পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধ - Ei Bangla
Ei Bangla ব্লগ পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধ

পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় সামুদ্রিক যুদ্ধ


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জানিয়েছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর সবচেয়ে চিন্তার কারন ছিল জার্মানির ইউবোট। তিনি আরও জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন ব্রিটেনের যুদ্ধ হচ্ছিল তখন নাজি জার্মান বায়ুসেনার একের পর এক যুদ্ধবিমান যখন ব্রিটেনে বোম্ব ফেলছিল যা দেখে মনে হচ্ছিল হিটলার বোধ হয় ব্রিটেনও দখল করে নেবে তখনও তাঁর এতটা ভয় হয়নি কিন্তু জার্মানির ইউবোট রয়েল ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম এটা নিয়েই তিনি চিন্তায় থাকতেন। যদি ব্রিটিশ নৌবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ থেকে ব্রিটেনে অস্ত্র ও খাদ্য আসতো না, যার ফলে ব্রিটেন আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হত হিটলারের সামনে, এই ভয়েই থাকতো উইনস্টন চার্চিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ও সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ ছিল আটলান্টিকের যুদ্ধ। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৪৫ সালের ৮ মে শেষ হয়। প্রায় ছয় বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে মূলত জার্মানির ইউবোটেরই রাজত্ব ছিল।

জার্মানির সাবমেরিনকে ইউবোট বলা হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই এই ইউবোট প্রথম তৈরি করে জার্মানি। যখন জার্মান নৌবাহিনী ইউবোট ব্যবহার করা শুরু করে তখন মিত্রশক্তি ইউবোটকে নিয়ে ততটা ভাবেনি কিন্তু যেই ইউবোট একের পর এক যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করতে শুরু করে তখন এর ক্ষমতা বুঝতে পারে সবাই। যার কারনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার থেকে সাহায্য আনতে আমেরিকার বানিজ্যিক জাহাজকে যথেষ্ট নিরাপত্তা দিয়ে আনতে হয় মিত্রশক্তিকে। কয়েকটি আমেরিকান বানিজ্যিক জাহাজকে নিরাপত্তা দেয় ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ। এই সময়েই ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক ইঞ্জিনিয়ার তেপথ চার্জ প্রযুক্তি তৈরি করে। যাতে বোম্ব জলের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় সাবমেরিনে স্পর্শ করে বা নিজে থেকেই বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। যার কারনে অনেক জার্মান সাবমেরিন ধ্বংস হয়ে যায় এবং শেষপর্যন্ত জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়।

আরো পড়ুন- ভগত রাম তলোয়ার! জেমস বন্ডও তার কাছে শিশু, পাঁচটি দেশের গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে জার্মানিতে হিটলারের উত্থান ঘটে এবং জার্মান নৌবাহিনীর কম্যান্ডাররা ভাবতে থাকে ভবিষ্যতে যুদ্ধে কি করে ইউবোটকে আরও শক্তিশালী করা যায়। সেসময় কার্ল ডনিটজ নামে এক বিখ্যাত জার্মান নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল উলফ প্যাক নীতি তৈরি করেন। কার্ল ডনিটজ হিটলারের মৃত্যুর পর কিছু সময়ের জন্য জার্মানির রাষ্ট্রপতি হয়েছিল। কার্ল ডনিটজের উলফ প্যাক নীতি নেকড়ের শিকার পদ্ধতির উপর তৈরি।

জঙ্গলে নেকড়ে যখন শিকার করতে যায় তখন একা যায়না একসাথে অনেকগুলো নেকড়ে আক্রমন করে। ঠিক তেমনি কার্ল ডনিটজ ঠিক করে কোন ইউবোট একা যাবেনা, একসাথে অনেকগুলো ইউবোট একসাথে আক্রমনে যাবে তাতে শত্রুর ক্ষতি অনেক বেশী হবে। কার্ল ডনিটজের এই নীতি কাজে লাগাতে হলে তাঁর অন্তত ৩০০ সাবমেরিন দরকার ছিল তাহলে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরে পুরো ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতেন। কিন্তু সেসময় জার্মানির কাছে সাবমেরিন ছিল মাত্র ৫৫ টি। আসলে অ্যাডলফ হিটলার মনে করতো ইউবোটের বদলে বড় বড় ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ তৈরিতে যাতে শত্রুর বেশী ক্ষতি হবে। এর জন্য তিনি বিসমার্কের মতোন যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছিলেন। কার্ল ডনিটজ ঠিক করে হিটলারের ইউবোটের ক্ষমতা দেখাবেন।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং অক্টোবর মাসেই ইউ ৪৭ নামে একটি জার্মান ইউবোট স্ক্যাপা ফ্লো নামে একটি ব্রিটিশ নৌঘাঁটিতে উপস্থিত হয়। সেখানে থাকা একটি পুরোনো ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস রয়েল ওককে ডুবিয়ে ইউ ৪৭ নিরাপদে ফিরে আসে। এইচএমএস রয়েল ওক ডুবে যাওয়ায় জাহাজে থাকা আটশো ব্রিটিশ নৌসেনার মৃত্যু হয়। এরপর হিটলার ইউ ৪৭ এর কম্যান্ডারকে অভিবাদন জানায় অর্থাৎ কার্ল ডনিটজ হিটলারকে মুগ্ধ করে দেয় ইউবোটের ক্ষমতা দেখিয়ে।

১৯৪০ সালে জার্মানি যখন ফ্রান্সকে পরাজিত করে তখন কার্ল ডনিটজ তার সাবমেরিন ঘাঁটি ফ্রান্সে স্থাপন করে। ফ্রান্সের বন্দর থেকে ইউবোট গুলো আটলান্টিক মহাসাগরের পুরো মাঝামাঝি গিয়ে শত্রুর উপর আক্রমন করতো। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাস আসতে আসতে জার্মান ইউবোট গুলো উলফস প্যাক নীতিতে অ্যালায়েড ফোর্সের প্রায় পাঁচ মিলিটন টন জাহাজের ক্ষতি করেছিল এবং বিপক্ষের প্রায় ছয় হাজারের বেশী নৌসেনার মৃত্যু হয়েছিল। এর বিপরীতে জার্মান ইউবোটের ক্ষতি খুব কম হয়েছিল। অর্থাৎ জার্মান ইউবোট একতরফা রাজত্ব করছিল সেসময় আটলান্টিক মহাসাগরে। উপরে অ্যালায়েড ফোর্সের গোপন কমিউনিকেশ ব্যবস্থাও ধরে ফেলেছিল জার্মানরা ফলে বিপক্ষের জাহাজ কোন স্থানে আছে তার সঠিক তথ্য চলে আসছিলে জার্মানদের কাছে।

১৯৪২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত জার্মান ইউবোট প্রতি মাসে গড়ে ১৬০ টি করে বিপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করতে শুরু করে। অ্যালায়েড ফোর্স এটা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিল কারন তারা যে পরিমানে জাহাজ তৈরি করছিল তার থেকে বেশী পরিমানে জাহাজ ধ্বংস করছিল জার্মানি। অ্যাডলফ হিটলার এতটা খুশি হয়েছিলে যে ইউবোট তৈরির পরিমান বাড়িয়ে দেয় এবং কার্ল ডনিটজকে ১৯৪৩ সালে জার্মান নৌবাহিনীর প্রধান বানিয়ে দেয়। সেসময় জার্মান নৌবাহিনীতে প্রায় চারশো ইউবোট ছিল! এত জাহাজ ডুবে যাওয়া সত্বেও ব্রিটেন বাধ্য হত আমেরিকা থেকে জিনিস আনাতে কারন ব্রিটেন একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। আমেরিকা থেকে জরুরী জিনিস না এলে ব্রিটেন বাধ্য হবে আত্মসমর্পন করতে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে আমেরিকা থেকে একশোটা জাহাজ রওনা হলে চল্লিশটা জাহাজ ব্রিটেনে পৌঁছতো। জাহাজ ধ্বংস হলে যেসব নাবিকরা বেঁচে থাকতো জলে তাদের উদ্ধার করার জন্যও বাকী জাহাজ দাঁড়াতো না কারন ইউবোটের আক্রমনের ভয় ছিল। যার কারনে উইনস্টন চার্চিলের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল সেসময়।

১৯৪৩ সালের দিকে অ্যালয়েড ফোর্সের ইঞ্জিনিয়াররা লং রেঞ্জ রেডার তৈরি করে। এসব রেডার বোম্বার বিমানে ইনস্টল করা হয়। এসব বিমান বানিজ্য জাহাজের আগেই আটলান্টিক সাগরে গিয়ে জার্মান ইউবোটকে খুঁজে বের করে তার উপর ডেপথ চার্জ করতে থাকে ফলে ইউবোট ডুবে যেতে শুরু করে। অ্যালায়েড ফোর্স এরপর ডেস্ট্রয়ারেও লং রেঞ্জ রেডার ইনস্টল করে, সাথে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারও পাঠাতে শুরু করে আটলান্টিক মহাসাগরে। যার কারনে জার্মান ইউবোট ব্যাপক আকারে ধ্বংস হতে শুরু করে। এর মধ্যেই ব্রিটিশরা জার্মান ইউবোটের গোপন কমিউনিকেশন সিস্টেম অ্যানিগমা কোড ক্র্যাক করে ফেলে যার ফলে আটলান্টিক মহাসাগরে জার্মান ইউবোটের সঠিক অবস্থান পর্যন্ত জেনে ফেলে অ্যালায়েড ফোর্স।

৭৫ শতাংশ জার্মান ইউবোট ধ্বংস হয়ে যায় অ্যালায়েড ফোর্সের আক্রমনে। কার্ল ডনিটজ মনে করতো তাঁর নৌবাহিনীর কেউই তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জার্মান ইউবোটের অবস্থান বলে দিত কারন কার্ল ডনিটজের জানা ছিলনা যে অ্যানিগমা কোড ব্রিটিশরা জেনে গেছে। অ্যালায়েড ফোর্সের আক্রমনে কার্ল ডনিটজের ছোট ছেলের মৃত্যু হয়, এরপরেই কার্ল ডনিটজ ঠিক করে আর ইউবোট দিয়ে আক্রমন করা যাবেনা অনেক ক্ষতি হচ্ছে জার্মান নৌবাহিনীর। এই কথা যখন হিটলারকে জানানো হয় হিটলার স্পষ্ট নির্দেশ দেয় ইউবোটের আক্রমন যেন চলতেই থাকে। কার্ল ডনিটজ হিটলারের কাছে জার্মান বায়ুসেনার সাহায্য চায় কিন্তু সেসময় পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধের কারনে জার্মান বায়ুসেনা কার্ল ডনিটজকে দেওয়া অসম্ভব ছিল। ফলে বাধ্য হয়ে ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি আবারও আটলান্টিকে ইউবোট পাঠায় কার্ল ডনিটজ। কিন্তু এবার অবস্থা আরও খারাপ হয়। গড়ে একটা অ্যলায়েড জাহাজ ধ্বংস করতে একটি জার্মান ইউবোটও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। কার্ল ডনিটজ বুঝে যায় আমেরিকা যে গতিতে জাহাজ নির্মান করছে সেই গতিতে তারা ইউবোট নির্মান করতে পারবেনা। বাধ্য হয়ে কার্ল ডনিটজ আবারও পিছিয়ে আসে।

১৯৪৫ সাল আসতে আসতে জার্মানি কিছু অন্য ধরনের সাবমেরিন তৈরি করেছিল কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। অ্যালায়েড ফোর্স আটলান্টিকের যুদ্ধ প্রায় জিতে গিয়েছিল। আটলান্টিকের যুদ্ধে প্রায় একশোর উপর যুদ্ধ হয়েছিল যেখানে জার্মান ইউবোটের কারনে অ্যালায়েড ফোর্সের বানিজ্যিক জাহাজের ৩৬,০০০ সদস্য এবং নৌবাহিনীরও ৩৬,০০০ সেনার মৃত্যু হয়েছিল। অন্যদিকে জার্মানির ৩০,০০০ সেনা মারা যায়। আটলান্টিকের যুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্সের ৩,৫০০ বানিজ্যিক জাহাজ এবং ১৭৫ যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়ে যায় এবং জার্মানির ৭৮৩ ইউবোট ও ৪৭ যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এত বড় সামুদ্রিক যুদ্ধ আর কখনও হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Post

বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব)বাংলার ভূস্বামী বিদ্রোহ (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ বিনা যুদ্ধে আকবরের হাতে বাংলা ও বিহার সঁপে দিয়ে ‘দাউদ কররানি’ যখন উড়িষ্যায় চলে গিয়েছিলেন তখন তিনি নিজের পিছনে এক বিরাট শূন্যতা ছেড়ে গিয়েছিলেন। সে যুগের সব দেশের

সামুদ্রিক সাম্রাজ্যে ভারতবর্ষ চোল নৌ-বাহিনিসামুদ্রিক সাম্রাজ্যে ভারতবর্ষ চোল নৌ-বাহিনি

ভারতে নৌ শক্তির গুরুত্ব প্রথম উপলব্ধি করেছিল মৌর্যরা , তাঁদের একটি ছোটোখাটো নৌ-বাহিনিও ছিল । কিন্তু নৌ অভিযানের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবিস্তারের পথপ্রদর্শক ছিলেন চোল সাম্রাজ্যের দুই নৃপতি — প্রথম রাজরাজ চোল

‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)‘বঙ্গদেশে রাজা মান সিংহ’ (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ ১৫৮৭ খৃস্টাব্দের ১লা আগস্ট তারিখে বিসূচিকা রোগে ‘উজীর খাঁ হেরেবি’র মৃত্যু হওয়ার পরে আকবর বিহারের শাসনকর্তা ‘সৈয়দ খাঁ’কে বাংলায় বদলি করেছিলেন, এবং ‘মান সিংহ’কে পাঞ্জাব থেকে বিহারে নিয়ে

‘বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক মূল্য’‘বাল্মীকি রামায়ণের ঐতিহাসিক মূল্য’

রানা চক্রবর্তীঃ সব মহাকাব্যই ‘কাব্য’ কিন্তু সব কাব্য ‘মহাকাব্য’ নয়। মহাকাব্যের নিরিখ নানা সাহিত্যে নানা সংজ্ঞায় নিরূপিত হয়েছে। তবে, মোটের ওপর বিগত পাঁচ হাজার বছরের বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়