'ইলিয়াসশাহী' বংশের পতন - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ ‘ইলিয়াসশাহী’ বংশের পতন

‘ইলিয়াসশাহী’ বংশের পতন


পিতা ‘সিকান্দার শাহের’ বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করবার পরে নিজের ষোলজন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের চোখ উপড়ে নিয়ে ‘গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ’ ইলিয়াসশাহী বংশের তখতে আরোহন করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনিই ইলিয়াসশাহী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন। তাঁর মধ্যে মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মত কর্মদক্ষতা থাকলেও কোন ধর্মান্ধতা ছিল না। তিনি ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর পিতার সঙ্গে যুদ্ধে পর্যদস্তু হয়ে তৎকালীন দিল্লীশ্বর ‘ফিরোজ শাহ তুঘলক’ তখনকার মত বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে গেলেও, আবার দ্বিগুণ সৈন্য নিয়ে পুনরায় গৌড়ে হানা দিতে পারেন। তাই সেই সম্ভাবনার সম্মুখীন হওয়ার জন্য তিনি শুধুমাত্র নিজের রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তকেই সুরক্ষিত করেন নি, জৌনপুরের তৎকালীন সুলতান ‘খাজা জাহানের’ সঙ্গে মিত্রতা বন্ধনেও আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা উভয়ে মাঝে মাঝেই পরস্পরকে মূল্যবান উপঢৌকন পাঠাতেন। এরপরে একদিন গিয়াসুদ্দীনের কাছে খবর এসেছিল যে, কামরূপরাজ জনৈক অহম বিদ্রোহীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ওই রাজ্যের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য শুরু হয়েছে, এবং কামরূপ ও অহম রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন। উভয় রাজ্যের সেই কলহের সুযোগ নেওয়ার জন্য তিনি নিজের সৈন্যবাহিনীসহ হঠাৎই কামরূপে হানা দিয়েছিলেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন তুর্কী সৈন্যরা পঙ্গপালের মত ওই রাজ্য ছেয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু আগের তুর্কী শাসকদের মত সেবারে তাঁরও হিসেবে একটি বড় রকমের ভুল হয়ে গিয়েছিল। ওই হিন্দু নরপতিদ্বয়কে তিনি যতখানি কলহপরায়ণ বলে মনে করেছিলেন, তাঁরা আসলে ততটা কলহপরায়ণ ছিলেন না। কামরূপে গিয়াসুদ্দীনের আগমন সংবাদ পেয়েই তাঁরা রাতারাতি নিজেদের মধ্যেকার সব বিবাদ মিটিয়ে ফেলে, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সৃষ্টি করেছিলেন। এর ফলে, গিয়াসুদ্দীনের আগমনের আগে দুই রাজ্যের যে সব সৈনিকেরা পরস্পরকে নিধন করবার জন্য মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরাই তখন পরম মিত্র হয়ে উঠেছিলেন। উভয় রাজ্যের সেই ঐক্যের সম্মুখে স্থির থাকা গিয়াসুদ্দীনের পক্ষে সম্ভব হয় নি, তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে স্বরাজ্যে ফিরে এসেছিলেন।
এরপরে নিতান্ত দৈবক্রমে চীনের জনৈক নরপতি ‘ইউং-পো’র সঙ্গে সুলতান গিয়াসুদ্দীনের মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয়েছিল। তখন ‘চেঙ্গিস খাঁ’র পুত্র ‘কুবলাই খাঁ’ প্রতিষ্ঠিত ইউয়ান সাম্রাজ্যের এক সামন্ত ইউং-পোকে সিংহাসনচ্যুত করবার জন্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ‘হুই-তি’ চক্রান্ত চালাচ্ছিলেন। সেই চক্রান্তের কথা হঠাৎই প্রকাশ হয়ে পড়বার ফলে হুই-তি শঙ্কাব্যাকুল চিত্তে নিজের দেশ অন্যত্র আত্মগোপন করেছিলেন। ইউং-পো শত্রুর শেষ রাখতে চাননি, হুই-তি আবার ফিরে এসে কখন কি বিপদ ঘটাবেন সে সম্পর্কে তিনি সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। শেষে বহু অন্বেষণের পরে রাজা ইউং-পো খবর পেয়েছিলেন যে, হুই-তি তাঁর সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে পাশ্চাত্য দেশে চলে গেছেন। যেহেতু মধ্য-এশিয়ার পথ তখন সঙ্কট সমাকুল হয়ে পড়েছিল, তাই সেই পথে না গিয়ে তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে কোন জাহাজে উঠে ভারতে যাওয়াই হুই-তির পক্ষে সম্ভব ছিল। তখন ভারতে তীর্থ করতে বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা যেমন আসতেন, তেমনি ভেকধারী অপরাধীরাও কম আসতেন না। তাই হুই-তিকে খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজা ইউং-পো তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মচারীকে সমুদ্রপথে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই চীনা মিশন ১৪০৬ খৃষ্টাব্দে যখন গৌড়ে গিয়ে পৌঁছেছিল, তখন গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ গৌড়ের সুলতান পদে আসীন ছিলেন। ওই চীনা দলের দোভাষী ‘মা-হুয়ান’, তৎকালীন গৌড় রাজধানীতে যেসব অভিনব জিনিষ দেখতে পেয়েছিলেন, সেগুলোর একটি কৌতুকোদ্দীপক বিবরণ তিনি তাঁর লেখায় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। সুলতান গিয়াসুদ্দীনের সঙ্গেও সম্ভবতঃ ওই চীনা মিশনের পরিচয় হয়েছিল, কারণ এর তিন বছর পরে, ১৪০৯ খৃষ্টাব্দে, তিনি তাঁর নিজের একজন দূতকে মূল্যবান উপঢৌকনসহ চীনরাজের দরবারে পাঠিয়েছিলেন। তারও ছয় বছর পরে, গিয়াসুদ্দীনের পরবর্তী সুলতান ‘সৈফুদ্দীন হামজা শাহ’ একটি জিরাফসহ নানাবিধ উপহার দ্রব্য চীনরাজের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর দূতের পরিচয়পত্র সোনার পাতে লেখা হয়েছিল। মা-হুয়ান সুলতান গিয়াসুদ্দীনের সময়ের গৌড়ের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে যে বিবরণ লিখে গিয়েছিলেন, সেটা থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন শাসকশ্রেণী তাঁদের দেহ শালোয়ার-কামিজ, মস্তক পাগড়ী ও পদযুগল ছুঁচালো পাদুকায় আবৃত করে রাখতেন। ধনী ও দরিদ্রদের জন্য গৌড়ের তাঁতীরা বিভিন্ন রকমের বস্ত্র তৈরী করতেন। তাঁদের তৈরী অতি সূক্ষ্ম ‘পি-চি’ কাপড় লম্বায় ১৯ হাত, চওড়ায় ২ হাত হত; ঠাস বুননের হলদে কাপড় লম্বায় ১৭ হাত ও চওড়ায় ২-১/৩ হাত হত। তখন পাগড়ীর জন্য ২০ হাত লম্বা, ২ হাত চওড়া যে ‘হিং-পে-তুং’ কাপড় তৈরী করা হত, সেটার চাহিদা খুব বেশী ছিল। সেগুলি সব ধনীদের জন্য তৈরী মিহি কাপড় ছিল। সেই সময়ের সাধারণ মানুষেরা ‘সা-তু-আর’ এবং ‘মো-হেই-মোলে’ কাপড় ব্যবহার করতেন। তখন রেশমী কাপড়ও যথেষ্ট পরিমানে তৈরী করা হত। সেই সময়ে গৌড় রাজ্যের সর্বত্র গুটি পোকার চাষ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন রকমের রেশমী রুমাল, জরীর টুপি, কারুকার্যখচিত মৃৎপাত্র, ইস্পাতের তৈরী ছুরি, কাঁচি প্রভৃতি মা-হুয়ানের দৃষ্টিকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। মা-হুয়ান লিখেছিলেন, “এ দেশের লোকরা চা খায় না, বাড়ীতে অতিথি এলে পানসুপারি দিয়ে আপ্যায়িত করে। নারকেল ও চাল দিয়ে তৈরী তাড়ি ও কাজাং প্রকাশ্য বাজারে বিক্রয় করা হয়। হোটেল ও মিঠাইয়ের দোকানে নানা প্রকারের সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। যে সব সমুদ্রগামী জাহাজে করে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলে সেগুলি এখানকার বন্দরে তৈরী করা হয়। বড় বড় লেনদেন রৌপ্যমুদ্রায় ও খুচরা বেচাকেনা কড়ি দিয়ে চলে।” তৎকালীন গৌড়ের বিচিত্র রকমের আমোদ প্রমোদের কথাও ওই চীনা ভ্রমণকারী লিখে গিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “এক শ্রেণীর গায়ক গলায় হার ও হাতে তাগাবালা পরে বাজনা বাজায়; আরেক শ্রেণী ধনীগৃহে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়ে গান গেয়ে গৃহস্বামীর চিত্ত বিনোদন করে। পালোয়ান ও কুস্তীগীররা রাস্তায় রাস্তায় কসরৎ দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে; তাতে তাঁদের দিন ভালই কাটে।” এক দিন মা-হুয়ান দেখতে পেয়েছিলেন যে, একজন পালোয়ান পথের পাশে তাঁর পোষা বাঘের সঙ্গে লড়াই করছেন, আর সেই লড়াই দেখবার জন্য বহু মানুষ ভীড় জমিয়েছেন। বাঘটাকে প্রথমে রাগাবার জন্য সেই পালোয়ান বার বার ঘুসি ও চড় মারবার পরে সে যখন ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর প্রভুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বহুক্ষণ যুদ্ধের পরে বাঘটি অবসন্ন হয়ে পড়লেও পালোয়ান সেটিকে ছাড়েন নি। এরপরে সেখানে উপস্থিত জনতা ভীতিবিহ্বল চিত্তে দেখতে পেয়েছিলেন যে, সেই হিংস্র জন্তুর মুখবিবরে হাত ঢুকিয়ে ওই পালোয়ান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন!

 

সুলতান গিয়াসুদ্দীন যে ভাবেই তখতে আরোহণ করুন না কেন, নিজের পরবর্তী জীবনে একজন সুশাসক হিসাবে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। একদিন তিনি যখন প্রথামত তীর ছোঁড়া অভ্যাস করছিলেন, সেই সময়ে হঠাৎই একটি তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একান্তে দণ্ডায়মান একটি বালককে বিদ্ধ করেছিল। এরপরে যথোচিত চিকিৎসা করা সত্বেও সেই বালকের জীবন রক্ষা না পাওয়ার জন্য তাঁর বিধবা জননী, গৌড়ের তৎকালীন ‘কাজী উল-কাজ্জা’ অর্থাৎ কাজীর কাজী ‘শাহ সিরাজউদ্দীনের’ কাছে গিয়ে নিজের পুত্রহন্তার বিচার দাবী করেছিলেন। সেই আবেদন পেয়ে কাজী প্রাথমিক তদন্তের পরে জানতে পেরেছিলেন যে, বালকের অপঘাতে মৃত্যুর অপরাধী আর কেউ নন – স্বয়ং গৌড়েশ্বর গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ! শাহ সিরাজউদ্দীন অত্যন্ত নির্ভীক প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। বিচার ব্যবস্থায় সমতা বজায় রাখবার জন্য তিনি কাউকেই খাতির করে চলতেন না। তাই যে অপরাধের জন্য তিনি অন্য কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতেন, খোদ সুলতানের বেলায় অন্য কোন ব্যবস্থা করতে তাঁর মন সায় দেয়নি। অপরাধী স্বয়ং গৌড়েশ্বর হলেও তিনি ওই অপরাধের বিচার করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সেজন্য তাঁর সম্মুখে হাজির হওয়ার জন্য সমন লিখে নিজের একজন পেয়াদাকে সুলতান মঞ্জিলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পেয়াদা সেখানে গিয়ে অতি কৌশলে সেই সমনটি গিয়াসুদ্দীনের সম্মুখে উপস্থাপিত করলে, তিনি সেটা পড়ে ক্রুদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কাজীর নির্দেশিত নির্দ্ধারিত সময়ে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হবেন। এরপরে বিচারের দিন তিনি নিজের পোষাকের নীচে একটি তরবারি লুকিয়ে নিয়ে বিচারসভায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। কাজী সিরাজউদ্দীন তাঁকে তাঁর অপরাধ বুঝিয়ে দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, ওই বালকের হত্যা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হলে তিনি অবশ্যই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতেন; কিন্তু তিনি যেহেতু নিজের অজ্ঞাতসারে সেই অপরাধ করে ফেলেছেন, সেক্ষেত্রে তিনি লঘু দণ্ড আশা করতে পারেন। গিয়াসুদ্দীন সেই কথা মেনে নিয়ে হাসিমুখে দণ্ড গ্রহণ করে কাজীকে জানিয়েছিলেন যে, সিরাজুদ্দীন যদি ওই বিধবার আবেদনকে উপেক্ষা করতেন তাহলে তিনি নিজের হাতে সেখানেই তাঁর শিরোচ্ছেদ করতেন – এই কথা বলে তিনি তাঁর পোষাকের নীচ থেকে তরবারিটি বের করে কাজীর সম্মুখে রেখেছিলেন। তারপরে কাজীর আদেশে সুলতান রাজকোষাগার থেকে ওই বিধবার আজীবন ভরণ পোষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করবার হুকুম দিয়েছিলেন।

সুলতান গিয়াসুদ্দীনের যে সব বেগমরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ‘সারো’, ‘গুল’ ও ‘লালা’ – এই তিনজনকে তিনি একটু বেশী ভালবাসতেন। একবার তিনি গুরুতর পীড়ায় শয্যাশায়ী হয়ে তাঁদের আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর মৃত্যু ঘটলে তাঁরা যেন মৃতদেহকে গোলাপজলে ধৌত করে দেন। সুলতানের সেই আদেশকে শিরোধার্য্য করে তাঁর প্রিয় তিন বেগম শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেছিলেন। সেবারে সুলতানের প্রাণ যায়নি, তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে ওই বেগম তিনজনকে তাঁর সেবার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা যে আসলে সুলতানের মৃতদেহ ধৌত করবার জন্য বসেছিলেন, অন্যান্য পুরবাসীরা সেকথা ভোলেন নি; তাই ওই ঘটনার পরে তাঁদের তিনজনকে সবাই ‘গুস্সালি’ অর্থাৎ ‘শবধৌতকারিনী’ বলে উপহাস করতে শুরু করেছিলেন। গিয়াসুদ্দীনের কানে সেই খবর গিয়ে পৌঁছানোর পরে তিনি উক্ত বেগমত্রয়ের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকাশ করবার জন্য একটি গজল লিখতে বসেছিলেন। অবসর সময়ে গজল লেখাটা তাঁর একটা অভ্যাস ছিল। কিন্তু কয়েক পংক্তি লেখবার পরে সেবারে শেষের দিকে তিনি আর ছন্দ মেলাতে পারছিলেন না। এরপরে তিনি দিনের পর দিন ধরে চেষ্টা করেও উপযুক্ত শব্দের অভাবে গজলটি শেষ করতে পারেন নি। শেষে নিরুপায় সুলতান একজন দূত মারফৎ সেই অসম্পূর্ণ গজলটিকে ইরাণের কবি ‘হাফিজের’ কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে হাফিজ নিম্নলিখিত কবিতাটি রচনা করে তাঁর দূতের হাতে সমর্পণ করেছিলেন –
“দেশের সেরা হিন্দুস্থান
সে দেশের সব বুলবুলি
ইরাণের এই মিছরি মধু
পানের তরে দিনগুলি
গুণছে জানি, তাদের বুকে
কতই দুঃখ কতই আশা
তুচ্ছ আমার গজল যেন
তাদের মুখে দেয় ভাষা।
সেই দেশের এক মহান রাজা
গিয়াসুদ্দীন দরবারে
হাফিজ তাহার সেলাম পাঠায়,
– আর কি আছে সংসারে?”
ঐতিহাসিকদের মতে বহু দোষ সত্ত্বেও গিয়াসউদ্দীন তুর্কী যুগের বাংলার একজন আদর্শ নরপতি ছিলেন। নিজের রাজ্যের প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি যেটুকু চেষ্টা করেছিলেন, সেই সময়কার অন্য কোন সুলতান সেসব কিছু করেন নি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে, তুর্কী যুগের অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে তাঁকেও শেষপর্যন্ত ১৪০৯ খৃষ্টাব্দে গুপ্তঘাতকের ছুরিতে নিজের প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
আততায়ীর ছুরিকাঘাতে সুলতান গিয়াসুদ্দীনের জীবনাবসান হওয়ার পরে আমীর ও সৈন্যাধ্যক্ষরা তাঁর পুত্র ‘সৈফুদ্দীন হামজা শাহ’কে গৌড়ের মসনদে অভিষিক্ত করেছিলেন (১৪০৯ খৃষ্টাব্দ)। কিন্তু কিছুদিন পরেই প্রতিপক্ষের চক্রান্তের ফলে তিনি গৌড়ের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, এবং তাঁর বালক পুত্র ‘দ্বিতীয় সামসুদ্দীন’ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই চক্রান্তের শেষ হয়নি। তিন বছর সাত মাস পাঁচ দিন ধরে রাজত্বের পর তিনিও আততায়ীর ছুরিকাঘাতে ধরাশায়ী হলে তাঁর পিতার একজন হিন্দু আমীর, ‘রাজা গণেশ’, গৌড় রাজ্যের শাসনকর্তা হয়ে বসেছিলেন।

(তথ্যসূত্র:
১- Ain-i-Akbari, ii, Abul Fazl Allami, Jarret’s translation.
২- Riyas-us-Salatin, Ghulam Hussain Salim.
৩- Memoirs of Gaur and Pandua, Abid Ali Khan.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)‘রাজরোষে রামকৃষ্ণ মিশন’ (দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ পরাধীন ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের উপরে ব্রিটিশ রাজরোষ নেমে আসবার কারণগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে সাজানো যেতে পারে – (১) রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই ব্রিটিশ সরকারের প্রধান সন্দেহভাজন তালিকায়

প্রাচীন ভারতে তনয়াপ্রাচীন ভারতে তনয়া

রানা চক্রবর্তীঃ প্রাচীন ভারতবর্ষে পুত্র জন্মালে শাঁখ বাজত, কন্যা জন্মালে নয়। তাছাড়া ‘ভাইফোঁটা’, ‘জামাই ষষ্ঠী’ – সবই পুরুষকেন্দ্ৰিক অনুষ্ঠান। জন্মদিনও ছেলেদেরই বেশি হয়। ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’-এ বলা হয়েছে – যে নারী

লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধলাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ

৫ কোটি লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নোটিশ বোর্ড। এই রাস্তায় আর মানুষ যেতে পারবে না। যান চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ। এমনকি মানুষের বাইরে বেরোনোর সময়সীমাও বেঁধে

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন (প্রথম পর্ব)ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশন (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রধানতঃ তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল, (ক) সশস্ত্র বিপ্লব – চরমপন্থা আন্দোলন, (খ) গান্ধীজীর নেতৃত্বে অহিংস গণ আন্দোলন, এবং (গ) নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর