তারা চক্রবর্তীঃ পণ্ডিতদের মতে মহাভারত মহাকাব্যের ‘সূচনা’ এবং ‘চূড়ান্ত রূপায়ণ’ এই দুই পর্বের মধ্যে প্রায় আট শতাব্দী সময় কেটে গিয়েছিল – মূল বীর গাথা যা এই মহাকাব্যের বীজ এবং তার পরে প্রক্ষিপ্তভাবে এবং কখনও বা ধীরে ধীরে, এই কাব্যের সৃষ্টি নিরন্তর ভাবে এই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছিল। এই আট শতাব্দী ধরে উত্তর ভারতে অন্যান্য সাহিত্যও রচিত হয়েছিল, এর মধ্যে ছিল ‘মহাবস্তু’ ও ‘ললিত বিস্তার’, কিছু কিছু জৈন গ্ৰন্থ, ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’, ‘যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি’, ‘পতঞ্জলির মহাভাষ্য’, ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, ‘রামায়ণ’ ও ‘মনুসংহিতা’। এই সময়ের অপেক্ষাকৃত পরবর্তী স্তরে অর্থাৎ খ্রীস্টিয় যুগের প্রারম্ভিক শতাব্দীগুলিতে যে সমস্ত গ্রন্থ রচিত হয়েছে সেগুলিতে দেখা যায় বহু উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত অথচ সুসংহত সামাজিক ধ্যান ধারণা মিলে গেছে।
‘মধ্যপ্রদেশের খোহা গ্রামে’ একটি লেখে (৫৩৬ খ্রী) বলা হয়েছে মহাভারতের ‘শ্লোক সংখ্যা শতসহস্ৰ’ (১ লক্ষ); কিন্তু বর্তমানে প্রাপ্ত ‘পুনা সংস্করণে’ দেখা যায় এই সংখ্যা মোটামুটি ‘৮২,০০০’। আবার মহাভারত মহাকাব্যের মধ্যেই বলা হয়েছে এর ‘শ্লোক সংখ্যা ২৪,০০০’। কেমন করে এই ২৪,০০০ শ্লোকের বীজকাব্য পল্লবায়িত হয়েছিল ৮২,০০০-এ সে কথাও কাব্যের মধ্যেই বলা হয়েছে। এই ‘কাব্যের মুখবন্ধ’ ছিল তিনটি; ‘মনুর উপাখ্যান’, ‘আস্তিকের উপাখ্যান’ আর ‘উপরিচর উপাখ্যান’। অর্থাৎ মহাকাব্যটি রচিত হয়েছিল ‘তিনটি পর্যায়ে’, এর তিনটি পৃথক পৃথক নামও ছিল, সম্ভবতঃ রচনার বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই – ‘জয়’, ‘ভারত’ এবং ‘মহাভারত’। এই মহাকাব্যে বলা হয়েছে এই গ্ৰন্থ রচনার পরে ‘ব্যাসদেব’ তা পাঠ করেন তাঁর পুত্ৰ ‘শুকদেবের’ কাছে, এবং তারপরে তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের কাছে। ‘শুকদেব’ এটি আবৃত্তি করেন ‘জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে’ এবং সম্ভবতঃ সেই সময়ই ‘চিরন্তন মূল্যবোধের নীতিমূলক আখ্যানগুলি’ এতে যুক্ত হয়। কিন্তু এই প্ৰক্ষেপণ খুব বৃহৎ অংশের নয় এবং এই বীরগাথাত্মক কাব্যের মূল সুরের সঙ্গে প্রক্ষিপ্ত অংশের ভাবনা ও সৌন্দর্যবোধ মিলে যায়। অনেক পরে, ‘শৌনকের দ্বাদশ বর্ষব্যাপী সোম যজ্ঞে’, ‘রাজা সূত’ ‘লোমহর্ষণের পুত্ৰ উগ্ৰশ্রবস’কে মহাকাব্যটি আবৃত্তি করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁর প্রথম অনুরোধ ছিল ‘ভার্গব বংশের একটি ঐতিহাসিক, প্রথম বিবরণের জন্য’। এই ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে আলোচ্য অংশের রচয়িতা ‘ভৃগুবংশের গুণকীর্তন’ করার সুযোগ পেয়ে যান, ‘ভার্গবদের কীর্তি’কে মহত্তর রূপে প্রচার করা হয় এবং প্রক্ষিপ্ত অংশের অতিরিক্ত প্রামাণ্যতা সৃষ্টির সুযোগ পাওয়া যায়। যখন এই ‘ভার্গবদের বিবরণ’ শেষ হয়েছিল, তখন ‘শৌনক’ ‘ব্যাসরচিত জয় সংহিতা’ শোনার ইচ্ছা করেছিলেন।
‘চারণ লোমহর্ষণ’ ও তাঁর পুত্ৰ ‘উগ্ৰশ্ৰবস’, এই ‘সূত পরিবার’ একত্রে প্রক্ষিপ্ত অংশের এক বৃহৎ ভাগের অধ্যায়গুলি রচনা করেন। এই প্ৰক্ষেপণ, বর্তমান মহাকাব্যটির আকারের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি; একেই ইতিহাসে বলা হচ্ছে ‘ভার্গব বা ব্ৰাহ্মণ্য সংযোজন’। রচনাশৈলির বিচারে এই অংশটি ‘অপেক্ষাকৃত দুর্বল’, ‘অতি-অলংকৃত’, ‘শব্দভারাক্রান্ত’ এবং ‘পুনরুক্তি দুষ্ট’। ‘আদি’, ‘বন’, ‘দ্রোণ’, ‘শল্য’, ‘শান্তি’ এবং ‘অনুশাসন’ পর্বগুলির অধিকাংশ এই প্রক্ষিপ্ত অংশেরই অন্তৰ্গত; এবং ‘আশ্বমেধিক’, ‘আশ্রমবাসিক’, ‘মৌষল’, ‘মহাপ্রস্থান’ এবং ‘স্বৰ্গারোহণ’ সম্ভবতঃ সম্পূর্ণভাবেই প্ৰক্ষেপণের অন্তর্ভুক্ত। এখানে আকর্ষণীয় তথ্য এই যে, এই ‘ভার্গববংশে’ই কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল, যাঁরা তাঁকে মহিমান্বিত করে উপস্থিত করেছিলেন। ‘ভৃগুর পুত্র কবি’, তাঁরই সন্তান ছিলেন ‘শুক্রাচার্য’, যাঁর কন্যা ‘দেবযানী’ হয়েছিলেন ‘যদুর জননী’; এই বংশধারাতেই কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে চূড়ান্ত ভাবে ভাৰ্গবেরা ‘কৃষ্ণের গুণগান’ করে গিয়েছিলেন যতক্ষণ না তিনি প্রকৃত অর্থে একজন দেবতা হয়ে উঠেছিলেন।
‘মনুসংহিতা’-ও সেই একই যুগের সৃষ্টি যখন এইসব সংযোজন ঘটেছিল; এই গ্ৰন্থ ভার্গব বংশেরই এক শিষ্যের রচিত। মহাভারত কোনও ধর্মসূত্র বা স্মৃতি গ্রন্থের উল্লেখ করে না; যে সময়ে মহাভারত রচিত হয়েছিল তাতে প্রাচীন সূত্রসমূহের প্রকৃত উৎস বিস্মৃতিতে ঢেকে গিয়েছিল, যদিও শাস্ত্রের কোনও বস্তুগত পরিবর্তন ঘটেনি। এই ভাবে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, ভৃগুবংশের তরুণ ব্যক্তিরা ও শিষ্যেরা, খ্রীস্টিয় যুগের প্রারম্ভিক শতাব্দীগুলিতে দুটি অত্যন্ত প্রভাবসম্পন্ন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন; অর্থাৎ ‘মনুসংহিতা’ এবং ‘মহাভারত-এর ভার্গব সংযোজন’ এই সময়ে ঘটেছিল।
আধুনিক পণ্ডিত ‘এম আর ইয়াদি’, মহাকাব্যের রচনার পর্যয়গুলির বিষয়ে ‘গবেষক সুকথঙ্করের মতামত’ মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মতে আরও দুজন লেখক এই রচনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যাঁরা ‘হরিবংশ’ এবং আলোচ্য মহাকাব্যের ‘পর্বসংগ্ৰহ পার্বণ’ রচনা করেছিলেন। ‘হরিবংশ’ অনেক পরবর্তী কালের রচনা, আর ‘পার্বণ’ অধ্যায়টি মহাকাব্যের উপর তার প্রভাবের বিচারে অকিঞ্চিৎকর। ‘ভার্গব অধ্যায়ে’ই আলোচ্য দুটি পর্বের সূত্রপাত যথাযথ ভাবে আন্দাজ করা যায়। এই সংযোজিত অংশেই যে যুদ্ধ কাহিনী প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের ঘটনার সময়ে তৎকালীন শাসকবংশে ‘কৌরবদের অনুকূলে’ রচিত হচ্ছিল, সেই কাহিনীকে বিজয়ী পাণ্ডবদের অনুকূলে পরিবর্তিত করা হয়েছিল। ‘সূত লোমহর্ষণ’ ও ‘সৌতি উগ্ৰশ্ৰবসের’ এই রচনাই এখানে আলোচ্য বিষয়। কেন তাঁরা এই অংশগুলি রচনা করেছিলেন? ভার্গব অংশগুলির সঙ্গে সহঘটিত ভাবে যুক্ত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হল ‘সংস্কৃত ভাষা’র ক্রমবর্ধমান ব্যবহার। প্রাকৃতের ক্রমশ সমৃদ্ধি হচ্ছিল। কিন্তু বিদেশি অভিযানকারীরা সংস্কৃতকেই প্রাধান্য দিতেন। খ্রীস্টিয় দ্বিতীয় শতকের প্রথম ‘যূপ’ শিলালেখে ‘কণিষ্ক’ সংস্কৃত ব্যবহার করেছিলেন, ‘রুদ্ৰদমন’ও তাঁর বিখ্যাত শিলালিপিতে (১৫০ খ্রী) সংস্কৃতই ব্যবহার করেছিলেন। এই ভাবে বিদেশি শাসক গোষ্ঠীগুলি সংস্কৃতের মাধ্যমে ভাষাগত ঐক্য খুঁজছিলেন এবং পুরোহিততন্ত্রের এতে সাগ্রহ সম্মতি ছিল, কারণ প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা থেকে দূরবর্তী এবং সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য না থাকার ফলে এটি পুরোহিত শ্রেণির হাতে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছিল।
যেহেতু মহাভারত তার ‘কাব্যগত উৎকর্ষের জন্য’ ইতিমধ্যেই বিপুল ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, ভার্গবদের পক্ষে নিজেদের মতামত বিজ্ঞাপিত করার জন্য এটিই ছিল শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। তাঁদের রচনার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলেই এই সংযোজনের কারণ বোঝা যায়।
ধর্মের ক্ষেত্রে এই ভার্গব গোষ্ঠী সর্বপ্রথম সম্প্রদায়গত ধর্মের জন্য এক প্রকার ‘দেবতাতত্ত্ব’ ও একটি ধর্মশাস্ত্রের সৃষ্টি করেছিলেন – মুখ্যতঃ ‘শিব’ এবং ‘কৃষ্ণ’ এই দুই দেবতাকে ঘিরে। ‘ঋগ্বেদ’-এ ‘রুদ্র’ ছিলেন সম্পূর্ণ ভাবে এক ‘গৌণ দেবতা’। ব্রাহ্মণ-সাহিত্যে তিনি অবশ্য ‘রুদ্র-শিব’ রূপে অপেক্ষাকৃত গুরুত্ব পেয়েছেন। কিন্তু মহাকাব্যের আলোচ্য অংশে তিনি প্রকৃতই ‘গুরুত্বপূর্ণ’, ‘ভীতিকর’, একজন ‘প্রধান দেবতা’ হয়ে উঠেছিলেন, গ্রিক পর্যটকরা ‘সিবই’ নামে জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেছিলেন। সম্ভবতঃ তাঁরাই ‘শৈব সম্প্রদায়’। ভার্গব প্ৰক্ষেপণগুলিতেই প্রথম শিবের উপর ‘মানবত্ব’ আরোপিত হতে দেখা যায়। সেখানে শিবের ভাবমূর্তি ধীরে ধীরে, অত্যন্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে একজন ‘প্রধান দেবতারূপে’ গড়ে তোলা হয়েছিল। ‘দ্ৰোণপর্বে’ প্রথম শিবের মধ্যে ‘প্রলয়কর্তা’র রূপ দেখতে পাওয়া যায়; ‘সৌপ্তিক পর্বে’ও তাঁর ভূমিকা ওই একই রকম। ‘দ্ৰোণপৰ্ব’ এবং অন্যত্র ‘কৃষ্ণ’ তাঁর গুণগান করেছিলেন। ‘ব্যাস’ও পরমেশ্বর শিবের স্তুতি করেছিলেন। অন্যান্য দেবতারাও ত্রিপুর ধ্বংসের পূর্বে তাঁর বন্দনা করেছিলেন। ‘অশ্বথামা’ এবং ‘উপমন্যু’ তাঁকে ‘দেবাদিদেবরূপে’, ‘সৃষ্টি-স্থিতি ও সংহারের দেবতারূপে’ স্তুতি করেছিলেন। এই সব চিন্তার কোনও কোনও ধারণা ইতিপূর্বেই ‘বৈশম্পায়ন’ রচিত মহাকাব্যের ‘ভারত’ পর্যায়েই দেখা গিয়েছিল। এই সময়েই ‘পাশুপত’ ও ‘লকুলীশ’ এই সম্প্রদায় দুটির বীজাকারে সূচনা হয়েছিল। ‘বনপর্বে’ ‘গাণপত্য সম্প্রদায়ের’ ধর্মগত আচার অনুষ্ঠানের সূচনা দেখতে পাওয়া যায়।
ভার্গব পর্যায়ের অপর প্রধান দেবতা হলেন ‘কৃষ্ণ’; তাঁর দেবত্ব আরোপ করেছিলেন ‘সূত’ এবং ‘সৌতি’। ‘বাসুদেব এবং নারায়ণীয় সম্প্রদায়ের’ অস্তিত্ব ইতিপূর্বেই ছিল; এখন যা ঘটেছিল তা হল – প্রথমতঃ ‘বিষ্ণু’ এবং ‘নারায়ণ’ উভয়ের সমন্বয় ঘটেছিল কৃষ্ণের মধ্যে এবং এঁদের সম্মিলিত ভাবরূপ হয়ে উঠেছিলেন ‘পরমেশ্বর’। ‘ক্ষত্ৰিয় কাব্য’ ‘জয়সংহিতা’-তে পাণ্ডবের সখা রূপে, দ্বারকার রাজা রূপে কৃষ্ণের যে চরিত্র সেখানে কোথাও কৃষ্ণ দেবতা নন। পরবর্তীকালে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘বাসুদেব সম্প্রদায়ের ধমৰ্মতত্ত্বের কেন্দ্ৰবিন্দু’। ‘বৈশম্পায়ন’ কৃত বিবরণে তিনি কেবলমাত্র ‘বৃষ্ণি’দের কাছেই একজন দেবতা রূপে স্বীকৃত ছিলেন। এই অংশের ‘মানব কৃষ্ণ’ যুধিষ্ঠিরের পদস্পর্শ করেছিলেন, যেমন ভাবে কনিষ্ঠেরা জ্যেষ্ঠকে প্ৰণাম করেন, সাধারণ মানুষ কোনও ধাৰ্মিক সাধু চরিত্রের ব্যক্তিকে প্ৰণাম করেন। পরবর্তীকালে ভার্গব-সংযোজন অংশে, যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের ‘মুখাপেক্ষী’ হয়ে গিয়েছিলেন, যেমন আচরণ করেন কোনও শিষ্য তাঁর গুরুর প্রতি। ‘ভূরিশ্রবস’, কৃষ্ণের কোনও দেবমহিমা উপলব্ধি করেন নি, তাই অৰ্জ্জুনকে তিরস্কার করে বলেছিলেন – ‘বৃষ্ণিরা অ-সভ্য, পাপপুণ্যের ভেদজ্ঞান রহিত দুষ্ট; এই গোষ্ঠীর কোনও লোককে তুমি কি করে সম্মান কর?’ এই মানব কৃষ্ণ ‘উমা’র কাছে বর প্রার্থনা করেছিলেন।
৪০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ‘আগাথোর্কেস’-এর মুদ্রায় কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি প্রথম পাওয়া যায়। একজন বিদেশি শাসকের মুদ্রায় এটিই একমাত্র প্রতিমূর্তি। পরবর্তী সময়ে ‘হেলিওডোরাস’ নিজেকে বলেছিলেন একজন ‘ভাগবত, বাসুদেবভক্ত’। বিষ্ণু নারায়ণের পরে, ‘পঞ্চ বৃষ্ণি-বীরের ব্যূহ’ থেকে বাসুদেবই নিজস্ব, পৃথক সত্তা রূপে পরিগণিত হন এবং ধীরে ধীরে একজন ‘মুখ্য দেবতার স্থান’ গ্ৰহণ করেন। ‘ভার্গব গোষ্ঠী’ তাঁর নিঃসংশয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে নিজেদের লক্ষ্য স্থির করেছিল। ‘সভাপর্বে’ ‘শিশুপালের’ প্ররোচনামূলক ঔদ্ধত্যের প্রত্যুত্তর স্বরূপ এই অঘোষিত লক্ষ্যের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এর পরে, ‘বনপর্বে’ ‘মার্কণ্ডেয়’ দেখেছিলেন শিশুর উদরে মহাজাগতিক সমুদ্রে ভাসমান মহাব্ৰহ্মাণ্ড। ‘দ্ৰোণপর্বে’ এবং অন্যত্র এরই বর্ধিত এবং অতিরঞ্জিত বিবরণ দেখা যায়। ‘বনপর্বে’ ‘কৃষ্ণবন্দনা’ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি উদাহরণযুক্ত আখ্যানের অন্তর্নিহিত। এমনকী বনপর্বে ‘কন্ধি অবতারের’ও উদ্ভব হয়েছিল। শিব এবং কৃষ্ণকে ঘিরে এই যে নূতন সম্প্রদায়গত ধর্ম গড়ে উঠেছিল তার কিছু কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। এই প্রথম একজন দেবতা অধ্যাত্মজীবনে একজন পরিত্রাতার ভূমিকায় দেখা দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে প্রথম ছিলেন ঐতিহাসিক চরিত্র ‘বুদ্ধ’, তাঁর মহিমা গান করা হয়েছিল ‘ললিত বিস্তার’, ‘মহাবস্তু’, ‘অবদানশতক’ এবং বৌদ্ধ সাহিত্যের অন্যত্র। বৈদিক দেবতারা ব্যক্তিগত পরিত্রাতা ছিলেন না; তাঁরা শুধুমাত্র পার্থিব প্রাপ্তির বিষয়ে আশীৰ্বাদ দিয়েছিলেন এবং ‘ঋগ্বেদ সংহিতা’-র অর্বাচীন অংশগুলিতে স্বৰ্গসুখের বিষয়ে কিছু অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতিও দেখা যায়। জীবন এতই আনন্দময় ছিল যে মানুষের লক্ষ্য ছিল যত দীর্ঘ সময়ের জন্য সম্ভব, জীবনকে প্রাণভরে উপভোগ করা। তাই ‘বৈদিক ঋষিরা’ প্রার্থনা করেছিলেন ‘দীর্ঘ জীবন’, ‘প্রাচুর্য’, ‘সমৃদ্ধি’ অর্থাৎ ‘সর্বপ্রকার বৈচিত্র্যসহ পার্থিব সুখ’। পরবর্তী ব্রাহ্মণ সাহিত্য এবং প্রাথমিক যুগের উপনিষদগুলিতে, জীবনকে মূলত ‘দুঃখদায়ী’ বলে চিত্রায়ন শুরু হয়েছিল কারণ এই সময় থেকেই ‘জন্ম-মৃত্যুর পুনরাবর্তনের ভাবনা’ রূপ নিয়েছিল। সুতরাং এই সময়েই জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ‘অস্তিত্বচক্রের শৃঙ্খল’ থেকে মুক্তিলাভ করা। তখন লক্ষ্য ছিল ‘মোক্ষলাভ’ এবং এই সব নতুন দেবতারা ‘মুক্তির বরদান’ করতেন। সেই প্রথমবারের জন্য আরাধ্য দেবতা আর তাঁর ভক্তের মধ্যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস আর আত্মসমর্পণের দ্বারা একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল – তা হল ‘ভক্তি’। তখন থেকে এই ভক্তিই মোক্ষলাভের একমাত্র সত্য পথ বলে স্বীকৃত হয়েছিল। মৌর্য এবং গুপ্ত যুগের মধ্যবর্তী সময়ে সম্রাটের অনুগ্রহ লাভ করার একমাত্র উপায় ছিল তাঁর কর্তৃত্বের কাছে ভক্তির মাধ্যমে নিঃশর্ত আত্মসমৰ্পণ; সেই যুগের ধর্মমতেও এই মনোভাবই অন্ততঃ আংশিক প্রতিফলিত হয়েছিল। ভক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ধরেই এসেছিল ‘পূজা’, ‘বিগ্রহ’, ‘মন্দির’ এবং নুতন ধরনের ‘অর্ঘ্য-উপহার’। ‘ভগবদগীতা’-য় কৃষ্ণ বলেছেন ‘পত্র, পুষ্প, ফল, জল যা কিছু ভক্তির সঙ্গে আত্মসংযমী ভক্ত আমাকে উৎসর্গ করেন তা-ই আমি গ্ৰহণ করি।’
ইতিহাসের এই অংশেই প্রথম ‘মূর্তি পূজা’ দেখা গিয়েছিল। কৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘আমার একনিষ্ঠ ভক্ত যে রূপে আমায় পূজা করতে চায় আমি সেই রূপই গ্রহণে স্বীকৃত হই।’ তখনই সর্বপ্রথম ‘উপবাসের উপকারিতা’ এবং ‘ব্ৰতরক্ষার পুণ্যফল’ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিল মানুষ। এই সব তত্ত্বও পুরাণে বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে, কিন্তু মহাকাব্যের এই সব আলোচ্য অংশেই এগুলি প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, ‘ব্ৰতপালন’ না করে, ‘তীর্থদর্শন’ না করে কেউ ‘স্বৰ্গলাভ’ করতে পারে না। ‘বনপর্বে’ তীর্থসমূহের একটি বিশদ বিবরণী আছে। নদী ও সমুদ্রতীরবর্তী আশ্রয়স্থল, পর্বত এবং অন্যান্য সুন্দর সুন্দর প্রাকৃতিক আকর্ষণীয় স্থান এবং বাণিজ্য কেন্দ্রগুলিও তীৰ্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। এই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিতে বিষ্ণুর অবতার সমূহের উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন – ‘নৃসিংহ’, ‘বামন’, ‘পরশুরাম’, ‘বলরাম’ এবং ‘কল্কি’।
‘স্বৰ্গনরকের বিচার’ উদ্ভূত হয়েছিল এই প্রথম। বিত্তবান সমাজের প্রত্যক্ষগোচর উচ্চমানের জীবনযাত্রার এক কল্পিত প্ৰতিফলনেই স্বগের রূপকল্পনা করা হয়েছিল এবং ক্ষমতাশালীর হাতে দুর্বলের নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি ছিল নরকের রূপকল্পনাতে। এই ভার্গব অংশে ‘দুর্লক্ষণ’, ‘অমঙ্গলের পূর্বাভাস’, প্রভৃতির বিবরণ পাওয়া যায়। অর্বাচীন ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে ইতিপূর্বেই পুরোহিতদের ‘যজ্ঞ-দক্ষিণার কথা’ সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, এরপরে দেখা দিয়েছিল এক নূতন শ্রেণির পুরোহিত যাঁরা ‘পূজা পরিচালনা’ করতেন, ‘ব্ৰতপূর্ণ করার পারণ কার্যে’ সাহায্য করতেন এবং তীর্থস্থানে সঠিক ভাবে পূজা দেওয়ার কাজে তীর্থযাত্রীদের সাহায্য করতেন। এই সব ‘পারিবারিক ও মন্দিরের পূজারীরা’ তখন বর্ধিত দক্ষিণা চাইতে লাগলেন এবং পেতে শুরু করলেন।
এই সব কিছুরই কারণ যে সব দার্শনিক তত্ত্ব সেগুলি ইতোমধ্যেই উপনিষদসমূহে প্রচারিত হয়েছিল, এর মধ্যে ‘কর্ম ও জন্মান্তরিবাদের তত্ত্বগুলি’ই প্রধান। এরপরে যে নুতন তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল তা হল ‘ভাগ্য বা নিয়তিবাদ’। যুক্তির বিচারে, ‘নিয়তিবাদ’ আর ‘কর্মফল্যবাদ’ একে অন্যের সঙ্গে মেলে না, কিন্তু ভার্গব অংশে উভয় তত্ত্বের ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ দেখা যায়। ‘গৌতমীপুত্রের অকালমৃত্যুর উপাখ্যান’ দিয়ে ‘অনুশাসন পর্ব’ শুরু হয় – ‘কাল’, ‘মৃত্যু’ এবং ‘কর্ম’ পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে, যতক্ষণ না সিদ্ধান্ত হয় যে মৃত বালক তাঁর মৃত্যুর জন্য নিজেই প্রকৃত দোষী। সমস্যা ছিল এই যে ‘গৌতমী’ বা ‘তাঁর পুত্র’ কেউ জানতেন না যে মৃত্যু কেন ঘটেছে; তাঁদের কাছে এই মৃত্যু ছিল ‘ভাগ্য’, ‘অ-দৃষ্ট’। ‘কর্মফলবাদের তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য অজস্র উপাখ্যান নির্মাণ করা হয়েছিল। কোথাও কোথাও ‘কর্ম’ আর ‘পুরুষকারের’ মধ্যে কে বেশি শক্তিশালী তাই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ‘দৈব অনুগ্রহ’, অকারণ আনুকূল্যের বিপরীতে ‘কেলভিনের পূর্ব নির্ধারণের তত্ত্বের’ মতোই এখানেও একটি তত্ত্ব দেখা যায়। এই সব তত্ত্বের ‘অন্তর্নিহিত বিরোধ’ বোঝা যায় একটি প্রশ্ন থেকে – তথাকথিত বিদেশী আত্মার পরিণতি কী হয়? মুক্তি? স্বৰ্গ? নরক? প্রেতাবস্থা? পুবর্জন্ম? মানুষ রূপে না পশুরূপে? প্রথমে কোনটি? কত দিনের জন্য? মৃত্যুর পরে কর্মের আপেক্ষিক ফলাফল সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করার জন্য কোথাও একটি নির্দিষ্ট বিধি নেই।
বিভিন্ন কর্মের জন্য একই প্রকার ফলের বিভিন্ন উদাহরণ এবং একই কর্মের বিভিন্ন ফলের উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়; ‘চিত্ৰগুপ্ত’ একজন সাধারণ ‘হিসাবরক্ষক’, তাঁর উপরে কোনও ‘সচিব’ নেই। এই শেষতম প্রক্ষিপ্ত অংশে হঠাৎ ‘অলৌকিক ভাবনার অত্যাধিক্য’ দেখা যায়। মূল ‘জয়সংহিতা’ প্রকৃতপক্ষে ছিল ‘মানব বীরদের কাহিনী’; সেখানে দেবতাদের মুখ্য স্থান ছিল না। ‘চাডউইক’ বলেছিলেন, ‘‘বীরগাথাতে যে লৌকিক কাহিনী অপেক্ষা অলৌকিকের প্রাধান্য অনেক কম, তার কারণ নিঃসন্দেহে এই যে, ওই সময়ের রাজসভাগুলি জনসাধারণের অবশিষ্ট অংশ অপেক্ষা এক অনেক উন্নত স্তরের সংস্কৃতির অধিকারী ছিল।’’ অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরোহিত শ্রেণির লেখকরাই ভার্গবদের সংযোজিত অংশে অলৌকিক ঘটনার বাহুল্য বিস্তার করেছিলেন।
ঘটনাপ্রবাহকে আরও জটিল করে তুলতে, এই সময়ই প্রথম দেখা গিয়েছিল ‘রাশি রাশি অভিশাপ আর আশীর্বাদের ঘটনা’। তপস্যার অন্তর্বতী অবসরে ‘কোপনস্বভাব মুনিঋষিরা’ মানুষকে অভিশাপ দিতেন। আবার সেবা প্ৰাপ্তিতে প্ৰসন্ন হয়ে তাঁরা বরদান করতেন – কিন্তু কাৰ্য আর অভিশাপ/আশীর্বাদের কোনও নৈমিত্তিক যোগসূত্র নেই। অতএব বিভ্রান্ত মানুষের কাছে অভিশাপ বা আশীর্বাদ ‘দৈবলীলার রূপ’ নিয়েছিল। ‘পুনর্জন্ম’, ‘কর্ম’ এবং ‘ভাগ্যের তত্ত্বসমূহ’ একই উদ্দেশ্য সাধন করে, অতীত এবং ভবিষ্যৎকে অজ্ঞাত এবং অ-জ্ঞেয় তত্ত্বসমূহ একই উদ্দেশ্য সাধন করে, অতীত এবং ভবিষ্যৎকে অজ্ঞাত এবং অ-জ্ঞেয় বলে প্রচার করে; ফলস্বরূপ, বর্তমান হয়ে পড়ে বোধের অতীত। এই সব কিছুই অবধারিত ভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তুলে দেয় এক বিশেষ শ্রেণির হাতে, যাঁরা জীবনের রহস্যময়তার গভীরে প্রবেশ করার ভান করে থাকে। এক শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে এই সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রাথমিক স্বার্থ হল জনসাধারণের কাছে অটল বিশ্বাস এবং প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রাপ্তি, ভাষান্তরে যাকে বলা যায় শোচনীয় বশ্যতা। যার ফলে ইহজন্মে দুঃখ প্রাপ্তি। পূৰ্ব্বজন্মের সেই অজ্ঞাত পাপকে ব্যাখ্যা করার নামে এবং উন্নততর অবস্থায় পুনর্জন্ম নিশ্চিত করার নামে এই শ্রেণি সাধারণ মানুষের কাছে আনুগত্য ও সেবা দাবি করে, পেয়েও থাকে। এই তথ্যের উদাহরণে ভার্গব সংযোজিত অংশ ভারাক্রান্ত।
এখানে দেখা যায় রাজা এক নূতন মহিমায় মণ্ডিত। ইহ-পরলোকে তাঁকে ‘ধর্মতঃ এবং বাস্তবত’ ‘গুরুর আসন’ দেওয়া হয়েছিল। রাজাকে যে অবহেলা বা অপমান করে তাঁর ‘দান’, ‘যজ্ঞ’ এবং ‘শ্রাদ্ধের পুণ্য’ বিনষ্ট হয় বলে প্রচার করা হয়েছিল। তখন ‘ন্যায়নিষ্ঠ রাজা’ একজন ‘চিরন্তন দেবতা’র স্থান পেয়েছিলেন, বলা হয়েছিল এমনকী দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন। বলা হয়েছিল, ‘সমৃদ্ধি’ চায় যে মানুষ তাঁরা প্রথমেই রাজা নির্বাচন করে; যেমন করে শিষ্যরা গুরুকে প্ৰণাম করে তেমনই মানুষদের উচিত রাজাকে প্ৰণাম করা; যেমন দেবতারা ইন্দ্ৰকে স্তুতি করেন তেমনিই প্রজাদের উচিত রাজাকে স্তুতি করা। আরও প্রচার করা হয়েছিল, একজন রাজাকে কখনও মানুষ ভাবা এবং অবহেলা করা উচিত নয়, কারণ নররূপে তিনি এক মহতী দেবতা।
খ্রীস্টপূর্ব যুগের শেষ শতকগুলিতে যে সব অভিযানকারী গোষ্ঠীগুলি উত্তর ভারতে এসেছিল, তাঁরা সকলেই নিজ নিজ রাজাকে ‘অতিমানব’ মনে করতেন। ‘ব্যাকট্রিয়ার গ্রিক’, ‘রোমান’, ‘হূন রাজ্যের অধিবাসীরা’; ‘সিথিয়ান’, ‘কুষান’, ‘য়ুয়ে চিহ’, ‘পার্শীয়’ সকলেই নিজেদের রাজাকে অতিমানবীয় মর্যাদা দিয়েছিলেন। এই বিশ্বাসের কথা তাঁদের ‘মুদ্রা’ ও ‘শিলালিপি’ থেকে জানা যায়, তাঁদের রাজাকে প্রায়ই বলা হয়েছিল ‘দেবপুত্র’, তাঁদের মাথা ঘিরে তাই এক ‘জ্যোর্তিবলয়’ দেখা যায়। ভারতবর্ষেও এই সব প্রভাব পড়েছিল এবং ‘গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ পর্যন্ত’ এখানে শক্তিমান রাজাদের এই ‘একই পরম্পরা’ দেখা যায়। সুতরাং রাজশক্তিকে মনে করা হত ‘দৈব শক্তির’ই রূপান্তর। ভার্গব সংযোজন সোৎসাহে এই ধারণাকে শক্তিশালী করেছিল। ‘সমুদ্রগুপ্তের সময়ের’ ‘হরিষেরের লিপি’তে জানতে পারা যায় যে রাজা শক্তিশালী, কারণ, তিনি ‘বন্দি করতে পারেন’, ‘মুক্ত করতে পারেন’ এবং ‘অনুগ্রহ করতে পারেন’; তিনি এই তিন কার্যের সমন্বয় সাধক। সুতরাং ‘রাজকীয় কর্তৃত্ব’ ছিল ‘বন্ধন’, ‘মোচন’ এবং ‘অনুগ্রহ প্রদানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল’; খ্রীস্টিয় দ্বিতীয় শতকের প্রথমে ‘নাসিক শিলালেখে’ ‘চতুৰ্বর্ণের ধারক রাজা’ ‘গৌতমী বলশ্রী’র কথা জানা যায়; ‘নাসিকে’ ‘রাজা নহপানের জামাতা উষভদত’ এক ব্রাহ্মণকে তাঁর কন্যার বিবাহের জন্য প্রচুর দান করেছিলেন, এ কথাও জানা যায়। ‘বনঘটে সাতকর্নীর শিলালেখে’ বলা হয়েছে রাজা ব্ৰাহ্মণদের মুক্ত হস্তে দান করেন এবং তিনি ‘বর্ণসংকর’ রোধ করেছেন। একটি ‘গুপ্ত যুগের শিলালিপি’তে বলা হয়েছে দানের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। সুতরাং রাজার কাছে এইটিই ছিল প্রত্যাশিত; তিনি ব্রাহ্মণদের প্রচুর দান করবেন এবং বর্ণ বিভাগকে অক্ষুন্ন রাখবেন যাতে ‘বৰ্ণসংকর’ না ঘটে।
মহাভারতের ভার্গবী অংশের অন্যতম কেন্দ্রীয় ভাবনা হল ‘বর্ণধর্ম’। বলা হয়েছিল, বৰ্ণাশ্রমের উচ্চতম যে ‘ব্রাহ্মণ’ তিনি রাজার মতোই পূজনীয়; তাঁর ক্ৰোধে সর্বনাশ হতে পারে। ‘বাতাপি ও ঈম্বলের উপাখ্যান’ একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। অনুরূপ একটি উপাখ্যান হল ‘কর্তবীর্যাজুন ও পরশুরাম’, এগুলি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে ‘ব্রাহ্মণ হল পৃথিবীচারী দেবতা’। সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়েছিল, ব্রাহ্মণের ব্যবহার সাধু বা অসাধু যাই হোক না কেন ব্ৰাহ্মণকে কখনও অপমান করা চলে না। আরও বলা হয়েছিল, ব্রাহ্মণ অন্য সব বর্ণের সম্পদ নিতে পারে; কিন্তু যে ব্ৰাহ্মাণের ধন অপহরণের চেষ্টা করে সে দুঃখভাগী হবে। অন্যান্য বর্ণের ক্ষেত্রে রাজদ্রোহের জন্য চরম দণ্ড পেতে হত, কিন্তু রাজদ্রোহে অপরাধী ব্ৰাহ্মাণের শাস্তি ছিল কেবল নির্বাসন। যখন রাজা পাওয়ার জন্য উৎসুক প্রজারা ‘বেণ-পুত্ৰ পৃথু’কে অভিষেক করেছিল তখন ভবিষ্যৎ প্রজাদের জন্য তাঁর প্রথম প্রতিশ্রুতিই ছিল যে তিনি ‘ব্রাহ্মণদের শাস্তি দেবেন না’ এবং ‘অন্তর্বর্ণ বিবাহ রোধ করবেন’। ইওরোপে যেমন চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ, তিক্ত বিরোধ চলেছিল, তেমনই এ দেশেও ব্রাহ্মণ সাহিত্যের যুগেই ক্ষত্রিয় ও ব্ৰাহ্মণের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। ভার্গব অংশে দেখা যায় ‘পৃথিবীর আধিপত্য কার? ব্রাহ্মণ না ক্ষত্ৰিয়ের?’ – উত্তরে বলা হয়েছিল, ‘পৃথিবীর সমস্ত কিছুরই অধিপতি ব্ৰাহ্মণ।’ ‘তবে ক্ষত্ৰিয় কেন রাজা?’ – উত্তর দেওয়া হয়েছিল, ‘যেমন স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা তাঁর দেবরকে আলিঙ্গন করে, এ-ও তেমন’। এক উপাখ্যানে বলা হয়েছিল ব্ৰাহ্মণের ফল চুরি করায় এক ব্যক্তি বানর হয়ে পুনর্জন্ম নিয়েছিল; আর একজন ব্ৰাহ্মণকে উদার ভাবে দান না করায় শৃগাল হয়েছিল। এই সব গল্পের স্পষ্ট ভাবেই একটি প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিল। একটি উপাখ্যানে বলা হয়েছিল যে, ‘জমদগ্নি’ তীর নিয়ে খেলা করতে করতে সেগুলিকে ক্রমেই দূর থেকে আরও দূরে নিক্ষেপ করেছিলেন; তাঁর পত্নী ‘রেণুকা’ সেগুলি কুড়িয়ে আনছিলেন। একবার মধ্যাহ্নের খর রৌদ্রে ক্লান্ত হয়ে তিনি ফিরে আসতে দেরি করেছিলেন; ক্রুদ্ধ ‘জমদগ্নি’ সে কথা জেনে সূর্যকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। সূর্য নীচে নেমে এসে তাঁকে একটি ‘তাপ নিরোধকারী শ্বেতছত্ৰ দিয়েছিলেন’। অতএব ব্ৰাহ্মণকে ছত্ৰদান করলে পুণ্য লাভ হয়। ব্রাহ্মণকে দানযোগ্য বস্তুর দীর্ঘ ক্লান্তিকর তালিকা দেখা যায়। সেই সঙ্গে আছে পরলোকে এই সব দানের কত গুণ পুণ্য হবে সে তালিকাও৷ কেবলমাত্র ‘অনুশাসন পর্বে’ই পঁয়ত্রিশটি দীর্ঘ পরিচ্ছেদে এই বর্ণনা রয়েছে।
কেবল ‘দান’ নয়, ‘দক্ষিণা’ও প্রচলিত ছিল ‘বৈদিক যুগ’ থেকেই; কিন্তু আলোচ্য ভার্গব অংশে এগুলির পরিমাণ বৃদ্ধি হয়েছিল ‘গাণিতিক অনুপাতে’; পুরাণে এই বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছিল। ‘খাদ্য’, ‘বস্ত্ৰ’, ‘জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিবিধ দ্রব্য’, ‘নানা বিলাসদ্রব্য’, ‘সোনা’, ‘গো-ধন’, ‘রথ’, ‘ভূমি’, ‘দাস’ এবং ‘নারী’–এগুলি যদি প্রচুর পরিমাণে দান করা হয় তবে ইহলোক-পরলোকে বহুগুণ ফল লাভ করা যায় বলে প্রচার করা হয়েছিল। ‘কুমারী’, ‘শিশু সন্তানসহ বিবাহিতা নারী’ এবং ‘সন্তানহীনা বিবাহিতা তরুণী’ – এঁদের বিশাল সংখ্যায় উল্লেখ যে কোন সুস্থ মানুষের বোধকে আহত করবে। এই সব নারীদের নিয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা কী করতেন সে আর এক প্রশ্ন। এই ভার্গব অংশেই প্রথম শুনতে পাওয়া গিয়েছিল ‘জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ’ – ‘ব্ৰাহ্মণ জাতির কথা’। ‘জপতপ-অধ্যয়ন’ ছাড়াও তাঁকে ব্রাহ্মণ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এই ব্রাহ্মণও পূজনীয়।
মহাকাব্যে ‘ক্ষত্ৰিয়’ হল ‘যোদ্ধা’, কিন্তু ‘স্থল-বাণিজ্যে’ ক্ষত্ৰিয়েরা ‘প্রহরী’ রূপে পণ্যবাহীর সঙ্গে যেতেন। সমকালীন বৌদ্ধ সাহিত্যে ক্ষত্রিয়কে ‘সমৃদ্ধ ভূস্বামী শ্রেণি’রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘বৈশ্যের জীবিকা’ ছিল দুটি – ‘কৃষি’ ও ‘বাণিজ্য’।
বণিকেরা প্রায়ই ধনী হতেন; ‘ব্ৰাহ্মণ’, ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘ধনী বৈশ্যরা’ একটি ‘বিশেষ সামাজিক শ্রেণি’রূপে গণ্য হতেন। প্রাচীন জৈন শাস্ত্ৰ – ‘অঙ্গবিজ’-তে দুটি শ্রেণির কথা বলা হয়েছে। ‘অজ্জ’ এবং ‘পেসস’। স্পষ্ট ভাবেই এটি অর্থনৈতিক বিচারে সরল শ্রেণিবিভাগ: ‘ক্ষমতাবান, সমৃদ্ধ শ্রেণি’ ছিল ‘আৰ্য’ বা ‘অজ’, অবশিষ্টেরা ছিল ‘ভৃত্য’, ‘প্ৰেষ্য’ বা ‘পেসস’।
অর্বাচীন যুগের বৈদিক সাহিত্য থেকেই দেখা যায় ‘শূদ্র’ হল ‘ভৃত্য’, প্রায়ই সে ‘দাস’ যে অপর তিন বর্ণকে সেবা করে। মহাকাব্যের আলোচ্য অংশে বলা হয়েছে ‘প্রজাপতি শূদ্রকে সৃষ্টি করেছেন অপর তিন বর্ণের ভৃত্যরূপে।’ বলা হয়েছে, ‘শূদ্রের উচিত বিগতদ্বেষ হয়ে উচ্চ তিন বর্ণের সেবা করা।’ আরও বলা হয়েছিল – ‘ছত্র, প্রলেপন, জুতা, পাখা এবং পরিচ্ছদ যখন জীর্ণ হয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হবে তখন শূদ্র দাসকে দিয়ে দেবে।’ আরও সাংঘাতিক কথা – ‘প্ৰভু স্বচ্ছন্দে তাঁর ভৃত্যের ধন ব্যবহার করতে পারে।’
কিন্তু এমনকী এই প্রেক্ষাপটেও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। ‘লৌহ লাঙ্গলের ব্যবহার প্রবর্তন’ হওয়াতে কর্ষণযোগ্য ভূমির বিস্তার হচ্ছিল। এক বৈশ্যের পক্ষে এত পরিমাণ ভূমিতে কৃষিকাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না, সুতরাং কিছু শূদ্ৰও কৃষিকাজ করছিলেন, খুব সম্ভব ‘ভাগীদার চাষি’ হয়ে। দ্বিতীয়তঃ, খ্রীস্টিয় প্রথম শতাব্দী থেকেই ‘মৌসুমী বায়ুর পূর্বজ্ঞান’ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল এবং ‘মাস ও বৎসরের গণনা পঞ্জিকা’ও প্রচলিত ছিল। ফলতঃ, অতএব সামুদ্রিক বাণিজ্যও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হয়েছিল, এবং কিছু কিছু ‘বৈশ্য’, যাঁদের বিনিয়োগ করার মতো সচ্ছলতা ছিল, তাঁরা এই পরিশ্রমসাধ্য কৃষিকাজ শূদ্রের হাতে ছেড়ে নিজেরা বাণিজ্য শুরু করেছিলেন। যাঁরা সামাজিক মর্যাদার গণ্ডির বহির্ভূত ছিলেন যেমন – ‘ম্লেচ্ছ’, ‘চণ্ডাল’, ‘পুলকস’, ‘স্বপাক’, ‘শবর’ ও ‘নিষাদ’ – এঁরা সকলেই ‘সমৃদ্ধিশালী বৈশ্য ও শূদ্রের অধীনে’ কাজ করতেন। ভার্গব সামাজিক মূল্যবোধের অন্যতম প্রবক্তা ‘মনু’ বলেছিলেন – এঁরা হল ‘স্বনির্ভর শূদ্র’। যে সব ব্রাহ্মণের ‘শূদ্ৰযাজী’ বা ‘শূদ্র প্রতিগ্রাহী’ ছিলেন না, সমাজে তাঁদের স্থান ছিল অধিকতর মর্যাদার। তবুও শূদ্রের অনুষ্ঠানে ‘যাজকবৃত্তি’ হয়ে উঠেছিল লোভনীয়। চাতুর্যের সঙ্গে এই উভয় সংকটের সমাধান করা হয়েছিল, কারণ ‘মনু’ বলেছিলেন – ন্যায়াবতীর্ণ শূদ্রের জন্য ধর্মানুষ্ঠানে যাজন করা যেতে পারে। আর কে সেই ‘ন্যায়াবতী শূদ্র’? ‘মনুর ভাষ্যকার মেধাতিথি’ বলেছিলেন – ‘যে পঞ্চ মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে সে ন্যায়বর্তী।’ এই ‘ন্যায়াবর্তী শূদ্রের’ পরিবারে কারও মৃত্যু হলে ‘ধর্মীয় অশৌচের কাল-সীমা’ এক মাস ছিল না, ছিল মাত্র পনেরো দিন। স্পষ্ট ভাবেই, আর্থিক সমৃদ্ধির বিচারে এই সব সুবিধা দেওয়া হত; তখন এই ‘ধনীশূদ্ররা’ সমাজে উন্নতির সোপানে ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছিলেন। অবশ্য ‘সাধারণ শূদ্র’ অর্থাৎ ‘শূদ্র জনসমাজের অধিকাংশই’ পড়ে ছিলেন ‘দরিদ্র ও অবদমিত স্তরে’। তাই দেখা যায়, যাঁরা অর্থ দিয়ে কর দিতে পারেন না তাঁরা ‘বিষ্টি’ অৰ্থাৎ ‘বাধ্যতামূলক শ্রম’ দিয়ে তা শোধ করতে পারেন। ‘বৃহস্পতি ধর্মসূত্র’-তে বলা হয়েছে – শূদ্র বণিককে সর্বোচ্চ হারে কর দিতে হবে। অতএব কোনও কোনও শূদ্র যথেচ্ছ হারে এবং অর্থমূল্যে কর দেওয়ার মতো যথেষ্ট ধনী ছিল এবং তা হলেই সমাজে তাঁরা সম্মান পেতেন। কিন্তু দরিদ্র শূদ্রর অবস্থান ছিল ‘জঞ্জাল-তুল্য’। ‘ব্ৰহ্মাণ্ড পুরাণ’ বলছে, ‘যে রাজার অধীনে বহু শূদ্র প্রজা রয়েছে তাঁরা রাজ্যের বহু অংশেই অ-বৈদিক ধর্মাচরণ হয়।’ ওদিকে ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ বলে ‘শবর, মুর্তিব পুণ্ড এবং অন্ধ এঁরা হল বিশ্বামিত্রের অবাধ্য সন্তান অর্থাৎ পতিত ক্ষত্ৰিয়।’ এই ভাবে ‘বিদেশি আগন্তুকদের’ সমাজে মিশিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং তাঁদের স্থান হয়েছিল ‘ম্লেচ্ছদের ওপরে’; তাঁরা ‘ব্রাত্যস্তোম যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে’ ‘যথাযথ ক্ষত্ৰিয়’ হতে পারতেন। সুতরাং ‘ব্রাত্যস্তোমের মাধ্যমে’, ‘বহুবিবাহের মাধ্যমে’ এবং ‘স্বাধীন সচ্ছল বৃত্তির মাধ্যমে’ কোনও কোনও শূদ্র সমাজে উচ্চতর স্থান অধিকার করতেন।
প্রাগোর্যরা ‘কারুশিল্প’ এবং বহু ‘কুটির শিল্পে’ অধিকতর দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত ছিলেন; সেই জন্য তাঁরা প্ৰাচীনকাল থেকেই এই সব ‘কারুশিল্পের ধারা’ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। ধীরে ধীরে এই কায়িক শ্রমকে হীন দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়েছিল। ভার্গব অংশে বলা হয়েছে যে, যদি কোনও ব্ৰাহ্মণ এই সব কারুশিল্প ও বাণিজ্যে যোগ দেয় তবে তাঁকে শূদ্র বলে মনে করা হবে। ‘মনু’রও একই মত। সমাজ বিদেশি আগন্তুকদের মধ্যে অভিজাতবর্গকে ‘ব্রাত্যক্ষত্ৰিয়’ আখ্যা দিয়েছিল এবং বিদেশিদের এই সম্প্রদায় ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’কে নিয়ন্ত্রণ করতেন। অতএব, এই সমস্যার সমাধান করতে আইন-নির্ধারকরা তাঁদের ‘মদদণ্ড’ পরিবর্তিত করেছিলেন; তাঁরা এই সব বিদেশিদের যথাযথ ক্ষত্ৰিয়ের মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তাঁদের রাজা ও অভিজাত বলে সম্মান করেছিলেন। ‘বশিষ্ঠের কামধেনুর উপাখ্যানে’, ‘কামধেনু’ তাঁর প্রভুর বিপদে বিদেশি সৈন্যদল সৃষ্টি করেছিল। এর থেকে বোঝা যায় যে ব্ৰাহ্মণেরা বিদেশিদের নিজেদের বন্ধু হিসাবেই গ্ৰহণ করেছিলেন।
ভার্গব অংশে ‘বর্ণ সংমিশ্রণ’কে অসন্দিগ্ধ ভাষায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে ‘বৰ্ণসংকর’ বিনাশ ডেকে আনে এবং এটি কলিযুগের এক বিশিষ্ট, অব্যৰ্থ লক্ষণ। ভার্গব অংশে কলির পীড়াদায়ক অবস্থা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাবে আলোচিত হয়েছে। বলা হয়েছে – কলিযুগে শূদ্র ধর্মীয় নির্দেশ দেবে, আর ব্রাহ্মণ হবে ভৃত্য; এবং শূদ্র ব্রাহ্মণকে সেবা করতে অস্বীকার করবে। কলিযুগের আর একটি স্বভাব বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে যে স্ত্রী স্বামীকে মান্য করবে না। ‘মার্কণ্ডেয়’ ‘যুধিষ্ঠির’কে উপদেশ দিয়েছিলেন – ‘একজন ক্রুদ্ধ ব্রাহ্মণ এক বককে অভিশাপে দগ্ধ করে; তারপর সে এক গৃহে যায় যেখানে ব্রাহ্মণ অতিথিকে সেবা করার আগে স্ত্রী তাঁর স্বামীকে খাবার পরিবেশন করে। ব্রাহ্মণ যখন তাঁকে শাপ দিতে উদ্যত হয়, তখন সে বিদ্রদিপ করে বলে, ‘আমি কি বক’; বিস্মিত ব্ৰাহ্মণকে তার পরে বলা হয় সমস্ত পতিব্ৰতা স্ত্রীদেরই দৈব অন্তর্দৃষ্টি থাকে।’ ‘মার্কণ্ডেয়’ বলেছিলেন – ‘পতিব্ৰতা রমণী সর্বদাই তাঁর স্বামীর ভোজন পাত্রের অবশিষ্ট খেয়ে থাকেন।’ ‘দ্ৰৌপদী’ ‘স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে’ ‘সত্যভামা’কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন – ‘আমি সভয়ে আমার স্বামীদের সেবা করি, যেন তাঁরা ক্রুদ্ধ সর্প; আমি কখনও আমার স্বামীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করি না, কখনও তাঁদের ছড়িয়ে যাই না, কখনও আমার শাশুড়ির বিরোধিতা করি না; আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পত্নীদেরও সেবা করি; এই হল ‘সাধ্বী’ স্ত্রীর, ‘সতী’ স্ত্রীর কর্তব্য।’ প্রসঙ্গতঃ, ‘সতী’ এবং ‘পতিব্ৰতা’ এই শব্দ দুটির অর্থগত দিক থেকে কোনও ‘পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ’ নেই। সুতরাং বিবাহিত জীবনের কর্তব্য সম্পূর্ণ ভাবেই একপক্ষের।
নারীর পক্ষে দ্বিতীয়বার বিবাহ করা অপরাধ বলা হয়েছিল, কিন্তু পুরুষের ‘বহুবিবাহ’ কোনও অন্যায় নয়। ‘অপ্সরা পঞ্চচূড়া’ ‘নারদ’কে বলেছিলেন – পুরুষ অপেক্ষা নারীই বেশি যৌন আনন্দ উপভোগ করে। গবেষকদের মতে এ কথা বলানো হয়েছিল একজন নারীর মুখ দিয়েই, যাতে বক্তব্যটির বিশ্বাসযোগ্যতা অধিক হয়। শরশয্যায় মৃত্যুমুখে পতিত ‘ভীষ্ম’, ‘যুধিষ্ঠির’কে দু’বার বলেছিলেন, ‘নারীর চেয়ে পাপিষ্ঠ কেউ নয়।’ তিনি বলেছিলেন – ‘অন্তক, শমন, মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরের ধার, বিষ, সৰ্প, অগ্নি – এই সব কিছু একত্রে একটি নারীর সমান।’ তরুণী রাজকন্যা মাধবীর উপাখ্যান অবশ্য উল্লেখ্য। ‘গুরুদক্ষিণা’ দিতে অপারগ ‘গালিব’ ‘রাজা যযাতি’র কাছে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু রাজার রাজকোষ তখন নিঃশেষিত, তাই অর্থের পরিবর্তে তিনি নিজের সুন্দরী কন্যা ‘মাধবী’কে গালিবের হাতে দিয়েছিলেন যাতে ‘গালিব’ একে একে তিন রাজার কাছে ‘মাধবী’কে এক এক বছরের জন্য গচ্ছিত রেখে তার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় অর্থ নিতে পারেন। ‘গালিব’ এতে কোনও অন্যায় দেখেননি। তিনি তা-ই করেছিলেন। নারীর কাছে শিক্ষা হয়েছিল নিষিদ্ধ। নারীকে বিবাহ করতেই হবে; পুরুষ নাও করতে পারে। তাই স্বৰ্গপ্রবেশের অধিকার লাভের জন্য ‘কুণিগর্গের কন্যা’, বর্ষীয়সী তপস্বিনীকেও বিবাহ করে এক রাত্রের জন্য হলেও ‘স্বামীসঙ্গ’ করতে হয়েছিল। ‘কৃষ্ণ’ নিজেই তাঁর উদ্ধারযোগ্য পাপীদের তালিকায় নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
মূল মহাকাব্যে ‘স্বামীর চিতায় সহমরণ’ এক বিরল ঘটনা; বিধবাদের বাঁচার অধিকার সেখানে আছে। কিন্তু মহাভারতের ভার্গব অংশে দুই একটি ব্যতিক্রম আছে; বসুদেবের মৃত্যুতে ‘দেবকী’, ‘ভদ্রা’, ‘রোহিণী’ ও ‘মদিরা’ স্বামীর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন; ওদিকে কৃষ্ণের মৃত্যুতে ‘সত্যভামা’, ‘রুক্মিণী’ এবং তাঁর অন্যান্য পত্নীরা সহমরণে গিয়েছিলেন। ‘শান্তি পর্বের উপাখ্যানে’ ঘুঘুপাখির পত্নীও স্বামীর সঙ্গে পুড়ে মরেছিল। কিন্তু ‘গান্ধারী’, ‘কুন্তী’, ‘সত্যবতী’ এবং আরও অনেক বিধবা ও যুদ্ধবিধবারা কোনও সামাজিক কলঙ্ক ব্যতীতই বেঁচে ছিলেন। ‘হেরোডোটাস’ বলেছেন ‘সিথিয়ান’দের মধ্যে ‘সতী’ প্ৰথা প্রচলিত ছিল। ‘এরাণ স্তম্ভ লিপি’তে পাওয়া যায় যে ‘রাজা গোপবর্ধনের পত্নী’ তাঁর স্বামীর চিতায় আরোহণ করেছিলেন।
মহাভারতের ভার্গব অংশের মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলির অন্যতম হল ‘নারীর সামাজিক অবনমন’। ১৪০ খ্রীস্টাব্দে জনৈক ‘সিরিয়ান লেখক বৰ্দোসনেস’ বিভিন্ন দেশের আইন সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন – ‘বুক অব দ্য লজ অব দ্য কাস্ট্রিজ’। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, ‘কুষাণরা’ তাঁদের পত্নীদের সঙ্গে ‘উপপত্নীর মতো ব্যবহার’ করতেন এবং তাঁদের কাছে ‘যৌন আনুগত্য’ আশা করত না। তাঁদের স্ত্রীরা এমনকী ভৃত্যের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করতেন। সম্ভাবনা আছে যে, এই ধরনের প্রবণতাকে বাধা দেওয়ার জন্যই আইন প্রণয়নকারীরা নারীর উপর বেশি করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। কিন্তু মহাভারতের ভার্গবী অংশে বারংবার নারীকে নিন্দা করা হয়েছে এবং তাঁদের অবদমিত রাখার জন্য বিধি তৈরি করা হয়েছে। তবুও কিন্তু পূর্বতন মূল মহাকাব্যে বেশ কিছু স্বাধীনচেতা নারীর কথা বলা হয়েছে, যাঁরা ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্রী। ভার্গব অংশে অবশ্য প্রয়োজন ছিল নারীর বশ্যতা স্বীকারের কথা প্রচার করা, সেই জন্যই এই বিষয়বস্তু নিয়ে অসংখ্য উপাখ্যান ও নীতিমূলক অংশ রচিত হয়েছিল। সমসাময়িক একটি অর্বাচীন গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে প্রথম বারের জন্য দেখতে পাওয়া যায় লক্ষ্মী নারায়ণের পদসেবা করছেন।
খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ এবং তৃতীয় শতাব্দী থেকে সমাজে এবং ধর্মবিশ্বাস ও আচার আচরণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। এই সবের জন্য কোনও শাস্ত্র তখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এই ‘প্রাক-পৌরাণিক ভার্গবী সংযোজন’ই সেই শাস্ত্র রচনা করেছিল। মূল ‘জয়সংহিতা’ রচনা শুরু হয়েছিল মোটামুটি ভাবে খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এবং শেষ হয়েছিল খুব সম্ভব দ্বিতীয়/প্রথম খ্রীস্টিয় শতকে, এই সময়েই সংযোজনের প্রথম পর্যায় রূপে চিরন্তন মূল্যবোধের উপাখ্যানগুলি যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। অল্পদিন পরেই ভার্গব সংযোজন শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং মোটামুটি খ্ৰীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে শেষ হয়েছিল। এই সংযোজন ছিল ‘সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন পুরোহিত গোষ্ঠীর’ রচিত, মূল মহাকাব্যের চেয়ে গঠনভঙ্গিতে ‘অনেক নিম্নস্তরের অলংকৃত’, ‘অতিরঞ্জিত’, ‘বাহুল্যযুক্ত’ এবং ‘পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট’।
‘বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক এবং উপনিষদীয় প্রভাব’ মুছে যাওয়ার পর অথবা যথেষ্ট কমে আসার পর মানুষ যাগযজ্ঞে বিশ্বাস হারিয়েছিল এবং উপনিষদের দুর্বোধ্য দর্শন সাধারণ মানুষের বোধক্ষমতার সীমানায় ছিল না। সুতরাং দেশজ মানুষেরা খুব সম্ভব সমাজের সীমারেখায় বসবাসকারী অ-বৈদিক আৰ্যদের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল এবং ধীরে ধীরে অথচ নিশ্চিত ভাবেই সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতিতে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আগন্তুক গোষ্ঠীগুলির বিশ্বাস এবং রীতিনীতি, যার ফলে তৎকালীন সামাজিক ধ্যানধারণাতে ইতিপূর্বেই যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। যজ্ঞবিহীন যে জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি ও বিশ্বাস এর আগে অবদমিত ও বিতাড়িত হয়েছিল তখন তা পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল এবং মহাকাব্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের স্তরে তা আবার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। ‘রাজার উপর ঐশ্বরিকত্ব আরোপ’, ‘সম্প্রদায়নিষ্ঠ ধর্মের তত্ত্বনির্মাণ’ এবং ‘পুরোহিত গোষ্ঠীর সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার ক্রমিক বৃদ্ধি’ এই সময়েই শুরু হয়েছিল। এর পর এই নতুন পূজাভিত্তিক ধর্মের নতুন নতুন দিক আবিষ্কার হতে শুরু হয়েছিল – ‘মন্দির’, ‘বিগ্রহ’, ‘ব্রত’, ‘তীর্থযাত্রা’ এবং ‘ব্রাহ্মণের প্রতি দান ও আনুষ্ঠানিক দক্ষিণার নিয়ত বৃদ্ধি’ সব কিছু ক্রমেই গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল। কয়েক শতাব্দী ধরেই ‘জন্মান্তরবাদ’ ও ‘কর্মফলবাদের তত্ত্ব’ প্রচলিত ছিল। ইতিপূর্বে ‘উপনিষদীয় যুগে’ই এই সব ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল এবং এই ‘নিগুঢ়-রহস্যময় জ্ঞান’ই ছিল ঋষিদের মূল তত্ত্ব। এখন এই সব তত্ত্বকে কাজে লাগানোর জন্য পুরোহিতগোষ্ঠী উপাখ্যানের পর উপাখ্যান রচনা করতে আরম্ভ করেছিলেন। ‘স্বৰ্গ-নরক-প্ৰেতকথা-জ্যোতিষ-দুর্লক্ষণ চিহ্ন’ – এই সব কিছুই এই নব্য ধর্মীয় দার্শনিক আদর্শের মূলভিত্তি যে ‘নিয়তিবাদ’ তার সহায়কের কাজ করতে শুরু করেছিল। এর ফলে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি এক রহস্যময়তায় আবৃত হয়ে হয়ে পড়েছিল, যে আবরণ ভেদ করতে পারতেন কেবলমাত্র পুরোহিতরা।
‘কুষাণ’, ‘শক’, ‘মুরুদ’, ‘পহুব’, ‘হুণ’ এবং ‘পারদ’-দের বারংবার আক্রমণের ফলে নিরাপত্তাবোধ ব্যাহত হয়েছিল, অন্ততঃ সাময়িক ভাবেও সমাজে কিছুটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। এই গোলযোগের ফলে রক্ষণশীল মনোভাব জেগে উঠেছিল এবং এই সব নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টিকর্তা পুরোহিত গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য ছিলেন ‘দরিদ্র’, ‘শূদ্ৰ’, ‘দাস’ এবং ‘নারীরা’। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর ভারতের এক বিশাল অংশে ‘অন্তর্বিবাহ’ দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। ‘নারীর সতীত্ব’ এবং ‘শূদ্রের আনুগত্য স্বীকার’ – উভয়কে অক্ষুন্ন রাখার জন্য আইনরক্ষকেরা অত্যন্ত সরব হয়ে পড়েছিলেন। ‘রক্ষণশীল মূল্যবোধ’, বিশেষ করে ‘বর্ণাশ্রমের নিয়ম বর্ণধর্ম’ ছিল ‘শূদ্র ও নারীর প্রতি অবদমনমূলক’। যে কলিযুগের তাঁরা বর্ণনা দিয়েছেন সে বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে ছিল তাঁদেরই সমকালের সমাজের; এই সময় ‘গ্রিস’, ‘রোম’ এবং ‘মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে’ জলপথের বাণিজ্য ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল। দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য কিন্তু বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এই দ্বিতীয় বাণিজ্য সম্পর্কটি কোনও নূতন ধ্যানধারণার সৃষ্টিধর্মী অভিঘাত বা নূতন চিন্তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব হয়ে আসেনি। অতএব এক প্রকার ‘সংকীর্ণ মনোভাব’ দেখা দিয়েছিল। খ্ৰীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ‘উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদনের সম্বন্ধ ও শ্রেণিবিন্যাস’ কিছুটা স্থিতাবস্থায় এসেছিল। বৰ্ণসংকরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং নিশ্চিত ভাবেই এই সরলীকরণ ধীরে ধীরে অপরিবর্তনীয় হয়ে উঠেছিল। ‘আৰ্য অভিজাত সমাজ’ ছিল ‘ব্রাহ্মণ’, ‘ধনী ক্ষত্রিয়’ ও ‘ধনী বৈশ্যদের’ নিয়ে গঠিত আর ‘দরিদ্র ক্ষত্রিয়’, ‘দরিদ্র ‘বৈশ্য’, ‘শূদ্র’, ‘ম্লেচ্ছ’ এবং ‘অন্ত্যজ অশুচিদের’ সমাহারে গঠিত হয়েছিল ‘দাসবর্ণ’। এই শ্রেণি ও বর্ণবিভাগে ক্লিষ্ট সমাজ শাসন করতেন ‘ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও নীতি নির্ধারকেরা’ই। ‘জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদের’ তত্ত্বের দ্বারা লালিত কুসংস্কারে মানুষকে অন্ধ করে রাখা হত, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘নিয়তিবাদ’, ‘শ্ৰাদ্ধ’ ও ‘পারলৌকিক ক্রিয়া’ এবং ‘প্ৰায়শ্চিত্তের প্রতি বিশ্বাস’। এই সব বিষয়ে শাস্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু মহাভারত মহাকাব্যের ভার্গব সংযোজন অংশেই এগুলির প্রথম সূচনা হয়েছিল। এই সব তত্ত্বের বিস্তারিত চর্চা দেখা গিয়েছিল ‘পুরাণসমূহ’, ‘স্মৃতি’, ‘ধর্মশাস্ত্র’ এবং ‘নিবন্ধগুলি’তে। মহাভারতের ভার্গব সংযোজনে যার প্রথম অন্ধুরোদগম পরবর্তী কালে তারই পরিণতরূপ দেখা যায় ‘হিন্দুত্বে’। এবং সেখানেই এই সংযোজনের প্রকৃত গুরুত্ব।