হেস্টিংস সাহেবের হানাবাড়ি - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ হেস্টিংস সাহেবের হানাবাড়ি

হেস্টিংস সাহেবের হানাবাড়ি


রানা চক্রবর্তীঃ কলকাতার আলিপুরের ‘বেলভেডিয়ারের বাড়ির’ সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা। এটি ছিল ‘লাটসাহেবেব পুরনো বাড়ি’, বর্তমানে এখানেই গড়ে উঠেছে আমাদের ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’। এই বাড়িতেই একসময় বসবাস করতেন ‘বহু সুকৃতী ও দুষ্কৃতীর নায়ক’ ‘বাংলার প্রথম গর্ভনর’ ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’। তাঁর আমলেই ‘মহারাজ নন্দকুমার’কে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। শুধু তাই নয় ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের রেশ’ তখনও দেশজুড়ে বহাল ছিল। ১৭৭২ থেকে ১৭৮৫ – এই তেরো বছরের রাজত্বকালে ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’ শুধু আলিপুরের সেই বিলাসগৃহে নয়, তিনি ‘মোট তেরোটি বাড়িতে’ বসবাস করেছিলেন। তাঁর এই গৃহ-প্রীতি নিয়ে সেইসময় বিস্তর আলোচনাও হতো। ‘ডব্লু কে ফার্মিংজারের’ ‘থ্যাকারস ক্যালকাটা ডিরেকটরি’-তে বলা হয়েছে, ‘‘হি হ্যাড এ লুক্রেটিভ ম্যানিয়া ফর হাউস বিল্ডিং অ্যান্ড সেলিং।’’

আরো পড়ুন- ‘রণজিৎ সিং ও বিবি মোরান’ (ঐতিহাসিক প্রেম ১)

‘হেস্টিংস’ মানুষটা ছিলেন ‘চঞ্চল’, ‘ছটফটে’, ‘উচ্ছৃঙ্খল’, ‘প্রবল খামখেয়ালি’ এবং ‘বেপরোয়া প্রকৃতির’। একদিন তাঁর ‘বেলভেডিয়ারের বাড়ির পশ্চিমদিকের বাগানে’ ‘দ্বন্দ্বযুদ্ধ’ বা ‘ডুয়েলে’ মেতে উঠেছিলেন ‘দুই যোদ্ধা’। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ‘তৎকালীন বাংলার দন্ডমুণ্ডের কর্তা বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস’ এবং অপরজন ‘তাঁরই লাটসভার বিশিষ্ট সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস’। এই দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা প্রথম থেকেই মোটেও মধুর ছিল না। সেইসময় ইংরেজদের সঙ্গে ‘মারাঠাদের’ প্রবল ঝগড়া চলছিল। কেউ কেউ মনে করেন ‘মারাঠা যুদ্ধের নীতি’ নিয়েই তাঁদের দু’জনের মধ্যে ‘মন কষাকষি’ শুরু হয়েছিল, যা তাঁদের দু’জনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ‘দ্বন্দ্বযুদ্ধের ময়দানে’। অবশ্য ‘নিন্দুকেরা’ বলতেন – ওসব নীতি-ফীতি ফালতু কথা, দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল ‘এক ফরাসি সুন্দরী, নীলনয়না, শ্বেতাঙ্গিনীকে কেন্দ্র করে’। তাঁর নাম ছিল ‘মাদাম গ্র্যান্ড’। শ্বেতাঙ্গিনী, নীলনয়নাই যে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের মূল কারণ তার কিছুটা আভাস ‘এইচ ই বাস্তিদ’ তাঁর ‘ইকোজ ফ্রম ওল্ড ক্যালকাটা’ বইতে দিয়েছিলেন এভাবে – ‘‘Nearly opposite Alipore Bridge stood two trees. Called ‘The trees of Destruction’, notorious for duels fought under their shade; here Hastings and Francis exchanged shots in the days when European women were few: Jealousy often gave rise to these affairs of honour.’’
১৭৮০ সালের ১৭ই আগস্ট তারিখে, সকাল ছ’টায় ‘হেস্টিংসের সহকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিয়ার্স’ এবং ‘ফ্রান্সিসের বন্ধু কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ওয়াটসনের’ উপস্থিতিতে শুরু হয়েছিল ‘ডুয়েল’। সেই ‘দ্বন্দ্বযুদ্ধে’ ‘ফিলিপ ফ্রান্সিস’ পরাস্ত হয়েছিলেন। বড়লাটের বন্দুক থেকে ছুটে আসা গুলি গিয়ে বিঁধেছিল তাঁর ডানদিকের ঘাড়ে। তিনি লুটিয়ে পড়েছিলেন মাটিতে। ‘ফ্রান্সিস’কে পড়ে যেতে দেখে ‘হেস্টিংস’ সহ সবাই ছুটে এসেছিলেন। ‘হেস্টিংস’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার আঘাত তেমন গুরুতর নয় আপনি আমার বাড়িতে চলুন।’’ ‘ফ্রান্সিস’ ঘৃণাভরে সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। তখন ঠিক হয়েছিল ‘প্রাথমিক শুশ্রূষা’ করে তাঁকে পালকি করে শহরে পাঠানো হবে। সেইমতো ব্যান্ডেজ বেঁধে তাঁকে তোলা হয়েছিল পালকিতে। কিন্তু জোয়ারের কারণে বাহকরা পালকি নিয়ে ‘আদি গঙ্গা’ পার হতে পারেন নি। তাঁরা আবার ফিরে এসেছিলেন ‘বেলভেডিয়ারের বাড়িতে’। এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় দুশো চল্লিশ বছর, ‘আদি গঙ্গা’ দিয়েও প্রবাহিত হয়েছে অনেক জল। ‘লাটসাহেবের বাড়ির নর্থ গেট’টাই নাকি ছিল ওই বাড়ির ‘সদর দেউড়ি’। এখনও বহু মানুষ গভীর রাতে লাইব্রেরির বাড়ির দিক থেকে উত্তরদিকের গেটে আহত, ‘রক্তাক্ত ফিলিপ ফ্রান্সিস’সহ সেই পালকি বাহকদের নাকি এগিয়ে আসতে দেখেতে পান!

একদা ‘পুরানো কলকাতার ভুতুড়ে বাড়ি’ গ্রন্থের লেখক ‘সুভাষ সমাজদার’ সেই ঘটনার এক ‘প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী’ ‘বীরবাহাদুরের’ সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। ‘বীরবাহাদুর’ তাঁকে যা জানিয়েছিলেন সেটা রীতিমতো ‘রোমহর্ষক’। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতটা পর্যন্ত ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। সেদিন ওই দিকের গেট-পাহারার দায়িত্বে ছিলেন ‘বীরবাহাদুর’। হঠাৎই তাঁর কানে ভেসে এসেছিল ‘হিপ্পোলো হুকুম্মা’, ‘হিপ্পোলো হুকুম্মা’ শব্দটি। অচেনা শব্দ শুনে তিনি বেশ চমকে উঠেছিলেন। শব্দটা ক্রমশ আরও কাছে চলে এসেছিল। একসময় ‘বীরবাহাদুর’ দেখেছিলেন, কয়েকজন বাহক একটা পালকি নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। আরও কাছে আসার পর তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, পালকির দরজাটা হাট করে খোলা। আর পালকির ভেতরে লম্বা, ঢ্যাঙা চেহারার এক সাহেব দারুণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাঁর সারা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাঁর বাঁদিকের ঘাড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সেই দৃশ্য দেখে ‘বীরবাহাদুর’ খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। একটু ধাতস্থ হয়ে তিনি পুবদিকের (জেলখানার দিকে) গেটের পাহারাদার ‘জামিল শেখের’ নাম ধরে চিৎকার করতে শুরু করেছিলেন। ওমনি, চোখের পলকে বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল ‘জখমি সাহেবের পালকি’!

ইংরেজরা আমাদের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিয়ে বহুকাল আগেই ভারতছাড়া হয়েছে। কিন্তু আজও ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’-এর অতৃপ্ত আত্মা নাকি নিজের ‘গ্রেভ’ থেকে উঠে চলে আসেন ‘জাজেস কোর্টের পাশের হেস্টিংস হাউসে’! সেই বাড়িতে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি টানা ‘সাতবছর’ কাটিয়েছিলেন। তারপর ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেশে এবং সেখানেই পরিণত বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাহলে কীসের টানে তিনি তাঁর মাতৃভূমির ‘গ্রেভ’ ছেড়ে এতবছর বাদেও ছুটে আসেন তাঁর ছেড়ে যাওয়া আবাসস্থলে? – কারণ, ‘একটা কালো কাঠের বাক্স’! তিনি নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার সময় যে কোনও কারণে ওই বাক্সটি খোয়া গিয়েছিল। বিদেশে ফিরেও তিনি তার সন্ধানে লোক লাগিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি মিঃ নেসবিট টমসন’কে দুঃখ করে একটা চিঠিও লিখেছিলেন – ‘‘তোমরা আমার সেই হারিয়ে-যাওয়া জিনিসগুলো আজও উদ্ধার করতে পারলে না। আমার সেই কালো কাঠের বাক্সের – গোপনীয় কাগজপ্রত্রগুলোর জন্য কী মানসিক যন্ত্রণাতেই যে কাটাচ্ছি।’’ ‘মিঃ টমসন’ চেষ্টা করেছিলেন সেই জিনিসগুলোর হদিশ করতে। ১৭৮৭ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর তিনি ‘ক্যালকাটা গেজেটে’ বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন –
‘‘এতদ্দ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে যে প্রাক্তন বড়লাট বাহাদুর ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলাদেশ হইতে চলিয়া আসার সময় তাঁর চৌরঙ্গীর বাড়ি কিংবা আলিপুরে তাঁর নূতন বাড়ি হইতে একটা কালো কাঠের বাক্স হয় চুরি না হয় ভুলক্রমে নিলামে বিক্রয় হইয়া যায়। যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি এই জিনিসগুলির সন্ধান দিতে পারেন তাহা হইলে তাঁহাকে মিঃ লারকিনস (হেস্টিংসের বন্ধু) এবং মিঃ টমসন দুই হাজার সিক্কা টাকা দিয়া পুরস্কৃত করিবেন।’’
কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। পাওয়া যায়নি ‘হেস্টিংসের সেই কালো বাক্সটি’। তাই তিনি নিজেই নাকি রাত গভীরে ‘চার ঘোড়ায় টানা ব্রুহাম গাড়িতে চেপে’ ‘হেস্টিংস হাউসের বাগান’, ‘দোতলার ঘর’ ও ‘স্নানঘরে’ খুঁজে বেড়ান তাঁর সেই ‘অতি গোপনীয় কালো কাঠের বাক্সটি’। কিন্তু প্রতিরাতেই তাঁকে ফিরতে হয় শূন্য হাতে। কিন্ত তিনিই যে ‘বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস’ তা কী করে জানা গেল? ‘ঐতিহাসিক হেনরি কটন’ এই ব্যাপারে আলোকপাত করে লিখেছিলেন, ‘‘যে প্রেতমূর্তি গভীর নিশীথে আকুল হয়ে কিছু খুঁজে বেড়ান তিনি আর কেউ নন – স্বয়ং বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস।’’ কী ছিল সেই ‘কালো কাঠের বাক্স’টিতে, যার টানে হেস্টিংসকে বারে বারে ফিরে আসতে হয়েছে আমাদের দেশে? সেই বাক্সে ছিল ‘দুটো ছবি এবং হেস্টিংসের ব্যক্তিগত কিছু জরুরি কাগজপত্র ও চিঠি’।
তবে শুধুমাত্র ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’ নন, ‘হেস্টিংস হাউসের’ আনাচে-কানাচে নিত্য রাতে অজস্র অশরীরীর কাণ্ডকারখানায় বহুবার বহু সাহসী মানুষ শিউরে উঠেছেন। আসলে সেই বাড়িটির গায়ে ‘অভিশপ্ত’ তকমাটি অতি সযত্নে লাগিয়েছিলেন স্বয়ং ‘বাংলার প্রথম বড়লাট বাহাদুর ওয়ারেন হেস্টিংস’। সেই বাড়িতেই হেস্টিংসের ‘পরবর্তী প্রজন্মের তিন সদস্য’ ‘অপঘাতে মারা গিয়েছিলেন’। আর এর জন্য এখনও দায়ী করা হয় ‘লাটবাহাদুর ওয়ারেন হেস্টিংস’কেই।

এই কাহিনীর ‘সূত্রপাত’ হয়েছিল ‘হেস্টিংসের বেলভেডিয়ারের বাড়িতে’। অন্যান্য নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি ‘সুন্দরী নারীর প্রতিও হেস্টিংসের দুর্বলতা’ ছিল অপরিসীম। ‘নারী-প্রীতি’ তাঁকে বহুবার বহু সমস্যায় ফেলেছিল। ‘মেরি গ্র্যান্ডের’ পাশাপাশি তিনি একটা সময়ে আর এক নীলনয়না সুন্দরী ‘ব্যারন ইমহফের স্ত্রী মেরিয়ান ইমহফের প্রেমে’ও প্রবল ভাবে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। পরস্ত্রী ‘ইমহফ’কে কাছে পাওয়ার জন্য তিনি ‘ব্যারন’কে বাধ্য করেছিলেন সস্ত্রীক ‘বেলভেডিয়ারে বাড়িতে’ বসবাস করতে। ‘ব্যারন’ খুব ভালোভাবেই জানতেন ‘তাঁর স্ত্রীর প্রতি হেস্টিংসের দুর্বলতার কথা’, কিন্তু তিনি ‘বড়লাটের আদেশ’ কোনওভাবেই ‘অমান্য করার সাহস’ দেখাতে পারেননি। সেই বাড়িতে আসার কয়েকমাস পরেই ‘হেস্টিংস’ ‘ব্যারনকে’ কোম্পানির কাজে ‘মাদ্রাজে’ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, স্বয়ং ‘ব্যারন’ মনের দুঃখে স্ত্রী ‘মেরিয়ান’কে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, বউ হারালে আবার বউ পাওয়া যাবে, কিন্তু বড়লাটের কোপে প্রাণটা গেলে স্থায়ী ঠিকানা হবে ‘গ্রেভইয়ার্ডে’।

‘ব্যারন’ কোথায় গিয়েছিলেন তা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও ‘মেরিয়ান’কে নিজের মতো করে পেতে ‘হেস্টিংসের’ সামনে এরপর আর কোনও বাধা ছিল না। ‘ব্যারন’ উধাও হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই গভীর রাতে ‘বেলভেডিয়ার দোতলার ঘরটি’ ‘হেস্টিংস ও মেরিয়ানের কলহাস্যে’ মুখরিত হয়ে উঠত। ‘সাতটা বছর’ ‘মেরিয়ান ইমহফ’ সেই বাড়িতেই বসবাস করেছিলেন। অবশেষে ১৭৭৭ সালে, ‘হেস্টিংস’ তাঁর নতুন ঘরনি ‘মেরিয়ান ইমহফ’কে নিয়ে উঠে এসেছিলেন ‘হেস্টিংস হাউসে’। বড়লাট মনের মতো করে তাঁর সেই প্রাসাদটিকে সাজিয়েছিলেন। আরণ্যক পরিবেশে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাসাদটির সৌন্দর্যের কথা তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘ওয়ারেন হেস্টিংসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শ্যালক’ ‘মিঃ ম্যাক্রাবি’ তাঁর এক বন্ধুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন – ‘‘জ্যোৎস্নাভরা চাঁদনি রাতে সাদা ধবধবে এই বাড়িটির আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য রীতিমত চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।’’ ‘১৭৭৭ থেকে ১৭৮৪’ – ‘হেস্টিংস হাউসে’ মোট সাত বছর ‘সস্ত্রীক বড়লাট’ বসবাস করেছিলেন। ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ‘মিসেস হেস্টিংস’ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন এবং পরের বছর দেশে ফিরে গিয়েছিলেন ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’।

আর তার কয়েক বছর পর থেকেই শুরু হয়েছিল যত কিছু সমস্যা। ‘হেস্টিংস হাউস’ হয়ে উঠেছিল ‘জমজমাট ভূতের আড্ডাখানা’। কিন্তু কেন? তার পিছনে রয়েছে ‘একটা করুণ ইতিহাস’, ‘এক অতৃপ্ত আত্মার প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনী’।
‘হেস্টিংস’ দেশে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর সেই বিশাল সম্পত্তি অর্থাৎ ‘হেস্টিংস হাউস’ দান করে দিয়েছিলেন ‘তাঁর স্ত্রী’ ‘মেরিয়ান ইমহফের প্রথম পক্ষের পুত্র’ (ব্যারন ইমহফের ঔরসজাত) ‘জুলিয়াস ইমহফ’কে। ‘হেস্টিংস’ স্বদেশে ফিরে যাওয়ার তিনবছর বাদে ১৭৮৮ সালে ‘জুলিয়াস’ ‘রাইটারের চাকরি’ নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। ১৭৯২ সালে তিনি ‘রাইটার’ থেকে ‘মুর্শিদাবাদের কালেক্টর’ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ‘জুলিয়াস ইমহফ’ ‘প্রোমোশন’ পেয়ে ‘মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট’ হিসাবেও কাজ করেছিলেন। ‘জুলিয়াস’, ‘তাঁর স্ত্রী’ ও ‘তিন সন্তান’ – ‘উইলিয়ম’, ‘চার্লস’ এবং ‘জন’কে নিয়ে ‘হেস্টিংস হাউসে’ই বসবাস করতেন। সেই বাড়িতেই তাঁর ‘তিন পুত্র’ অপঘাতে মারা গিয়েছিলেন।

‘বড় ছেলে উইলিয়মের’ বয়স তখন দশ বছর। চমৎকার মায়াবী এক আলোমাখা বিকেলে সে ‘হেস্টিংস হাউসের কম্পাউন্ডে’ খেলছিল। হঠাৎই শুরু হয়েছিল প্রবল ঝড়। ধুলোয় ঢেকে গিয়েছিল চর্তুদিক। সেইসময় ‘উইলিয়ম’ নাকি দেখতে পেয়েছিল ‘দীর্ঘদেহী এক মানুষকে’। সেই ‘ছায়া মূর্তির তীব্র ঘৃণাভরা চাউনিতে’ শিউরে উঠেছিল দশ বছরের ‘উইলিয়াম’। প্রবল ভয় পেয়ে সে ছুটতে শুরু করেছিল। কোনওক্রমে ঘরে ঢুকে সে লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। সেদিন রাতেই ‘উইলিয়াম’ প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। এরপর সে বেঁচেছিল মাত্র তিনদিন। এই মৃত্যুর কিছুদিন বাদেই ওই একই ‘কম্পাউন্ডে’ ‘উইলিয়মের পরের ভাই চার্লস’কে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন এক মহিলা। তিনি ছিলেন ‘চার্লসের আয়া’। ‘চার্লস’ও আর ঘরে ফিরতে পারেনি। ‘হেস্টিংস হাউসের পাতকুয়োতে’ কোনওভাবে পড়ে গিয়ে সেদিন তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ‘আয়া’ সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে ‘চার্লস’ কুয়োতে পড়েছিল সে রহস্যের উন্মোচন আজও হয়নি। ‘জুলিয়াসের ছোটপুত্র জন’ অবশ্য কিছুদিন পৃথিবীতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। বেশ বড় হওয়ার পর ‘কোনও গুপ্ত আততায়ীর হাতে’ তাঁর প্রাণ গিয়েছিল।

‘তিন পুত্রকে’ অকালে হারিয়ে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন ‘জুলিয়াস’। তিনি তাঁর ‘সৎ পিতা ওয়ারেন হেস্টিংস’কে পরবর্তীকালে একটি করুণ চিঠি লিখেছিলেন – ‘‘In the grounds between Hasting’s House and the Judge’s court my three children William, Charles and John lie buried …’’
‘উইলিয়ম’ যে ‘দীর্ঘদেহী ছায়ামূর্তি’কে দেখে ভয় পেয়ে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তাঁর পরিচয় পরবর্তীকালে কিছুটা হলেও জানা গিয়েছে। ‘হেস্টিংসের অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবও’ সেই ‘ছায়ামূর্তি’কে গভীর রাতে ‘জাজেস কোর্টের প্রাচীরের কাছে’ যাঁরা ঘোরাফেরা করতে দেখেছিলেন, তাঁরা বলতেন, তিনি আর অন্য কেউ নন, ‘মেরিয়ান ইমহফের প্রথম পক্ষের স্বামী ব্যারন ইমহফ’। অনেকেই মনে করতেন ‘মেরিয়ান’কে কাছে পাবার জন্য অতি সুকৌশলে ‘ব্যারন’কে এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিয়েছিলেন ‘হেস্টিংস’। তাই পরপার থেকে ‘হেস্টিংস ও মেরিয়ানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য’ ‘অশরীরী ব্যারন’ মাঝে মাঝেই ছুটে আসতেন ‘হেস্টিংস হাউসে’!
এখন সেই হেস্টিংস হাউসেই গড়ে উঠেছে ‘টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’। যখন সেখানে ‘হস্টেল’ ছিল, তখন ‘সেখানকার আবাসিকরাও’ মাঝেমাঝেই নিশি রাতে নাকি ‘ঘোড়ার খুরের খট, খট শব্দ’ শুনতে পেতেন। শুধু তাই নয় মাঝরাতে ওই বাড়ির ‘হলঘরে’ ‘দীর্ঘদেহী এক ছায়ামূর্তিকে’ নাকি ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন অনেকেই!
‘পুরনো কলকাতার ইতিহাস’ ও ‘সরকারি নথিপত্রে’ এই ‘হেস্টিংস হাউসের কুখ্যাতির কথা’ লিপিবদ্ধ আছে। সেখানে বলা হয়েছে – ‘‘For calcutta tradition connects the ‘House’ with a famous ghost.’’

(তথ্যসূত্র:
১- পুরানো কলকাতার ভুতুড়ে বাড়ি, সুভাষ সমাজদার।
২- ছায়া আছে কায়া নেই: অন্যজগতের অতিথিদের অব্যক্ত কথা, অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়, পত্র ভারতী।
৩- প্ল্যানচেট, সুশীল কুমার সিনহা।
৪- Echoes from Old Calcutta: Being Chiefly Reminiscences of the Days of Warren Hastings, Francis and Impey, Henry Elmsley Busteed, Forgotten Books (২০১৮)।
৫- Indian & Home Memories by Sir Henry Cotton, Sir Henry Cotton, Wentworth Press (২০১৬)।
৬- India’s Most Haunted: Tales of Terrifying Places, K. Hari Kumar, HarperCollins India (২০১৯)।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯০১ সালে গান্ধীজী বেলুড় মঠে স্বামীজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তবে সেবারে শ্রান্ত-ক্লান্ত গান্ধীজীর সঙ্গে বিবেকানন্দের দেখা হয় নি। কারণ, স্বামীজী তখন অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু

ভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ

স্পাই গেম কথাটা বলা যতো সহজ বাস্তবে গুপ্তচর সংস্থার কাজ অনেক কঠিন। কোন দেশের এজেন্ট কোন সংস্থার হয়ে কাজ করছে তা বলা কঠিন। ইনটেলিজেন্স দুনিয়ায় অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট সংস্থার

বই নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে নিনবই নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে নিন

আসুন বই নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে নেই ————————————————————— ১.হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে ৪ খানা বই আছে যা মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা। ২.মাথা পিছু বই পাঠের দিকে শীর্ষে হলো আইসল্যান্ড।

চীনকে চাপে রাখতে আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে মঙ্গোলিয়া ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছেচীনকে চাপে রাখতে আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে মঙ্গোলিয়া ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে

আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে মঙ্গোলিয়া ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে। ভারতের কাছে স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন মঙ্গোলিয়া। পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত মঙ্গোলিয়ার সাথে পৃথিবীর দুটি অন্যতম শক্তিশালী দেশ রাশিয়া ও