বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব) - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)


রানা চক্রবর্তীঃ মধ্যযুগের বাংলার ভূস্বামীদের মধ্যে আরেকজন পরাক্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন বর্তমান বরিশাল জেলার বাকলা চন্দ্রদ্বীপের অধিপতি ‘রামচন্দ্র বসু’। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তিনি সোনারগাঁর শেষ অধীশ্বর ‘দনুজমাধবদেবের’ বংশধর ও গৌড়ের সেনরাজাদের দৌহিত্র বংশীয় ছিলেন। তাঁর পিতামহ ‘পরমানন্দের’ সঙ্গে পর্তুগীজদের সৌহার্দ স্থাপিত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে চট্টগ্রাম ও হুগলীতে কুঠী স্থাপনের পর থেকে পর্তুগীজরা দেখতে পেয়েছিলেন যে, প্রথমোক্ত বন্দরের উপরে একদিক থেকে মুর ও অন্যদিক থেকে মগদের আক্রমণের ফলে তাঁদের পক্ষে শান্তিতে ব্যবসা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তখন পূর্বাঞ্চলে বিকল্প একটি বন্দরের অন্বেষণ করতে গিয়ে তাঁদের দৃষ্টি পড়ে বাকলার উপরে পড়েছিল। সেটি একেবারে নগণ্য স্থান হলেও উন্নয়নের সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে দেখে তাঁরা রাজা পরমানন্দকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ঠিকমত সুযোগ সুবিধা পেলে বাকলাকে তাঁরা দ্বিতীয় চট্টগ্রামে পরিণত করবেন। তাঁদের কথায় আস্থা জ্ঞাপন করে চন্দ্রদ্বীপরাজ নিজের এক কর্মচারীকে গোয়ার পর্তুগীজ ভাইসরয় ‘কনষ্ট্যান্টিনো ডি ব্রাগাঞ্জা’র কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মারফৎ আলাপ আলোচনার পরে ১৫৫৯ খৃষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল তারিখে পারস্পরিক সামরিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উভয় পক্ষে মধ্যে যে চুক্তিনামা সম্পাদিত হয়েছিল, সেটির শর্তানুসারে রাজ৷ পরমানন্দ পূর্বে বাকলা থেকে পশ্চিমে চট্টগ্রাম পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে পর্তুগীজদের অবাধ বাণিজ্য করবার অধিকার প্রদান করেছিলেন। প্রতিদানে তাঁরা তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, পর্তুগীজরা চট্টগ্রামে কোন বাণিজ্য জাহাজ প্রেরণে বিরত থাকবেন ও চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের চারটি জাহাজকে গোয়া, অম্বুর্জ ও মালাক্কায় গিয়ে বাণিজ্য করবার লাইসেন্স দেবেন। এছাড়া আরও একটি শর্ত ছিল যে, চন্দ্রদ্বীপরাজ পর্তুগীজদের কোন শত্রুর সঙ্গে কোন ধরণের সন্ধিতে আবদ্ধ হবেন না এবং পর্তুগীজরা তাঁকে যে সামরিক সাহায্য দেবেন, সেজন্য তাঁরা পর্তুগীজদের নির্দিষ্ট পরিমাণে পণ্যদ্রব্য প্রদান করবেন। উক্ত সন্ধির সর্তগুলি চন্দ্রদ্বীপরাজের পক্ষে আদৌ সম্মানজনক না হলেও চারিদিকে শত্রুবেষ্ঠিত হয়ে বাস করবার ফলে তাতে সম্মতি দেওয়া ছাড়া তাঁর অন্য কোন উপায় ছিল না। গৌড় সে সময়ে কররানিদের শাসনাধীন ছিল। তাঁদের সঙ্গে পরমানন্দ বা তাঁর পুত্র ‘জগদানন্দের’ সম্পর্ক যে কি ধরণের ছিল সেটা ইতিহাস থেকে জানা না গেলেও, মোঘলদের আক্রমণে দাউদ কররানি বিব্রত হয়ে পড়বার পরে জগদানন্দের পুত্র ‘কন্দর্পনারায়ণ’ কিন্তু তাঁকে কোন ধরণের সাহায্য করেন নি। সে সুযোগও অবশ্য তাঁর হয় নি। পরে দাউদ বিজয়ী মোঘল সেনাপতি খান-ই-খানান মুনাইম খাঁ জগদানন্দের বশ্যতা দাবী করে ‘সুবাদ খাঁ’কে এক ব্যাটালিয়ান সৈন্যসহ চন্দ্রদ্বীপে পাঠালে তিনি বিনা দ্বিধায় মোঘলদের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। আর যে পর্তুগীজদের সঙ্গে তাঁর পিতা সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন সেই বিপদের দিনে তাঁদের মুখও দেখতে পাওয়া যায় নি। ওই ঘটনার পরে জগদানন্দ তাঁর সদর কচুয়া থেকে মাধবপাশা গ্রামে স্থানান্তরিত করেছিলেন। এর কিছু দিন পরে তাঁর মৃত্যু হলে অষ্টমবর্ষীয় পুত্র ‘রামচন্দ্র’ চন্দ্রদ্বীপের অধীশ্বর হয়েছিলেন। পর্তুগীজ মিশনারি ‘মালিফায়ার ফোনেস্কা’ সেই বালক নরপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর রাজ্যের সর্বত্র গির্জা নির্মাণ ও প্যাগানদের খৃষ্টান করবার অধিকার আদায় করেছিলেন। উভয়পক্ষের মধ্যে সেই নতুন মৈত্রী স্থাপনের সংবাদ আরাকানে পৌঁছানোর পরে সেখানকার অধীশ্বর বাকলা বন্দর আক্রমণের আয়োজন করেছিলেন। তাঁদের সেই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পর্তুগীজ এ্যাডমিরাল ‘গঞ্জালেশ’ সন্দ্বীপ অধিকার করে সেখানে নিজেদের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য রাজা রামচন্দ্রের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি দু’শো অশ্বারোহী ও কয়েক শত বরকন্দাজ এই শর্তে পাঠিয়েছিলেন যে, পর্তুগীজ অধিকৃত সন্দ্বীপের রাজস্ব তাঁদের উভয়ের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হবে। কিন্তু কাজের সময়ে দেখা গিয়েছিল যে, চুক্তির প্রতিশ্রুতি রক্ষা তো দূরের কথা, গঞ্জালেশ চন্দ্রদ্বীপ থেকে দক্ষিণ সাহাবাজপুর ও পাপেলভাঙা নামক দুইটি মৌজা অধিকার করে নিয়েছিলেন। সেই বালক রাজার হাত থেকে চন্দ্রদ্বীপ অধিকার করবার জন্য তাঁর শ্বশুর প্রতাপাদিত্য যে ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তা বাংলার ইতিহাসে আজও বহুল চর্চিত।

মধ্যযুগের বাংলার হিন্দু ভূস্বামীদের মধ্যে বিষ্ণুপুরের বীর হাম্বীর ও বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের রামচন্দ্র বসু প্রাচীন বংশসম্ভূত হলেও যশোহর-ধুমঘাটের ‘প্রতাপাদিত্য’ তখন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন। মূলে সপ্তগ্রামবাসী সেই পরিবারের ইতিহাস কররানিদের উত্থান পতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। প্রতাপাদিত্যের পিতামহ ‘রামচন্দ্র গুহ’ গৌড়েশ্বর সুলেমান কররানির কানুনগো দফতরে মুহুরির কাজ করতেন। তাঁর দুই পুত্র ‘শ্রীহরি’ ও ‘জানকীবল্লভ’ পিতার সুপারিশে একই দফতরে উচ্চ-স্তরের অফিসারের কাজ পেয়ে সপ্তগ্রাম থেকে গৌড় নগরীতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে সুলেমানের পুত্র দাউদের সঙ্গে শ্রীহরির পরিচয় হয়েছিল ও তাঁর অনুগ্রহে তিনি চাকরিতে বহু সুবিধা লাভ করেছিলেন। পরে দাউদ মসনদে আরোহণ করে যখন মোঘলদের প্রভুত্ব অস্বীকার করেছিলেন তখন তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনি যে মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবাৰ্য্য। আর সেই যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে তিনি রাজকোষের বহু অর্থ শ্রীহরির হাতে সমর্পণ করে সেগুলিকে নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য সুন্দরবনের কোন দুর্গম জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এর কিছু দিন পরে দাউদ যখন বিনাযুদ্ধে বিহার ও গৌড় আফগানদের হাতে তুলে দিয়ে উড়িষ্যার দিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তখন শ্রীহরি সেই অর্থ আত্মসাৎ করে নিজের নামে সুন্দরবনে একটি জমিদারীর পত্তন করেছিলেন। তখন আফগানরা বাংলা থেকে বিদায় নিলেও মোঘলরাও বাংলায় আসেন নি। উভয় পক্ষে তখন মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আরাকানের মগরা এসে তখন প্রায়ই বাংলায় লুটতরাজ চালাচ্ছিল। দক্ষিণাঞ্চলের সর্বত্র পর্তুগীজরা সুযোগ পেলেই তখন দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছিলেন। ওই সময়ে বাংলার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা তো দূরের কথা, নিজের সৈন্যবাহিনীও পুরাপুরি আকবরের অনুগত ছিল না। বাংলার সর্বত্রই তখন বিশৃঙ্খলা আর বিদ্রোহ চলছিল। ওই অবস্থায় শ্রীহরিকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামান নি, কেউ তাঁর কাছে এসে হিসাবও চান নি। ফলে জমিদারী থেকে তাঁর যা আদায় হচ্ছিল, সেটার সবটাই তাঁর লাভ ছিল। কখনো ওই লাভের টাকা দিয়ে, আবার কখনও বা লাঠির জোরে তিনি নিজের জমিদারী বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এরপরে ওই ভাবে বাড়তে বাড়তে সেই জমিদারী একটা সময়ে আর জমিদারী থাকেননি, সেটি একটি ছোটখাট রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। শ্রীহরি তখন সপ্তগ্রাম থেকে নিজের পরিবারবর্গকে নিয়ে এসে ইছামতী তীরে ধুমঘাট গ্রামে বসবাস শুরু করেছিলেন। সেখানেই তাঁর সদর দফতর স্থাপিত হয়েছিল। কোন যুদ্ধ জয় করে নিজের রাজ্য স্থাপন না করলেও তিনি নিজেকে দিগ্বিজয়ী বীর বলেই ভাবতেন। তাই দিগ্বিজয়ীদের চিরন্তন রীতি অনুযায়ী তিনি নিজেই নিজেকে ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তাঁর রাজভ্রাতাও আর জানকীবল্লভ নামে থাকতে পারেন নি, তাঁর নতুন নাম হয়েছিল ‘রাজা বসন্তরায়’। আকবর সেসব ব্যাপারের কিছু খোঁজ রাখতেন না। পরে তাঁর নির্দেশে ‘রাজা টোডরমল’ যখন বিভিন্ন সুবার রাজস্ব তালিকা তৈরী করেছিলেন, তখন তাঁর কাছে খবর গিয়েছিল যে, কররানি রাজ্যের জমিজমার যা কিছু হিসাব তা তাঁদের কানুনগো শ্রীহরি ও তাঁর ভ্রাতা জানকীবল্লভের কাছে রয়েছে। তাই টোডরমল তাঁদের উভয়কেই আগ্রায় আহ্বান করে তাঁদের দেওয়া বিবরণের ভিত্তির উপরে বাংলার রাজস্ব তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। তারপরে তিনি যখন দেখতে পেয়েছিলেন যে, সেই উভয় ভাই-ই বেশ করিতকর্মা ব্যক্তি, তখন তাঁদের উভয়কেই তিনি বাদশাহী দফতরে উচ্চপদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই উচ্চ পদ নিশ্চই তাঁদের নতুন রাজ্যের তুলনায় বড় ছিল না। তাই টোডরমলের সেই আহ্বান তাঁরা ধন্যবাদের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে ধুমঘাটে ফিরে এসেছিলেন। ওই ঘটনার কিছু দিন পরে শ্রীহরি পরলোক গমন করলে তাঁর দেওয়া বণ্টননামা অনুযায়ী জমিদারীর দশ আনা পেয়েছিলেন তাঁর পুত্র প্রতাপাদিত্য, ও ছয় আনা পেয়েছিলেন তাঁর ভাই বসন্ত রায়। কিন্তু পিতার বণ্টননামাটি দেখে প্রতাপ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, কোনও জমিদারী শরিকদের মধ্যে অবশ্যই বণ্টিত হোতে পারে, কিন্তু তাঁর পিতা যখন বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন তখন তাঁর রাজ্য কেমন করে ভাগ হয়? এরপরেই প্রতাপ তুমুল কাণ্ড শুরু করেছিলেন। তাঁর উচ্চাকাঙ্খা ছিল গগনস্পর্শী, তার মধ্যে তুর্কী-আফগানদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে তিনি তাঁদের রীতিনীতিতে বেশ ভালভাবেই রপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাই তাঁদেরই পদ্ধতিতে নিজের পথের কাঁটা দূর করবার জন্য একদিন তিনি সুযোগ বুঝে পিতৃব্য বসন্তরায় ও তাঁর দুই পুত্রকে হত্যা এবং বাকি সাত পুত্রকে কারারুদ্ধ করে সমস্ত জমিদারী আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। কেবলমাত্র দুগ্ধপোষ্য শিশু ‘রাঘবরায়’কে জনৈকা পরিচারিকা একটি কচু বনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে তিনি রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন। পরে একসময়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করলে তাঁর নাম হয়েছিল ‘কচুরায়’। ওই ভাবে স্ববংশীয়দেরকে নিধন করবার পরে প্রতাপাদিত্য বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের উপরে নিজের লুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন। সেই রাজ্যের তরুণ অধীশ্বর রামচন্দ্র বসুর সঙ্গে তিনি নিজের কন্যা ‘বিন্দুমতি’র বিবাহ ঠিক করে এক শুভ দিনে যথারীতি তাঁকে ধূমঘাটে আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রথামত বরযাত্রীদের নিয়ে বর রামচন্দ্র সেখানে এলে মহা ধূমধামের সঙ্গে গোধূলি লগ্নে সেই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। তারপরে, “উৎসব শেষে সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলে মধ্যরাত্রে সদ্য বিবাহিতা বিন্দুমতি বাসরঘরে প্রবেশ করে স্বামীকে বললেন – ‘পালাও! এখনই পালাও! আর কিছুক্ষণ পরে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন পিতার ঘাতকরা এসে ওই পাশের দরজা দিয়ে এই ঘরে ঢুকে তোমাকে হত্যা করবে। আমার চক্ষের সম্মুখে তোমার জীবনদীপ নিভে যাবে। সে দৃশ্য আমি সইতে পারব না। তুমি পালাও! দেখছ না, ওই দরজায় কোন অর্গল নেই। এই পথ দিয়ে এখনই তাঁরা ঘরের ভিতর চলে আসবে। শুনছ না তাঁদের পায়ের শব্দ? ঘরে এসে তাঁরা আঘাতে তোমার দেহ দ্বিখণ্ডিত করবে। তুমি পালাও! ওগো পালাও!’ বলতে বলতে সদ্য বিবাহিতা বিন্দুমতি মূর্ছিতা হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে এলে রামচন্দ্র বললেন – ‘আর তুমি? আমি পালালে তাঁরা কি তোমাকে ছেড়ে দেবে? মরতে হয় সেও ভাল, কিন্তু যতক্ষণ জীবন থাকবে ততক্ষণ কাউকে তোমার কেশ স্পর্শ করতে দেব না।’ … ‘না, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।’ … ‘ওগো আমার প্রাণের দেবতা, আমার জন্য একটুও ভেবো না। তুমি বাঁচলে তবে আমি বাঁচবো। তুমি গেলে, আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো? তুমি এখনই পালাও। আমি নিজের পথ নিজে তৈরী করে রেখেছি। আমাকে বাঁচাবার জন্যই তুমি পালাও। ওই ওদিকে খিডকি দরজা। সেখান দিয়ে বেরিয়ে বাগান পার হয়ে সদর রাস্তা পশ্চিমে রেখে সোজা নদীতীরে চলে যাও। এখনই যাও, এক মূহুর্তও দেরী কোরো না।’ রামচন্দ্র চলে গেলেন। ঘাটে ছিপ বাঁধা ছিল, তাতে উঠে কিছু দূর যাওয়ার পরে তিনি শোনেন নারীকণ্ঠের আহ্বান – ‘ছিপ থামাও! মাঝি, সামনের ঘাটে নৌকা ভেড়াও।’ অন্য পথ ধরে বিবাহ সাজে সজ্জিত৷ বিন্দুমতি সেখানে এসে স্বামীর সঙ্গে মিলিতা হোলেন। সেই নৌকার মধ্যে রচিত হোল তাঁদের বাসর সজ্জা।” ওদিকে ১৫৯৩ খৃষ্টাব্দে উড়িষ্যায় আফগান বিদ্ৰোহ তখনকার মত দমিত হলে মান সিংহ যখন বাংলার বিদ্রোহী ভূঁইয়াদের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন, তখন তাঁদের মধ্যে সব চেয়ে শক্তিমান ঈশা খাঁ তাঁর প্রধান লক্ষ্য হলেও অন্যদের তিনি উপেক্ষা করতে পারেন নি। রাজমহল থেকে যাত্রা করে কৃষ্ণনগরের পথ ধরে তিনি ধুমঘাটের কাছাকাছি এলে প্রতাপাদিত্য নামমাত্র প্রতিরোধের পরে তাঁর কাছে আত্মসমপর্ণ করেছিলেন। কচুরায় তখন সাবালক হয়ে বাদশাহী ফৌজের সঙ্গে এসেছিলেন। মান সিংহ তাঁকে শ্রীহরির বণ্টননামা অনুযায়ী ছয় আনা জমিদারী প্রদান করে ‘যশোরজিৎ’ উপাধি দিয়েছিলেন। বাকি দশ আনা প্রতাপাদিত্যকে এই শর্তে দেওয়া হয়েছিল যে, আজীবন তিনি মোঘলদের অনুগত থাকবেন ও প্রয়োজনের সময়ে তাঁদের সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন। কয়েকটি মহাদোষ সত্বেও প্রতাপাদিত্য যে একজন শক্তিশালী ভূস্বামী ছিলেন সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। বহু অলঙ্ঘনীয় বাধা অতিক্রম করে তিনি তাঁর পিতার জমিদারীকে একটি ছোটখাট রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। তাঁর সামরিক বল কিছুমাত্র নগণ্য ছিল না। পর্তুগীজ অফিসারদের নিয়োগ করে তিনি নিজের সৈন্য ও নৌবাহিনীকে আধুনিক রণনীতিতে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। নিজের শক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাঁর কোন ভ্রান্ত ধারণাও ছিল না। তাই মোঘলদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতার দুরাকাঙ্খা তিনি করেন নি। শান্তিতে নিজের জমিদারী বজায় রাখতে পারলে তিনি সুখী হতেন। কিন্তু সেটাও তাঁর অদৃষ্টে ঘটেনি। জবরদস্ত মোঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে মশা মারতে কামান দেগে বসেছিলেন। সে যুগের আর কোন জমিদার যা করেন নি প্রতাপাদিত্য তাই করেছিলেন। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতেন। নিজের রাজ্যের সর্বত্র তিনি বহু চতুষ্পাঠী ও টোল স্থাপন করিয়েছিলেন। দাক্ষিণাত্য থেকে কয়েকজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে নিয়ে এসে তিনি নিজের রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে বর্তমান ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁরাই ছিলেন বঙ্গদেশে দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণদের আদিপুরুষ।

আরো পড়ুন- বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব)

বিদ্রোহী ভূস্বামী তখন আরও ছিলেন। তাঁদের বিরোধীতার জন্যই আকবরের সুদীর্ঘ রাজত্বকালে বাংলায় মোঘল আধিপত্য স্থিতিলাভ করতে পারে নি। ‘বাহারিস্তান-ই-গৈবি’ থেকে জানা যায় যে, জাহাঙ্গীরের রাজত্বের গোড়ার দিকে ‘শামস খাঁ’ মানভূম জেলায়, এবং ‘সেলিম খাঁ’ হিজলিতে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করতেন। মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনার জমিদার চন্দ্রভানু ও বড়দা-ঝাকরার জমিদারেরা তখনও মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেন নি; সুবাদার দরবারে হাজির হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ গেলে তাঁরা সেটা সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বরেন্দ্রভূমিতে ‘পুঠিয়া’ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘পীতাম্বর’ মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেও প্রায় সব বিষয়ে একজন স্বাধীন নরপতির মতই আচরণ করতেন। পাটনা জেলায় মাসুম খাঁ কাবুলির পুত্র ‘মীর্জা মুনিমের’ জমিদারিতে বাদশাহর নামে খুৎবা পাঠ করা হলেও, ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খাঁ যখন মোঘলদের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন তখন মীর্জা মুনিম বিনা দ্বিধায় তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। আধুনিক ফরিদপুর জেলায় ফতাবাদের জমিদার ‘মজলিশ কুতুব’ও মুসা খাঁর সঙ্গে মোঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। আবার ওই একই সময়ে মোঘলদের অনুগত ভূস্বামীও বাংলায় কম ছিলেন না। পাটনা জেলার সাহাজাদপুরের জমিদার ‘রাজা রায়’ মোঘলদেরকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। কেদার রায়ের পতনের পরে মধু রায় (মতান্তরে মুকুন্দ রায়) নামক যে ব্যক্তিকে মান সিংহ ভূষণার জমিদারী প্রদান করেছিলেন, তিনি ও তাঁর পুত্র ‘সত্রজিৎ’ বাংলায় মোঘলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিশিষ্ট ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কামরূপ ও আসাম যুদ্ধে সত্রজিৎ মোঘলদের ডান হাত ছিলেন। সুসং-এর জমিদার ‘রঘুনাথ’ও ওই সব যুদ্ধে মোঘলদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। রাজা মান সিংহ প্রথম বাংলায় এসে দেখেছিলেন যে ভূঁইয়া রাজগণের প্রতাপ দুৰ্দ্দমনীয়। তাঁর মত প্রতিভাবান সেনানায়কের পক্ষে তাঁদের সবাইকে উচ্ছেদ করা হয় তো শক্ত হত না, কিন্তু মোঘল সাম্রাজ্যের সংহতি তখন বহু দূর বলে তিনি আর শত্রু না বাড়িয়ে বারো ভূঁইয়াদের নির্বিষ সর্পে পরিণত করে তবেই বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

(তথ্যসূত্র:
১- Tabakat-i-Akbari, Nazimuddin Ahmed.
২- Akbarnama iii, Abul Fazl Allami.
৩- Tarikh-i-Sher Shahi, Abbas Sarwani, Elliot’s translation.
৪- Tarikh-i-Salatin-i-Afghann, Ahmed Yadgar.
৫- Makhzan-i- Afghani, Niamatullah, Elliot’s translation.
৬- Riyaz-us-Salatin, Ghulam Husain Salim.
৭- Baharistan-i-Gaibi, Mirza Nathan.
৮- গৌড়ের ইতিহাস, রজতকান্ত চক্রবর্তী।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

চীন, ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাথে নিজেদের মুদ্রাতে ব্যবসা করছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকী পূর্ব বনাম পশ্চিম! কোন পথে বিশ্ব রাজনীতি?চীন, ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাথে নিজেদের মুদ্রাতে ব্যবসা করছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকী পূর্ব বনাম পশ্চিম! কোন পথে বিশ্ব রাজনীতি?

১৫৫৫ সালে অর্থাৎ প্রায় চারশো বছর আগে ফ্রান্সের বিখ্যাত জ্যোতিষী নস্ত্রাদ্রামুস এমন কিছু ভবিষ্যত বানী করেছিলেন যা আজও মানুষকে অবাক করে দেয়। ওনার প্রায় অধিকাংশ ভবিষ্যত বানীই সত্য হয়েছিল যার

দ্য হিস্ট্রি অফ ইসরায়েলে জামাই বলে উল্লেখ! মোসাদের এক দুর্ধর্ষ মিশরীয় এজেন্ট এঞ্জেলদ্য হিস্ট্রি অফ ইসরায়েলে জামাই বলে উল্লেখ! মোসাদের এক দুর্ধর্ষ মিশরীয় এজেন্ট এঞ্জেল

সময়টা ১৯৭৩ এর ৫ অক্টোবর, রাত একটার সময় কায়রো থেকে ইসরায়েলে তেল আভিবে মোসাদের হেড অফিসে ফোন আসে একটি। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যাক্তিটি নিজেকে এঞ্জেল হিসাবে পরিচয় দেয়, যা ব্যাক্তিটির

অপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাঅপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা

সময়টা ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন দুপুরবেলা, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি কার্গো বিমান। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন, (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯০১ সালে গান্ধীজী বেলুড় মঠে স্বামীজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তবে সেবারে শ্রান্ত-ক্লান্ত গান্ধীজীর সঙ্গে বিবেকানন্দের দেখা হয় নি। কারণ, স্বামীজী তখন অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু