রানা চক্রবর্তীঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে ইউরোপীয় কেম্পানিগুলির ব্যবসা সরকারি ব্যবসা (Public trade); আর কোম্পানিগুলির কর্মচারী, লাইসেন্সধারী স্বাধীন বণিক (free merchant) ও লাইসেন্সহীন বেআইনি বণিকদের (interloper) ব্যবসা একত্রে বেসকারি ব্যবসা (private rade) নামে অভিহিত হত। অর্থাৎ, ইউরোপীয় বণিকদের ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবসাই তখন বেসরকারি ব্যবসা নামে পরিচিত ছিল। সেই সময়ে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা তাঁদের নিয়োগপত্রের সঙ্গেই ব্যক্তিগত ব্যবসা করবার অধিকার লাভ করতেন। (ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল, পৃ- ১৮) তাঁদের সঙ্গে হওয়া কোম্পানির চাকরি সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে (covenant) পরিষ্কার ভাবে জানানো হত যে, বঙ্গদেশে কোম্পানির চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় তাঁরা বিনাবাধায় ব্যক্তিগত ব্যবসা করতে পারবেন। উক্ত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কোম্পানির কর্মচারীদের সেই অধিকার বজায় ছিল। যদিও অষ্টাদশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সেই স্বাধীনতার উপরে নানা ধরণের বিধি নিষেধ আরোপ করা শুরু হয়েছিল। ওই শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে ফরাসি কোম্পানিগুলি তাঁদের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা করবার অধিকার দিয়েছিল। ওলন্দাজ কোম্পানির কর্মচারীরা ওই শতাব্দীর পঞ্চম দশক থেকে বঙ্গদেশে ব্যক্তিগত ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাঁরা ছাড়াও দিনেমার, অস্টেণ্ড ও প্রাশিয়ান কোম্পানির কর্মচারীরাও সেই অধিকার ভোগ করতেন। তখন শুধুমাত্র কোম্পানির চাকরি নয়, ব্যক্তিগত ব্যবসা করে ধনবান হওয়ার উদ্দেশ্যেও ইউরোপীয়রা ভারতে আসতেন। দেশে ফিরে স্বচ্ছল ভদ্রলোকের জীবন যাপনের আশাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয়রা দুস্তর সাগর পেরিয়ে সুদূর ভারতবর্ষে আসবার উৎসাহ পেতেন (incentive)। সেযুগে শুধু ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারীরা নন; ধর্মযাজক, ডাক্তার ও সৈন্যবাহিনীর অফিসারেরা পর্যন্ত সেই ধরণের ব্যবসায়ে যোগ দিতেন। তখন ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সর্বশ্রেণীর কর্মচারীরা – গভর্ণর থেকে রাইটার – সকলেই বঙ্গদেশে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা করবার সুযোগ পেতেন। তাছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বণিকেরাও কোম্পানির অনুমতি নিয়ে কোম্পানির তত্ত্বাবধানে বাণিজ্য করতেন, তাঁরা স্বাধীন বণিক নামে পরিচিত ছিলেন। এঁরা ছাড়াও আরো কিছু বণিক তখন ছিলেন যাঁরা কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার অস্বীকার করেই ভারতে ব্যবসা করতে আসতেন। তাঁরা ছিলেন বেআইনি বণিক বা ‘interloper’। কোম্পানি তাঁদের সবধরণের কাজ কর্মের উপরে নিজেদের তীক্ষ্ণ নজর রাখত, এবং ধরা পড়লে তাঁদের বন্দী করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিত। তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবসার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে কোম্পানির কর্মচারীরা স্বাধীন বা বেআইনি বণিক কাউকেই বিশেষ পছন্দ করতেন না। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি তখন তাঁদের কর্মচারীদের কম বেতন দিত বলে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবসা করবার অধিকারও তারা মেনে নিত। প্রাক-পলাশী যুগে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন খুবই কম ছিল। সেযুগে একজন ইংরেজ গভর্ণর সব মিলিয়ে ২৪০ পাউণ্ড বার্ষিক বেতন পেতেন, একজন কাউন্সিলর পেতেন ৪০ পাউণ্ড, একজন ফ্যাক্টর ১৬ পাউণ্ড ও একজন রাইটার মাত্র ৫ পাউণ্ড বেতন পেতেন। (প্রাক-পলাশী বাংলা, সুবোধ কুমার মজুমদার, পৃ- ১৫৮) যদিও ওই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কর্মচারীদের বেতন কিছুটা হলেও বেড়েছিল। সেই সময়ে একজন কাউন্সিলরের বার্ষিক বেতন হয়েছিল ২৫০ পাউণ্ড, একজন ফ্যাক্টর পেতেন ১৪০ পাউণ্ড, এবং একজন রাইটার পেতেন ১৩০ পাউণ্ড। (হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ৩য় খণ্ড, জেমস মিল, পৃ- ১২ – পাদটীকা সহ) অবশ্য বেতনের সঙ্গে আহার, বাসস্থান, চাকর, জল প্রভৃতি বিভিন্ন খাতে নানারকম ভাতাও তাঁরা পেতেন। কিন্তু তৎকালীন বঙ্গদেশে ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারীরা এবং স্বাধীন বণিকেরা বেশ আড়ম্বরপূর্ণ জীবনই যাপন করতেন। কোম্পানির সামান্য বেতন তাঁদের ওই ধরণের রাজকীয় জীবন যাপনের জন্যে যথেষ্ট ছিল না। চাকর, পরিচারক, দোভাষী, মালি, সহিস, রাঁধুনী প্রভৃতিদের নিয়ে তাঁরা নিজেদের সংসার সাজাতেন, এবং তার সঙ্গে থাকত তাঁদের ব্যক্তিগত পাল্কি, বেহারা, কুকুর, ঘোড়া প্রভৃতি। ফলে প্রচুর অতিরিক্ত অর্থের যোগানের জন্যও তখন তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবসা করবার প্রয়োজন হত। কোম্পানিগুলি তখন তাঁদের কর্মচারীদের সৎভাবে ও ন্যায়সঙ্গত পথে ব্যবসা করবার অধিকার দিলেও, কোম্পানির একচেটিয়া অধিকাররূপে বিবেচিত ইউরোপ-এশীয় বাণিজ্য কিন্তু তাঁদের নাগালের বাইরেই থাকত। কোম্পানির কর্মচারী ও স্বাধীন বণিকেরা এদেশীয় বেনিয়ান, গোমস্তা, মুন্সী ও সরকারদের মাধ্যমে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এদেশীয়দের পুঁজি, ব্যবসায়ী সংগঠন, ব্যবসায়ী বুদ্ধি, শ্রম ও দক্ষতা তখনকার ইউরোপীয় বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের প্রধান স্তম্ভ ছিল বলা যেতে পারে। কোম্পানির নবাগত রাইটারদের কেন্দ্র করে এদেশীয় বেনিয়ান ও গোমস্তাদের মধ্যে তখন রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। প্রাক-পলাশী যুগে তাঁরা বেশিরভাগই বৈশ্য সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন; যদিও পলাশী-উত্তরকালে এদেশের অনেক উচ্চবর্ণের হিন্দুও সে কাজ করতেন। তাঁরা একই সঙ্গে ইউরোপীয়দের দোভাষী, দালাল, হিসাবরক্ষক, সেক্রেটারি, পুঁজির যোগানদার ও খাজাঞ্চী হিসাবে কাজ করতেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, এন. কে. সিংহ, ১ম খণ্ড, পৃ- ১০১) বেনিয়ান ও গোমস্তারা এদেশের হালচাল, গোপন কাজকর্ম, ছোটখাট জালিয়াতিতে রপ্ত লোক ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে ইউরোপীয়রা শুধু তাঁদের নামটাই ধার দিতেন, এবং সেটার বিনিময়েই তাঁরা ব্যবসায়ের লভ্যাংশ পেতেন। তখন একজন বেনিয়ান একই সময়ে অনেকের হয়ে ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন। ইউরোপীয় বণিক ও এদেশীয় বেনিয়ানদের মধ্যে সেই সময়ে প্রায়শঃই একটি অবিশ্বাসের মনোভাব দেখতে পাওয়া যেত। সুযোগ পেলেই তাঁরা একে অন্যকে ফাঁকি দিতে কোন দ্বিধা করতেন না। সে যুগের ইংরেজ বণিক ও এদেশীয় বেনিয়ানদের মধ্যে বিশ্বস্ততার একটি বাতিকুম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল ‘উইলিয়াম ল্যাম্বার্ট’ ও তাঁর বেনিয়ান ‘বলরাম মজুমদারের’ মধ্যেকার সম্পর্ক। ‘রামকিশোর ঘোষ’, ‘লক্ষ্মণ’, ‘দুর্গাচরণ মিত্র’, ‘শেখ জাওদি’, ‘গোকুল ঘোষাল’, ‘বারাণসী ঘোষ’, ‘হৃদয়রাম ব্যানার্জী’, ‘অঙ্কুর দত্ত’, ‘জয়নারায়ণ ঘোষাল’ ও ‘মনোহর মুখার্জি’ – অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার উল্লেখযোগ্য বেনিয়ান ছিলেন। পলাশী-উত্তর যুগে বাংলার ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেকেই, যথা – ‘মহারাজা নবকৃষ্ণ’, ‘গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ’, ‘কৃষ্ণকান্ত নন্দী’ প্রভৃতি – ইউরোপীয়দের বেনিয়ানের কাজ করেছিলেন। তখন বেনিয়ান ও গোমস্তা ছাড়াও ইউরোপীয় বণিকেরা কোম্পানির সরকারি বাণিজ্যের মত দাদনি ব্যবসায়ী, দালাল ও পাইকারদের মাধ্যমে উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ব্যবসা করতেন। ওই সময়ে ইউরোপীয় বণিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্রে কতগুলি ঝুঁকি নিতে হত। প্রথমতঃ, চড়া সুদে তাঁদের ব্যবসায়ীক পুঁজি যোগাড় করতে হত। দ্বিতীয়তঃ, ব্যবসা পরিচালনার জন্য তাঁদের এদেশীয় বেনিয়ান ও গোমস্তাদের উপরে নির্ভর করতে হত। তাঁরাই অনেক সময়ে ব্যবসায়ে ক্ষতির কারণ হতেন। তৃতীয়তঃ, এদেশে এশীয় দেশগুলিতে রাজনৈতিক অশান্তি ও জবরদস্তি শুল্ক আদায়ও অনেক সময়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু সেসব ঝুঁকি নিয়েও ইউরোপীয় বণিকেরা এদেশে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে আগ্রহী ছিলেন, কারণ, তখন এদেশের ব্যবসায়ে তাঁদের লাভ অনেক বেশি হত। ১৭৭৬ সালে ‘এ্যাডাম স্মিথ’ বাণিজ্যে ৮ থেকে ১০ শতাংশ লাভকে যথেষ্ট বলে মনে করেছিলেন। সেখানে ১৭৬৭ সালেই বঙ্গ দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সাধারণভাবে লাভের অংক ২০ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। (ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল, পৃ- ৪৯) ওই সময়ে বঙ্গদেশে চালের ব্যবসায়ে লাভের পরিমাণ ছিল ২৫ শতাংশ। তখন অন্যান্য অনেক জিনিসেই বিভিন্ন সময়ে লাভের পরিমাণ আরো বেশি হত। ১৭৬৪ সালে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে লাভের পরিমাণ ১০০ শতাংশ হবে বলে আশা করা হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের ষাটের দশকে বাংলার তিনটি প্রধান নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য – লবণ, সুপরি ও তামাকের ব্যবসায়ে মাঝেমাঝেই লাভের পরিমাণ ৭৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন সমুদ্র বাণিজ্যেও মাঝেমাঝেই অনুরূপ লাভের অঙ্ক দেখতে পাওয়া যেত। ওই একই সময়ে ইংরেজ ও ওলন্দাজরা পারস্যের সঙ্গে যে ব্যবসা করতেন, তাতে তাঁদের ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ লাভ হত। (ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল, পৃ- ৪৯) এখানে তথ্যের খাতিরে অষ্টাদশ শতকের ষাটের দশকে দু’জন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লাভের অঙ্কটা উল্লেখ করলে সাধারণভাবে তখনকার ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লাভের পরিমাণ সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতে পারে। মুর্শিদাবাদ দরবারের বৃটিশ রেসিডেন্ট ‘ফ্রান্সিস সাইকস’ (Sykes) সোরা, সিল্ক ও কাঠের ব্যবসায়ে নিজের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাত্র দু’বছরেই ব্যবসা ও সালামি থেকে তিনি বারো থেকে তেরো লক্ষ টাকা আয় করেছিলেন। তখন কোম্পানির উচ্চপদস্থ প্রভাবশালী কর্মচারীরা বিনা পুঁজিতেই নিজেদের ব্যবসা করতেন। হেস্টিংসের বন্ধু ‘বারওয়েল’ ১৭৬৭ সালে একটি চিঠিতে স্বদেশে তাঁর পিতাকে লিখেছিলেন যে, শুধু সোরার ব্যবসা থেকেই তাঁর ৫০,০০০ টাকা আয় হচ্ছে, অথচ তাঁকে এক টাকা দাদনও দিতে হচ্ছে না! তাঁর কাঠের ব্যবসাতেও সেই একই অবস্থা ছিল। শুধুমাত্র সিল্কের ব্যবসায়ে তাঁকে অগ্রিম দিতে হয়েছিল। ওই তিনটি ব্যবসাতেই তিনি সরকারি প্রভাব খাটিয়েছিলেন, এবং অব্যর্থভাবে তাঁর বার্ষিক মোট আয় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ২,৫০,০০০ টাকা। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, এন. কে. সিংহ, ১ম খণ্ড,
পৃ- ২২৩)
এই প্রবন্ধের আলোচনার সুবিধার্থে অষ্টাদশ শতাব্দীর বেসরকারি বাণিজ্যকে চারভাগে ভাগ করা যেতে পারে – (১) বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ইউরোপীয় বণিকদের অংশ গ্রহণ, (২) আন্তঃপ্রাদেশিক ও উপকূল-ভাগের সঙ্গে বাণিজ্য, (৩) এশিয়ার বিভিন্ন দেশের (পশ্চিম, পূর্ব এশিয়া সুদূর প্রাচ্যের চীন) সঙ্গে বাণিজ্য ও (৪) ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য। প্রথম তিন শ্রেণীর বাণিজ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয়রা নির্ভয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারতেন। ওই সময়ে ইউরোপের সঙ্গে সাধারণতঃ মূল্যবান পাথর, হীরা, জহরত, মণিমুক্তো ইত্যাদির মাধ্যমে বাণিজ্য চলত। এছাড়া অন্য দেশের জাহাজেও কিছু কিছু পণ্য আমদানি রপ্তানি চলত। তৎকালীন বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রথম বৈশিষ্ট্য ছিল যে, প্রাক-পলাশী যুগে কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করতেন, এবং তাঁদের বেসরকারি বাণিজ্যের জন্য কোম্পানির দস্তক ব্যবহার করে তাঁরা এদেশীয় সরকারকে বাণিজ্য শুল্ক ফাঁকি দিতেন। এর ফলে একটা সময় থেকে এদেশীয় বণিকেরা তাঁদের সঙ্গে সেই অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছিলেন। সেযুগের বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজারের অপর বৈশিষ্ট্যটি ছিল যে, বাংলার নবাবেরা তখন কয়েকটি বিশেষ পণ্য, যেমন – লবণ, সুপারি, তামাক, চুন ইত্যাদি নিজেদের কয়েকজন মনোনীত ব্যক্তিকে ইজারা দিয়ে রাজস্ব নিতেন ৷ ওই পণ্যগুলি তখন এদেশের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছিল, সেজন্য সেগুলিতে লাভও বেশি হত। পলাশীর যুদ্ধের আগেই সেই পণ্যগুলির ব্যবসায়ের সঙ্গে ইংরেজরা যুক্ত হওয়ার ফলে একটা সময়ে বাংলার রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ দেখা দেয়। ১৭২৭ সাল থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে অন্ততঃ সাতবার সেই বিরোধ দেখা দিয়েছিল (সেসবের মধ্যে আবার প্রধান বিরোধীয় বিষয় ছিল লবণের ব্যবসা), এবং প্রতিবারই নবাবকে বেশ মোটা টাকা জরিমানা দিয়ে ইংরেজদের সেই বিরোধগুলি মেটাতে হয়েছিল। ১৭৫৩ সাল থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাদের এজেন্ট ও গোমস্তাদের মাধ্যমে বঙ্গদেশ থেকে পণ্য ক্রয় করা শুরু করেছিল। এর ফলে কোম্পানির সরকারি ব্যবসা ও কোম্পানির কর্মচারীদের বেসরকারি ব্যবসা একত্রিত হওয়ার ফলে বেসরকারি ব্যবসা আরো প্রসার লাভ করেছিল। সেই পর্বে কোম্পানির দস্তক এদেশীয় বণিক ও স্বাধীন ইউরোপীয় বণিকদের কাছে চড়া মূল্যে বিক্রি করা শুরু হয়েছিল। সেই দস্তকের জোরে এদেশীয় বণিকদের কলকাতায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া পণ্যগুলি কোম্পানির বলে ঘোষিত হত, এর ফলে বাংলা সরকার সেগুলি থেকে কোনো শুল্ক আদায় করতে পারত না। আবার কলকাতা থেকে এদেশীয় ব্যবসায়ীদের জেলায় জেলায় কিনে নিয়ে যাওয়া পণ্যও তখন দস্তকের সুবিধা পেত। ফলে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা কমদামে সেই পণ্য কিনতে পারতেন, এবং ইউরোপ থেকে আমদানি করা জিনিস বেশি দামে বিক্রি করতে পারতেন। (বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭, এস. সি. হিল, ৩য় খণ্ড, পৃ- ৮৪) অর্থাৎ ইংরেজদের কাছে পণ্য বিক্রি করলে বা তাঁদের পণ্য কিনলে কোন সরকারি শুল্ক লাগত না বলে বণিকেরা নির্দ্বিধায় সেই সুবিধা ভোগ করতেন। কিন্তু দস্তকের ওই ধরণের অপব্যবহারের জন্য একটা সময়ে কোম্পানির ডিরেক্টর সভা নিয়মিতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছিল, এবং শেষপর্যন্ত ১৭৫৮ সালে দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করবার জন্য নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল। (লেটার ফ্রম কোর্ট, ৩রা মার্চ ১৭৫৮ সাল) ওই সময় থেকেই কলকাতার কাস্টমস মাষ্টারকে দস্তক ব্যবহারকারীর হিসেব রাখতে বলা হয়েছিল, এবং ইংরেজ স্বাধীন বণিক, এদেশীয় ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে দস্তক দিতে নিষেধ করা হয়েছিল। শুধুমাত্র কোম্পানির কর্মচারীরা শপথ নিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্য দস্তক ব্যবহার করবার অনুমতি পেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ১৭০০ থেকে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত কোম্পানি তাদের কর্মচারীদের বঙ্গদেশে বিনাশুল্কে ব্যক্তিগত বাণিজ্য করবার অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল। তবে ১৭৬২ সাল পর্যন্ত এদেশীয় সরকারের কাছে কোম্পানির কর্মচারীদের বিনাশুল্কে বাণিজ্যটা অনেকটা গোপন ব্যবসাই ছিল। নবাব মীরকাশিমের সময় থেকে সেই ব্যবসা প্রকাশ্যে ও ব্যাপকরূপে দেখা দিয়েছিল।
পলাশী-উত্তর কালে ইংরেজ বণিকেরা বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য – বিশেষ করে সেই সময়ের লাভজনক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাগুলিকে নিজেদের কুক্ষিগত করবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য গ্রাস করবার সেই চেষ্টা শেষপর্যন্ত বাংলার নবাবের অধিকার ও এক্তিয়ারের উপরে আঘাতস্বরূপ দেখা দিয়েছিল। এই সম্পর্কে নবাব মীরকাশিম ১৭৬২ সালের মে মাসে ইংরেজ গভর্ণর ‘ভ্যান্সিটার্ট’কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “এই হল আপনার ভদ্রলোকদের ব্যবহার। আমার দেশের সর্বত্র তাঁরা উপদ্রব করে, জনগণকে লুন্ঠন করে আর আমার কর্মচারীদের অপমান ও জখম করে। … প্রত্যেক পরগনা, গ্রাম ও ফ্যাক্টরিতে তাঁরা লবণ, সুপারি, ঘি, চাল, খড়, বাঁশ, মাছ, চট, আদা, চিনি, তামাক, আফিম এবং অন্যান্য অনেক জিনিস বেচাকেনা করে। আমি আরো অনেক বস্তুর নাম করতে পারি, অপ্রয়োজনবোধে বিরত হলাম। তাঁরা বল প্রয়োগে কৃষক ও বণিকের বিভিন্ন পণ্য এক চতুর্থাংশ দামে ছিনিয়ে নেয়; আবার জবরদস্তি ও অত্যাচারের মাধ্যমে এক টাকার জিনিসের জন্য কৃষককে পাঁচ টাকা দিতে বাধ্য করে। আবার পাঁচটি টাকার জন্য তাঁরা এমন একজন লোককে অপমান ও আটক করে যে একশো টাকা ভূমিরাজস্ব দেয়। তাঁরা আমার কর্মচারীদের কোনোরকম কর্তৃত্ব করতে দেয় না। … প্রতি জেলাতে আমার কর্মচারীরা সমস্ত রকম কাজকর্ম থেকে বিরত আছে; সমস্ত শুল্ক থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে আমার বার্ষিক মোট রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে পঁচিশ লক্ষ টাকা।” (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃ- ২৩) বাখরগঞ্জ থেকে ‘সার্জেন্ট ব্রেগো’র (Sergeant Brego) ১৭৬২ সালের ২৬শে মে তারিখে লেখা চিঠিতেও মীরকাশিমের চিঠিতে বর্ণিত ইংরেজ ও তাঁদের গোমস্তাদের কার্যকলাপের অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। ব্রেগো লিখেছিলেন, “একজন ভদ্রলোক (ইংরেজ). বেচাকেনার জন্য এখানে একজন গোমস্তা পাঠান। ঐ লোকটি সঙ্গে সঙ্গে ধরে নেয় যে প্রতিটি স্থানীয় অধিবাসীকে বলপ্রয়োগে তাঁর জিনিস কিনতে, এবং তাঁকে জিনিস বেচতে বাধ্য করবার মত যথেষ্ট ক্ষমতা তাঁর আছে। যদি কেউ অক্ষমতাবশতঃ অনিচ্ছা প্রকাশ করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বেত্রাঘাত বা কয়েদ করা শুরু হয়। তাঁরা রাজী হলেও যথেষ্ট নয়। এরপর দ্বিতীয় শক্তির ব্যবহার শুরু হয়। বিভিন্ন পণ্য বাণিজ্য তাঁরা কুক্ষিগত করে, এবং সেসব পণ্য কেউ বেচাকেনা করতে পারে না। স্থানীয় কেউ যদি একাজ করে তাহলে তাঁদের ক্ষমতার পুনর্ব্যবহার হয়। আবার তাঁরা যে জিনিস কেনে তার জন্য অন্য বণিকদের চেয়ে বেশ কম দাম দেয়, এবং প্রায়ইসেই দামও দেয় না। আমার হস্তক্ষেপ ঘটলে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানায়। গোমস্তাদের এরকম আরো অনেক বর্ণনাতীত অত্যাচারের ফলে এই স্থানটি (সমৃদ্ধ বাখরগঞ্জ জেলা) ক্রমশঃ জনশূন্য হচ্ছে। অধিবাসীরা প্রতিদিন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শহর ছাড়ছে। যে সমস্ত বাজার আগের দিনে প্রাচুর্যে ভরা ছিল, এখন সেগুলিতে প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না। তাঁদের পিওনরা গরীবদের লুন্ঠন করবার ফলে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। যদি জমিদার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে তাঁর সঙ্গেও অনুরূপ ব্যবহার করা হবে বলে ভয় দেখানো হয়। আগের দিনে শুধুমাত্র সরকারি কাছারিতে বিচার হত। এখন প্রত্যেক গোমস্তাই একজন বিচারক এবং তাঁর গৃহ কাছারি। এমনকি তাঁরা জমিদারদেরও বিচার করে শাস্তি দেয়। তাঁদের পিওনের সঙ্গে ঝগড়া এবং চুরির মিথ্যা অভিযোগ এনে তাঁরা জমিদারদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করে।” (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃ: ২৩-২৪) রানী ভবানীর জমিদারি ও রাজশাহীর অন্যান্য জায়গায় কয়েকজন ইংরেজ বণিকের জবরদস্তিতে ব্যবসা ও অত্যাচারের সংবাদ পেয়ে গভর্ণর ভ্যান্সিটার্ট (১৭৬০-৬৫) ঐ অঞ্চলে অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ‘গঙ্গারাম মিত্ৰ’কে বরকন্দাজসহ সেখানে পাঠিয়েছিলেন। (প্রসিডিংস, ১৭ই জানুয়ারী ১৭৬৩ সাল) অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এলাহাবাদ অঞ্চলে কোম্পানির কর্মচারীদের জবরদস্তি ব্যবসার বিরুদ্ধে কলকাতা কাউন্সিলের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। (প্রসিডিংস অফ সিক্রেট ডিপার্টমেন্ট, ২৬শে এপ্রিল ১৭৬৪ সাল; সিলেকশনস ফ্রম দি আনপাবলিশড রেকর্ডস অফ দ্য গভর্ণমেন্ট: ১৭৪৮-১৭৬৭, রেভারেণ্ড জেমস লঙ, রেকর্ড নং: ৮০২. পৃ- ৫৩৮) নবাব মীরকাশিমের অভিযোগ থেকে আরো জানা যায় যে, তাঁর সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা সারা বঙ্গদেশে ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্যে চারশো থেকে পাঁচশো ফ্যাক্টরি বানিয়ে ফেলেছিলেন। নবাব ৯ শতাংশ হারে বাণিজ্য শুল্কের বিনিময়ে কোম্পানির কর্মচারীদেরকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যাধিকার দিতে চেয়েছিলেন (সেই সময়ে এদেশীয় বণিকদের দেয় বাণিজ্য শুল্কের হার ছিল ২৬ শতাংশ)। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা শুধু লবণের উপরে ২২ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক ছাড়া আর কোনো পণ্যের উপরে শুল্ক দিতে রাজী হননি। শেষপর্যন্ত নবাব বিরক্ত হয়ে দু’বছরের জন্য বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শুল্ক মুক্ত বলে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃ- ৩০) ওই ঘোষণার মাধ্যমে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশীয় বণিকদের কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়াটাই মীরকাশিমের আসল উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তাঁর সেই ঘোষণার পরেই বিশেষ সুবিধাভোগী ইংরেজ বণিকেরা মীরকাশিমকে তাঁদের বেসরকারি বাণিজ্যিক স্বার্থের সবচেয়ে বড় শত্রু ধরে নিয়ে গভর্ণর ভ্যান্সিটার্টকে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য করেছিলেন। সেই সময়ের ইংরেজ বণিকদের আচরণ সম্পর্কে জেমস মিলের অসাধারণ উক্তিটি এখানে স্মরণ করা যেতে পারে – “স্বার্থ মানুষের সমস্তরকম বিচারবোধ এমনকি লজ্জাবোধও কেমন করে নষ্ট করে দেয় সেটার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল এসময়ে কোম্পানির কর্মচারীদের আচরণ।” মীরজাফর মীরকাশিমের সেই আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়ে (১৭৬৩) কোম্পানির কর্মচারীদের সুবিধাজনক ব্যক্তিগত ব্যবসা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এমনকি তাঁর পুত্র ‘নাজমুদ্দৌলা’ও (১৭৬৫) সেই ব্যবসা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, এন. কে. সিংহ, ১ম খণ্ড, পৃ- ৮১) ১৭৬২ সালের সেই ধরণের ব্যবসায় ইংরেজদের লাভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬,৭৩,১১৭ পাউণ্ড বা শতকরা ১০০ ভাগ। ১৭৬৬ সালের ১৭ই মে এবং ১লা নভেম্বর তারিখে কলকাতা কাউন্সিলকে লেখা ডিরেক্টর সভার চিঠিতে কোম্পানির কর্মচারীদের অবৈধ অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলা হয়েছিল যে, বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অংশ নিয়ে কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের আদেশ ও সম্রাটের ফারমান ভঙ্গ করেছেন, এবং তার ফলে যে যুদ্ধ হয়েছিল (মীরকাশিমের সঙ্গে যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধ), সেটার পিছনে ওই ব্যক্তিগত ব্যবসাই প্রকৃত কারণ ছিল। “এই ব্যবসায়ের ক্ষতিপূরণের (যুদ্ধের দরুন) যে বিশাল অঙ্ক তাঁরা দাবী করেছেন তাতে তাঁদের ব্যবসার বিস্তৃতি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি খুলেছে। নবাবী রাজ্যের সর্বত্র হতভাগ্য অধিবাসীদের উপরে এই ব্যবসা নিয়ে যে অত্যাচার করা হয়েছে তা থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে একচেটিয়া ব্যবসা এমনিতেই অনর্থ সৃষ্টি করে, আর যেহেতু ইংরেজরা এখন সর্বময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সেহেতু তাঁদের হাতে এই বাণিজ্য আরো দুর্দশা ও অনর্থের সৃষ্টি করতে সক্ষম।” এর আগে ১৭৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিরেক্টর সভা কোম্পানির কনিষ্ঠতম কর্মচারী রাইটারদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করবার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। তারপরে ১৭৬৪ সালের জুন মাসে তাঁরা গভর্ণরকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিচালনার জন্যে পরিকল্পনা রচনা করতে বলেছিলেন। তারই ফলশ্রুতি দেখা দিয়েছিল ক্লাইভের তিনটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসে – লবণ, সুপারি ও তামাকের একচেটিয়া ব্যবসায়ের পরিকল্পনায় (আগষ্ট, ১৭৬৫ সাল); এর লভ্যাংশ কোম্পানির ষাটজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মধ্যে (সোসাইটি অব ট্রেড) বণ্টন করবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কোম্পানি কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি। তাই তাঁরা সরকারি তত্ত্বাবধানে ওই ধরনের একচেটিয়া ব্যবসা তুলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ তাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছিল, এবং বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ক্ষেত্রের অবাধ ও মুক্ত পরিবেশ ক্ষুন্ন হয়েছিল। (লেটার ফ্রম কোর্ট, ১৭ই মে, ১৭৬৮ সাল; কনসিডারেশন্স অন ইন্ডিয়ান এ্যাফেয়ার্স, উইলিয়ম বোল্টস, পৃ: ১৭০-৮৮; সিলেক্ট কমিটি প্রসিডিংস, ৪ঠা আগস্ট, ১৭৬৭ সাল)
কিন্তু ‘সোসাইটি অব ট্রেড’ তুলে দিয়েও তখন বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোন উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়নি। তারপরেও কোম্পানির কর্মচারীরা এদেশীয় কর্মচারীদের মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বেসরকারি ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৭৭৩ সালে ‘লর্ড হেস্টিংস’ সেই দস্তক তুলে দিয়ে, এবং সবার জন্য ২ শতাংশ হরে শুল্ক ধার্য করে সমস্যার আংশিক সমাধান করেছিলেন। (ইকনমিক এ্যানালিস অব বেঙ্গল, জে. সি. সিংহ, পৃ- ১৫৮) ওই বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে একটি আদেশ জারি করে তিনি কোম্পানির কর্মচারীদের বিনাশুল্কে বাণিজ্যাধিক্যর বজায় রেখেও দস্তকের অপব্যবহার ও সরকারের শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থায় তখন প্রত্যেককে প্রথমে ২২ শতাংশ হারে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শুল্ক দিতে হত। যদিও পরে কোম্পানির কর্মচারীরা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্য প্রদত্ত সেই শুল্ক ফেরত পেতেন (drawback system)। হেস্টিংসের চলি করা ওই ব্যবস্থায় এদেশীয় বণিকদের কাছে কোম্পানির দস্তক বিক্রি করে সরকারি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রথা বন্ধ হয়েছিল। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং এ্যাক্টে রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া তখন কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীদের ক্ষেত্রে, স্বনামে ও বেনামে, প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে লবণ, সুপারি, তামাক ও চালের ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণ করা বেআইনি বলে ঘোষিত হয়েছিল। ১৭৮৮ সালে ‘লর্ড কর্ণওয়ালিশ’ কোম্পানির রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের অধিকার রহিত করেছিলেন। তবে তিনি অবশ্য তাঁদের বেতন ও কমিশন অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে কোম্পানির শুধুমাত্র বাণিজ্য বিভাগের কর্মচারীদের কতগুলি শর্তাধীনে সেই অধিকার রজায় রাখা হয়েছিল। সেই শর্তগুলি ছিল – (ক) কোম্পানির কমার্শিয়াল এজেন্টরা আগে কোম্পানির পণ্য কিনে তবেই নিজের ব্যবসার জন্য পণ্য কিনতে পারবেন। (খ) তিনি উৎপাদকদের কাছে কোম্পানি ও তাঁর নিজের ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দেবেন। (গ) কোম্পানির পণ্যের ক্রয়মূল্যকে মাপকাঠি করে তিনি নিজের কোন পণ্য কিনতে পারবেন না। (ঘ) তিনি কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে নিজের প্রভাব বিস্তার করে অন্য বণিকদের কোনো ধরণের ক্ষতি করতে পারবেন না। (ঙ) অন্যান্য্য বণিকদের সঙ্গে সমপর্যায়ে আইনানুগভাবে তাঁর বাণিজ্য বিরোধের নিষ্পত্তি করতে হবে। (চ) তিনি কোম্পানির বাণিজ্য পরিচালনায় কোনো রকমের কমিশন নেবেন না; নিজের পুঁজির উপরে নির্ভর করেই তাঁকে বাণিজ্য করতে হবে। (ছ) নিজের আড়ঙে অন্য কোনো ব্যক্তির নামে তিনি ব্যবসা করতে পারবেন না। (জ) তিনি আড়ঙে যে পণ্য কিনবেন তা সেখানে বিক্রি করা চলবে না বা অন্য কোনো বিদেশী কুঠিতে পাঠানো যাবে না। যদি কলকাতা বা উত্তর ভারতে সেই পণ্য পাঠানো হয় তাহলে সেক্ষেত্রে শুল্ক চৌকিতে তাঁর নামেই নথিবদ্ধ করতে হবে। (ঝ) প্রতিবছর ১৫ই ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে তাঁর ব্যবসায়ের সম্ভাব্য বার্ষিক হিসাব – ১লা মে থেকে ৩০ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত বোর্ড অব ট্রেডের কাছে দাখিল করতে হবে। বোর্ড সেই হিসেব তাঁদের মন্তব্যসহ গভর্ণর জেনারেলের কাছে বিবেচনার জন্য পাঠাবে। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, এন. কে. সিংহ, ১ম খণ্ড, পৃ- ৮৯) ইতিপূর্বে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা অমন কঠোরভাবে কখনোই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়নি। কর্ণওয়ালিশ শুধু কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বৃটিশ বণিকদের ব্যবসা ও কাজকর্মও অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁদের জন্যও ১৭৯৩ সালে কতগুলি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। সেগুলি ছিল – (১) ১৭৯৩ সালের ৩১ নং রেগুলেশনে বাংলার তাঁতিদের সঙ্গে যে কোন ধরণের জবরদস্তি চুক্তি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। (২) ঐ বছরের ৩৮ নং রেগুলেশনে ইউরোপীয়দের এদেশে জমি কেনবার উপরে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়েছিল। (৩) ২৮ নং রেগুলেশনে প্রেসিডেন্সি শহরের দশ মাইলের বাইরে ইউরোপীয়দের অবস্থিতির উপরে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপিত করা হয়েছিল। (ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠি, পৃ- ২০) উক্ত শতাব্দীর শেষ দশকে স্বাধীন বণিকেরা নিজেদের এজেন্সি হাউস ও ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তখন নীল, চিনি, রেশম, তুলা, সুতীবন্ত্র ও খাদ্যশস্য রপ্তানি করে সেই স্বাধীন বৃটিশ বণিকেরা কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা, এমনকি কোম্পানির সরকারি ব্যবসাকে পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন। সেটার পিছনে প্রধান কারণগুলি ছিল – (১) বৃটিশ স্বাধীন বণিকেরা কোম্পানির চেয়ে বেশি দামে রপ্তানি পণ্য কিনতেন। (২) কোম্পানিকে ইংল্যাণ্ডে উচ্চহারে শুল্ক দিতে হত, এবং কোম্পানির পণ্য দেরিতে বিক্রি হত। (৩) স্বাধীন বণিকেরা ইউরোপে খুব সহজেই তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে পারতেন, এবং তাঁদের নামমাত্র শুল্ক দিতে হত। (৪) তাঁরা বিদেশী বন্দর ও জাহাজ ব্যবহার করতেন। এই সব সুবিধা থাকবার জন্যই তৎকালীন বাংলায় বৃটিশ বণিকদের বাণিজ্য ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছিল। উক্ত শতকের আশির দশকে ঢাকা অঞ্চলে কোম্পানি ও ব্রটিশ বণিকদের মধ্যে সুতীবস্ত্র কেনার প্রশ্নে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার বেসরকারি ব্যবসায়ের অপর উল্লেখযোগ্য দিকটি ছিল, বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে বাণিজ্যে সহযোগিতা। তখন উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে আসবার পরে বিভিন্ন দেশের ইউরোপীয়দের মধ্যে জাতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা দেখতে পাওয়া যেত। প্রাক-পলাশী যুগে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ওরকম অসংখ্য সহযোগিতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ ‘মশিয়ে ল’ এবং কলকাতার ‘উইলিয়ম ব্যাটসনের’ মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ইংরেজরা ফরাসি ও ওলন্দাজদের মাধ্যমেই নিজেদের দেশে টাকা পাঠাতেন। পলাশী-পরবর্তীকালে শ্রীরামপুরের দিনেমার গভর্ণর ‘অল বাই’ (Ole Bie) ইংরেজদের বেসরকারি ব্যবসায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। হেস্টিংসের সময়ে (১৭৭২-৮৫) চন্দননগরের ফরাসি গভর্ণর ‘শেভালিয়র’ (Chevalier) এবং চুঁচুড়ার ওলন্দাজ গভর্নর ‘রস’ (Ross), ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতায় নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা করতেন। সে যুগের বেসরকারি ব্যবসায়ের অপর বৈশিষ্ট্যটি ছিল যে, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যবসা কোম্পানির সরকারি ব্যবসায়ের ক্ষতি করত। কোম্পানির ব্যবসায়ের ক্ষতি করে নানা অবৈধ উপায়ে কর্মচারীরা অর্থোপার্জন করতেন। (১) নিম্নমানের পণ্য তাঁরা কোম্পানির কাছে বেশি দামে বিক্রি করতেন। (২) কোম্পানির মূলধন উৎপাদকদের আগাম দেওয়ার সময়ে সেটার একাংশ আত্মসাৎ করবার ব্যবস্থা তাঁরা করে নিয়েছিলেন। (৩) কোম্পানির পুঁজি কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লগ্নি করা হত; ফলে ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লোকসান দেখা দিলে তাতে অনেক সময়ে কোম্পানির পুঁজিও নষ্ট হত। (৪) জবরদস্তি করে উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করবার জন্য কোম্পানির সুনাম ও এদেশের উৎপাদন – দু’ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। (৫) ইংরেজদের বাণিজ্য হস্তগত করবার চেষ্টার ফলস্বরূপ বাংলায় অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাধীনতা ও প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়েছিল। শেষপর্যন্ত কোম্পানির কর্মচারীদের ওই ধরণের কাজকর্মের ফলে দেখা গিয়েছিল, যে পণ্যের ব্যবসা করে কোম্পানির লোকসান হত, অন্যদিকে ঠিক সেই পণ্যেরই বেসরকারি ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লাভ হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ১৭৭১-৮৬ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির রেশম ব্যবসায়ে লোকসান হলেও ঐ একই সময়ে কোম্পানির কর্মচারীদের কিন্তু সেই সেই ব্যবসায়ে লাভ হয়েছিল। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, এন. কে. সিংহ, ১ম খণ্ড, পৃ- ৯০) তখন কোম্পানির কর্মচারীরা ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের সমস্ত বন্দরের সঙ্গে, যথা – বালেশ্বর, মাদ্রাজ, পণ্ডিচেরি, রাজমুদ্রি, নেগাপতম, বিশাখাপতম, কালিকট, কোচিন, মাহে, সুরাট, বোম্বে, গোয়া প্রভৃতির সঙ্গে বাণিজ্য করতেন। স্থলপথে তাঁরা আগ্রা, দিল্লী, মির্জাপুর, বারাণসী, অযোধ্যা, নাগপুর, হায়দ্রাবাদ, আসাম, তিব্বত, নেপাল ও ভূটানের সঙ্গে নিজেদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চন্দননগরের গভর্নর শেভালিয়র তুলা, চুন, তামাক, সোনার সুতো, মুগাধুতী, শাঁখ, হাতির দাঁত প্রভৃতি পণ্যের ব্যবসা করতেন। কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলা থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে লবণ, চিনি, চাল, চট, আদা, হলুদ, তামাক, সুপারি, রেশম, মলিন ও সুতীবস্ত্র পাঠাতেন। আর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জল ও স্থলপথে বাংলায় তুলা, নীল, আফিম, কাঠ, লঙ্কা, মশলা ও লবণ নিয়ে আসতেন। নীল, আফিম ও উপকূল বাণিজ্যে বেসরকারি ব্যবসায়ে বেশ লাভ হত। শতাব্দীর শেষ দুই দশকে কোম্পানির কর্মচারীরা কলকাতার এজেন্সি হাউসগুলিতে টাকা লগ্নি করে লভ্যাংশ পেতেন, আর বৃটিশ স্বাধীন বণিকেরা বেসরকারি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এশিয়ার পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গেও, যথা – পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, তুরস্ক, আরব, ইয়েমেন, ওমান, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, সুমাত্রা, ফিলিপিন, চীন, শ্রীলংকা, ব্রহ্মদেশ ও মালদ্বীপপুঞ্জর সঙ্গে বাংলার ইউরোপীয় বণিকেরা নিজেদের বেসরকারি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেই বাণিজ্যে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা একটি বিশিষ্ট স্থানাধিকারী ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কোম্পানির কর্মচারীরা অনেকগুলি জাহাজের মালিকও ছিলেন। সেই যুগে, উক্ত শতাব্দীর শেষের দিকে কলকাতায় ৫৬টি জাহাজ ও ৯০টি স্নো (Snow) তৈরি হয়েছিল। সেগুলির মোট পণ্য পরিবহন ক্ষমতা ছিল ৩৯,০৮০ টন। জাহাজ ভাড়া দেওয়ার ব্যবসাও তখন বেশ লাভজনক ছিল। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে কোম্পানির কর্মচারীরা চাল, রেশমবস্ত্র, চিনি, সুতীবস্ত্র ও মসলিন নিয়ে যেতেন, আর বঙ্গদেশে খেজুর, মদ, গোলাপজল, ঘোড়া ও সোনারূপো আমদানি করতেন। অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকে পৌঁছে সেই ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছিল, তবে সত্তরের দশকে পূর্ব-এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য জোরালো হয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছিল। সেই অঞ্চলে ইউরোপীয় বণিকেরা প্রধানতঃ সুতীবস্ত্র ও আফিম নিয়ে যেতেন, আর সেখান থেকে টিন, লঙ্কা, মশলা, দস্তা, ও তুতেনাগ (দস্তা ও তামার সঙ্কর ধাতু) নিয়ে আসতেন। বেসরকারি বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্রহ্মদেশ থেকে টিন ও কাঠ, মালদ্বীপ থেকে কড়ি ও শাঁখ তখন বাংলায় আসত। চীনের ক্যান্টন বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্য সেই যুগের বেসরকারি বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা চীনদেশে আফিম পাঠাতেন। সেই আফিম বিক্রির টাকা কোম্পানির ক্যান্টন ট্রেজারিতে জমা দিয়ে বিল অব এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের দেশে টাকা পাঠাতে পারতেন। কোম্পানি সেই টাকায় চীনদেশ থেকে চা কিনতেন। সারা অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে সেই ব্যবসা চালু ছিল। তখন চীনদেশ থেকে বাংলায় তুতেনাগ, ফিটকিরি, চিনি (Sugar candy), চা ও পোর্সলেনের তৈজসপত্র আসত। (ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠি, পৃ- ২৯, ৩৮) প্রাক্-পলাশী যুগে কিন্তু কোম্পানির কর্মচারী ও স্বাধীন বণিকদের ইউরোপের সঙ্গে কোন বাণিজ্যাধিকার ছিল না। সেই বাণিজ্য তখন কোম্পানিগুলির একচেটিয়া অধিকার (Monopoly right) ছিল। তবে শুধুমাত্র মূল্যবান পাথর, হীরা, জহরত, মণিমুক্তোই তাঁরা ইউরোপে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু কোম্পানির প্রতি জাহাজের অধ্যক্ষ ও কর্মচারীরা পঞ্চাশ টন পণ্য নিজেদের জন্য নিয়ে যেতে পারতেন। সেই সুবিধাজনক বাণিজ্যাধিকার (Privileged trade) তাঁরা কোম্পানির কর্মচারী ও স্বাধীন বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। তখন ওই ভাবে বছরে ৭০০-৭৫০ টন রেশম ও সুতীরস্ত্র ইউরোপীয় বণিকেরা স্বদেশে পাঠাতে পারতেন। উক্ত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁরা কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেছিলেন। সেই সময়ে বিদেশী জাহাজে বাংলার পণ্য লিসবন, কোপেনহেগেন, আমস্টারডাম, অস্টেণ্ড, কালোন ও হামবুর্গ পৌঁছাত। অবশ্য সেই ব্যবসা গোপন ও অপ্রকাশিত থাকত। ১৭৯৩ সালের চার্টার এ্যাক্টে কোম্পানির জাহাজে বৃটিশ বণিকদের ৩,০০০ টন আমদানি-রপ্তানি পণ্য বহন করবার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। একদিকে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার অন্যদিকে বৃটিশ বণিকদের স্বাধীন বাণিজ্যের দাবী (Monopoly vs Free Trade) নিয়ে বিতর্ক তখন ইংল্যাণ্ডের রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইংল্যাণ্ডের শিল্পপণ্য ভারতে বিক্রি করা এবং এদেশ থেকে শিল্পের উপযোগী কাঁচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইংল্যাণ্ডের শিল্পপতি ও বণিক গোষ্ঠীরা কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকারের অবসান দাবী করতে শুরু করেছিলেন। ১৭৯৩ সালের চার্টার এ্যাক্টে ‘পিট’ ও ‘ডাণ্ডাস’ (প্রধানমন্ত্রী ও বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট) কোম্পানির হাতে নিয়ন্ত্রিত একচেটিয়া বাণিজ্য (regulated monopoly) বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুতী ও রেশম- বস্ত্র, তামা, গোলাবরুদ, সমরসম্ভার, মসলিন প্রভৃতি কয়েকটি পণ্যে কোম্পানির অধিকার রক্ষা করা হয়েছিল। উক্ত শতাব্দীর শেষের দশকে বৃটিশ বণিকদের বাণিজ্য অসাধারণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখন বছরে তাঁরা গড়ে প্রায় দু’কোটি টাকার পণ্য ইউরোপে পাঠাতেন ৷ ১৭৯৫-৯৬ সালে তাঁরা ২,০৪,৫০,১৩১ টাকার পণ্য রপ্তানি করেছিলেন। সেই সময়ে তাঁদের ইউরোপে পাঠানো পণ্যগুলি ছিল – নীল, চিনি, সুতীবস্ত্র, রেশম, খাদ্যশস্য ও তুলা। (ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠি, পৃ- ৭৯) ওই শতাব্দীর শেষের দিকে সামগ্রিকভাবে বাংলার অর্থনীতির উপরে ইউরোপীয় বণিকদের বেসরকারি বাণিজ্যের প্রভাব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। জাহাজ পরিবহন ব্যবসা, সরকারি ঋণপত্র ক্রয়, ব্যাঙ্কিং, ইনস্যুরান্স, কমিশনে ব্যবসা, এক্সচেঞ্জের কাজ সবই ইউরোপীয় এজেন্সি হাউস ও ব্যাঙ্কারদের হাতে অনেকখানি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা তাঁদের সংগৃহীত অর্থ সে সব প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করে নিজেদের লভ্যাংশ পেতেন। বাংলার অর্থ ও বাণিজ্যের সিংহভাগই তখন বৃটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের হাতে চলে গিয়েছিল।
আরো পড়ুন- ‘শের খাঁ-হুমায়ুন সংবাদ’ (প্রথম পর্ব)
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় বণিকদের বেসরকারি ব্যবসা বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের উপরে অনেকগুলো কারণে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্রথমতঃ, বৃটিশ বণিকেরা বাংলার কয়েকটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য – লবণ, আফিম, চুন ও সুপারি – এগুলোর উপরে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করেছিলেন। এগুলিতে পাইকারি ব্যবসা ইংরেজদের হাতে থাকত আর খুচরো ব্যবসা এদেশীয় বণিকেরা পরিচালনা করতেন। তবে এগুলি ছাড়া অন্যসকল পণ্য, যেমন খাদ্যশস্য, তুলা ও মোটাকাপড় ইত্যাদির ব্যবসা তখন মুক্ত ছিল। (ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল, পৃ- ২৬৯) দ্বিতীয়তঃ, কোম্পানি ও কর্মচারীদের সেই একচেটিয়া ব্যবসায়ের ফলে লবণ, সুপারি, চুন ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে পরবর্তীকালের কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী মন্তব্য করেছেন যে, তখন বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ইংরেজদের অযৌক্তিক প্রাধান্য বিস্তারের ফলে বাংলার আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য – ভারতের অন্যান্য অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলির সঙ্গে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তার ফলে ওই সব অঞ্চল থেকে যেসব বণিকদল প্রতিবছর বাংলায় বাণিজ্য করতে আসতেন, তাঁরা নিরুৎসাহিত হয়েছিলেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, এন. কে. সিংহ, ১ম খণ্ড, পৃ- ২২২) তৃতীয়তঃ, ওই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপীয়দের বাড়তি রপ্তানি বাণিজ্যের ফলে বঙ্গদেশে পণ্য উৎপাদন আদৌ বেড়েছিল কিনা বা শ্রমের নতুন কোন চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল কিনা, সেটা যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাবে নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে যেটা নিশ্চিত করে বলা যায় সেটা হল, লবণ উৎপাদক মালঙ্গিরা তখন তাঁদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পেতেন না। ঢাকার তাঁতিদের সত্তরের দশকের পারিশ্রমিক চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের পারিশ্রমিক অপেক্ষা কম হয়ে গিয়েছিল। বিহারের আফিম চাষীদেরও তখন ঐ একই দশা হয়েছিল। চতুর্থতঃ, এদেশের রেশম শিল্প, চিনি ও নীল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোম্পানির কর্মচারী ও সাধারণ বণিকেরা আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তাই উক্ত তিন ক্ষেত্রে তখন ইউরোপীয় প্রযুক্তি জ্ঞানের প্রয়োগও করা হয়েছিল। এছাড়া জাহাজ নির্মাণ, ব্যাঙ্কিং ও বীমার ক্ষেত্রেও তখন নতুন চিন্তা ও সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছিল। বাংলার সমুদ্র বাণিজ্যে জাহাজ পরিবহন বৃটিশ ও ইউরোপীয় বণিকদের হাতে চলে গিয়েছিল ঠিকই; তবে তাতে এদেশীয় বণিকদের এশীয় বাণিজ্যের কোনো ক্ষতি কিন্তু হয়নি। সুতরাং সেই বাণিজ্যের পরিমাণ তখন বরং বেড়েছিল বলে অনুমান করাটা অসঙ্গত কিছু নয়। পঞ্চমতঃ, ইউরোপীয়দের বেসরকারি বাণিজ্যের জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার বণিকসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল – একথাও ইতিহাসের দিক থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে প্রাক-পলাশী যুগের সঙ্গে তুলনায় উক্ত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার বণিকেরা যে তাঁদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা হারিয়েছিলেন (প্রথম থেকে দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসে) – সেকথা অবশ্যই বলা যায়। ষষ্ঠতঃ, তখনকার বেসরকারি ব্যবসায়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, ওই শতাব্দীর শেষ তিন দশকে ইউরোপীয় ব্যাঙ্কিং ও এজেন্সি হাউসের উদ্ভব। এর ফলে এদেশের স্রফ ও ব্যাঙ্কারদের কাজকর্ম অবশ্যই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পলাশীর পর থেকেই বাংলার নবাবদের রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক জগৎশেঠ পরিবারের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। ১৭৭২ সালে রাজস্ব দপ্তর পাকাপাকিভাবে কলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকেই তাঁদের পতন আসন্ন হয়ে উঠেছিল। তবে তৎকালীন কলকাতা ও বারাণসীর ব্যাঙ্কিং পরিবারগুলি – ‘গোপালদাস’, ‘হরিকিষেণদাস’, ‘বুলাকি দাস’, ‘মনোহর দাস ও দ্বারকাদাস’, ‘শেঠ ও বসাক’ – এঁরা ওই শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের ব্যবসায়ে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন।
(তথ্যসূত্র:
১- ইস্ট ইণ্ডিয়ান ফরচুনস: দ্য ব্রিটিশ ইন বেঙ্গল ইন দি এইটিনথ সেঞ্চুরি, পি. জে. মার্শাল।
২- প্রাক-পলাশী বাংলা, সুবোধ কুমার মজুমদার।
৩- দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, এন. কে. সিংহ, ১ম খণ্ড।
৪- হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ৩য় খণ্ড, জেমস মিল।
৫- বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭, এস. সি. হিল, ৩য় খণ্ড।
৬- দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত।
৭- ইকনমিক এ্যানালিস অব বেঙ্গল, জে. সি. সিংহ।
৮- ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠি।
৯- কনসিডারেশন্স অন ইন্ডিয়ান এ্যাফেয়ার্স, উইলিয়ম বোল্টস।)