রানা চক্রবর্তীঃ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের প্রায় অর্দ্ধ শতাব্দী আগে ‘মালাধর বসু’ যখন তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনা করেছিলেন, তখন ‘কবীরের দোহা’ উত্তরাপথের অসংখ্য নরনারীর মনে এক নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছিল। মুসলমান পিতামাতার সন্তান ‘কবীর’ সেই সময়ের বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধক ‘রামানন্দের’ কাছে দীক্ষা নিয়ে প্রচার করেছিলেন যে, রাম ও রহিমের মধ্যে কোন ভেদ নেই – সবই সেই নারায়ণের বিভিন্ন রূপ। তিনি বলেছিলেন, “বন্ধু, বেঁচে থাকতে থাকতে তাঁকে পাওয়ার আশা করো, তাঁকে বুঝে নাও, কারণ জীবনের মধ্যেই মুক্তির নিবাস। জীবিত থাকতে যদি কর্মের ফাঁস না কাটে তবে মৃত্যুর পরে মুক্তির আশা কোথায়? দেহ ত্যাগ হলে তাঁর সঙ্গে মিলন ঘটবে – এই ধরণের কোন আশা করা বৃথা। যদি এখন মিলে থাকে তবেই তখন মিলবে, নতুবা যমপুরে তোমার বাস হবে। তাই কবীর বলে, সদগুরুকে জানো, সত্যনামে বিশ্বাস করো। আমি সাধনের দাস, সাধনই হিতকারী।”
“সাধো ভাই জীবতহী করো আসা ৷
জীবত সমঝে জীবত বুঝে জীবত মুক্তি নিবাসা।
জীবত করমকী ফাঁস ন কটি মুক্তি কী আসা॥
অ ছুটেজিব মিলন কহত হৈ সো সব ঝুটি আসা।
অবহুঁ মিলা সো তবহু মিলেগা নাহি তো যমপুর বাসা।
সওগহে সতগুরুকো চিন্ হে সত্ত্ব নাম বিশ্বাসা।
কহৈ কবীর সাধন হিতকারী হম সাধনকে দাসা॥”
কবীরের পরে এসেছিলেন ‘মীরা’। তিনি ছিলেন মেবারের রাজমহিষী, মহারাণা কুম্ভের স্ত্রী ‘মীরাবাঈ’। তাঁরা স্বামী স্ত্রী উভয়েই বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু তাঁদের উভয়ের বৈষ্ণবমতের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। রাণা একদিকে ‘গীতগোবিন্দের’ ভাষ্য রচনা করে বৈষ্ণবমতকে যেমন নতুন রূপ দিয়েছিলেন, তেমনি আবার অন্যদিকে প্রবল যুদ্ধে তুর্কীদের পরাভূত করে গুজরাট ও মালব পুনরুদ্ধার করেছিলেন। রাণার বিষ্ণু ছিলেন সুদর্শনচক্রধারী মুরারী, কিন্তু রাণীর বিষ্ণু ছিলেন সব হিংসাদ্বন্দ্বের উর্দ্ধে অবস্থিত গিরিধারী গোপাল। মেবার রাজপ্রাসাদের নিজস্ব মন্দিরে রাণী মীরা যখন দেবতার সামনে নাম সঙ্কীর্তন করতেন, তখন দলে দলে নরনারীরা বৈষ্ণববেশে সেখানে গিয়ে তাতে যোগ দিতেন। তাঁদের সেই অধিকার তিনিই দিয়েছিলেন। কিন্তু রাণা কখনো ভুলতে পারেন নি যে, তিনি ‘বাপ্পা রাও’য়ের বংশধর – হিন্দুধর্মের রক্ষক ও ভারতের সকল নরপতির স্বাভাবিক নায়ক। তিনি এই আশঙ্কাকে কখনো উপেক্ষা করতে পারেন নি যে, মেবারেশ্বরীর কীর্তন শোনবার জন্য বৈষ্ণবের ছদ্মবেশ ধারণ করে শত্রু সৈন্যরা যখন তখন প্রাসাদে প্রবেশ করে বহু অনর্থের সৃষ্টি করতে পারে। তাই তিনি মীরাকে বাধা দিয়েছিলেন। বাধা পেয়ে মীরা মনঃক্ষোভে গেয়ে উঠেছিলেন – “হে সখি, আমি যে হরি বিনা থাকতে পারি না। শ্বাশুড়ী কুন্দন করেন, ননদ গঞ্জনা দেন, আর রাণা তো আমার উপর বিরক্ত হয়েই আছেন। তিনি চৌকিতে প্রহরী বসিয়েছেন, দুয়ারে তালা লাগিয়েছেন। কিন্তু আমার এই জন্মজন্মান্তরের প্রেম ভুলি কেমন করে? হে মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর আমার আর কিছু যে ভাল লাগে না।”
“হেরী মহাসু হরি বিন
রাহো না জায়।
সাসু লড়ে মেরি ননদ খিজারে
রাণা বাহ্যো রিসায়।
পহ রোভী রাখো চৌকী
বিঠায়ো তালা দিয়ো জড়ায়।
পূর্ব্ব জনমকী প্রীত পুরাণী
সো ক্যু ছোড়ী জায়॥
মীরাকে প্রভু গিরিধর
নাগর আওর না আয়ে
সহারী দায়৷৷”

মধ্যযুগের বরণীয় বৈষ্ণব সাহিত্য
মধ্যযুগ থেকে মীরার সঙ্গীতের মূর্ছনা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মিথিলায় ‘বিদ্যাপতি’ আবির্ভূত হয়েছিলেন। এক মহাপণ্ডিত বংশের সন্তান বিদ্যাপতি নিজের সৃজনী শক্তি দিয়ে তাঁর সব পূর্বপুরুষের জ্যোতিকে ম্লান করে দিয়েছিলেন। তাঁর পিতা ‘গণপতি ঠাকুর’ একটি মূল্যবান স্মৃতিগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পুত্র গ্রন্থের পর গ্রন্থ রচনা করে সবাইকে চমৎকৃত করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন মিথিলানরেশ ‘শিবসিংহ’ তুর্কী আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য সব সময় বিব্রত থাকলেও বিদ্যাপতির প্রতিভাকে যথেষ্ট সমাদর করতেন, তাঁর রাণী ‘লছিমা’ও বিদ্যাপতির অনুরাগিণী ছিলেন। রাজার কাছ থেকে তিনি ‘কবিকণ্ঠহার’ উপাধি ও দ্বারভাঙ্গা জেলার বিসবিয়ার বিসকী গ্রামটি লাভ করেছিলেন। মৈথিল ও বাংলা ভাষার মধ্যে পার্থক্য অতিশয় সূক্ষ্ম এবং আলোচ্য সময়ে উভয় ভাষার অক্ষরগুলি অভিন্ন ছিল বলে গৌড়ের অধিবাসীরা তাঁকে নিজেদের আপনজন বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। সে যুগের বহু কবি তাঁর মানস শিষ্য ছিলেন; এমনকি পরবর্তী যুগেও, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথসহ বহু কবি তাঁকে সম্যক মৰ্য্যাদা দিয়েছিলেন। কবীর ও মীরাবাঈয়ের মত বিদ্যাপতিও পুরাপুরি বৈষ্ণব কবি ছিলেন। তাঁর রাধা বিরহযন্ত্রনায় কাতর হয়ে সখীকে বলেছিলেন, “যাঁর জন্য বস্ত্র, হার, এমন কি চন্দন পর্যন্ত দিলাম না সে আজ গিরিনদীর অন্তর হোল! যে প্রিয়র গরবে আমি কাউকে গণ্য করি নি সেই প্রিয় বিহনে আজ কে কি না বলছে? মরমে বড় কালেও দুঃখ, প্রিয় যদি ত্যাগ করে যায় তবে এ জীবনে কাজ কি?” –
“চীর চন্দন উরে হার ন দেলা।
সো অব নদী গিরি আঁতর ভেলা॥
পিয়াক গরবে হম কাহুক না গণলা।
সো পিয়া বিনা মোহে কো কি না কহলা॥
বড় দুখ রহল মরমে।
পিয়া বিছুরল যদি কি আর জীবনে॥
পূরব জনমে বিহি লিখিল ভরমে।
পিয়াক দোখ নহি যে ছিল করমে॥
আন অনুরাগে পিয়া আনি দেশে গেল।
পিয়া বিনে পাজর ঝাঁঝর ভেলা॥
ভনয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি।
ধৈরজ ধর চিতে মিলব মুরারি॥”
বিদ্যাপতির কবিতা যখন মিথিলায় এক নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করছিল, ‘চণ্ডীদাসের’ পদাবলীতে তখন গৌড়ের আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু উভয় জনপদের ধর্মজীবনের পটভূমিকা ভিন্ন ছিল বলে উক্ত দুই কবির চিন্তা ও কাব্যধারার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। সেই যে সেনশক্তির অভ্যুদয়ের সময় থেকে গৌড়-বঙ্গে বৌদ্ধমতের ক্ষয় শুরু হয়েছিল, ওই সময়ে সেটা নিম্নতম স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। বজ্রযানপন্থী বৌদ্ধরা জঘন্য যৌন সাধনাকে ‘সহজিয়া’ মত বলে চালিয়ে দিয়ে তখন কায়ক্লেশে নিজেদের অস্তিত্বকে বাজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু জনসাধারণ তাঁদের ক্ষমা করেন নি, তাঁদের শ্রাবক শ্রাবিকারা সমাজের ধিক্কারের পাত্র হয়ে পড়েছিলেন। তা সত্ত্বেও চণ্ডীদাস সেই সহজিয়াদের দলে যোগ দিয়েই নিজের কাব্যসাধনা শুরু করেছিলেন। বীরভূম জেলার নান্নুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণ বংশে চণ্ডীদাসের জন্ম হয়েছিল। গবেষকদের মতে ওই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিশালাক্ষী বা বাঁশুলী মূলে সম্ভবতঃ পুরীর জগন্নাথের মত কোন বৌদ্ধ দেবী ছিলেন। এখন তাঁর মন্দিরে যেমন নিত্য পূজা ও দ্বিপ্রহরে শিবাভোগ হয়, তখনও সেটাই হত। ওই মন্দিরের পূজারীর কাজ করবার সময়ে চণ্ডীদাস সহজিয়া সাধনায় আত্মনিয়োগ করে গেয়ে উঠেছিলেন –
“সহজ সহজ কহিব কাহারে
সহজ জানিবে কে?
সহজ কথাটি মনে করিলাম
শুন লো রাজার ঝি।
বাশুলী আদেশে জানিবে বিশেষে
আমি আর কব কি?”
নারী না হোলে সহজিয়াদের সাধনা অপূর্ণ থেকে যায়। সেই ধরণের নারী কাছেই ছিলেন। বাঁশুলী মন্দির সংলগ্ন পুষ্করিণীতে ‘রামী ধোপানী’ (রামী ধোপানীর ঘাট এখনও রয়েছে) নামের যে রজককন্যা কাপড় কাঁচতেন, চণ্ডীদাস তাঁকে নিজের সহজ সাধনার সঙ্গিনী করে নিয়ে গেয়ে উঠেছিলেন –
“চণ্ডীদাস কহে তুমি যে গুরু।
তুমি যে আমার কল্পতরু।
শুন রজকিনী রামি!
ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া শরণ লইমু আমি॥”
চণ্ডীদাসকে পেয়ে সহজিয়া সম্প্রদায় পুলকিত হয়ে উঠলেও তাঁর শক্তিশালী নেতৃত্ব কিন্তু জনসাধারণের ধিক্কার থেকে তাঁদের রক্ষা করতে পারেনি। তাই নিছক আত্মরক্ষার তাগিদে তাঁরা দ্রুতগতিতে বৈষ্ণব সমাজে মিশে যেতে শুরু করেছিলেন। চণ্ডীদাসও সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে গেয়েছিলেন –
“ বঁধু, কি আর বলিব আমি।
জীবনে মরণে জনমে জনমে
প্ৰাণনাথ হইও তুমি॥
তোমার চরণে আমার পরাণে
বান্ধিল প্রেমের ফাঁসি।
সব সমর্পিয়া একমন হইয়া
নিশ্চয় হইলাম দাসী॥
ভাবিয়াছিলাম এ তিন ভুবনে
আর মোর কেহ আছে।
রাধা বলে কেহ শুধাইতে নাই
দাঁড়াব কাহার কাছে॥”
আরো পড়ুন- আমৃত্যু প্রতিবাদী থাকতে চাওয়া এক চলচ্চিত্রকার – মৃণাল সেন
চণ্ডীদাসের পরিণত বয়সের উপরোক্ত ধরণের কবিতা ও সঙ্গীতগুলি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে রচিত হলেও তাঁর প্রথম জীবনের সেই সহজিয়াপন্থী মনের কোনদিনই পরিবর্তন হয় নি। তাই তাঁর পদাবলীর মধ্যে আদিরসের এত ছড়াছড়ি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তা সত্বেও তাঁকে আদিযুগীয় বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি বলে ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেন। তবে তখন তিনি একা ছিলেন না, সেই সময়ে বৈষ্ণব সাহিত্যের যে স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল, সেটার সর্বত্রই আদিরসের আধিক্য দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ওই ত্রুটি সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করা যায় না যে, সেই বৈষ্ণব কবিতা ও সঙ্গীতগুলি অনবদ্য ছিল। শুধু হিন্দুরা নন, সেই সময়ের মুসলমান কবিরাও ওই সাহিত্য সাধনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলীতে ‘সৈয়দ আইমুদ্দিন’, ‘আলাওল’, ‘সৈয়দ মুর্ত্তজা’ প্রভৃতি মুসলিম কবিদের অবদানও খুব একটা কম নয়। নাম সঙ্কীর্তনে বিভোর হয়ে সৈয়দ মুর্ত্তজা গেয়ে উঠেছিলেন –
“ শ্যাম বঁধু আমার পরাণ তুমি।
কোন শুভ দিনে দেখা তোমা সনে
পাসরিতে নারি আমি॥
যখন দেখিয়ে ও চাঁদ বদনে
ধৈরষ ধরিতে নারি।
অভাগীর প্রাণ করে আনচান
দণ্ডে দশবার মরি॥
মোরে কর দয়া দেহ পদছায়া
শুন শুন পরাণ কানু।
কুল শীল সব ভাসাইনু জলে
না জীয়ব তুয়া বিনু॥
সৈয়দ মুর্ত্তজা ভনে কানুর চরণে
নিবেদন শুন হরি।
সকলি ছাড়িয়ে রহঁ তুয়া পায়ে
জীবন মরণ ভরি॥”
(তথ্যসূত্র:
১- কবীর, ক্ষিতিমোহন সেন।
২- মীরাবাঈ, অমরচন্দ্র ঘোষ।
৩- চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি, শঙ্করীপ্রসাদ বসু।
৪- বৈষ্ণব-পদাবলী সাহিত্যের পশ্চাৎপট ও উৎস, দেবাশীষ ভট্টাচার্য।
৫- বৈষ্ণব সাহিত্য, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ।
৬- পূর্ব ভারতীয় বৈষ্ণব আন্দোলন ও সাহিত্য, অনুরাধা বন্দোপাধ্যায়।)