হোসেনশাহী বংশের উত্থান - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ হোসেনশাহী বংশের উত্থান

হোসেনশাহী বংশের উত্থান


রানা চক্রবর্তীঃ গৌড়-বঙ্গে হাবসী যুগের শেষ সুলতান ‘সামসুদ্দীন মুজাফরের’ আততায়ী হোসেন শাহ আরব ভাগ্যান্বেষী ‘সৈয়দ আসরাফের’ পুত্র ছিলেন। অনেক আশা আকাঙ্খা নিয়ে আসরফ বঙ্গদেশে এসেছিলেন, কিন্তু কোথাও কিছু সুবিধা না হওয়ার জন্য তাঁর জীবন খুব দুঃখে কেটেছিল। শেষে একটা সময়ে নিজের পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য তিনি তাঁর পুত্র হোসেনকে মুর্শিদাবাদ জেলার একআনি চাঁদপাড়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ গৃহস্থের বাড়ীতে রাখালের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। সেই সহৃদয় ব্রাহ্মণ দেখেছিলেন যে, ওই বালক দরিদ্র হলেও বুদ্ধিমান, তাই তাঁকে অবসর সময়ে তিনি লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন, ও সে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরে স্থানীয় কাজীর সহায়তায় তাঁকে রাজ সরকারে অধীনে একটি ছোটখাট চাকুরী জোগাড় করে দিয়েছিলেন। ওই ভাবে নিজের আত্মোন্নতির সুযোগ পেয়ে হোসেন তাঁর কর্মদক্ষতার গুণে শেষপর্যন্ত উজীরের পদ লাভ করেছিলেন। কিন্তু তিনি উজীর ছিলেন কেবল নামে, আসল রাজ্য চালাতেন হাবসীরা। শেষে মুজাফর হাবসীর সময়ে যখন তাঁদের বিরুদ্ধে চারিদিকে গণবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, তখন একদিন সবার অলক্ষ্যে নিজের প্রভুকে হত্যা করে তিনি গৌড়-বঙ্গের মসনদ আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। সেই যুগের মানদণ্ডেও হোসেন শাহ যে যথেষ্ট গর্হিত কাজ করেছিলেন একথা সত্যি, কিন্তু তিনি তখন হাবসীদের ওই বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ না করলে, বঙ্গদেশ থেকে হাবসী বিভীষিকা কখনো দূর হোত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু তাঁর ক্ষমতালাভে হাবসীরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বাংলার গ্রামাঞ্চলে গিয়ে ব্যাপকভাবে লুঠতরাজ চালাতে শুরু করেছিলেন; যার ফলে তৎকালীন জনজীবন রীতিমতো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। হোসেন শাহও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। তাই তাঁদের কঠোর হাতে দমন করে সুলতান হোসেন শাহ ১২ হাজার হাবসী সৈন্যকে হত্যা করিয়েছিলেন, এবং বাকী হাবসীদের বন্দী করে একপ্রকার জোর করে জাহাজে তুলে তাঁদের স্বদেশ আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়ের প্রাসাদরক্ষী পাইকেরা এদেশীয় হলেও তাঁদের উপরে হোসেন শাহের কোন আস্থা ছিল না। কারণ, তাঁরা নাচ-গান-স্ফূর্তিতে নিজেদের দিন কাটাতেন। কোন ধরণের কর্মদক্ষতা তাঁদের মধ্যে যেমন ছিল না, তেমনি নিজেদের উপরে ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করবার আগ্রহও তাঁদের ছিল না। হোসেন শাহের তখত দখলের মাত্র কয়েক বছর আগে তাঁদেরই চোখের সামনে হাবসীরা শাহাজাদা প্রাসাদে প্রবেশ করে সুলতান ‘ফাত শাহ’কে হত্যা করেছিলেন; আবার তাঁদের অনেকের জ্ঞাতসারেই হোসেন স্বয়ং সামসুদ্দীন মুজাফরকে অপসারিত করেছিলেন। তাই ওই সব অকর্মন্য সিপাহীদের দিয়ে কোন কাজ হবে না বুঝতে পেরে, তিনি নিজের রক্ষীবাহিনীর বিলোপ সাধন করে সব সৈন্যকে তাঁদের নিজের নিজের গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন দিল্লীর ‘লোদী’ ও জৌনপুরের ‘শর্কী’রা পরস্পরের সঙ্গে কলহে লিপ্ত ছিলেন বলে গৌড়ের পশ্চিম সীমান্ত থেকে কোন ধরণের বিপদের আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু এরপরেই ১৪৯৪ খৃষ্টাব্দে দিল্লীশ্বর ‘সিকান্দার লোদী’ জৌনপুর অধিকার করে নেওয়ার ফলে গৌড়ের সমূহ বিপদ দেখা দিয়েছিল। লোদীদের সেই সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করবার জন্য হোসেন শাহ তাঁর রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি নিজের জন্য একজন বন্ধুর সন্ধানও পেয়েছিলেন। লোদীদের আক্রমণে রাজ্যচ্যুত জৌনপুরের শেষ শর্কী বংশীয় সুলতান ‘হোসেন শর্কী’ তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তাঁকে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। হোসেন শাহ সানন্দে তাঁকে নিজের রাজ্যে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর বসবাসের জন্য ভাগলপুরের অদূরে একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর ভরণপোষণের জন্য তাঁকে উপযুক্ত জায়গীরও দেওয়া হয়েছিল। লোদীদের নিয়ে আলাউদ্দীন হোসেনের আশঙ্কা কিন্তু অমূলক ছিল না। জৌনপুরে নিজেদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করবার পর থেকেই দিল্লীশ্বর ইব্রাহিম লোদী তাঁর রাজ্য আক্রমণ করবার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর সামনে বহু সমস্যা থাকবার জন্য সেই অভিযান কয়েক বছরের জন্য বিলম্বিত হয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত একদিন তিনি পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করলে, হোসেন শাহ তাঁর সম্মুখীন হওয়ার জন্য নিজের পুত্র ‘দানিয়েল’কে লোদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান পাটনা শহরের অদূরে অবস্থিত ‘বাঢ়’ গ্রামে উভয় সৈন্যবাহিনীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী সেনাপতিরা যখন সেখানে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে তাঁবু ফেলে শত্রুর উপরে প্রথম আঘাত হানবার জন্য উপযুক্ত সময়ের প্রতীক্ষা করছিলেন, এমন সময়ে এক দিন লোদী শিবির থেকে দূত এসে দানিয়েলকে জানিয়েছিলেন যে, সুলতান ইব্রাহিম যুদ্ধ চান না, তিনি সন্ধির প্রত্যাশী। লোদীদের পক্ষ থেকে সেই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব তখন সকলকে বিস্মিত করলেও, সেটা ছাড়া ইব্রাহিমের সামনে তখন অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। কারণ, তিনি যখন হোসেনী সৈন্যদের সঙ্গে নিজের চূড়ান্ত শক্তি পরীক্ষার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে দিল্লী থেকে খবর এসেছিল যে, বাবরের নেতৃত্বে মোঘলরা লাহোরে এসে উপস্থিত হয়েছেন, এবং পাঞ্জাবের তৎকালীন শাসনকর্তা ‘দৌলত খাঁ লোদী’ তাঁদের বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টে গোপনে তাঁদের ভারতে আহ্বান জানিয়েছেন। ইব্রাহিম জানতেন যে, পাঞ্জাব যদি বাবরের অধিকারে চলে যায় তাহলে দিল্লীর প্রবেশদ্বার নিজে থেকেই মোঘলদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তাই তখন আগে সেই মোঘল বিপদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য তিনি নিজের সব সৈন্যসহ তড়িঘড়ি দিল্লীর দিকে রওনা হয়েছিলেন। আর দানিয়েলও গৌড়ে ফিরে এসেছিলেন।

হোসেনশাহী বংশের উত্থান

রো পড়ুন- মধ্যযুগের বরণীয় বৈষ্ণব সাহিত্য

ওই ঘটনার কিছুদিন আগেই তৎকালীন কামতারাজ ‘নীলাম্বরের’ প্রধানমন্ত্রী ‘শচিপাত্র’ হোসেন শাহের দরবারে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাজা নীলাম্বর তাঁর পুত্রকে হত্যা করবার জন্য তখন তিনি তাঁর উপরে প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন গৌড়-বঙ্গের বিভিন্ন তুর্কী সুলতান কামরূপ-কামতা জয় করবার জন্য বারবার চেষ্টা করলেও ওই ধরণের সুযোগ তাঁদের কারো ভাগ্যেই জোটেনি। বিক্ষুব্ধ মন্ত্রীর কাছ থেকে কামতা রাজ্যের বহু আভ্যন্তরীণ সংবাদ জানতে পেরে হোসেন শাহ তাঁর এক সৈন্যবাহিনীকে কামতা অভিযানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বাহিনী কামতা রাজ্যের রাজধানী কামতাপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘ অবরোধের পরেও তাঁরা সেই নগরী অধিকার করতে সক্ষম না হওয়ার জন্য বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক রাজা নীলাম্বরকে বন্দী ও কামতাপুরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। কামতার সেই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে হোসেন শাহ এরপরে আসাম জয়ের জন্য আরেকটি অভিযাত্রীবাহিনী সংগঠিত করেছিলেন। প্রথমে আসামে তাঁদের অকস্মাৎ আগমনে অহমরাজ নিজের রাজধানী ও সৈন্যবাহিনীকে পার্বত্য অঞ্চলে অপসারিত করেছেন দেখে হোসেনশাহী সৈন্যরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলেন। কিন্তু বিজয়লক্ষী তাঁদের উপরে বিরূপ ছিলেন। এরপরে বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তাঘাট দুর্গম হয়ে উঠলে অহম-বাহিনী পাহাড় থেকে নেমে এসে হোসেন শাহের বাহিনীর উপরে এতটাই প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল যে, হোসেনশাহী বাহিনীর চব্বিশ হাজার পদাতিক ও কয়েক হাজার অশ্বারোহী ও নৌসৈন্যের মধ্যে মাত্র কয়েকজন নিজের প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন। অহমরা প্রায় সমস্ত অভিযাত্রী বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন।

আসামে সামরিক ব্যর্থতার জন্য হোসেন শাহের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল, সেটা পূরণ করবার জন্য তিনি যখন চারদিকে নিজের দৃষ্টি ফেরাচ্ছিলেন, এমন সময়ে গুপ্তচরদের মারফত খবর এসেছিল যে, উড়িষ্যার সীমান্ত তখন অরক্ষিত রয়েছে, রাজা প্রতাপরুদ্র দূরদেশে অবস্থান করবার জন্য কোন বহিরাক্রমণ প্রতিরোধ করবার মত কোন সৈন্যাধ্যক্ষ রাজধানীতে নেই। তাই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবার জন্য হোসেন শাহ ১৪০৯ খৃষ্টাব্দে নিজের একটি সৈন্যবাহিনী উড়িষ্যায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পথে কোন প্রতিরোধ না থাকবার জন্য তাঁরা অনায়াসে পুরী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার পরে হঠাৎ খবর এসেছিল যে, উড়িষ্যা বাহিনী ওই ধর্মনগরীর অদূরে এসে উপনীত হয়েছে। তাঁদের সংখ্যা ও শক্তির কথা শুনে হোসেনশাহী সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কালবিলম্ব না করে অন্য পথ ধরে গৌড়ের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। উড়িষ্যা তখনও পর্যন্ত এক দুর্ধর্ষ শক্তি ছিল। শত্রু পালিয়ে গেছে বলে আত্মপ্রসাদ উপভোগ করবার মত নরপতি রাজা প্রতাপরুদ্র ছিলেন না। তাই তাঁর সৈন্যরা উড়িষ্যা থেকে পলায়নপর হোসেনশাহী বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে শেষপর্যন্ত গৌড়-বঙ্গের সীমান্তদুর্গ মান্দারণে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। এরপরে ওই দুর্গ অধিকার করবার জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম চলেছিল। উড়িষ্যা বাহিনী মাসের পর মাস ধরে ওই দুর্গ অবরোধ করে থাকলেও শেষপর্যন্ত তাঁদের সেনাপতি ‘গোবিন্দ বিদ্যাধরের’ নির্বুদ্ধিতার জন্য তাঁরা সেই অবরোধ তুলে নেওয়ার ফলে গড়-মান্দারণ উভয় রাজ্যের অলিখিত সীমান্ত বলে স্বীকৃত হয়েছিল।
সেই সময়ে ত্রিপুরা এক পরাক্রান্ত রাজ্য ছিল। সেখানকার সৈন্যরা তুর্কী অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে হানা দিয়ে মাঝে মাঝেই লুঠতরাজ চালাতেন, একবার তো তাঁরা সোনারগাঁ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। আলোচ্য সময়ের কিছু আগে আরাকানরাজ ‘মেং-সো-সোয়ান’ ব্রহ্মরাজ কতৃক সিংহাসনচ্যুত হওয়ার ফলে রাজা ‘ধর্মমাণিক্যের’ আদেশে ত্রিপুরী সৈন্যরা সেখানে গিয়ে তাঁকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে তখন আরাকান ও ত্রিপুরার মধ্যে মনোমালিন্য লেগেই থাকত। এরপরে হোসেন শাহের সৈন্যরা ওই অঞ্চলে উপস্থিত হয়ে পূর্বতন দুই দাবীদারকে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আহ্বান করলে উক্ত বন্দরটি অধিকারের জন্য তিন শক্তির মধ্যে তুমুল সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ত্রিপুরী সেনাপতি ‘রায় চাইচাগ’ অনন্যসাধারণ প্রতিভাবান একজন সমরনায়ক ছিলেন। নিজের সৈন্যবাহিনীকে দুইভাগে বিভক্ত করে তিনি একদিকে আরাকান ও অন্যদিকে হোসেন শাহের বিরুদ্ধে সমানে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সৈন্যরা সংখ্যাল্প হলেও উভয় ফ্রন্টেই অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। ওই ভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে সেনাপতি চাইচাগ তাঁর উভয় শত্রুকেই পরাভূত করে চট্টগ্রামের উপরে ত্রিপুরেশ্বরের আধিপত্যকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর আক্রমণের ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে হোসেন শাহী সৈন্যরা নিজেদের সীমান্তের মধ্যে ফিরে এসেছিলেন। সেই পরাজয়ের পরে হোসেন শাহ তাঁর বিচক্ষণ সেনাপতি ‘গৌর মল্লিকের’ অধীনে বৃহত্তর আরেকটি সৈন্যবাহিনীকে ত্রিপুরায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা কুমিল্লার কাছাকাছি কোনও এক জায়গায় পৌঁছানোর পরে ত্রিপুরী বাহিনী তাঁদের সম্মুখীন হয়েছিল, কিন্তু হোসেনশাহী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁরা সোনামোতিয়া দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই বিজয়ে উৎফুল্ল হয়ে গৌর মল্লিক এরপরে মেহেরকুল দুর্গ অধিকার করে রাজধানী রাঙামাটির দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেই পারেননি যে তাঁকে ধরবার জন্য রায় চাইচাগ ফাঁদ পেতে রেখেছিলেন। গৌর মল্লিক যখন নিজের সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে শুষ্ক গোমতী নদী পার হচ্ছিলেন, তখন শত্রুপক্ষীয় একজন সৈনিকও সেখানে উপস্থিত ছিল না। কেবল ধীবরেরা নদীর বেলাভূমিতে শামুক বা কাঁকড়ার অন্বেষণে ব্যস্ত ছিলেন, আর রাখালেরা নদীতীরে নিজেদের গরু চড়াচ্ছিলেন। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। হাজার হাজার হোসেনশাহী সৈনিক শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে মার্চ করতে করতে যখন বালুকাময় সেই নদীর প্রায় মধ্যস্থলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, ঠিক সেই সময়ে ধীবর ও রাখালেরা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা একে অন্যের কাছে ইঙ্গিতে কি যেন বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরেই মাইল খানেক উত্তরে গোমতী নদীর উপরে বাঁধ ভেঙে গিয়ে অবরুদ্ধ জলরাশি গর্জন করতে করতে হোসেনশাহী সৈন্যদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছিল। সেই ভয়াল দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেও হোসেনশাহী বাহিনীর তখন পাড়ের দিকে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। প্রবল জলস্রোতের মুখে পড়ে হাজার হাজার সৈনিক খড়কুটোর মত ভেসে গিয়েছিলেন। বিহ্বল গৌর মল্লিক নিজের মুষ্টিমেয় কয়েকজন সৈন্যকে নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে তীরে উঠে চণ্ডীগড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও তাঁরা বিশ্রাম পাননি, সেদিন রাত্রিশেষে ত্রিপুরী সৈন্যরা আচমকাই তাঁদের শিবিরে হানা দিয়ে সবকিছু ছারখার করে দিয়েছিলেন। ফলে শেষপর্যন্ত হতাবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে গৌর মল্লিক পরের দিনই গৌড়ের পথে রওনা হতে বাধ্য হয়েছিলেন। হোসেন শাহের কাছে সেই দুঃসংবাদ পৌঁছানোর পরে তিনি নিজের আরো বৃহত্তর একটি সৈন্যবাহিনীকে ‘হাতিয়ান খাঁ’র অধীনে ত্রিপুরায় পাঠিয়েছিলেন। গৌর মল্লিকের তুলনায় হাতিয়ান খাঁ এমন কিছু কীর্তিমান সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, দ্বিতীয় শ্রেণীর সৈনিকরাও মাঝে মাঝে অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তাই অনেক উৎসাহ দিয়ে, অনেক আশার কথা শুনিয়ে হোসেন শাহ হাতিয়ানকে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে বিদায় জানিয়েছিলেন। সেবারে আগের দু’বারের পরাজয়ের কথা মাথায় রেখে সবদিক থেকে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল। কিন্তু অত সতর্কতা সত্ত্বেও সেবারেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। সেনাপতি রায় চাইচাগ যখন জানতে পেরেছিলেন যে, শত্রুরা আবার ত্রিপুরার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন তিনি তাঁর সমস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। কুমিল্লার কাছাকাছি কোন একটা জায়গায় হাতিয়ান খাঁর সৈন্যদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। এরপরে কয়েকদিন প্রতীক্ষার পরে একদিন সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই রায় চাইচাগ হাতিয়ান খাঁকে আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতার জন্য সেদিন সন্ধ্যার দিকেই তিনি পশ্চাদপসারণ করতে শুরু করেছিলেন। কিংবা সেটাই হয়ত তাঁর পরিকল্পনা ছিল। ওই ভাবে যখন তিনি যখন শত্রুকে নিজের পিছনে টেনে আনছিলেন, তখন রাত্রির অন্ধকারে পৃথিবী ঢেকে গিয়েছিল। সেই অন্ধকারের ফলে হাতিয়ান খাঁর বাহিনী বুঝতে পারেনি যে তাঁরা আবার শুষ্ক গোমতী নদীর উপরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এরপরে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। গৌর মল্লিকের বাহিনীর সাথে যা হয়েছিল, হাতিয়ান খাঁর বাহিনীর সাথেও সেই একই কাণ্ড ঘটেছিল। সেই অবস্থায় নিজের আসন্ন মৃত্যুকে পরিহার করে হাতিয়ান খাঁ কোনক্রমে পালিয়ে গিয়ে সুগনিয়া দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর হাজার হাজার সৈন্য গোমতীর জলের তলায় ডুবে মারা গিয়েছিলেন। যাঁরা সেদিন ওই নদীবক্ষে আসে নি এবং যাঁরা নদী পার হয়ে ওপারে চলে যেতে পেরেছিলেন, তাঁরা নিজেদের চোখের সামনে সহকর্মীদের সেই শোচনীয় পরিণতি দেখে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁদের অস্ত্র ধারণের শক্তি পর্যন্ত লোপ পেয়েছিল। এরপরে ত্রিপুরী সৈন্যগণ অতি সহজেই তাঁদের বন্দী করে নিজেদের দুর্গে নিয়ে গেলে রাজা ধনমাণিক্যের আদেশে তাঁদের সবাইকে চতুর্দশ দেবতার সামনে বলি দেওয়া হয়েছিল। ত্রিপুরার বিরুদ্ধে ওই ভাবে বারবার পরাজয়ের ফলে হোসেন শাহের মনে নিদারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। তিনি নিজে বিশাল এক রাজ্যের অধীশ্বর হলেও ক্ষুদ্র ত্রিপুরাকে বশীভূত করতে না পারবার জন্য তাঁর মর্য্যাদা যে যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল, সেকথা বুঝতে পেরে তিনি আরো বড় একটি সৈন্যবাহিনীকে সংগঠিত করে ত্রিপুরায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বাহিনীর নতুন সেনাপতি আগের দু’বারের অভিজ্ঞতা থেকে কুমিল্লার পথ পরিহার করে অন্য এক পথ ধরে ত্রিপুরা রাজধানীর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। কৈলারগড়ের এক মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে তাঁর শিবির স্থাপিত হয়েছিল। সেই বিশাল হোসেনশাহী সৈন্যবাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার জন্য রাজা ধনমাণিক্য তাঁর রাজ্যের সব সীমান্ত থেকে সৈন্যদের সেখানে সমবেত করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেবারে তাঁরা শত্রুকে প্রতিরোধ করতে অক্ষম হয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে অবশেষে হোসেনশাহী সৈন্যরা ত্রিপুরার সমতল অঞ্চলগুলিকে অধিকার করে নিয়ে ত্রিপুরেশ্বরকে পার্বত্য প্রদেশে কোণঠাসা করে দিতে পেরেছিলেন; কুমিল্লা ও সন্নিহিত অঞ্চলগুলি ত্রিপুরা রাজ্যের হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। গৌড় ও ত্রিপুরার মধ্যে সেই জীবনমরণ সংগ্রামের সময়ে আরাকানী সৈন্যরা আচমকাই চট্টগ্রাম থেকে ত্রিপুরী সৈন্যদের হটিয়ে দিয়ে বন্দরটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। তবে তাঁদের সেই অধিকার অবশ্য বেশী দিন স্থায়ী হয় নি; কারণ, ‘পরাগল খাঁ’র অধীনে হোসেন শাহ শীঘ্রই একটি সৈন্যবাহিনীকে পাঠিয়ে দিয়ে মগদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। এরপরে বিজয়ী পরাগল ওই নগরীর শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন।

ত্রিপুরার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরে হোসেন শাহ আর কোন বড় রকমের যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়ার জন্য তিনি নিজের কর্মশক্তিকে তাঁর রাজ্যের প্রজাদের মঙ্গলের জন্য নিয়োজিত করেছিলেন। তখন ভারতের অন্যান্য সব অঞ্চলের মত গৌড়েও ‘শকাব্দ’ প্রচলিত ছিল। জনসাধারণ সেই অব্দের হিসাব ধরেই নিজেদের কাজকর্ম করতেন, কিন্তু তখনকার শাসনকার্যে ইসলামী ‘হিজিরাব্দ’ ব্যবহার করা হত। ‘হজরত মহম্মদ’ কোরেশদের উপদ্রব থেকে আত্মরক্ষার জন্য ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই তারিখের সন্ধ্যাগমের পরে যখন মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে গিয়েছিলেন, সেই সময় থেকেই ওই অব্দের প্রবর্তন হয়েছিল। গৌড়ে এসে তুর্কীরা সেই অব্দ প্রচলিত করবার পর থেকে তৎকালীন জনসাধারণ সেটাকে মেনে নিলেও, চান্দ্রমাসের অনুধাবন করাটা তাঁদের আয়ত্বের বাইরে ছিল। এর ফলে সেই সময়ের রাজকার্য্যের জন্য হিজিরাব্দ ও জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনের জন্য শকাব্দ ব্যবহার করা হত। ওই ধরণের দ্বৈত অব্দ ব্যবস্থায় যথেষ্ট সমস্যার সৃষ্টি হোলেও সুলতানরা যেমন হিজিরাব্দ ছাড়েন রাজী ছিলেন না, প্রজারও তেমনি শকাব্দকে ত্যাগ করতে রাজী ছিলেন না। হোসেন শাহ দেখতে পেয়েছিলেন যে, সেই দুই অব্দের সন তারিখের জটিলতার ফলে বহু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু সমাধান কিছুই হচ্ছে না। তাই তিনি তাঁর উজীর ‘গোপীনাথ বসু’, ‘মুকুন্দ দাস’, ‘স্মার্ত রঘুনন্দন’ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করে, অতীতের গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের চালু করা ‘বঙ্গাব্দ’কে কিছুটা সংশোধন করে একটি নতুন বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর চালু করা সেই অব্দটিও পয়গম্বরের হিজিরার দিন থেকেই শুরু হয়েছিল; কিন্তু সেটিতে ইসলামী চান্দ্রমাসের পরিবর্তে ভারতীয় সৌরমাস ধরে বছর গণনা করবার রীতি চালু করা হয়েছিল। সৌর বছর ৩৬৫ দিনে হয়, পক্ষান্তরে চান্দ্রমাস হয় ৩৫৫ দিনে। সূক্ষ্মভাবে হিসাব করে উভয় বছরের মধ্যে ১০ দিন ২১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের পার্থক্য দাঁড়ায়। সেই পার্থক্য অনুসারে নতুন বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের সময়ে হিজিরাব্দের সঙ্গে সেটির ব্যবধান ছিল ৯ বছর। এখন সেই ব্যবধান আরো বেড়েছে।
হোসেন শাহ আরব পিতার বাঙালী পুত্র ছিলেন। গৌড়ের মাটিতেই তাঁর জন্ম হয়েছিল, এবং গৌড়কে তিনি যেভাবে নিজের করে নিয়েছিলেন, তাঁর আগের কোন সুলতানই সেটা করতে পারেন নি। বখতিয়ারের সময় থেকে যাঁরা গৌড় রাজ্যের শাসনদণ্ড পরিচালনা করেছিলেন, তাঁরা শাসক ও শাসিতের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রেখে চললেও, হোসেন শাহের সময় থেকেই সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। তিনি প্রজাদের আশাআকাঙ্খার যথেষ্ট মর্য্যাদা দিয়েছিলেন। তাই মুঙ্গের থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর রাজ্যে কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নি। তিনি নিজে একজন ধৰ্ম্মনিষ্ঠ মুসলিম হলেও, তাঁর আগেকার অধিকাংশ মুসলমান সুলতানের মত ধর্মান্ধ ছিলেন না। মুসলমান ফকিরদের মত হিন্দু সাধুরাও তাঁর কাছে যথেষ্ট সমাদর পেতেন। তাঁর সময় থেকেই হিন্দুরা রাজসরকারে সর্বোচ্চ পদে নিযুক্ত হতে শুরু করেছিলেন। অবশ্য আগেও অধিকাংশ সরকারী কাজ তাঁদের করতলগত ছিল, কিন্তু তখন তাঁদের নির্দেশ দেওয়ার জন্য উপরে একজন করে মুসলমান অফিসার বসে থাকতেন। হোসেন শাহ তাঁর প্রশাসনের বিভাগীয় অধ্যক্ষ, এমন কি প্রধান মন্ত্রীত্বের পদেও হিন্দুদের নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর উজীর গোপীনাথ বসুর কর্মদক্ষতার জন্য শাসনযন্ত্রের যথেষ্ট উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছিল। গোপীনাথ হোসেন শাহের রাজস্ব বিভাগকে এমনভাবে ঢেলে সাজিয়েছিলেন যে, তার ফলে রাজস্ব আদায় শুধু যে সুশৃঙ্খলিত হয়েছিল তা নয়, যথেষ্ট বৃদ্ধিও পেয়েছিল। ‘কেশব ছত্রী’ ছিলেন সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর অধ্যক্ষ; ইতিপূর্বে কোনও হিন্দুকে সেই ধরণের দায়িত্বপূর্ণ কোন পদে নিযুক্ত করা হয় নি। ‘রূপ’ ও ‘সনাতন’ নামক দুই ভাই ছিলেন হোসেন শাহের ‘দবির-ই-খাস’ ও ‘সকর মল্লিক’ – সুলতানের নিজস্ব বিভাগের সর্বাধিনায়ক। বৈদ্য ‘মুকুন্দ দাস’ ছিলেন তাঁর নিজস্ব চিকিৎসক। প্রাসাদের কারো অসুখ হলে সেই চিকিৎসকেরই ডাক পড়ত। টাঁকশালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কায়স্থ ‘অনুপের’ উপরে। তাঁর নির্দেশে বিভিন্ন মানের মুদ্রা প্রস্তুত করা হত। পরবর্তী কালে সপ্তদশ শতাব্দীতে দিল্লীতে বাদশাহ আকবর যা করেছিলেন, তার দুই শতাব্দী আগে পঞ্চদশ শতাব্দীতে গৌড়ে হোসেন শাহ সেটাই করেছিলেন। গৌড়ের চারিদিকে উড়িষ্যা, নেপাল, কামতা ও ত্রিপুরার মত শক্তিশালী হিন্দু রাজ্য রয়েছে জেনেও তিনি বহু হিন্দুকে তাঁর সৈন্য বিভাগের উচ্চপদে নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়া অন্যান্য বিভাগেও বহু হিন্দু দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়ে হোসেন শাহের রাজ্যের সংহতি সাধন করেছিলেন। গৌড় থেকে সেনশক্তির নিষ্ক্রমণের পরে সেই রাজ্যের উপরে যে অমানিশা নেমে এসেছিল, হোসেন শাহের সময়ে সেটার অবসান ঘটেছিল। যে প্রতিভা শাসনযন্ত্রের চাপে রুদ্ধশ্বাস হয়ে মরতে বসেছিল, তাতে নতুন জীবনের ছোঁয়াচ লেগে তা দিকে দিকে প্রসার লাভ করেছিল। এর আগে হাবসী সুলতানদের উৎপীড়নের জন্য নবদ্বীপ প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। হোসেন শাহের অভ্যুত্থানের ফলে সেখানে নূতন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছিল। হোসেন শাহের আমলেই গৌড়ের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ধর্মপ্রচারক শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর কর্মজীবন উড়িষ্যায় কাটলেও নিজের জন্মভূমি গৌড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। হোসেন শাহ চৈতন্যের প্রতি কোন বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন নি। তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য যে সব ভক্ত জগন্নাথক্ষেত্রে যেতেন, তিনি কোন দিনই তাঁদের যাত্রাপথে বাধার সৃষ্টি করেন নি। স্মার্ত রঘুনন্দন হোসেনী যুগের বাংলার আরেক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন। বঙ্গদেশে প্রথম আগমনের পর থেকে তুর্কীরা তৎকালীন হিন্দুসমাজের উপরে বিরামহীন আঘাত হেনে যে ফাটলের সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে জনসাধারণ নিজেদের সমাজব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। রঘুনন্দন সেই মুমূর্ষু সমাজে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। পূর্ববর্তী সুলতানদের মত হোসেন শাহ যদি তীব্র হিন্দুবিরোধী হোতেন, তাহলে রঘুনন্দনের প্রতিভাবিকাশ আদৌ কখনো সম্ভব হত কিনা – সেটা বলা শক্ত। তবে কিছু প্রশ্ন অবশ্যই থেকে যায়।

অতীতে ‘রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’ তাঁর ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান’ গ্রন্থের একাধিক প্রবন্ধে “হোসেন শাহ স্বীয় প্রকৃতি ও কৃতকার্য্যের জন্য হিন্দুদিগের বিরূপ ভয় ও অবিশ্বাসের কারণ হইয়াছিলেন”, সেটা দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। এক্ষেত্রে রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত মোটামুটিভাবে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু তাঁর সেই আলোচনার একটি প্রধান ত্রুটি ছিল যে, তিনি কয়েকটি অপ্রামাণিক সূত্রের উক্তিকে প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত করেছিলেন; যেমন – ঈশান নাগরের ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’, ‘প্রেম বিলাস’ ও ‘বৃহৎ সারাবলী’। তিনি যেগুলোকে সমসাময়িক ও প্রামাণিক সূত্র বলে মনে করেছিলেন, সেই ঈশান নাগরের ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’ আসলে একটি জাল গ্রন্থ, বাস্তবে সেটি অনেক পরবর্তীকালের রচনা; ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থের একটি বৃহৎ অংশ প্রক্ষিপ্ত, এবং ‘বৃহৎ সারাবলী’ নিতান্তই একটি অর্বাচীন গ্রন্থ – সেটি ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে রচনা করা হয়েছিল। তাছাড়া রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যে সমস্ত ঘটনা হোসেন শাহের রাজত্বকালে ঘটেছিল বলে মনে করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলিই হোসেন শাহের রাজত্ব সুরু হওয়ার অনেক আগে ঘটেছিল; যেমন – গৌড়েশ্বর কর্তৃক ‘নদীয়া উচ্ছন্ন’ করা এবং ‘হরিদাস ঠাকুরের’ উপরে নির্যাতন। এছাড়া তিনি বিজয় গুপ্তের সাক্ষ্যও তাঁর লেখায় উদ্ধৃত করেছিলেন; কিন্তু বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’, হোসেন শাহের সিংহাসনে আরোহণের প্রায় ন’বছর আগে লেখা হয়েছিল। অবশ্য রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দুদের প্রতি হোসেন শাহের আচরণ সম্বন্ধে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও অনেক উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। তবে একই সাথে এটাও বলে রাখা দরকার যে, এই সমস্ত দৃষ্টান্ত থেকে পরধর্ম সম্বন্ধে হোসেন শাস্ত্রের অনুদারতার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাঁর ধর্মোন্মত্ততার কোন প্রমাণ কিন্তু ইতিহাসে পাওয়া যায় না। হোসেন শাহ হিন্দুধর্ম তথা পরধর্মের উপর বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না, তাই সময়ে সময়ে তিনি হিন্দুদের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছিলেন – একথা সত্যি। কিন্তু তিনি যে ‘ফিরোজ শাহ তুঘলক’, ‘সিকন্দর লোদী’ বা ‘ঔরংজেবের’ মত ধর্মোন্মাদ ছিলেন না, সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মনে কোন সন্দেহ নেই। হোসেন শাহ যদি সত্যিই ধর্মোন্মাদ হতেন, তাহলে নবদ্বীপের কীর্তন বন্ধ করতে গিয়ে সেখানকার কাজী ব্যর্থতা বরণ করবার পরে, তিনি নিজেই অকুস্থলে উপস্থিত হতেন এবং জোর করে কীর্তন বন্ধ করে দিতেন। এমনকি নির্দেশ অমান্য করবার জন্য চৈতন্যকে বন্দি করবার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। কিন্তু তিনি সেসবের কিছুই করেন নি। তাঁর রাজত্বকালে কয়েকজন মুসলমান হিন্দু-ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ‘কবিকর্ণপুর’ লিখিত ‘চৈতন্য চন্দ্রোদয়’ নাটক ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, শ্রীবাসের মুসলমান দর্জি চৈতন্যদেবের রূপ দেখে প্রেমে পাগল হয়ে মুসলমানদের তিরস্কার এবং তাড়নাকে অগ্রাহ্য করে হরিনাম ও কীর্তন করেছিলেন, আর উৎকল-সীমান্তের মুসলমান সীমাধিকারী নিজেই ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে চৈতন্যদেবের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ইতিপূর্বে-নিযাতিত ‘যবন হরিদাস’ হোসেন শাহের রাজত্বকালে তাঁর রাজ্যে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন এবং নবদ্বীপে নগর সঙ্কীর্তনের সময়ে একেবারে সামনের সারিতে থাকতেন। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ‘পরাগল খান’ ও তাঁর পুত্র ‘ছুটি খান’ হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ মহাভারতের পাঠ শুনতেন। ঐসব ব্যাপার, অন্ততঃ শেষ ব্যাপারটা হোসেন শাহের কাছে অজানা থাকবার কথা ছিল না। কিন্তু হোসেন শাহ যখন তাঁদের কোন শাস্তি দেন নি, তখন বুঝতে হবে যে তিনি মোটেও ধর্মোন্মাদ ছিলেন না। একই সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, তাঁর রাজধানীর খুব কাছেই ‘রামকেলি’, ‘কানাই-নাটশালা’ প্রভৃতি গ্রামে বহু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব বাস করতেন। ‘রাজমালা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, হোসেন শাহের হিন্দু সৈন্যেরা ত্রিপুরায় যুদ্ধ করতে গিয়ে ‘গোমতী’ নদীর তীরে পাথরের প্রতিমা পূজা করেছিল। হোসেন শাহ যদি সত্যিই ধর্মোন্মাদ হতেন, তাহলে ঐসব ব্যাপার কিছুতেই সম্ভব হত না। আসল কথা হল, হোসেন শাহ একজন বিচক্ষণ ও রাজনীতিচতুর নরপতি ছিলেন। হিন্দুধর্মের প্রতি অত্যধিক বিদ্বেষের পরিচয় দিলে অথবা হিন্দুদের মনে বেশী আঘাত দিলে সেটার ফল যে বিষময় হতে পারে, সেটা তিনি জানতেন। তাই তাঁর হিন্দু বিরোধী কার্যকলাপ সংখ্যায় অল্প না হলেও সেগুলো কোনদিনই একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে যায় নি।

(তথ্যসূত্র:
১- Eastern India, F. Buchanon Hamilton.
২- চৈতন্য চরিতামৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ।
৩- চৈতন্য ভাগবত, বৃন্দাবন দাস।
৪- আসামর বুরঞ্জী, পদ্মনাথ গোঁহাই বড়য়া।
৫- History of Assam, বানেশ্বর ও শুক্রেশ্বর।
৬- Ahalis-ul-Khwanin, Hamidullah.
৭- বাংলার ইতিহাস: ১২০৪-১৫৭৬: সুলতানী আমল, সুখময় মুখোপাধ্যায়।
৮- মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস: সুলতানী আমল: ত্রয়োদশ থেকে ষষ্ঠদশ শতাব্দী, অনিরুদ্ধ রায়।
৯- আদি ও মধ্যযুগে ভারত: ৬৫০-১৫৫৬, সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’‘পুরানো কলকাতার একটি মুদির দোকান’

রানা চক্রবর্তীঃ ১৯৪০-এর দশকে কেউ যদি সর্বদেশীয় মেয়েদের নামের মিলন যদি দেখতে চাইতেন, তাহলে তাঁর পুরানো কলকাতার একটি ষ্টীমার ঘাটে গেলেই চলত। সেখানে তখন থরে থরে গঙ্গার বুকের উপরে বাড়ির

‘কররানি বংশের কথা’‘কররানি বংশের কথা’

রানা চক্রবর্তীঃ আফগানিস্থানের ‘কুরম’ উপত্যকার অধিবাসী কররানিরা অন্য সব আফগানের মত হিন্দুস্থানে এসে প্রথমদিকে বিভিন্ন হিন্দু রাজা ও তুর্কী সুলতানের সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতেন। তুর্কীদের পতনের পরে ‘বহলোল লোদী’ যখন দিল্লীতে

অপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারাঅপরের স্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়েরা হত রাজার যৌন লালসার শিকার! ইতিহাসের অধঃপতনকারী রাজারা

বর্তমানে একটা দেশ শাসন করে সরকার কিন্তু পূর্বে সেই শাসনভার ছিল রাজ রাজা ও সম্রাটদের হাতে। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে অনেক দয়ালু রাজার জনগণের প্রতি প্রেমের ব্যাখ্যা তো কিছু

পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধপৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জানিয়েছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর সবচেয়ে চিন্তার কারন ছিল জার্মানির ইউবোট। তিনি আরও জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন ব্রিটেনের যুদ্ধ হচ্ছিল তখন