্যায়ের পথ; তাই আল্লাহ আমাদের মদদ দেবেন। ব্রহ্মজিং গৌড়ের মত বীর হিন্দুও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। আজ রাত্রেই আমরা হুমায়ুনের সঙ্গে শেষ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবো। তোমরা প্রস্তুত?” শের খাঁর মুখ থেকে সেকথা শুনে তাঁর সৈন্যাধ্যক্ষরা আনন্দিত হয়েছিলেন। তখনই সৈন্যদের তিন ভাগে ভাগ করে সেটার এক ভাগ পুত্র জালাল, দ্বিতীয় ভাগ ‘খাওয়াস খাঁ’ ও তৃতীয় ভাগ নিজের অধীনে রেখে শের খাঁ রাত্রির অন্ধকারে অতি সন্তর্পণে মোঘল শিবিরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। মোঘল সৈন্যরা তখন কেউ বা ঘুমে অচেতন ছিলেন তো কেউ আবার শয্যাত্যাগের আয়োজন করছিলেন। হুমায়ুন তখন ভোরের নমাজের জন্য তৈরী হয়ে উজু করছিলেন। আর ঠিক সেই সময়ে শের খাঁর অশ্বারোহীরা মোঘল শিবিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বার ফলে তাঁদের সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। চারিদিকে শুধু মার মার কাট কাট আওয়াজ উঠেছিল। সেই আওয়াজে সচকিত হয়ে উঠে হুমায়ুন চেঁচিয়ে বলেছিলেন, “যুদ্ধ চালাও, উজু শেষ করে আমি এখনই আসছি।” কিন্তু সেই সময়টুকু তিনি পাননি। আফগানেরা তিন দিক থেকে মোঘলদের উপরে এমনভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁরা যাতাকলে পেশাই হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিলেন; তাঁর যতই সামনে এগিয়েছিলেন, নিষ্ক্রমণের পথ ততই তাঁদের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নদীর পথেও সেই যুদ্ধ চলেছিল। গঙ্গার উপরে নৌকা দিয়ে তৈরী যে পুলটি ছিল, শের খাঁর ফৌজ সেটিকে ধ্বংস করে দিয়ে মোঘল শিবিরের উপরে কামান দাগতে শুরু করেছিল। এরপরে দেখতে দেখতে জালাল ও খাওয়াস খাঁর অশ্বারোহীরা হুমায়ুনের তাঁবুর কাছে পৌঁছে গেলে, তাঁকে বাঁচানোর জন্য তিনশো মোঘল সৈন্য সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ঠিক সেই সময়ে আফগানদের একটি হাতী বাদশাহের তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করবার ফলে সবাই ধরেই নিয়েছিলেন যে তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হোতে চলেছে। কিন্তু হুমায়ুন ছিলেন চেঙ্গিজ-বাবরের বংশধর, তাঁকে খতম করা অত সহজ ছিল না। যতই আফিমের নেশা করুন না কেন, যুদ্ধ তাঁর রক্তে ছিল, তিনি উপযুক্ত অস্ত্র শিক্ষাও পেয়েছিলেন। তাই ওই বিপদে হতবুদ্ধি না হয়ে তিনি তাঁর একজন সৈনিকের হাত থেকে বর্শা কেড়ে নিয়ে সেই হাতীটিকে এমন প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছিলেন যে সেটি আর্তনাদ করতে করতে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তখনকার মত প্রাণে বাঁচলেও হুমায়ুন যে শেষপর্যন্ত আফগান অশ্বারোহীদের স্রোতের নিচে তলিয়ে যাবেন, সে বিষয়ে কারো মনেই কোন সন্দেহ ছিল না। আফগান সৈন্যদের রণহুঙ্কারে সমস্ত মোঘল তাঁবু মুহুর্মুহুঃ কাঁপতে শুরু করেছিল, তাঁদের তরবারির আঘাতে হাজার হাজার মোঘল সৈন্য ধরাশায়ী হয়েছিলেন। চারিদিকে আহত সৈনিকদের আর্তনাদ সতীয়াও হুমায়ুন চীৎকার করে তাঁর সৈন্যদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই কোলাহলের মধ্যে তাঁর গলার স্বর কোথায় যেন তলিয়ে গিয়েছিল। তখন তাঁকে বাঁচানোই মোঘল অফিসারদের একমাত্র ভাবনা হয়ে উঠেছিল। শেষে একজন সৈনিক প্রায় জোর করে তাঁকে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিলে তিনি অদূরে নদীতীরে গিয়ে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। যে অসংখ্য মোঘল সৈন্য সেখানে আগে উপস্থিত হয়েছিল, নদী পার হতে গিয়ে তাঁরা হাজারে হাজারে জলের নিচে তলিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের নায়ক অক্ষত থেকে গিয়েছিলেন। কোথা থেকে ‘নিজাম’ নামের একজন ভিস্তি এসে নিজের মশক তাঁর সামনে রেখে দিলে তিনি সেটাকে ধরে সাঁতার দিয়ে নদীর ওপারে চলে গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রধানা মহিষী ‘মরিয়ম মাকানি’ ও চার হাজার অন্তঃপুরিকা শের খাঁর হাতে বন্দী হয়েছিলেন।
(পরের পর্বে সমাপ্ত)

(তথ্যসূত্র:
১- Gulshan-i-Ibrahimia, Firishta.
২- Tarikh-i-Salatin-i-Afghana, Ahmed Yadgar.
৩- History of Portuguese in Bengal, J. J. A. Campos.
৪- Akbarnama, Abul Fazl Allami.
৫- Makhzan-i-Afghani, Niamatullah, Elliot’s translation.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

অপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাঅপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা

সময়টা ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন দুপুরবেলা, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি কার্গো বিমান। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন (প্রথম পর্ব)ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রধানতঃ তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল, (ক) সশস্ত্র বিপ্লব – চরমপন্থা আন্দোলন, (খ) গান্ধীজীর নেতৃত্বে অহিংস গণ আন্দোলন, এবং (গ) নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর

লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধলাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ

৫ কোটি লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নোটিশ বোর্ড। এই রাস্তায় আর মানুষ যেতে পারবে না। যান চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ। এমনকি মানুষের বাইরে বেরোনোর সময়সীমাও বেঁধে

শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে এক দম্পতি নিজের পুত্র সন্তানের সঙ্গে বড় করেছিলেন এক কন্যা শিম্পাঞ্জীকে! কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে এক দম্পতি নিজের পুত্র সন্তানের সঙ্গে বড় করেছিলেন এক কন্যা শিম্পাঞ্জীকে! কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে সেখানে উল্লেখ করা রয়েছে মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল শিম্পাঞ্জি কিংবা হনুমান। অর্থাৎ বংশানুক্রমে ও কালের পরিবর্তনে এই শিম্পাঞ্জিরাই আস্তে আস্তে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সভ্য